ভারতের ৭৮তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আজ সকালে লালকেল্লার প্রাকার থেকে দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁর আজকের ভাষণে ভারতের উন্নয়ন প্রচেষ্টার মূলধারাগুলির কথা তুলে ধরার পাশাপাশি দেশ গঠনে জাতীয় সংকল্পের কথাও দৃঢ়তার সঙ্গে ব্যক্ত করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে 'দেশই প্রথম' - এই সংকল্পের কথা ঘোষণা করে জানান যে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ভারত যে ইতিমধ্যেই বিশ্বজুড়ে সুখ্যাতি অর্জন করেছে একথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ভারত সম্পর্কে বিশ্ববাসীর চিন্তা-ভাবনা ও ধারণার এখন আমূল পরিবর্তন ঘটেছে।
দেশের ১৪০ কোটি নাগরিককে তাঁর পরিবারের সদস্য বলে বর্ণনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন যে সকলকে সঙ্গে নিয়ে ধাপে ধাপে স্বপ্নের ভারত গড়ে তুলতে তিনি একান্ত বিশ্বাসী। প্রতিটি সমস্যার মোকাবিলায় ভারত যে সাফল্য অর্জন করে আগামী ২০৪৭ সালের মধ্যে এক উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হবে এবিষয়ে তাঁর দৃঢ় আস্থা ও বিশ্বাসের কথাও এদিন ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমাদের জীবনযাপন ও জীবন ধারণ শুধুমাত্র দেশের উন্নয়নের স্বার্থেই। তাই, প্রতিটি নাগরিকের স্বপ্ন ও অঙ্গীকার প্রস্ফুটিত হবে বিকশিত ভারত গঠনের মধ্য দিয়ে।
শ্রী মোদী বলেন, গণতন্ত্রের ওপর আমাদের আস্থা ও বিশ্বাস এবং দেশাত্ববোধ বিশ্ববাসীকেও অনুপ্রাণিত করেছে। আমাদের সংস্কার প্রচেষ্টার পথ উন্নয়নের এক মডেল হয়ে উঠতে চলেছে। সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে বিচার করলে ভারতে এখন সোনালী যুগ উপস্থিত। তাই, এই সুযোগকে কোনভাবেই আমরা হারিয়ে যেতে দেবো না। কারণ, জাতির আশা-আকাঙ্খা রূপায়ণে সোনার ভারত আমাদের গড়ে তুলতে হবেই।
ভারতের উন্নয়নে প্রচেষ্টার প্রতিটি ক্ষেত্রে যে এক নতুন ও আধুনিক ব্যবস্থা গড়ে উঠছে একথার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা-পদ্ধতি অবলম্বন করে আমরা কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে দেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে ইচ্ছুক। ভারতের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রয়োজন আধুনিকীকরণ ও উদ্ভাবন। এজন্য আমাদের প্রযুক্তির আশ্রয় অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে।
কারণ আমাদের লক্ষ্য হল প্রতিটি ক্ষেত্রেই উন্নয়নের গতিকে আরও ত্বরান্বিত করা। এজন্য তিনটি বিষয়ের ওপর আমাদের বিশেষ ভাবে নজর দিতে হবে - প্রতিটি ক্ষেত্রের উপযোগী নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি, পরিকাঠামোকে আরও শক্তিশালী করে তোলা এবং নাগরিকদের প্রাথমিক সুযোগ-সুবিধা দানের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
শ্রী মোদী বলেন, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও প্রতিকূলতা আমাদের এক গভীর উদ্বেগের বিষয় হলেও আমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করে তার মোকাবিলা করবো। কারণ আমাদের লক্ষ্য হল দেশের প্রতিটি অঞ্চলের প্রতিটি পরিবারের প্রতিটি মানুষকে যথাযথ ভাবে পরিষেবা যুগিয়ে যাওয়া।
দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে নতুন নতুন উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে নতুন নতুন উচ্চতায় দেশকে উন্নীত করার জন্য দেশবাসীকে আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, যারা ছোটখাটো সাফল্যকে আত্মতুষ্টির দৃষ্টিতে দেখে থাকেন আমরা তাঁদের মধ্যে অন্যতম হতে চাই না। কারণ আমাদের মধ্যে রয়েছে প্রতিটি বিষয়ে নতুন নতুন জ্ঞান অহরণের ইচ্ছা, সংকল্প ও অধ্যাবসায়, যাকে সম্বল করে আমরা সাফল্যকে এক নতুন শিখরে নিয়ে যাতে পারি। যেসমস্ত মানুষ শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থ ও কল্যাণের কথা চিন্তা করেন তাদের থেকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, মানুষের মানসিকতা যদি বিপদগামী হয় তার থেকে বড় কোন আশঙ্কা ও উদ্বেগের বিষয় হতে পারে না। তাই, এই সমস্ত মানুষের সংসর্গ আমাদের এড়িয়ে চলা উচিত। কারণ, উন্নয়ন প্রচেষ্টায় আশাবাদই মূল পাথেয়। আত্মতুষ্টি বা নৈরাশ্যবাদের সেখানে কোন স্থান নেই। আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল ১৪০ কোটি দেশবাসীর ভাগ্য পরিবর্তন এবং এই কাজে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই, এমন এক পরিবেশ ও পরিস্থিতি গড়ে তুলতে আমি আগ্রহী যা হয়ে উঠবে সম্পূর্ণ ভাবে ভয় ও দুর্নীতি মুক্ত।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাংবিধানিক ভাবধারার মধ্য দিয়ে ভারতের ৭৫টি বছর গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ওপর আস্থা স্থাপন করেছে। দেশের দলিত, নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের অধিকারকে সুরক্ষা দিয়েছে ভারতীয় সংবিধান। তাই, সংবিধানের ৭৫ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে প্রতিটি নাগরিকের উচিত জাতীয় কর্তব্য বোধে উদ্বুদ্ধ হওয়া।
বিভিন্ন কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের উন্নয়ন প্রচেষ্টা ও সাফল্যের কথাও এদিন সংক্ষেপে বিবৃত করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে আমরা ক্রমশ স্বনির্ভর হয়ে উঠছি। তাই, ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীর শৌর্য ও সাহসিকতায় গর্ব অনুভব করেন ১৪০ কোটি ভারতীয় নাগরিক। অন্যদিকে, ফিনটেক ক্ষেত্রে ভারত তার সাফল্যের জন্য বিশেষ ভাবে গর্বিত। দেশে মাথা পিছু আয় ও উপার্জন দ্বিগুণ করে তোলার কাজেও আমরা সফলতা অর্জন করেছি। এমনকি, কর্মসংস্থান ও স্বনিযুক্তি ক্ষেত্রেও দেশ নিত্যনতুন রেকর্ড স্থাপন করে চলেছে। দেশের ব্যাঙ্ক ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে নানা ধরনের সংস্কার প্রচেষ্টা আমরা নিরন্তর রেখেছি। সেই কারণে বিশ্বের বড় বড় ব্যাঙ্কগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলি এখন আর কোন ভাবেই পিছিয়ে নেই। সাধারণ মানুষ বিশেষত মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির কাছে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা একান্ত প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। শুধু তাই নয়, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও অনুশিল্পের উন্নয়নেও ব্যাঙ্কগুলি এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গত এক দশকে আমরা পরিকাঠামো উন্নয়নের বিষয়গুলি প্রত্যক্ষ করেছি। রেল, বিমান পরিবহণ, বন্দর ও সড়ক ব্যবস্থা সংযোগ ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেছে।
তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের তৃতীয় মেয়াদকালেও ভারত যে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠতে চলেছে এবিষয়ে তাঁর দৃঢ় আস্থা ও বিশ্বাসের কথা ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন যে এই লক্ষ্য পূরণে তিনি আরও তিন গুণ বেশি শক্তি নিয়োগ করতে সংকল্পবদ্ধ।
দেশের কৃষি ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন তথা রূপান্তর এই মুহূর্তে যে একান্ত জরুরী একথা ঘোষণ করে শ্রী মোদী বলেন যে প্রাকৃতিক কৃষি পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকল কৃষকদের কাছেই তিনি কৃতজ্ঞ। কারণ, মাতা বসুন্ধরার সেবা করার লক্ষ্যেই কৃষিজীবী মানুষ প্রাকৃতিক কৃষি পদ্ধতির সুযোগ গ্রহণ করেছেন।
শ্রী মোদী বলেন, জি২০-র সাফল্য থেকে একথাই প্রমাণিত যে বড় বড় যেকোন ধরনের আন্তর্জাতিক বৈঠক ও সম্মেলনের উদ্যোগ আয়োজনের ক্ষমতা ভারতের রয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রকে তিনি এই মর্মে আশ্বস্ত করেন যে ভারতের উন্নয়ন প্রচেষ্টা কখনই অন্যের স্বার্থের পরিপন্থী হয়ে উঠবে না। কারণ, ভারত হল ভগবান বুদ্ধের দেশ। তাই, যুদ্ধ বিদ্রোহের পথ আমাদের কাম্য নয়। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি যে অনতিবিলম্বে স্বাভাবিক হয়ে উঠবে এ আশাও ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, একটি প্রতিবেশী দেশ রূপে ভারত সর্বদাই অন্যের শান্তি ও কল্যাণ কামনা করে। তবে, বাংলাদেশে বসবাসকারী সংখ্যালঘু হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি ১৪০ কোটি ভারতবাসীর কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলি যে শান্তি ও কল্যাণের পথ অনুসরণ করবে এই আশা ভারতের রয়েছে। কারণ, ভারতীয় সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে শান্তির বাণী যা আমাদের অঙ্গীকার পূরণের পথকে আলোকিত করেছে।
দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন যে গ্রাম ব্যবস্থায় ২ লক্ষ পঞ্চায়েতকে ইতিমধ্যেই অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। সিক্স জি প্রযুক্তি বাস্তবায়িত করতে আমরা মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করে চলেছি। যার সাফল্য বিশ্ববাসীর কাছে এক আশ্চর্যের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।
শ্রী মোদী বলেন, দেশের মহাকাশ ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের অভ্যুদয় ঘটতে চলেছে। বেসরকারি প্রচেষ্টায় রকেট ও কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষিপ্ত হচ্ছে এবং এর পাশাপাশি চন্দ্রায়নের সাফল্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে এক নতুন উৎসাহ ও আগ্রহের জন্ম দিয়েছে। সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে ভারত যে বর্তমানে একটি অগ্রণী দেশ হয়ে উঠেছে একথাও আজ গর্বের সঙ্গে ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, দরিদ্র, মধ্যবিত্ত এবং বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত সাধারণ মানুষের জীবনে পরিবর্তনের সূচনা করতে আমরা সংস্কার প্রচেষ্টার পথ বেছে নিয়েছি। অন্যদিকে, শহরাঞ্চলের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং দেশের তরুণ ও যুবসমাজের স্বপ্ন ও সংকল্পের বাস্তবায়নেও আমরা বিশেষ ভাবে দৃষ্টি দিয়েছি। দেশের ২৫ কোটি মানুষকে দারিদ্র সীমার বাইরে নিয়ে আসার ক্ষেত্রেও আমরা সাফল্য অর্জন করেছি।
দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রেও আমূল সংস্কার সাধনের পথ আমরা অবলম্বন করেছি। আগামী ৫ বছরে দেশের মেডিকেল কলেজগুলিতে ৭৫০০০ অতিরিক্ত আসন যুক্ত করা হবে তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য। অন্যদিকে, নতুন শিক্ষানীতির মধ্য দিয়ে ২১ শতকের উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আমরা সংকল্পবদ্ধ। ভারতের সুপ্রাচীন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদর্শ ও শিক্ষা ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে উন্নততর পঠন-পাঠন ও গবেষণা প্রচেষ্টাকে আমরা উৎসাহিত করতে আগ্রহী। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতের উপযোগী দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এক দক্ষ ভারত গড়ে তুলতেও আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। গর্বের বিষয় গবেষণা ও উদ্ভাবন প্রচেষ্টা খাতে এক লক্ষ কোটি টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে এবছরের ঘোষিত বাজেটে।
শ্রী মোদী বলেন, দেশের তরুণ ও যুবপ্রজন্ম, কৃষক সম্প্রদায়, মহিলা ও আদিবাসী প্রত্যেককেই দাসত্বের শৃঙ্খল মুক্ত করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী জনমান কর্মসূচি যাতে দেশের প্রত্যন্ত গ্রাম, পার্বত্য অঞ্চল ও অরণ্যভূমিতেও বসবাসকারী আদিবাসী ভাই-বোনদের কাছে পৌঁছে যায় আমরা অবশ্যই তা নিশ্চিত করবো। ভগবান বিরসা মুন্ডার সার্ধশত জন্মবার্ষিকীতে তাঁর উত্তরাধিকারের ঐতিহ্য থেকে আমরা অনুপ্রেরণা লাভ করবো।
প্রধানমন্ত্রীর এদিনের ভাষণে কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রক, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক, পরিবেশ অরণ্য ও জলবায়ু মন্ত্রক, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রক, রেলমন্ত্রক, জলশক্তি মন্ত্রক, আবাসন ও শহরাঞ্চল বিষয়ক মন্ত্রক, পশুপালন মন্ত্রক, সংস্কৃতি মন্ত্রক, নতুন ও পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানি মন্ত্রক, বিদ্যুৎ মন্ত্রক, সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক মন্ত্রক, ক্রীড়া ও যুব বিষয়ক মন্ত্রক, উত্তর পূর্বাঞ্চলের উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রক, দক্ষতা বিষয়ক মন্ত্রক, আইন ও বিচার মন্ত্রক সহ বিভিন্ন সরকারি মন্ত্রক ও দপ্তরগুলির সাফল্যের বিভিন্ন দিকও এদিন তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।