দেশেরনানাপ্রান্ত থেকে আসা কর্তব্যপরায়ণা প্রেরণারূপী মা ও বোনেরা,
আমি ভাগ্যবান,আজ ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবসে দেশের নানাপ্রান্ত থেকে আসা মা ও বোনেদেরদর্শন করার সৌভাগ্য হয়েছে।
আমাকে বলাহয়েছে যে, এই অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার জন্য অনেকেই দু-তিনদিন আগে থেকেই এখানে এসেগেছেন। কেউ কেউ অনুষ্ঠানের পরও দু’দিন থেকে যাবেন। আপনারা এ রাজ্যের বিভিন্ন জেলায়গিয়ে বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখে এসেছেন। এখানেও আপনারা দুটো প্রদর্শনী ঘুরে দেখেছেন।প্রথমটি গ্রামের উন্নয়ন-ভিত্তিক। এতে রয়েছে – পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব, আধুনিকপ্রযুক্তির মাধ্যমে উন্নতমানের প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। আমার আসতে একটু দেরীহয়েছে, কারণ, ঐ প্রদর্শনীটি এত সুন্দর ছিল যে আমি সবকিছু ভুলে দেখে যাচ্ছিলাম।আপনারা ভালভাবে একজন শিক্ষার্থীর মতো করে ঐ প্রদর্শনীটি দেখবেন। কারণ, সরপঞ্চেরগুরুদায়িত্ব সামলাতে গিয়ে আপনাদের প্রতিদিন যত সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, এইপ্রদর্শনী আপনাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ণয়ে নতুন পথ দেখাবে, অনেক নতুন কিছুজানতে পারবেন, আর আমার বিশ্বাস এর ফলে আপনাদের সংকল্প আরও দৃঢ় হবে।
দ্বিতীয়প্রদর্শনীটি হ’ল, পরিচ্ছন্ন শক্তির সমারোহ। মহাত্মা গান্ধীর জন্মভূমি গুজরাটে।তাঁর নামে গড়ে ওঠা শহরে, আমরা যাঁকে মহাত্মা বলি, সেই মহাত্মা মন্দিরে এর কতগুরুত্ব তা আপনারা হয়তো অনুভব করছেন। এখানে রয়েছে একটি ডিজিটাল প্রদর্শনী,শ্রদ্ধেয় বাপুর জীবন নির্ভর একটি ভারচ্যুয়াল মিউজিয়াম। এখানে যে গান্ধীকুটিরনির্মাণ করা হয়েছে, সেটিও অবশ্যই ঘুরে দেখবেন। শ্রদ্ধেয় বাপুজির জীবনকে যদি আমরাঅনুভব করি, তা হলে দেখব যে পরিচ্ছন্নতাই ছিল তাঁর জীবনের মূল আগ্রহ। তাঁর সেইআকাঙ্খাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার সংকল্প আর বাস্তবায়নের ইচ্ছা বিফল যাবে না।
২০১৯ সালেমহাত্মা গান্ধীর সার্ধশতবর্ষ পালিত হবে। তিনি বলতেন, ভারত গ্রামে বসবাস করে।আরেকটি কথা তিনি বলতেন, আমাকে যদি স্বাধীনতা এবং পরিচ্ছন্নতা দুটোর মধ্যে আগেএকটিকে বেছে নিতে বলা হয়, তা হলে আমি আগে পরিচ্ছন্নতাকেই বেছে নেব। এই বক্তব্যথেকেই বোঝা যায় যে, তাঁর জীবনে পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব কতটা ছিল। ২০১৯ সালে আমরা যখনতাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষ পালন করব, তখন এই পরিচ্ছন্নতা একটি মূল বিষয় হয়ে উঠবে।স্বাধীনতার পর এদেশে যতগুলি সরকার এসেছে, প্রত্যেকেই কোনও না কোনওভাবেপরিচ্ছন্নতার জন্য কাজ করেছেন। কিন্তু আমরা ঠিক করেছি যে, অনেক কিছু করতে হবে।তবেই সেটা আমাদের স্বভাবের অংশ হয়ে উঠবে। তবেই আমরা পরিচ্ছন্নতাকে আমাদের জাতীয়পরিচয় হিসাবে গড়ে তুলতে পারব। আমাদের শিরা-ধমনীতে পরিচ্ছন্নতার অনুভূতি প্রবাহিতহবে। আমরা দেশে এমন পরিস্থিতি গড়ে তুলতে চাই। আর আমি নিশ্চিত যে, আমাদের দেশ এটাকরে দেখাতে পারবে।
এখানে সেইসরপঞ্চ বোনেরা বসে আছেন, যাঁরা নিজেদের গ্রামে এটা করে দেখিয়েছেন। তাঁরা খোলা মাঠেপ্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। নিজেদের গ্রাম এভাবে তাঁরাপরিচ্ছন্ন করে তুলেছেন। এই শক্তিরূপা বোনেরা যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এটা করেদেখাতে পারেন তাহলে বাকিরাও পারবেন, এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তবেই আমরা গান্ধীজিরজন্ম সার্ধশতবর্ষের আগে অনেক পরিবর্তন আনতে পারব।
একটু আগেইআপনারা একটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র দেখলেন, সেখানে বলা হয়েছে যে,পরিচ্ছন্নতার নিরিখে আমরা কত কম সময়ে ৪২ শতাংশ থেকে ৬২ শতাংশে পৌঁছে গেছি। এত অল্পসময়ের মধ্যে যদি আমরা ২০ শতাংশ পরিচ্ছন্নতা বৃদ্ধি করতে পারি, তা হলে আগামী দেড়বছরে এর থেকেও বেশি করতে পারব এটা আপনারা নিজেদের কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করেদেখিয়েছেন।
আজ যে মা ওবোনেদের সম্মান করার সৌভাগ্য হ’ল তাঁদেরকে নিয়ে নির্মিত এক এক মিনিটের ছোট ছোটচলচ্চিত্র আমরা দেখেছি। এই চলচ্চিত্রগুলি দেখলে যাঁদের মনে ভ্রম রয়েছে সব নিরসনহবে। অনেকে ভাবেন, শুধু পড়াশোনা জানা লোকেরাই বুঝি কিছু করে দেখাতে পারেন। কিন্তুএই মা ও বোনেরা, তাঁদের ধারণা যে ভুল, তা প্রমান করে দেখিয়েছেন।
অনেকে ভাবেন,যারা শহরে থাকেন আর পটর পটর ইংরেজি বলতে পারেন, তাঁরাই বুঝি সবকিছু করতে পারেন।যাঁরা নিজের মাতৃভাষা ছাড়া আর কোনও ভাষা জানেন না, তাঁরাও যদি লক্ষ্য স্থির করেকোনও কাজে লেগে পড়েন, তা হলে তাঁরাও যে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন, সেটা আপনারাপ্রমাণ করেছেন। অনেকে এটাই জানেন না যে, তাঁর জীবনের লক্ষ্য কী? কাল কী করবেন,সেটা জিজ্ঞেস করলে বলবেন, রাতে ভাববো। যাঁর জীবনের লক্ষ্য স্থির নেই, তিনি জীবনেকিছুই করে উঠতে পারেন না। দিন গুনে গুনে জীবন পার হয়ে যায়। নিজে থেকেই কিছু ভালহয়ে গেলে তা নিয়ে গানবাজনা করে রাতে ঘুমিয়ে পড়েন।
কিন্তু যিনিজীবনের লক্ষ্যকে চিনতে পারেন, যাঁর জীবনের লক্ষ্য স্থির থাকে, তিনি না থেমে,অক্লান্তভাবে, মাথা নত না করে, যাঁকে প্রয়োজন, তাঁকে সঙ্গে নিয়ে লড়াই চালিয়ে যান,সমস্যার মোকাবিলা করেন, আর একদিন লক্ষ্য পূরণ করে তবেই শান্তি পান।
একটি গ্রামেরসরপঞ্চ নির্বাচিত হওয়াটা ছোট ব্যাপার নয় । অনেকে হয়তো খুব সহজেই নির্বাচিত হয়েছেন, কিন্তু অধিকাংশকেই গণতান্ত্রিকপদ্ধতিতে লড়াই করে এতদূর পৌঁছতে হয়েছে।
আজ থেকে ১৫ বছরআগে যখন সরপঞ্চদের সভা হতো, ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণ থাকা সত্ত্বেও দেখতাম, অনেক মহিলাসরপঞ্চের বদলে পুরুষরা চলে এসেছেন। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, আমি এসপি। আমি ভাবতাম, এটাতো রাজনৈতিক কর্মীদের জনসভা, এখানে পুলিশের পদাধিকারী কোথা থেকে এসেছেন? তখন তিনিস্পষ্ট করে বলেন যে, আমি পুলিশ আধিকারিক নই, আমি সরপঞ্চপতি অর্থাৎ সরপঞ্চেরস্বামী। আমার স্ত্রী সরপঞ্চ কিন্তু সকল সভায় আমিই যাই। কিন্তু আজ দেখুন, মহিলারাআর তাঁদের স্বামীদের নিজের প্রতিনিধিত্ব করতে পাঠাচ্ছেন না। পারিবারিক অগ্রাধিকারগুলিসমাধান করেই তাঁরা এখানে এসেছেন। পরিবারেও আজ পরিস্থিতি বদলেছে। আমাদের অভিজ্ঞতাবলে, পুরুষ সরপঞ্চদের তুলনায় মহিলা সরপঞ্চরা নিজেদের কাজে অনেক বেশি সমর্পিতপ্রাণ।পুরুষ সরপঞ্চরা আরও ৫০টা কাজে ব্যস্ত থাকেন। সরপঞ্চের দায়িত্ব সামলানোর চেয়েআগামীবার জেলা পরিষদে নির্বাচিত হওয়ার জন্য যা যা করতে হবে, সেসব কাজ তাঁর জীবনেঅগ্রাধিকার পায়। কিন্তু মহিলাদের যে কাজ দেওয়া হয়, তাঁরা একাগ্রতার সঙ্গে সেই কাজনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পূর্ণ করেন।
একটি সংস্থাক্ষেত্র সমীক্ষা করে দেখেছে যে, নতুন কিছু শেখার প্রতি মহিলা পেশাদারদের আগ্রহপুরুষ পেশাদারদের তুলনায় অনেক বেশি। যতক্ষণ তাঁরা সামনে যা আছে, তা সম্পর্কেভালভাবে জেনে কাজ করতে না পারেন, ততক্ষণ সেটার পেছনে পড়ে থাকেন। সেজন্য তাঁরা কোনওসংকোচ না করে যে কাউকে নমস্কার জানিয়ে কাজ তুলে নিতে পারেন। আর যেখানে ধমক ও চমকদেখাতে হয়, তা করতেও পিছ পা হন না।
আমাদের দেশে ৫০শতাংশ মাতৃশক্তি দেশের উন্নয়ন যাত্রায় সক্রিয় অংশীদার হলে আমরা দেশকে কোথা থেকেকোথায় পৌঁছে দিতে পারব। আর সেজন্যই বর্তমান সরকার ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ মন্ত্রনিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমরা জানি, যে গ্রামগুলিতে মহিলা সরপঞ্চ রয়েছে সেইগ্রামগুলিতে কন্যাভ্রূণ হত্যা সহজেই বন্ধ করা যাবে। মায়ের গর্ভে কন্যাসন্তানকেমেরে দেওয়ার পাপ যাতে আপনার গ্রামের গায়ে না লাগে, সেটা দেখা আপনার দায়িত্ব। পারিবারিকচাপে কোনও বধূর ওপর অত্যাচার হলে, তাঁর রক্ষক হয়ে ওঠার ক্ষমতা আপনার রয়েছে। একবারপ্রতিবাদ করুন, তা হলে দেখবেন কেউ আর সাহস পাবে না। আজও আমাদের সমাজে ১ হাজারপুত্রের সামনে কোথাও ৮০০ জন, কোথাও ৮৫০, কোথাও ৯২৫ জন কন্যা রয়েছে। সমাজে এত বড়ভারসাম্যহীনতা থাকলে সমাজচক্র কিভাবে চলবে? এই পাপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোরদায়িত্ব আমাদের।
পঞ্চায়েতপ্রধান মহিলারা এক্ষেত্রে সর্বাধিক সাফল্য পেতে পারবেন। মেয়েদের প্রতি সমাজের যেদৃষ্টিকোণ, মেয়েকে যত্ন করে আর কি হবে, অন্যের ঘরেই তো চলে যাবে, ছেলে হলে তাকেযত্ন কর। আপনারাও যখন ছোট ছিলেন, আপনার মা নিজে মহিলা হয়েও খাবার দেওয়ার সময়আপনাকে এক চামচ ঘি দিলে, আপনার ভাই বা দাদাকে দু’চামচ ঘি দিয়েছেন, কেন? আপনিঅন্যের ঘরে চলে যাবেন বলে! আর ছেলে বৃদ্ধ বয়সে মা-বাবাকে দেখবে? আমি এরকম মেয়েদেখেছি, মা-বাবার একমাত্র সন্ততি, বৃদ্ধাবস্থায় মা-বাবার যাতে কষ্ট না হয়, তাই সেসারা জীবন বিয়েই করেনি। আবার এরকম ছেলেও দেখেছি যে, চার চার জন ভাই থাকা সত্ত্বেওমা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়েছে, তা হলে?
সেজন্য এই হীনবিভেদমূলক দৃষ্টিভঙ্গীকে বদলানোর জন্য আমাদের সংকল্পবদ্ধ হতে হবে। পরিবর্তন যেআসছে না, তা নয়। আপনারাই দেখুন, এবার অলিম্পিকে ভারতের মুখ উজ্জ্বল করেছেন কারা?তাঁরা সবাই আমার দেশের কন্যা। আজ দশম কিংবা দ্বাদশ শ্রেণীর ফলাফল দেখুন, প্রথমদশজনের মধ্যে অধিকাংশই থাকেন মেয়েরা। এভাবেই মেয়েরা নিজেদের প্রমাণ করে দিচ্ছে।
যেখানে যেভাবেইসুযোগ পায়, সে কাজকে পরিচ্ছন্নভাবে আমাদের মা ও বোনেরা সুসম্পন্ন করেন। সেজন্যইআমাদের শ্লোগান হ’ল ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’। এটা আমাদের সামাজিক দায়িত্ব,রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, মানবিক দায়িত্ব। আমাদের শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে :
“ইয়াবত গঙ্গাকুরুক্ষেত্রে, ইয়াবত তিষ্টতি মেদনী।
ইয়াবত সীতাকথালোকে, তাবৎ জীবেতু বালিকা।।
অর্থাৎ, যতক্ষণগঙ্গা কুরুক্ষেত্র আর হিমালয় রয়েছে, যতক্ষণ সীতার জয়গান এই দেশে শোনা যাবে, ততক্ষণতুমি বেঁচে থাকবে বালিকা। এর মানে, আমাদের শাস্ত্রেও পুরুষ আর মহিলাদের মধ্যে কোনওভেদভাব রাখেনি।
আমাদের মহিলাপঞ্চায়েত প্রধানদের কাছে আমার অনুরোধ, আপনারা গ্রামে ফিরে গিয়ে এই বিষয়টিতে বিশেষনজর দিন। গ্রামের প্রতিটি মেয়েকে পড়াশুনা করতে হবে। যতই গরিব হোক না কেন,ছেলেমেয়েদের সকলকেই পড়াশুনা করতে হবে। আপনারা এজন্য বাজেটের কথা ভাববেন না। সরকারিস্কুল রয়েছে, সরকারি বেতনভোগী শিক্ষকরা রয়েছেন, আপনাদের কেবল নজর রাখতে হবে যেছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে কি না, কোন্ পরিবার মেয়েদের ঘরে বসিয়েরাখছে।
পঞ্চায়েতপ্রধান হিসেবে আপনার অনেক ক্ষমতা রয়েছে। প্রতিটি স্কুলের প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীদেরতাদের গ্রামের সরপঞ্চের নাম লেখা শিখতে হবে। আপনি দু’বছর কিংবা তিন বছর ধরে পঞ্চায়েতপ্রধান হিসেবে কাজ করছেন, অথচ আপনার গ্রামের স্কুলের বাচ্চারা আপনার নাম জানবে না,এটা কেমন কথা। তারা যদি প্রধানমন্ত্রীর নাম জানতে পারে, মুখ্যমন্ত্রীর নাম জানতেপারে, তা হলে পঞ্চায়েত প্রধানের নাম না জেনে থাকতে পারে না। আপনার গ্রামের স্কুলেসরকারি শিক্ষক রয়েছেন, রাজকোষ থেকে প্রতি মাসে তাঁরা বেতন পাচ্ছেন, হাজার হাজারলক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে স্কুল বাড়ি বানানো হয়েছে, সেই স্কুলের প্রত্যেকছাত্রছাত্রী পঞ্চায়েত প্রধানের নাম লিখতে না পারলে এর থেকে দুঃখের কিছু হতে পারেনা। আপনি ফিরে গিয়ে স্কুলের মাস্টারমশাইকে বলুন, যাতে প্রত্যেককে পঞ্চেয়েতপ্রধানের নাম লিখতে শেখান।
আমি জানি নাআপনারা গ্রামের মানুষ বাড়িতে এলে তাঁদের চা খাওয়ান কি না, কিন্তু মাসে দু-একবার আধঘন্টার জন্য গ্রামের শিক্ষকদের চা খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। তখন কথায় কথায়তাঁদের বলুন, আমাদের গ্রামের কোনও বাচ্চা যেন পিছিয়ে না থাকে। এই তহশিলের মধ্যেজেলার মধ্যে এমনকি রাজ্যের মধ্যে তাঁরা যেন গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করে। দেখবেন,আপনার সক্রিয়তা, আপনার স্বপ্ন শিক্ষক মশাইয়ের মনকে ছুঁয়ে যাবে, তাঁকে প্রভাবিতকরবে। তিনি আগের থেকে অনেক বেশি উজ্জীবিত হয়ে কাজ করবেন। বছরে চার মাস তো তাঁদেরছুটিই থাকে। তারপরও হোলি আর দীপাবলি থাকে। কাজেই সারা বছরে সাত-আট বারের বেশিনিমন্ত্রণ জানাতে হবে না। আজ চতুর্দশ অর্থ কমিশনের পর ২ লক্ষ কোটি টাকা সরাসরিগ্রামের উন্নয়নে পাঠানো হয়। ২ লক্ষ কোটি টাকা কম কথা নয়।
আপনারা যদিগ্রামবাসীদের সঙ্গে নিয়ে ঠিক করেন যে আগামী পাঁচ বছরে এই ২৫টি কাজ আমাদের করতেহবে, তা হলে তা আপনারা সহজেই তা করতে পারবেন। গ্রামের অঙ্গনওয়াড়ির বোনেদের ডেকেপাঠান, নিজেরাও মাঝে মধ্যে অঙ্গনওয়াড়ি গিয়ে দেখুন, পরিচ্ছন্নতা বজায় রয়েছে কি না,ছেলেমেয়েরা ঠিকমতো খাবার পাচ্ছে কিনা, তাদের স্বাস্থ্য কেমন রয়েছে, তাদের সঙ্গেঅঙ্গনওয়াড়ির দিদিমনি খেলা করেন কি না! প্রতি বছর টিকাকরণের জন্য সরকার অনেক টাকাব্যয় করে। এক্ষেত্রে আপনার গ্রামের জন্য নির্ধারিত বাজেটের টাকা খরচ করতে হবে না।আপনার গ্রামে যদি ৫০টি শিশু থাকে, তাদের মধ্যে ৪০ জনকে টিকা দেওয়া হয়ে থাকলে বাকি১০ জনকে কেন দেওয়া হয়নি, সেখবর যদি আপনি রাখেন, তা হলে সংশ্লিষ্ট কর্মীরা কোনও রকমগাফিলতি করতে পারবে না। গ্রামের কোনও শিশুর যদি কঠিন কোনও রোগ হয়, তার চিকিৎসারপাশাপাশি সেই রোগ সংক্রামক কি না, সংক্রামক হলে অন্য শিশুদের প্রতি কিভাবে যত্ননেবেন? টিকাকরণ সঠিকভাবে হলে শিশুরা যখন ২০-২৫ বছর বয়সী যুবক-যুবতী হয়ে উঠবে, তখনআপনার গর্ব হবে, আমাদের সক্রিয়তার ফলেই এরা আজ সুস্থসবল নাগরিক। আপনি বৃদ্ধ বয়সেঅনেক আনন্দ পাবেন। এভাবে আপনার উপস্থিতি, আপনার নেতৃত্ব অনেক পরিবর্তন আনতে পারে ।
আচ্ছা আপনারাকি কিছু খেয়েছেন? শুধু চা খেয়েছেন, ঠিক আছে ঠিক আছে খেয়ে নিন। আমি টিকাকরণ নিয়েবলছিলাম। পঞ্চায়েত প্রধান হিসেবে আপনারা নিশ্চিত হবেন, যাতে গ্রামের প্রতিটি শিশুটিকাকরণের আওতায় আসে। যাতে গ্রামের প্রতিটি মেয়ে ছেলেদের পাশাপাশি স্কুলে পড়তেযায়। কোনও ছেলেমেয়েই যেন স্কুলছুট না হয়। গ্রামের স্কুলের মাস্টারমশাই যেন নিয়মিতস্কুলে আসেন – এগুলো দেখার দায়িত্ব আপনার।
আমাদের গ্রামপ্রধানরা এই নেতৃত্ব দিলে, কোনও অর্থব্যয় না করে, সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে গতিআসবে। কখনও আমাদের মনে হয়, গ্রামের মধ্যেই অসুস্থতার কারণ লুকিয়ে রয়েছে।
আজকাল আমাদেরসকলের দৃষ্টি শৌচালয়ে নিবদ্ধ। কিন্তু আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি যে পরিচ্ছন্নতাথেকে কতটা আর্থিক লাভ হয়? বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্ট অনুযায়ী, নোংরা থেকে যে গরিবপরিবারগুলিতে রোগ হয়, গড়ে প্রতি দরিদ্র পরিবারের জন্য বছরে ৭ হাজার টাকার ওষুধকিনতে হয়। আমরা যদি পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে পারি, গ্রামে রোগ ঢুকতে না দিই, তা হলেওই গরিব পরিবারগুলি বছরে ৭ হাজার টাকা করে বাঁচাতে পারবে নাকি পারবেন না? সেইসাশ্রয় করা টাকা দিয়ে তাঁরা বাচ্চাদের দুধ খাওয়াতে পারবে কি পারবে না? সেইসুস্থ শিশুরা আপনার গ্রামের মুখ উজ্জ্বলকরবে কি না? সেজন্য গ্রাম প্রধান হিসেবে ভাববেন, আমার শাসনকালে আমার গ্রামে এসবকিছু কি থাকা উচিৎ! সেজন্য কোনও সমঝোতা না করে স্থির বিশ্বাস নিয়ে কাজ করে যাবেন।
আমাদের দেশেঅনেকেই গ্রামের গুরুত্ব নিয়ে অনেক কথা ভেবেছেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৪সালে শহর আর গ্রাম নিয়ে কিছু লিখেছেন, বাংলাভাষায় । আমি হিন্দি অনুবাদ পড়ছি। আজ থেকে ৯০ বছর আগে তিনি লিখেছেন, আজ এখানে নারীদিবসে সেই উক্তির উচ্চারণ যথাযথ হবে! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, “গ্রাম হ’ল নারীরমতো, অর্থাৎ গ্রাম যেমন – মেয়েরাও তেমনি। তাদের অস্তিতকে সমস্ত মানবজাতির কল্যাণনিহিত, গ্রাম নারীর স্বভাবের প্রতিবিম্ব। শহরের তুলনায় গ্রাম প্রকৃতির অধিক নিকটে,আর জীবনধারার সঙ্গে বেশি যুক্ত। তার প্রাকৃতিক রূপে ‘হিলিং পাওয়ার’ বা সমস্ত ঘাশুকানোর শক্তি রয়েছে। নারীর মতো গ্রামও মানুষের আহার ও আনন্দের সকল বুনিয়াদীপ্রয়োজনগুলি মেটায় জীবনের একটি সহজ কবিতার মতো। পাশাপাশি মেয়েরা গ্রামেস্বতঃজন্মগ্রহণকারী সুন্দর ঐতিহ্যসমূহের মতো উল্লাসে, আনন্দে ভরে দেয়, কিন্তু যদিগ্রাম কিংবা নারীর উপর অনবরত ভার চাপিয়ে দেওয়া হয়, গ্রামগুলিকে শোষণ করা হয়, তাহলে সেগুলির আভা চলে যায়”।
আমরাও গ্রামীণউপাদানগুলিকে শোষণমুক্ত করতে চাই। গ্রামের প্রকৃতিকে বাঁচাতে চাই। গাছপালা, সবুজ,নির্মল জল, বিশুদ্ধ তাজা বাতাসের জন্য আমাদের গ্রামকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। শহরেবসবাসকারী অনেক মানুষও গ্রামে একটি বাড়ি বানিয়ে রাখতে চান। সপ্তাহান্তে বা প্রতিমাসে কয়েকদিন তিনি সপরিবারে কিংবা সবান্ধবে সেখানে এসে থাকতে চান। গ্রামে এরকমপরিবেশ বাঁচিয়ে রাখতে হবে। অন্যথায় এরকম পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকাররারবান মিশন প্রকল্প চালু করেছে। এর মূল বার্তা হ’ল, আত্মা গ্রামের আর সুবিধাশহরের হবে। ভারতের প্রতিটি পঞ্চায়েতকে ‘অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক’-এর মাধ্যমেযুক্ত করার কাজ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৭০ হাজার গ্রামকে যুক্ত করার কাজ সম্পন্নহয়েছে। গ্রামের স্কুলগৃহ অব্দি, পঞ্চায়েত অব্দি কেবল পৌঁছে দিতে পেরেছি। গ্রামেরপ্রয়োজন অনুসারে এই সংযোগ আরও বিস্তৃত করা যাবে। গ্রামে সকল আধুনিক পরিষেবা পৌঁছেদেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখানে যে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে, সেটি ঘুরে দেখারসময় আমাদের সচিব বলছিলেন যে, গ্রামপ্রধান বোনেরা মহা উৎসাহে এই প্রদর্শনীর সবকিছুখুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন আর প্রত্যেকেই সেলফি তুলেছেন। মাঝে মধ্যে আমরা সংসদেশুনি প্রযুক্তি কিভাবে চালু হবে, গ্রামের মানুষ প্রযুক্তির ব্যবহার জানেন না!তাঁরা নিছকই ভাষণের খাতিরে এসব কথা বলেন কি না জানিনা, আমার অভিজ্ঞতা ভিন্ন। আমিযখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলাম এদিকে একবার কপরাড়া নামে একটি গ্রামে গিয়ে দুগ্ধশীতলীকরণ কেন্দ্র উদ্বোধন করেছি। অত্যন্ত প্রত্যন্ত তহশিলের একটি পিছিয়ে পড়াআদিবাসী গ্রামে সেই মিল্ক চিলিং সেন্টারের আশেপাশের আরণ্যক পরিবেশে কোনও মাঠ নাথাকায় তিন কিলোমিটার দূরে একটি বিদ্যালয়ের মাঠে জনসমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল।মিল্ক চিলিং সেন্টার উদ্বোধন করতে গিয়ে দেখি ২৫-৩০ জন মহিলা দুধ রাখতে এসেছেন। সেইবোনেরা সেখানে দাঁড়িয়ে আমাকে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন, ফিতে কাটার কাজে সাহায্য করছিলেন।আজ থেকে ১০ বছর আগের কথা বলছি। আমি সেদিন অবাক হয়ে দেখছিলাম, সেই আদিবাসী বোনেরামোবাইল ফোন নিয়ে প্রত্যেকে ঐ অনুষ্ঠানের ফটো তুলছিলেন। আমি তাঁদের কাছে গিয়েজিজ্ঞেস করি আপনাদের ছবি তো উঠছে না, আমার ছবি তুলে কী করবেন? তখন তাঁরা যে জবাবদেন তা আমাকে চমকে দিয়েছিল। তাঁরা বলেছিলেন, আমরা এই ছবি ‘ডাউনলোড’ করিয়ে নেব। ঐপ্রত্যন্ত আদিবাসী গ্রামের লেখাপড়া না জানা বোনেদের মুখে ‘ডাউনলোড’ শব্দটি শুনেআমি অবাক হয়েছিলাম।
প্রযুক্তিকিভাবে সাধারণ মানুষের জীবনে প্রবেশ করেছে! কেন্দ্রীয় সরকার এখানকার গ্রামগুলিতে‘কমন সার্ভিস সেন্টার’ খুলেছে। সেই সেন্টারগুলিতে নবীন প্রজন্মেরত যেযুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থান হয়েছে তাঁরা গ্রামের মানুষকে কম্পিউটার ও ইন্টারনেটেরমাধ্যমে কী কী পরিষেবা প্রদান করছেন? এসব পরিষেবা কি আপনাদের সকলের গ্রামে আছে? নাথাকলে কিভাবে আপনার গ্রামেও এমন ‘কমন সার্ভিস সেন্টার’ খুলবেন সেই পরিকল্পনা করুন।তা হলে দেখবেন, প্রযুক্তি কত দ্রুত পরিবর্তন আনছে। গ্রামের শিক্ষিত যুবক-যুবতীদেরউপযুক্ত কর্মসংস্থান হলে আপনারা মাথা উঁচু করে বলতে পারবেন যে আমার শাসনকালে এইকাজ করেছি!
হয়তো আপনি এসববোঝেন না, তা হলে যাঁরা বোঝেন, তাঁদের সঙ্গে নিন। অহংকারী পুরুষেরা যেটা করতেপারেন না আপনারা অনায়াসে তা করতে পারেন। বাড়ির দ্বাদশ শ্রেণীতে পাঠরত ছেলে বামেয়েটিকে সঙ্গে নিন। সে আপনাকে বলে দেবে, কী কী করতে হবে। কেমন করে করতে হবে!একবার চেষ্টা করে দেখুন, আপনার শক্তি অনেক গুণ বৃদ্ধি পাবে।
আপনার গ্রামেরক’জন মানুষ সরকারি রাজকোষ থেকে বেতন পান? সেই সরকারি কর্মচারী কিংবা ভাতাপ্রাপ্তব্যক্তিদের নিয়ে মাসে একবার মিটিং করবেন। কেউ হয়তো ড্রাইভার, কেউ কম্পাউন্ডার, কেউপিওন, কেউ আবার শিক্ষক – প্রত্যেক গ্রামেই এমন সরকারি বেতন কিংবা ভাতাপ্রাপ্ত১৫-২০ জন মানুষ পাবেন। তাঁদেরকে নিয়ে প্রতি মাসে একবার আলোচনায় বসুন, প্রশ্ন করুন,তাঁরা কিভাবে গ্রামের উন্নয়নে শরিক হবেন? তাঁদের মাধ্যমে কিংবা তাঁদের পরিচিতিরমাধ্যমে গ্রামের উন্নয়নযজ্ঞ নতুন গতি পেতে পারে! শুধু তহশিলদার কিংবা পাটোয়ারিরসঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করলে চলবে না। গ্রামের অঙ্গনওয়াড়ি দিদিমনি, আশাকর্মী,শিক্ষকদের মতো সরকারি প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে গ্রামের উন্নয়নেরকাজ করুন, দেখবেন আপনার শক্তি, আপনার ক্ষমতা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আপনার কাজও অনেকসহজ হবে। আরেকটি বার্ষিক কাজ শুরু করলে খুবই লাভবান হবেন, সেটি হল – গ্রামেরজন্মদিন পালন । আপনার গ্রামের জন্মদিন কবে সেটা জানা না থাকলে, পঞ্চায়েতসদস্যরা একত্রে বসে গ্রামের ইতিহাসে কোনও স্মরণীয় দিনকে জন্মদিন হিসেবে ঠিক করুন।তারপর ঐ দিনটিকে প্রতি বছর মহা সমারোহে পালন করুন, মেলার আয়োজন করুন। গ্রামের যেসবমানুষ কর্মসূত্রে শহরে চলে গেছেন, বিয়েসাদী কিংবা অন্যান্য উৎসব অনুষ্ঠানে কখনওগ্রামে আসেন, কিংবা ফসলের ভাগ নিতে আসেন, তাঁদেরকে ঐ গ্রামের জন্মদিনে চিঠি পাঠিয়েআমন্ত্রণ জানান। প্রয়োজনে সেই অনুষ্ঠানকে তিন-চারদিনের সাম্বৎরিক উৎসবে পরিণতকরুন। গ্রামের প্রবীণ নাগরিকদের সেই সময় সম্মানিত করুন, যাঁদের বয়স ৭৫-এর বেশি সেইবয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান আপনাদের উৎসবকে গরিমা প্রদান করবে। ঐ সময় প্রত্যেক গ্রামবাসীযাতে অন্ততপক্ষে একটি করে গাছ লাগান, গ্রামের ছেলেমেয়েরা যাতে গ্রামের পরিচ্ছন্নতাঅভিযানে সামিল হয় – এসব তদারকির কাজ করবেন । বয়োজ্যেষ্ঠরা শহর থেকে আমন্ত্রণ জানিয়ে গ্রামের যে কৃতী সন্তানদের ডেকেএনেছেন তাঁদের নিয়ে একদিন মিটিং করুন। তাঁদের মধ্যে কেউ গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করেথাকলে তাঁকে সম্মানিত করুন। তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করুন, তাঁরা গ্রামের উন্নয়নে কে কীকরতে পারেন! আপনারা দেখবেন, গ্রামবাসীদের মনে একটি উৎসাহের জোয়ার আসবে। গ্রাম কেমনপ্রাণবন্ত হয়ে উঠবে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সমবেত নৃত্য গান নাটকে মেতে উঠবে। তা হলেদেখবেন, লেখাপড়া শিখে ১৮ বছর বয়স হতে না হতেই গ্রামের ছেলেমেয়েদের শহরমুখী হওয়ারপ্রবণতাও কমবে। গ্রামেই যদি কর্মসংস্থান হয়, তা হলে হাতে গোনা কয়েকজনই শুধুউচ্চশিক্ষার জন্য শহর কিংবা মহানগরে যাবে! এভাবে আপনারা নবীন প্রজন্মকে গ্রামমুখীকরে তোলার ক্ষেত্রে সদর্থক ভূমিকা নিতে পারেন। গ্রামকে প্রাণবন্ত করে তুলতে পারেন।
একইভাবেগ্রামের যত আবর্জনা সেগুলিকে সম্পদে পরিণত করার কথা ভাবতে হবে। গৃহপালিতপশুপাখিদের মলমূত্র জৈব সার হতে পারে। আমাকে বলা হয়েছে এই গান্ধীনগরের আশেপাশে বড়বড় পশুখামার ঘিরে কয়েকটি গ্রাম গড়ে উঠেছে। তাঁরা সমস্ত আবর্জনাকে জৈব সারেরূপান্তরিত করে সেই সার বিক্রি করে মোটা টাকা উপার্জন করেন। আপনারাও নিজেদেরগ্রামে স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে তুলে তাঁদের মাধ্যমে বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তরিত করারকথা ভাবতে পারেন। গ্রামের আবর্জনাকে কম্পোস্ট সারে রূপান্তরিত করলে তা বিক্রি করেপঞ্চায়েতের আয় বাড়বে। জমিতে জৈব সার মেশাতে পারলে গ্রামের ফলনও বৃদ্ধি পাবে। এধরণের ছোট ছোট উদ্যোগ নিলে দেখবেন, বরাদ্দ বাজেটের টাকা খরচ না করেও অনেক কাজ করতেপারবেন। গ্রামের পরিচ্ছন্নতা সুনিশ্চিত হলে গ্রামের সামর্থ্য বৃদ্ধি পাবে।পরিচ্ছন্নতাকে স্বভাবে পরিণত করতে হবে। মনে করুন, আপনি কোথাও যাচ্ছেন, তখন শরীরেকোথাও নোংরা লেগে গেলে আপনি কি অন্যের পরামর্শ নিতে ছুটবেন> নাকি তখনই রুমালবের করে মুছবেন কিংবা বেশি নোংরা লেগে গেলে নিকটবর্তী কল থেকে বা জলাশয় থেকে জলনিয়ে তা ধুয়ে ফেলবেন। তেমনই আমাদের ভারতমাতার গায়ে নোংরা পড়লে আমাদের সবাইকেএকসঙ্গে হাতে হাত লাগিয়ে তা পরিষ্কার করতে হবে। তা হলেই দেখবেন, অনেক রোগের পেছনেখরচ কমে যাবে। অপুষ্টি কমবে। অনেক সাশ্রয় হবে।
এতে সবচাইতে লাভবানহবেন গরিব মানুষ। অপরিচ্ছন্নতা গরিব মানুষ, বস্তিবাসী মানুষ, অপরিশ্রুত জলপান করামানুষদের জীবনেই অভিশাপ ডেকে আনে। এর বিরুদ্ধে লড়াই মানবতার পক্ষে লড়াই। এই জনসেবাপ্রভুসেবা থেকে অনেক বেশি পুণ্যের কাজ। আমরা পবিত্র মনে এই কাজ করলে ২০১৯ সালেমহাত্মা গান্ধীর জন্মশতবর্ষে ‘স্বচ্ছ ভারত’ অভিযানের সাফল্য আমাদের পরিবেশকে বদলেদেবে। শুধু শৌচালয় নির্মাণ করলে, উন্মুক্ত শৌচ বন্ধ করতে পারলেই দেশ পরিচ্ছন্ন হয়েপড়বে – তা নয়। পরিচ্ছন্নতাকে আন্দোলনে পরিণত করতে হবে, জনগণের স্বভাবে পরিণত করতেহবে। গত দু’বছর ধরে এ বিষয়ে সারা দেশে এত আলোচনা আর কাজ হয়েছে, যা স্বাধীনতার পরএত বছরে হয়নি। এটা ভাল লক্ষণ। আমি জনসমক্ষে এই কথাগুলি বলছি। সাধারণত, সরকারেরপক্ষে থেকে যে কোনও ঘোষণা হলে, সেদিনই সংবাদমাধ্যম তার ত্রুটিগুলি খুঁজে বের করারচেষ্টা করে, ভুল খোঁজে, মিথ্যে খোঁজে।
কিন্তুপরিচ্ছন্নতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যম সরকারের সমস্ত পদক্ষেপকে অকুন্ঠসমর্থন জানিয়েছে। এক্ষেত্রে সরকার যতটা সাফল্য পেয়েছে, সংবাদ মাধ্যম তার থেকে এককদম এগিয়ে সেই সাফল্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছে। দেশের প্রতিটি সংবাদ মাধ্যম‘স্বচ্ছ ভারত’ অভিযানের স্বেচ্ছা প্রচারক হয়ে উঠেছে। আর দলমত নির্বিশেষে সবাই যেকাজে হাত লাগায় – সে কাজে সাফল্য আসবেই। সরকারকে দেখতে হবে এই অভিযান যাতেসুনিয়ন্ত্রিত পথে এগোয়। শুধু মুখে বললে কিংবা মন্ত্র জপলে চলবে না। কাজে করেদেখাতে হবে। আপনারা নিজের নিজের গ্রামকে পরিচ্ছন করে তুলতে, গোটা ভারত পরিচ্ছন্নহয়ে উঠবে, সারা দেশে রোগ প্রদূষণ কমবে। আমাদের জীবনে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হবে।
যাঁরা এখানেসম্মানিত হয়েছেন, তাঁদেরকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানাই। তাঁদের কাজ, তাঁদের জীবন,তাঁদের সাহসিকতা, তাঁদের সংকল্প আমাদের সকলের কাছে প্রেরণাস্বরূপ। আর এখানে এইআন্তর্জাতিক নারী দিবসে উপস্থিত দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা গ্রামপ্রধান মহিলাদেরপ্রণাম জানাই। পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে মায়েরাই পথ দেখাবেন। কারণ, আজ দেশের সর্বত্রপরিচ্ছন্নতার আন্দোলনে তাঁদের নেতৃত্বই সবচাইতে বেশি সাফল্য এসেছে। সব ধরনেরপরিচ্ছন্নতা, সামাজিক জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্নতা, সংস্কার, সদ্গুণ,সৎকার্যে মাতৃশক্তির অবদানই সর্বাধিক। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, পরিচ্ছন্নতার এই অভিযানেওমাতৃশক্তির আশীর্বাদ অভূতপূর্ব সাফল্য আনবে। আপনাদের সবাইকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
অনেক অনেকধন্যবাদ।