লোকসভা নির্বাচন মহোৎসবের কোলাহলের মধ্যে শ্রীমৎ স্বামী স্মরণানন্দজি মহারাজের প্রয়াণ সংবাদে কয়েক মুহূর্তের জন্য আমার মনটা যেন নিশ্চল হয়ে গেছিল। শ্রীমৎ স্বামী স্মরণানন্দজি মহারাজ ছিলেন ভারতের আধ্যাত্মিক চেতনার অগ্রদূত এবং তাঁর প্রয়াণ আমার ব্যক্তিগত ক্ষতির মতো। কয়েক বছর আগে স্বামী আত্মস্থানন্দজির প্রয়াণ এবং এখন এই স্বামী স্মরণানন্দজির অনন্ত যাত্রার পথে গমন বহু মানুষকে শোকাচ্ছন্ন করবে। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের কয়েক কোটি ভক্ত, সাধু এবং অনুগতজনদের মতো আমার হৃদয়ও গভীর শোকসন্তপ্ত।
এ মাসের গোড়ায় আমার কলকাতা সফরের সময় আমি হাসপাতালে গিয়েছিলাম স্বামী স্মরণানন্দজির স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজ নিতে। স্বামী আত্মস্থানন্দজির মতোই স্বামী স্মরণানন্দজি তাঁর সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন সারা পৃথিবীর কাছে আচার্য রামকৃষ্ণ পরমহংস, মাতা সারদা দেবী এবং স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ প্রচারে। এই নিবন্ধ লেখার সময় তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ও কথাবার্তার স্মৃতি নতুন করে মনে ভেসে উঠছে।
২০২০-র জানুয়ারিতে বেলুড় মঠে থাকাকালীন আমি স্বামী বিবেকানন্দের ঘরে ধ্যান করেছিলাম। ওই সফরে স্বামী স্মরণানন্দজির সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল স্বামী আত্মস্থানন্দজিকে নিয়ে।
এটা সকলেই জানেন যে রামকৃষ্ণ মিশন এবং বেলুড় মঠের সঙ্গে আমার অত্যন্ত নিকট সম্পর্ক। আধ্যাত্মিকতার খোঁজে পাঁচ দশকেরও বেশি সময়ে বহু সাধু এবং মহাত্মার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, আমি গেছিও নানা জায়গায়। এমনকি রামকৃষ্ণ মঠে আমি সেইসব সাধুদের সম্পর্কে জানতে পেরেছি যাঁরা তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন অধ্যাত্মের পথে। যার মধ্যে স্বামী আত্মস্থানন্দজি এবং স্বামী স্মরণানন্দজি অন্যতম প্রধান। তাঁদের পবিত্র ভাবনা এবং জ্ঞান আমার মনকে পূর্ণ করে দিয়েছে। আমার জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এই সাধুরা আমাকে জনসেবা হি প্রভু সেবার প্রকৃত অর্থটি শিখিয়েছেন।
স্বামী আত্মস্থানন্দজি এবং স্বামী স্মরণানন্দজির জীবন রামকৃষ্ণ মিশনের আদর্শ ‘আত্মন মোক্ষর্থম জগদ্ধিতায় চ’-এর অনপনেয় উদাহরণ।
শিক্ষার প্রসার এবং গ্রামোন্নয়নে রামকৃষ্ণ মিশনের কাজের দ্বারা আমরা সকলেই উদ্বুদ্ধ। রামকৃষ্ণ মিশন কাজ করছে ভারতের আধ্যাত্মিক উদ্ভাস, শিক্ষা ক্ষেত্রে ক্ষমতায়ন এবং মানব সেবার জন্য। ১৯৭৮-এ যখন ভয়াবহ বন্যা বাংলায় আঘাত এনেছিল, রামকৃষ্ণ মিশন তখন তার স্বার্থশূন্য সেবার মাধ্যমে প্রত্যেকের হৃদয় জয় করেছিল। আমার মনে আছে ২০০১ সালে যখন ভূমিকম্প কচ্ছকে ধূলিস্যাৎ করে দিয়েছিল, স্বামী আত্মস্থানন্দজি সেই কয়েকজন মানুষের অন্যতম যিনি আমাকে প্রথম ফোন করেছিলেন এবং রামকৃষ্ণ মিশনের তরফ থেকে বিপর্যয় মোকাবিলায় সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছিলেন। তাঁরই নির্দেশে রামকৃষ্ণ মিশন ভূমিকম্পে দুর্গত মানুষকে সাহায্য করেছিল।
গত কয়েক বছরে বিভিন্ন পদে থাকাকালীন স্বামী আত্মস্থানন্দজি এবং স্বামী স্মরণানন্দজি অত্যন্ত জোর দিয়েছিলেন সামাজিক ক্ষমতায়নের ওপর। যাঁরা এই মহান ব্যক্তিদের জীবন সম্পর্কে জানেন, তাঁরা নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারবেন এই সাধুরা আধুনিক শিক্ষা, দক্ষ করে তোলা এবং মহিলাদের ক্ষমতায়ন সম্পর্কে কতটা গভীরভাবে ভাবিত ছিলেন।
উদ্বুদ্ধ হওয়ার মতো তাঁর অনেক গুণের মধ্যে একটা জিনিস সবচেয়ে বেশি আমাকে প্রভাবিত করেছে, সেটি হল, প্রত্যেক সংস্কৃতি এবং প্রত্যেক ঐতিহ্যের প্রতি স্বামী আত্মস্থানন্দজির ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা। এই কারণেই তিনি নিয়মিত বহু জায়গায় ভ্রমণ করেছেন এবং দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন ভারতের বিভিন্ন অংশে। গুজরাটে থাকাকালীন তিনি গুজরাটি বলতে শিখেছিলেন। তিনি আমার সঙ্গে এমনকি সেই ভাষাতেই কথা বলতেন এবং আমি তাঁর গুজরাটি শুনতে ভালোবাসতাম।
ভারতের উন্নয়নের যাত্রার বিভিন্ন বিন্দুতে আমাদের মাতৃভূমি স্বামী আত্মস্থানন্দজি স্বামী স্মরণানন্দজির মতো বহু সাধু-সন্তের আশীর্বাদ লাভ করেছে যাঁরা সমাজ পরিবর্তনের স্ফুলিঙ্গতে ইন্ধন জুগিয়েছেন। তাঁরা আমাদের একতার আদর্শে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং সমাজ যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয় তার মোকাবিলা করতে প্রেরণা জুগিয়েছেন। এই নীতি চিরন্তন এবং অমৃতকালে বিকশিত ভারত গঠনে আমাদের যাত্রায় এটি আমাদের শক্তি যোগাবে।
আরও একবার সমগ্র দেশের পক্ষ থেকে আমি সেই মহান আত্মার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করি। আমার বিশ্বাস রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে যুক্ত সকল মানুষ তাঁদের দেখানো পথে আরও এগিয়ে যাবে।
ওঁ শান্তি।