বন্ধুগণ, আজ কথা ছিল আমি আপনাদের কথা শুনব, আপনাদেরকে বুঝব। আমি সর্বসমক্ষে একথা বার বার বলেছি যে, আপনাদের বুঝতে পারা এবং আপনাদের কথা শোনা আমার জন্য অত্যন্ত জরুরি। এর মাধ্যমেই আমি জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারি। এত বড় দেশ, যদি কোনও সরকার এটা ভেবে থাকে যে, তারা এই দেশ পরিচালনা করে, তা হলে এটা ভ্রম মাত্র। বিগত প্রজন্মে শৈল চতুর্বেদী নামক একজন হাস্যরসের কবি ছিলেন। তিনি একবার ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, এক নেতা গাড়ি করে আসার সময় চালককে বলেন আজ আমি চালাব, তখন চালক বললেন, আমি নেমে যাব। নেতা জিজ্ঞেস করেন, কেন? তখন চালক বললেন, এটা গাড়ি, সরকার নয় যে, যে কেউ চালিয়ে নেবেন। আমরা যদি ৫০ বছর পেছনের কথা ভাবি, তখন দেখব, সমাজে সরকারের উপস্থিতি অনেক কম জায়গায় ছিল। সামাজিক বুনোটই এরকম ছিল যে, সমাজ ব্যবস্থা নিজের ক্ষমতায় চলত। আপনারা হয়তো লক্ষ্য করেছেন যে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য গ্রন্থাগার ছিল। সেগুলি কি কোনও সরকার চালাতো। সমাজের কিছু গণ্যমান্য মানুষ নিজের খরচে অথবা চাঁদা তুলে এ ধরনের কিছু সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন। শিক্ষা ক্ষেত্রও আজকের মতো এত ব্যবসার বিষয় হয়ে ওঠেনি। সমাজে যাঁরা দান-ধ্যান করতেন, তাঁরাই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদন্ড ছিলেন। নিঃস্বার্থভাবে তাঁরা এই কাজ করতেন। যে এলাকায় জলের ব্যবস্থা ছিল না, এই মানুষেরা নিজেদের উদ্যোগেই সেসব অঞ্চলে জল পৌঁছনোর ব্যবস্থা করতেন। প্রখর গ্রীষ্মে পথেঘাটে জলসত্র বসাতেন। আমরা রাজস্থান বা গুজরাটে গেলে স্থানে স্থানে অসংখ্য জলাশয় দেখতে পাই। এগুলো কোনও সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে গড়ে ওঠেনি। সাধারণ মানুষ নিজস্ব বা মিলিত উদ্যোগে এগুলো করতেন। তখন যাঁরা সমাজের কর্তাব্যক্তি ছিলেন, তাঁরা এসব কাজের নেতৃত্ব দিতেন। আর সেজন্য আমাদের দেশে সরকারের উদ্যোগে ব্যবস্থা কোনও গড়ে উঠলেও, উন্নয়ন সর্বদাই সমাজের সক্রিয় উদ্যোগে মিলিত শক্তি ও সামর্থ্যের মাধ্যমে এবং মনে সমর্পন ভাব নিয়ে সম্পন্ন হ’ত।
এখন সময় বদলে গেছে। আর এই পরিবর্তিত সময় অনুসারে আমাদের ব্যবস্থাগুলিরও পরিবর্তন আনতে হবে। আজও সমাজে এ ধরনের উদারমনস্ক ধনসম্পন্ন, জ্ঞানী, অভিজ্ঞ ও সেবাপরায়ন মানুষেরা রয়েছেন। সেই অমূল্য রত্নদের একেকটি সুতোয় গেঁথে যদি ফুলের মালা গড়ে তোলা যায়, সেই মালা ভারতমাতা’কে অনেক বেশি সুন্দর করে সাজিয়ে তুলতে পারবে। আমরা এরকমই বেশ কিছু শক্তিকে সরকারের কাজে লাগিয়েছি, যাঁরা সংবাদ মাধ্যম দ্বারা প্রচারিত নন, কারণ, এমন অনেক কিছু রয়েছে, যা সংবাদ মাধ্যমের উপযুক্তই নয়। আবার অনেককে সংবাদ মাধ্যম দেখেও, দেখে না। আপনারা কি লক্ষ্য করেছেন যে, সরকার কাদের পদ্মপুরস্কারে বিভূষিত করেন? পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ! কোনও বড় নেতা সুপারিশ করলেই হয়ে যায়। অধিকাংশ রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা এ ধরনের পুরস্কার পেয়ে থাকেন।
আমরা একটি ছোট্ট সংস্কার আনি, এক্ষেত্রে সুপারিশ নেওয়া বন্ধ করে দিই। যে কোনও নাগরিক অনলাইনে নিজের বিবরণ পাঠাতে পারেন। খবরের কাগজের কাটিং পাঠাতে পারেন যে, এমন একজন মানুষ সম্পর্কে আমি জানি, যিনি এ ধরনের রাষ্ট্রীয় সম্মান পাবার জন্য। এবার আমরা এ রকম সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাজার হাজার এমন মানুষের খোঁজ পেয়েছি। যে নবীন দলকে এই খোঁজ পাওয়া মানুষদের মধ্যে থেকে শ্রেষ্ঠদের বেছে নিতে বলা হয়েছে, তাঁরা কেউই আগে এঁদের সম্পর্কে জানতেন না। ফলস্বরূপ, এবার অনেক অজানা নতুন মুখ এ ধরনের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছেন। যেমন – পশ্চিমবঙ্গের একটি মুসলমান ছেলে, যাঁর মা উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে মারা গেছেন। ঠিক সময়ে মা’কে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সম্ভব হয়নি। এই ছেলেটি তারপর থেকে নিজের মোটর সাইকেলে করে সাধারণ রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে যায়। পেট্রোলের খরচও সে নিজেই বহন করে। পুরো এলাকায় সে এখন অ্যাম্বুলেন্স আঙ্কেল নামে পরিচিত। ইতিমধ্যেই তাঁর পরিষেবায় আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তের বিভিন্ন গ্রামের মানুষ উপকৃত হয়েছেন। আমাদের নির্বাচক মণ্ডলী তাঁকে পদ্ম পুরস্কারের জন্য বেছে নিয়েছেন। অর্থাৎ সরকার চাইছে যে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাঁরা নিজের চেষ্টায় কোনও না কোনোভাবে সমাজের নিঃস্বার্থ সেবা করছেন, তাঁরা সম্মানিত হন। বর্তমান সরকার ফাইলের পরিসীমা থেকে বেরিয়ে জনজীবনের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়। এটা আমাদের উভয়মুখী প্রয়াস। সেজন্য আমরা এরকম ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পেরেছি, যাতে সকলের পরামর্শ লিপিবদ্ধ হয়। এই ব্যবস্থা এ ধরনের প্রথম ব্যবস্থা, তাই এতে অনেক ত্রুটি থাকতে পারে, আমাদের ভাবনাচিন্তার সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। কিন্তু আমরা এই প্রয়োগকে কিভাবে প্রাতিষ্ঠানিক করে তুলব, একে কিভাবে সাম্বাৎসরিক অনুষ্ঠানে পরিণত করব, যা সরকারের পরিবর্ধিত অঙ্গ হয়ে উঠবে। যেমন – আপনারা ৬টি গ্রুপ বানিয়েছেন। এর মধ্যে প্রত্যেকটি গ্রুপটি ৫টি আলাদা আলাদা বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করেছেন।
এখন আমি ভাবছি, এই গ্রুপগুলি কি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের সঙ্গে স্থায়ীভাবে যুক্ত হতে পারে? যাঁরা ডিজিটাল ক্ষেত্রে কাজ করেছেন, তাঁরা যদি নিজেদের সময় উপহার দেন, তা হলে আমরা সরকারি দপ্তরে যাঁরা ডিজিটাল ইন্ডিয়ার কাজ করছেন, সেই দপ্তরের মন্ত্রী ও আধিকারিকদের সঙ্গে আপনাদের একটি টিম তৈরি করে দিতে পারি। এই টিম প্রতি মাসে একবার সকলে মুখোমুখী বসে নতুন নতুন বিষয় নিয়ে কথা বলবেন, কী বলবেন তা আপনারাই ঠিক করবেন, কারণ আমি তো ডিজিটাল বিষয় নিয়ে কিছু বুঝি না! এখানে একটি সূচিতে আমি দেখছিলাম, অনেকেই আমার মতো কিছুই বোঝেন না। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সরকারের সর্বস্তরে এই একই অবস্থা। সরকারের ডিজিটাল হওয়ার মানে হার্ডওয়্যার কেনা। টেবিলে আগে যেখানে ফুলদানি থাকত, এখন সেখানে ল্যাপটপ, যাতে বাইরে থেকে ঘুরতে আসা কারও মনে হয় যে সরকারি অফিস এখন আধুনিক হয়েছে। সরকারে ক্ষমতায় আসা অধিকাংশ জনপ্রতিনিধিরই বয়স ৫০-৫৫’রও বেশি। তাঁদেরকে এখন ৩০ বছরের কম বয়সী মানুষের মতো ভাবতে হচ্ছে। সেজন্য আমি এই প্রকল্প শুরু করেছিলাম। আমি অত্যন্ত আনন্দিত, আজ সরকারে আমার সঙ্গে যে টিম কাজ করছে - মন্ত্রী, সচিব ও আধিকারিকদের প্রায় ২০০ জনের টিম। তাঁদের সঙ্গে আমার নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ ও মতবিনিময় হয়। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নয়, আমি একজন সহকর্মী হিসাবে ওঁদের সঙ্গে সময় কাটাই। এখন গত তিন বছরের অভিজ্ঞতার ফলে আমি বলতে পারি, যেমন করে কৃষক ক্ষেতে ফসল বোনার আগে ভাবনাচিন্তা করেন - কবে বৃষ্টি আসতে পারে, ফসল ফলতে কতটা সময় লাগবে, তারপর সেই ফসল বাজারে কত টাকা দামে বিক্রি হতে পারে – এগুলি সম্পর্কে স্থির নিশ্চিত না হয়েও তিনি ফসল ফলান। আমিও তেমনই এই ২০০ জনের টিমের সদস্যের মস্তিষ্কে আমার ভাবনাচিন্তা বোনার চেষ্টা করি। আর আজ আমি অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এই টিমের প্রত্যেক সদস্য যে কোনও ভাবনার বীজকে গ্রহণ করার জন্য মহা উৎসাহে লালায়িত থাকেন। আমার অগ্রজ টিমের প্রত্যেক সদস্যই নতুন কিছু খুঁজে বের করে সেটাকে বোঝা এবং স্বীকার করার জন্য প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠার বদলে অনুকূল হয়ে ওঠার সুযোগ খোঁজেন। তাঁদের এই আন্তরিক প্রয়াসের ফলস্বরূপ আমি আজ আপনাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা ভাবতে পারছি। তাঁরা যদি প্রতিকূলতা সৃষ্টি করতেন, তা হলে আজ আমি এই সাহস করতাম না, এ সম্পর্কে ভাবতামই না। কারণ, আজ থেকে ছ’মাস পর আপনারাই হতাশার সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে উঠতেন। বলতেন - ছাড়ুন তো, সবাই মুখে বড় বড় কথা বলেন, সবাই একই রকম। কিন্তু আমার টিম যেহেতু নতুন যে কোনও কিছু স্বীকার করতে উৎসাহী, তাঁদের সেই উৎসাহে ভর করে আমি আপনাদের আহ্বান জানানোর সাহস করছি। গতকাল থেকে আপনারা আমার টিমের সদস্যদের সঙ্গে যেরকম ইতিবাচক আলাপ-আলোচনা করেছেন, আজ যে ধরনের বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন, আমরা এই বিষয়গুলিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।
আপনাদের প্রতি আমার অনুরোধ যে, নিজেদেরকেও চিনুন। অনেকেরই হয়তো পরস্পরের সঙ্গে এই প্রথমবার দেখা হয়েছে কিংবা পত্রপত্রিকায় তাঁদের লেখা পড়েছেন অথবা কোনও সোশ্যাল মিডিয়ায় পরস্পরের কাজ ও ভাবনা সম্পর্কে জেনেছেন। এখন আপনারাও নিজেদের মধ্যে টিম গড়ে তুলছেন। আমি জানি, এখানে উপস্থিত ২১২ জনেরই একটি টিম গড়ে ওঠেনি। কিন্তু আপনাদের পারস্পরিক পরিচয় ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ৩০-৩৫ জনের এক একটি গ্রুপ গড়ে উঠেছে। আপনারা পরস্পরের অবদানকে মনে মনে মেপে নিয়ে এই গ্রুপগুলি গড়ে তুলেছেন।
কোনও কাজ করতে গিয়ে কেউ যদি বেশি সময় নষ্ট করে থাকে, সেটাও আপনারা টের পেয়েছেন। কে এখানে এসে নিজের ব্যবসা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নেটওয়ার্কিং-এ বেশি সময় ব্যয় করেছেন, সেটাও আপনারা জানেন। এর মানে আপনারা পরস্পরের ইতিবাচক ও নেতিবাচক সকল বিষয়ে অবগত হয়েছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনারা ঐ নেতিবাচক দিকগুলিকে দূরে সরিয়ে ইতিবাচক দিকগুলি নিজের গ্রুপ গড়ে তোলার সময় মাথায় রেখেছিলেন। বিশ্বের কোথাও নতুন কোনও ঘটনা ঘটেছে, নতুন কোনও আবিষ্কার হয়েছে, তার ভালোমন্দ যাচাই না করে আপনারা যে ঝাঁপিয়ে পড়বেন না, সে সম্পর্কে আমি স্থির নিশ্চিত। আপনারা আগে নিয়মিত অধ্যয়নের মাধ্যমে নিজেকে অবগত ও উন্নত করে নিজেদের অগ্রাধিকার ঠিক করবেন। ভাবনাচিন্তার বাস্তবায়নে ভবিষ্যৎ নক্শা গড়ে তুলবেন। সাফল্যের জন্য আপনারা কোন্ কোন্ উপাদানকে বেছে নেবেন, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা কী হবে? সরকার নিয়ম মেনে চলে। যদি নিয়ম বদলাতে হয়, তা হলে কিভাবে বদলাবেন, নতুন কী নিয়ম হবে? সরকার কাগজে চলে। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনও আইন কাগজে-কলমে স্বীকৃত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত সরকার কোনও পদক্ষেপ নিতে পারে না। সেজন্য আপনারা কোন্ বিষয়ে কিভাবে সরকারের সঙ্গে যুক্ত হবেন, তা আপনাদেরকেই ঠিক করতে হবে। আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ নেতৃত্ব দিয়ে আগামী মাসে কোথাও একত্রে বসার কথা ভাবতে পারেন। আপনারা নিজস্ব পদ্ধতিতে একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে পারেন। আপনাদের মধ্যে থেকেই কেউ নেতৃত্ব দিয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে নতুন নতুন ব্যক্তি উদ্ভাবনকে আমন্ত্রণ জানাতে পারেন। মনে করুন, মাসে একবার গুগল হ্যাংআউটে কনফারেন্স করলেন, বিতর্কে অংশগ্রহণ করলেন আর বছরে দু-একবার সাক্ষাতে মিলিত হলেন। এভাবে আপনারাই এক সময় সরকারকেও নিজেদের সময় দিয়ে জাতির উন্নয়নে অবদান রাখতে পারেন। আর যথা সময়ে আপনাদের অবদান দেশে অনেক বড় পরিবর্তন আনতে পারে।
সরকারি ব্যবস্থায় নানা সমস্যা যেমন রয়েছে, তেমন অনেক ইতিবাচক দিকও রয়েছে। ঐ সমস্যার জায়গাগুলিতে আপনাদের অবদান অনেক ফলপ্রসূ হতে পারে। আমাদের দেশে অসাধারণ জিনিসের বেশি প্রয়োজন নেই। ছোট ছোট বিষয় অনেক পরিবর্তন এনে দেয়। যেমন – মানুষের ব্যবহার, আপনারা আমাকে বলুন – দেশের সাধারণ মানুষকে সরকার কী বিশ্বাস করবে না! এর সরল জবাব হ’ল, বিশ্বাস করা উচিৎ। কিন্তু এ যাবৎ সরকার জনগণ থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কিংবা গেজেটেড আধিকারিকদের বেশি ভরসা করতো। যে কোনও জায়গায় চাকরি বা অন্যান্য সরকারি কাজে দরখাস্ত জমা দিতে হলে তাঁদের সকল শংসাপত্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বা গেজেটেড আধিকারিকদের দিয়ে প্রত্যয়িত করতে হ’ত। আর আপনারা সকলেই জানেন, সেই প্রত্যয়ন কিভাবে হ’ত। সাহেবের ঘরের সামনে একটি ছেলে বসে থাকতো, তার হাতে টাকা-পয়সা দিলে সে কাজটি করে দিত। আমার মনে হয়েছে যে, এই পদ্ধতি অপ্রয়োজন। সেজন্য এই প্রক্রিয়া আমরা উঠিয়ে দিয়েছি। এখন যে কোনও মানুষ স্ব-প্রত্যয়িত শংসাপত্র জমা দিতে পারেন। সেগুলি দেখে কোনও চাকরির জন্য নির্বাচিত হলে, চাকরিতে যোগদানের আগে যোগদানকারীর মূল শংসাপত্রের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে নিলেই হ’ল। এভাবে গত তিন বছরে আমরা অনেক পরিবর্তন এনেছি। একটু আগেই এখানে দুর্নীতি নিয়ে কথা হচ্ছিল। কুলীন বলছিলেন যে, বিচার ব্যবস্থাকে শুধরালে বাকি সবকিছু শুধরে যাবে। কুলীন ঠিকই বলেছেন।
দেখুন, আমরা পরিবারে টাকা রাখি কিংবা গয়না – তালা লাগিয়ে রাখি। কিন্তু এই তালা লাগিয়ে কি আপনারা চুরি-ডাকাতি রুখতে পারবেন? চোর বা ডাকাতরা অনায়াসেই যে কোনও তালা ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আসলে তালা দেওয়া হয় বাড়ির ছেলেমেয়েদের স্বভাব যাতে খারাপ না হয় সেটা নিশ্চিত করার জন্য। তাদের হাতে টাকা পড়লে বাজে খরচ করার স্বভাব গড়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ, আমরা যে কোনও ব্যবস্থা নিজেকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য গড়ে তুলি। দুর্নীতিও দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রতিষ্ঠানিক হয়ে উঠেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা এর বিরুদ্ধে প্রতি-প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারব, একে আমরা আটকাতে পারব না।
আমাদের দেশে এত দালাল রয়েছে, তাদেরও তো রোজগার চাই। আজ তারা বেকার হয়ে পড়েছে। আজ তারা হাহাকার করছে। এরা অনেক গরিব বাড়ি থেকে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে ছেলেকে পিয়নের চাকরির ব্যবস্থা করে দিত। ২০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে ছুটির দিনে অস্থায়ী কাজ যোগাড় করে দিত। আমরা সরকারে এসে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ইন্টারভিউ প্রথা তুলে দিয়েছি। আপনারা আমাকে বলুন, পৃথিবীতে এমন কোন্ মনোবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আছে, যার মাধ্যমে তিনজন নির্বাচকের প্যানেল কয়েক মিনিটের মধ্যে একজন মানুষের সবকিছু বুঝে নিতে পারেন। অনেক সময় প্রতিযোগী পিছু ৩০ সেকেন্ড সময়ও তাঁরা পান না। এখন আমরা কম্প্যুটারের মাধ্যমে তাঁদের মেধা তালিকা তৈরি করি। মেধা অনুসারে চাকরিতে যোগদানের জন্য ডাকা হয়। এতে ২-৫ শতাংশ অযোগ্য মানুষও সুযোগ পেয়ে যেতে পারে। কিন্তু আগের পদ্ধতিতে ৮০ শতাংশই অযোগ্য মানুষ সুযোগ পেত।
এসব কথা বলার তাৎপর্য হ’ল, সরকার এরকম প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলছে, যাতে কোনও ব্যক্তি কিছু ভুল করলেও ব্যবস্থা সেই ভুলকে সামলে নিতে পারবে। কারণ, ব্যক্তির পদস্খলন সম্ভব। কিন্তু ব্যবস্থা পরিস্থিতি রক্ষা করতে পারে। আজকের পৃথিবীতে যেখানে ‘গ্যাপ’, সেখানেই ‘অ্যাপ’ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এসব ক্ষেত্রেও এরকম অনেকে নাক গলাচ্ছেন, যাঁরা লোক ঠকাতে অভ্যস্থ। একটি অ্যাপ-এ নানা কাজ করে পরের মাসে দ্বিতীয় অ্যাপ-এ তথ্য হস্তান্তর করে মুনাফা লুন্ঠন করবে। এই সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও প্রযুক্তি বিপ্লব আজ মানবজীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। আজ আর কেউ প্রযুক্তি-প্রতিবন্ধক নন। আর যাঁরা বলেন, প্রযুক্তি বুঝতে পারি না, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই পুরুষ, মহিলারা নন। সেজন্য রান্নাঘরে ব্যবহৃত অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সরঞ্জামগুলি ভালো ব্যবসা করছে। এমনকি, যেসব লেখাপড়া জানেন না, তাঁরাও দ্রুত হাতে-কলমে ঐ অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে অভ্যস্থ হয়ে উঠছেন।
ব্যবহার-বান্ধব প্রযুক্তি জীবন বদলে দিয়েছে। সরকারি প্রশাসনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার কিন্তু সেভাবে এত দ্রুত বদলায় না। আপনারা নানা ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ, আপনারা ভালোভাবেই বোঝেন যে, উদ্ভাবনই সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়। না হলে, সমাজ থমকে দাঁড়ায়। যেখানে থমকে দাঁড়ায়, সেখানেই আবর্জনা জন্ম নেয়। উদ্ভাবন থেকেই পরিবর্তন আসে। আপনারা সেই উদ্ভাবন জগতের মানুষ। যিনি হস্তশিল্পের কাজ করছেন, তিনিও হস্তশিল্পীদের হাতে বিশ্ব বাজারের প্রয়োজন অনুযায়ী নিখুঁত অথচ কম সময়ে অধিক উৎপাদনে উপযোগী প্রযুক্তি তুলে দিচ্ছেন বা প্রচলিত পদ্ধতিকেই সামান্য পরিবর্তনের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি ও নিখুঁত করার উপায় সেখাচ্ছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে যে সাফল্য আসছে, তাকে নবীন প্রজন্মের মানুষদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তুলছেন, যাতে তাঁরাও উৎপাদনে অংশগ্রহণ করতে পারেন। তাঁদেরকেও বাজারের চাহিদা সম্পর্কে বোঝাতে পারছেন। সেজন্য আজ এমনকি বাঁশ দিয়ে যাঁরা আসবাবপত্র নির্মাণ করেন, তাঁরাও বাজারের কথা মাথায় রেখে, গ্রাহক স্বাচ্ছন্দ্যের কথা মাথায় রেখে নতুন নতুন নক্শায় আসবাবপত্র নির্মাণ করছেন।
আমাদের দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে চাষবাস ছাড়া আরও অনেক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রয়েছে। দেশের নানা প্রান্তে এই ব্যবস্থা নানা রকম। আমরা এই কেন্দ্রাতিগ ব্যবস্থাকে কিভাবে সুসংহতভাবে দেশের অর্থনীতিতে উপযোগী উপাদান হিসাবে প্রস্তুত করব! একটা সময় ছিল, যখন গ্রামের কামার কিংবা মুচিরাই গ্রামের সকল প্রয়োজন মেটাতেন। সেজন্য গ্রামের মানুষকে গ্রামের বাইরে কোথাও যেতে হ’ত না। কিন্তু এখন অর্থনীতি এমন বদলেছে যে, সবচেয়ে বড় কামার হয়ে উঠেছেন টাটা আর সবচেয়ে বড় মুচি হয়ে উঠেছেন বাটা। এই পরিবর্তন খারাপ আমি বলছি না। কিন্তু এর মধ্যেও আমাদের কেন্দ্রাতিগ ব্যবস্থাও গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে সাফল্য এলে আমরা এমন ব্যবস্থা বিকশিত করতে পারব, যা দেশের অর্থনীতিকে একটি সুদূরপ্রসারী স্থায়ীত্ব প্রদান করবে। আপনাদের যে স্টার্ট আপ কোম্পানিগুলি রয়েছে, সেগুলির দ্বারা উৎপাদিত পণ্য কতটা ফ্যাশনদুরস্ত, সেদিকে আপনাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। ডিজিটাল সফটওয়্যারে স্টার্ট আপ বিশ্ব যেমন বিশ্বমানের, অন্যান্য ক্ষেত্রেও তেমনই হয়ে উঠতে হবে। সাধারণ মানুষের ছোট ছোট সমস্যার সমাধান যেন আপনাদের উৎপাদিত পণ্য করতে পারে। আপনাদের চিন্তাভাবনার বুনিয়াদ হওয়া উচিৎ গ্রাম-ভিত্তিক।
এক-দেড় বছর আগে আমি সিকিম গিয়েছিলাম। সিকিম ভারতের প্রথম জৈব রাজ্য। অনেকেই হয়তো জানেন না যে, ১৩-১৪ বছর ধরে লাগাতার পরিশ্রম করে সিকিমের জনসাধারণ তাঁদের রাজ্যকে জৈব রাজ্যে পরিণত করেছেন। আমাদের দেশে হিমালয়ের পাদদেশে যে সকল রাজ্য রয়েছে, প্রতিটিকেই দ্রুত জৈব রাজ্যে রূপান্তরিত করার সম্ভাবনা রয়েছে। আমি সিকিমের জৈব উৎসবেও অংশগ্রহণ করেছিলাম। সেদিনই সিকিম নিজেকে জৈব রাজ্য হিসাবে ঘোষণা করেছিল। সেখানে আমার সঙ্গে এক নবীন ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলার পরিচয় হয়। তাঁরা আইআইএম আমেদাবাদ থেকে পাসআউট করে সরাসরি সেখানে পৌঁছেছেন। আমি ভেবেছিলাম, ওরা ঘুরতে এসেছেন। কিন্তু আমি তাঁদের কথা শুনে অবাক হলাম যে তাঁরা ছ’মাস ধরে ওখানে কাজ করছেন, সিকিমের সকল জৈব উৎপাদনকে কিভাবে বিশ্ব বাজারে বিক্রি করা যায়, তার খুঁটিনাটি নিয়ে গবেষণা করছেন। তাঁদের ফলিত প্রচেষ্টায় একটি নমুনা ব্যবসাও ইতিমধ্যেই ফুলেফেপে উঠছিল।
এখন দেখুন, আমাদের স্টার্ট আপ বন্ধুরা কত দ্রুত এই নতুন জিনিসগুলোকে উপলব্ধি করতে পারেন। আমরা তাঁদের কিভাবে সাহায্য করতে পারি! বর্জ্য থেকে সম্পদ আমাদের অর্থনীতির একটা বড় ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে। নতুন প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে পুনর্নবীকরণের মাধ্যমে এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সারা ভারতে জনপ্রিয়তা করে তোলার প্রয়োজন রয়েছে। ভারতে পুনর্নবীকরণ কোনও নতুন বিষয় নয়। যুগ যুগ ধরে ভারতবাসী পুনর্নবীকরণে অভ্যস্থ। আমাদেরকে শুধু বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের সঙ্গে এই পুনর্নবীকরণকে যুক্ত করে সঙ্গবদ্ধভাবে দেশব্যাপী বর্জ্য থেকে সম্পদ আহরণের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তা হলে আমরা বড় পরিবর্তন আনতে পারব।
এটা সত্যি যে, শিক্ষাক্ষেত্রে আজ আইআইএম-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলিতে ক্যাম্পাস প্লেসমেন্ট হচ্ছে। বার্ষিক ১-২-৩ কোটি দর লাগিয়ে কোম্পানিগুলি মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের চাকরিতে নিয়োগ করছে। আমরা কি এরকম স্বপ্ন দেখতে পারি না, যে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলি থেকেও তেমনই ক্যাম্পাস প্লেসমেন্ট হবে আর মেধাবী শিক্ষিকরাও বছরে ১-২-৫ কোটি টাকা রোজগার করবেন। এটা সম্ভব! অবশ্যই সম্ভব! আজ আপনারা ভারতের ধনী, গরিব, শিক্ষিত, অশিক্ষিত নির্বিশেষে যে কাউকে প্রশ্ন করুন যে, তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য কী? তিনি জবাব দেবেন, ছেলেমেয়েদের ভালো শিক্ষা। আমি নিজেও অনেককে জিজ্ঞাসা করে দেখেছি, গাড়ির চালক, লিফ্টম্যান সকলেই একই জবাব দেন। তার মানে, সবচেয়ে যে পেশার চাহিদা রয়েছে, সেটি হ’ল শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের চাকরি। এখন আমাদের দেখতে হবে যে, আমরা তেমন যোগ্যতার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক কিভাবে গড়ে তুলব! সেজন্য অনেক নতুন মডেল আসছে, ফলিত মডেল আসছে। আর এক্ষেত্রে প্রযুক্তি বড় অবদান রাখতে পারে।
আমরা মহাকাশে যত কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠাই, তা নিয়ে গর্ব করি। কিন্তু শুনলে অবাক হবেন যে, সেই কৃত্রিম উপগ্রহগুলিতে এমন অনেক ট্র্যান্সপন্ডার থাকে, যেগুলি অব্যবহৃত থেকে যায়। আমরা সরকারে এসে এই অপচয় বন্ধ করি। মহাকাশ-বিজ্ঞান, মহাকাশবিদ্যা ও প্রযুক্তি প্রশিক্ষিত সকলকে একত্রিত করে আমরা দুই-তৃতীয়াংশ ট্রান্সপন্ডারকে শিক্ষার প্রসারে ব্যবহার করার উদ্যোগ নিয়েছি। ঐ ট্রান্সপন্ডারগুলি এখন আপনার বাড়িতে ছেলেমেয়েদের পাঠদানের ক্ষেত্রে নিঃশুল্ক ব্যবহার করা যাবে। অর্থাৎ, দেশের দরিদ্র থেকে দরিদ্র পরিবারে, সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে আধুনিক শিক্ষার বিষয়গুলিকে বিন্দুমাত্র অবনমন না ঘটিয়ে ছেলেমেয়েদের উৎকৃষ্ট শিক্ষাদানে এগুলি কাজে লাগছে। আমরা প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষার উৎকর্ষ বৃদ্ধি করতে পারছি। এই উৎকর্ষ যখন ছাত্রদের শিক্ষার ভিত্তিকে উৎকৃষ্ট করে তুলবে, তখন শিক্ষকরা নিজে থেকেই চাপে পড়ে যাবেন। তাঁরা অস্তিত্বের স্বার্থে নিজেদেরকে আরও সময়ানুগ শিক্ষিত করে তুলবেন। শুধু পাঠক্রম নির্ভর পড়াশুনা নয়, সমস্ত কিছুকে উদ্ভাবনী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা, ছাত্রছাত্রীদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের ব্যবহারকে জাগিয়ে তুলতে পারলে তাদের উৎসাহ, উদ্দীপনা এবং ভাবনাচিন্তা নতুন নতুন উদ্ভাবনের পথ খুলে দেবে। এগুলিকে সরকারের সঙ্গে যুক্ত করার প্রচেষ্টাই আমি চালিয়ে যাচ্ছি।
সরকারের প্রকল্পগুলি বাস্তবায়নের মাধ্যমেই আমরা দেশকে নতুন ভারতে রূপান্তরিত করতে পারব, এমনটি আমি কিংবা আমার সরকার ভাবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত ১২৫ কোটি ভারতবাসী নতুন ভারত গঠনের সংকল্প গ্রহণ করবেন না, নতুন ভারত নির্মাণে প্রত্যেকেই নিজের ভূমিকা নির্দিষ্ট করবেন না আর সেই নির্দিষ্ট ভূমিকাকে নিজের ক্ষমতার থেকেও বেশি পরিশ্রমের মাধ্যমে বাস্তবায়নের চেষ্টা করবেন না, ততক্ষণ এই কাজ অসম্পূর্ণ থাকবে। সেজন্য আপনাদের প্রতি আমার অনুরোধ, যিনি যতটা পারেন, মনে করুন, আপনার সংস্থায় ২০ জন কর্মচারী রয়েছেন, কারও ৫০ অথবা ১০০ বা ১০০০ জনও থাকতে পারে। আপনারা তাঁদের সঙ্গে বসুন। আর তাঁদের সঙ্গে বসে জিজ্ঞেস করুন, ভাই ২০২২ সালে আমাদের দেশকে নতুন ভারতে উন্নীত করতে হবে, সেজন্য তুমি নিজের কাজের বাইরে দেশের জন্য কি করতে পারবে? দেখবেন, প্রত্যেকেই এগিয়ে আসবেন। প্রত্যেকেই অনেক কিছু করতে পারেন – এভাবেই আমরা সর্বস্তরে একটি নতুন কর্মসংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারি।
আমার মনে পড়ে, তখনও আমি রাজনৈতিক জীবনে পা রাখিনি, একজন বড় শিল্পপতিকে দেখেছি যে তিনি গান্ধীজির অনুগামী ছিলেন, সেবার মনোভাব নিয়ে সমস্ত কাজ করতেন, তাঁর পরিবারের একজন সদস্য রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, আমিও তখন রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। তাই আমি ওই পরিবারটিকে ভালভাবে জানতাম। সেই শিল্পপতি একটি বন্ধ কারখানা কিনেছিলেন। ওই কারখানাটি কেন বন্ধ হয়েছিল? উগ্র শ্রমিক আন্দোলন, হরতাল আর ইউনিয়নবাজির কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া ওই কারখানাটি তিনি কেন কিনলেন? একথায় জিজ্ঞাসা করায় তিনি আমাকে সহজ জবাব দিলেন, ব্যস কিনে নিলাম। আর আমার এতে লাভই হয়েছে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কিভাবে এই অসাধ্য সাধন করলেন? তিনি বললেন, আমি প্রথম দিনই ঠিক করেছিলাম যে, ছ’মাস নিয়মিত কারখানায় যাব। প্রথম দিনই আমি শ্রমিকদের ক্যান্টিনে গিয়ে দুপুরে তাঁদের পাশে বসে খাই এবং রোজই তাঁদের সঙ্গে খেতে থাকি, কাজ নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলিনি। আমি শুধু সুযোগ পেলে তাঁদের ব্যক্তিগত ভালোমন্দ জানতে চাইতাম। ফলে, আমার প্রতি শ্রমিকদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেল। আমাকে তাঁরা মালিক বলে ভাবতেন না আর আমার কাছেও তাঁরা শ্রমিক ছিলেন না। সবাই একসঙ্গে খেতাম। তাই, পরস্পরের আত্মীয় ও বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। আর শ্রমিকরাও একেক জন পরিবারের সদস্যের মতোই পরিশ্রম করেন। ফলে, ছ’মাসের মধ্যেই সেই লাটে ওঠা কারখানাটি একটি লাভজনক সংস্থায় পরিণত হয়। আমি শ্রমিকদেরও সেই লাভের অংশীদার করি। এই উদাহরণ দেওয়ার তাৎপর্য হ’ল, আপনারা কি কখনও নিজের সংস্থার সাধারণ কর্মীদের সঙ্গে এভাবে মিশেছেন। তাঁদের পরিবারের ১২-১৫-১৮ বছরের ছেলেমেয়দেরকে বছরে এক-দু’বার ডেকে এনে কথা বলে উদ্বুদ্ধ করেছেন? তাঁরা যাতে কোনও বিপথে পরিচালিত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে তাঁদের ইতিবাচক পথে পরিচালিত করার কথা ভেবেছেন? আপনি যদি কারও পরিবারের সঙ্গে তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে মিশতে পারেন, তা হলে তাঁরাও আপনাকে আপন ভাবতে শুরু করেন। এই সম্পর্ক থেকে আপনি কোনও ইনক্রিমেন্ট বা বোনাস পান বা না পান, সারা জীবনের সমর্পণ অবশ্যই পাবেন। আমি পরিবর্তন আনতে চাই। আপনারা আমাকে বলুন, সরকার নতুন যে বিমা ব্যবস্থা চালু করেছে, একদিনে এক টাকা, আরেকটি বিমা ব্যবস্থায় মাসে এক টাকা, আপনারাও এই ব্যবস্থাকে নিজেদের কর্মচারীদের জন্য ব্যবহার করতে পারেন অথবা বছরে ৫০০ টাকা ব্যাঙ্কে ফিক্সড্ ডিপোজিট করে দিতে পারেন, যার সুদ থেকে তাঁরা বার্ষিক বিমার টাকা জমা দিতে পারবেন। দুর্ভাগ্যবশত কারও জীবনে কিছু হয়ে গেলে, তাঁদের পরিবার ২ লক্ষ টাকা আর উভয় ক্ষেত্রে ৪ লক্ষ টাকা পাবে।
আপনাদের সংস্থাগুলিতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা যাতে সকল সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পান, সেদিকে কি আপনারা লক্ষ্য রাখছেন? আজ সকালে গৌরব সরকারের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত বলেছেন। আপনাদের মধ্যে অনেকেই ডিজিটাল দুনিয়ার মানুষ। কিন্তু ঐ নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আপনি হয়তো ঢোকেননি। আপনারা কি এক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিশ্চিত করতে পারেন, যাতে এই সরকারি প্রকল্প আরও বেশি করে সাধারণ মানুষের উন্নয়নে কাজে লাগে। সরকারি প্রকল্পের অংশিদারিত্বের মাধ্যমে আপনারা কি দেশের উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করতে পারেন? আপনাদের সক্রিয়তায় এই নতুন সম্পর্ক পরিবর্তনের গতিকে যে হারে ত্বরান্বিত করবে, তা ভারতকে অনেক শক্তিশালী করে তুলবে। আমরা যে যাই হই না কেন, আমরা প্রত্যেকেই ভারতের নাগরিক। কে কোন্ পদ অলঙ্কৃত করছি, কোন্ ব্যবস্থায় রয়েছি, কোন্ দোকানে বসছি, কোন্ কারখানা চালাচ্ছি, সবকিছু ঊর্ধ্বে আমাদের মিলিত পরিচয় হ’ল আমরা ভারতবাসী। ১২৫ কোটি ভারতবাসীর ভাবনাকে সংহত করতে আমি আপনাদের সঙ্গ চাই।
এটা ঠিক যে, আমি যত কিছু ভাবি, দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও সব কিছুই যে করে যেতে পারব, তা নয়। আমাকেও এই ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই কাজ করতে হয়। সেজন্য হতে পারে যে, আপনাদের ৫৯টি পরামর্শের মধ্যে ৪০টি গৃহীতই হ’ল না। কিন্তু ১০টি পরামর্শও যদি গৃহীত ও বাস্তবায়িত হয়, তা হলে দেশের উন্নয়নযজ্ঞে আপনাদের অংশগ্রহণ কত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে! এই মনোভাব নিয়েই চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, নিরাশ হবেন না। আরে বন্ধু, আমরা ভাবি তো অনেক কিছু, কিন্তু করে উঠতে পারি না। আবার আমরা অনেক কিছু করেও ফেলতে পারি। আর এভাবেই পরিবর্তন আসে। অনেক সময় আমাদের ব্যবস্থায় অনেক ভালো কিছু গ্রহণ করার মতো ক্ষমতাই থাকে না। কিন্তু প্রচেষ্টা জারি থাকলে ধীরে ধীরে ব্যবস্থারও পাচন শক্তি বৃদ্ধি পায়। তারপর একদিন সেই নতুন ভাবনাটি ব্যবস্থার অংশও হয়ে ওঠে এবং উন্নয়নের পথপ্রদর্শক হয়। এই মনোভাব নিয়ে আপনারা আমাকে সঙ্গ দিন।
আমি চাই, এই সম্মেলনকে একটি বাৎসরিক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে। আপনাদের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত নানা পরামর্শ নিয়মিত এই সম্মেলনকে সমৃদ্ধ করুক। মধ্যবর্তী সময়ে আপনারা ই-মেলের মাধ্যমে নানা প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন, পরামর্শও দিতে পারেন। পরস্পরের ভাবনার ও কাজের মূল্যায়নও করতে পারেন। গতকাল সন্ধ্যায় আমি এসেছিলাম। আপনাদের সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছে। আজও আমার আপনাদের আপনাদের কথা শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। আমি দেখে অবাক হয়েছি, আপনারা কত নতুনভাবে প্রতিটি জিনিসকে ভাবতে পারেন, কত সুন্দরভাবে নতুন পদ্ধতিতে নিজেদের ভাবনার কথা অন্যদের সামনে তুলে ধরতে পারেন।
সরকারের ক্ষেত্রে আমি একটি ছোট পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছি। আমরা সমস্ত আইআইটি’র ছাত্রদের আমন্ত্রণ জানিয়ে একটি জাতীয় স্তরের হ্যাকাথন-এর আয়োজন করেছিলাম। প্রথম পর্যায়ে প্রায় ৪০ হাজার ছাত্র এতে অংশগ্রহণ করেছিল। আমি সরকারি আধিকারিকদের বলেছিলাম যে, আপনাদের পরিষেবা দানে যে যে ক্ষেত্রে অসুবিধার সম্মুখীন হন, সেগুলির একটি তালিকা তৈরি করে এই ছাত্রদের কাছে তুলে ধরুন। গোড়ায় এ নিয়ে ভীষণ দ্বিধার সম্মুখীন হয়েছি। দ্বিধার কারণ হ’ল, কেউ বিশাল অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সচিব, যুগ্মসচিব বা নির্দেশক তাঁরা কিভাবে আমাকে জানাবেন যে, তাঁদের বিভাগে অমুক সমস্যার কোনও সমাধানই নেই। তাঁরা ভেবেছেন, এটা জানানো তাঁদের ক্ষেত্রে অপমানের সামিল। আমি সেজন্য তাঁদের সঙ্গে অনেক কথা বলি। অবশেষে, সমস্ত বিভাগ থেকে ৪০০টির মতো এমন সমস্যা উঠে আসে, যেগুলির সমাধান খুঁজে বের করার প্রয়োজন রয়েছে। আমি সেই ৪০০টি সমস্যা সেই কলেজ ছাত্রদের হাতে তুলে দিই। প্রায় ৪০ হাজার ছাত্রছাত্রী, নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০ ঘন্টা লাগাতার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ভাবনাচিন্তার মাধ্যমে এমন সুন্দর সব সমাধান খুঁজে বের করল যে আপনারা শুনলে অবাক হবেন, আনন্দ পাবেন। রেলের নানা সমস্যা নিয়ে তাদের দেওয়া সমাধানগুলি এত সুন্দর ছিল যে, পরদিনই রেল দপ্তরের উচ্চ পদস্থ আধিকারিকরা তাদের সঙ্গে বসে বেশ কিছু পরামর্শ বাস্তবায়িত করে। এতে রেল পরিষেবা উন্নত হয়।
আমাদের দেশের ১৬-১৮ বছরের ছেলেমেয়েরা কী করে, তা নিয়ে তাদের বাবাকে জিজ্ঞেস করলে, বাবা মাইনাস ১০ মার্কস দেবেন। কিন্তু তাদের প্রতিভা সঠিকভাবে ব্যবহৃত হলে তারা দেশকে এরকম সুন্দর ভবিষ্যৎ উপহার দিতে পারে। আমি দেশকে যতটা ভালোবাসি, আপনারা দেশকে যতটা ভালোবাসেন, তার থেকে ওদের মনে দেশের প্রতি ভালোবাসা কোনও অংশে কম আছে বলে আমি মনে করি না। আমরা সকলেই চাই যে, দেশ এগিয়ে যাক। আর দেশের জন্য কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমরা সকলে মিলে কাজ করলে অনেক ভালো পরিণাম আসবে। আমি আরেকবার আপনাদেরকে ধন্যবাদ জানাই। আমি জানি যে, সময় অত্যন্ত মূল্যবান, বিশেষ করে, আপনাদের মতো ব্যস্ত শিল্পপতিদের কাছে সময়ের মূল্য অপরিসীম। তা সত্ত্বেও আপনারা আমাকে এতক্ষণ বলার সুযোগ দিয়েছেন, সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে আপনাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই এবং আশা করি যে আপনারা আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন। সরকারি প্রকল্পগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবেন। পরবর্তী সময়ে আমরা বিষয়-ভিত্তিক একত্রিত হয়ে আলোচনা করতে পারি। কখনও কারণ-ভিত্তিক মিলিত হয়ে নানাভাবে আলোচনা করতে পারি। এতে আপনাদের ও দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। সবাইকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ।