সুধীবৃন্দ,
ভদ্রমহোদয়া ও ভদ্রমহোদয়গণ,
নমস্কার!
ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্ট সামিটে দ্বিতীয়বার মূল ভাষণ দেওয়ার সুযোগ পাওয়া আমার কাছে অত্যন্ত সম্মানের। এই আমন্ত্রণ পাঠানোর জন্য শেখ মোহাম্মেদ বিন রশিদজির প্রতি আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। তিনি আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। আমার প্রিয় ভাই শেখ মোহাম্মেদ বিন জায়েদকেও আমি এই অবকাশে কৃতজ্ঞতা জানাই। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি কর্মসূচিতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ আমার হয়েছে। তিনি শুধু দূরদর্শী এক নেতাই নন, বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও অঙ্গীকার বাস্তবায়নের পথিকৃৎ-ও তিনি।
বন্ধুগণ,
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের নেতৃবৃন্দকে এক গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্ট সামিট উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। শেখ মোহাম্মেদ বিন রশিদের দূরদর্শী নেতৃত্বের কথা এখানে উল্লেখ করতে হয়। দুবাইকে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং প্রযুক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার জন্য তিনি যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা প্রশংসার দাবী রাখে। কোভিড-১৯ অতিমারীর সময়কালে এক্সপো, ২০২০-র সফল বাস্তবায়ন অথবা সিওপি-২৮-এর আয়োজন – প্রত্যেকটিই দুবাইকে এমন এক স্থানে পৌঁছে দিয়েছে, যা অনুসরনযোগ্য। এই সম্মেলন আয়োজন করার জন্য আমি আপনাকে অভিনন্দন জানাই এবং আপনার জীবনের সাফল্য কামনা করি।
বন্ধুগণ,
আজ আমরা একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছেছি। সারা পৃথিবী আধুনিকতার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে, কিন্তু একইসঙ্গে গত শতাব্দীর বিভিন্ন সমস্যাতেও আমরা নাজেহাল। খাদ্য, স্বাস্থ্য, পানীয় জলের সঙ্কট, শিক্ষা এবং সমন্বিত সমাজ গড়ে তোলার মতো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রত্যেকটি সরকার কাজ করছে। প্রযুক্তি, জীবনের প্রতিটি পর্বে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক - দু’ভাবেই প্রভাব ফেলছে। সন্ত্রাসবাদ মানবজাতির কাছে নতুন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। আবার, প্রত্যেকদিনই জলবায়ু সংক্রান্ত সমস্যা আরও বৃহদাকারে আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে। একদিকে সরকারগুলি যেমন দেশের বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনাতেও নানা সমস্যা রয়েছে। এইসব সমস্যা এবং উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্ট সামিটের আয়োজন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
বন্ধুগণ,
আজ প্রতিটি সরকার এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে একে অন্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সামিল হবেন। আমি বিশ্বাস করি, বর্তমান পৃথিবীতে সেই সরকারগুলির প্রয়োজন যারা সকলকে নিয়ে একসঙ্গে নিয়ে চলতে পারে। একটি সপ্রতিভ, উদ্ভাবনমূলক এবং বিভিন্ন পরিবর্তনের জন্য প্রযুক্তিকে উৎসাহদান করতে ইচ্ছুক – এ ধরনের সরকারই আমাদের প্রয়োজন। প্রশাসনিক কাজকর্মের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও সমন্বয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যার মাধ্যমে দুর্নীতির মোকাবিলা করা যাবে। বর্তমান সময়কালে পরিবেশ সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার মোকাবিলায় সরকারগুলিকে পরিবেশ-বান্ধব উদ্যোগ নিতে হবে। আজ সারা বিশ্বে সেই সরকারের প্রয়োজন যারা সহজ জীবনযাত্রা, সহজে যথাযথ বিচার পাওয়া, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সহজে চলাচল করা, উদ্ভাবনমূলক এবং সহজে ব্যবসা করার মতো বিষয়গুলিকে অগ্রাধিকার দেয়।
বন্ধুগণ,
গত ২৩ বছর ধরে আমি নিরবচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সরকারের সর্বোচ্চ পদে আসীন। আমি ১৩ বছর গুজরাটের জনসাধারণের সেবা করেছি এবং সেই রাজ্যকে ভারতের অগ্রগণ্য রাজ্যে পরিণত করেছি। আর এখন আমি কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য ১০ বছর ধরে কাজ করছি। আমি মনে করি, বিভিন্ন উদ্যোগে সরকারের কম হস্তক্ষেপ করা উচিত এবং মানুষের ওপর কোনোভাবে যাতে চাপ সৃষ্টি না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। সাধারণ নাগরিকদের জীবনযাত্রায় যাতে কম হস্তক্ষেপ করা যায়, সরকারের সেদিকটিই দেখা উচিত।
আমরা অনেক সময়েই শুনে থাকি, কোভিড অতিমারীর পর বিশ্বজুড়ে সরকারগুলির ওপর মানুষের আস্থা হ্রাস পাচ্ছে। তবে, ভারতের ক্ষেত্রে কিন্তু পরিস্থিতি একেবারেই বিপরীত। গত কয়েক বছর ধরে ভারতবাসীর, সরকারের ওপর আস্থা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের সরকারের উদ্দেশ্য এবং অঙ্গীকারের সম্পর্কে মানুষের মনে বিশ্বাস তৈরি হয়েছে। এটা কিভাবে সম্ভব হল? কারণ, আমরা জনগণের আবেগকে গুরুত্ব দিয়ে থাকি। দেশবাসীর চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য আমরা সব রকমের চেষ্টা চালাই।
গত ২৩ বছর ধরে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে আমার নীতি হল – ‘ন্যূনতম সরকার, সর্বোচ্চ প্রশাসন’। নাগরিকদের মধ্যে শিল্পোদ্যোগের মনোভাব গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করতে আমি সচেষ্ট হয়েছি। ওপর থেকে নিচে এবং নিচ থেকে ওপরে - সবক্ষেত্রেই সমাজের সকলকে নিয়ে চলতে হবে। মানুষের অংশগ্রহণকে আমরা অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি। মানুষ যাতে তৃণমূল স্তর থেকে বিভিন্ন সরকারি কর্মসূচিকে নেতৃত্ব দেন, আমরা সেটি নিশ্চিত করেছি। জনসাধারণের অংশীদারিত্বের নীতিকে অনুসরণ করায় ভারতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। শৌচালয় গড়ে তোলা, নারীশিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া, ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে উৎসাহিত করা - প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষের অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করা হয়েছে।
বন্ধুগণ,
আর্থিক ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তিই আমাদের সরকারের মূল উদ্দেশ্য। যাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ছিল না, সেরকম ৫০ কোটির বেশি মানুষকে আমরা ব্যাঙ্কিং পরিষেবার আওতায় নিয়ে এসেছি। সচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে নানা পদক্ষেপ নেওয়ায় ভারত ফিনটেক এবং ডিজিটাল লেনদেনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। মহিলাদের নেতৃত্বে উন্নয়নের ক্ষেত্রেও আমরা প্রথম সারিতে। ভারতীয় নারীর আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। মাস কয়েক আগেই আমরা একটি বিল পাস করেছি যার ফলে ভারতীয় সংসদে মহিলাদের সংরক্ষণ নিশ্চিত হয়েছে। আজ আমরা ভারতীয় যুবক-যুবতীদের জন্য নতুন নতুন সুযোগ নিয়ে আসছি। তাঁদের দক্ষতা বিকাশকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। খুব কম সময়ের মধ্যে স্টার্ট-আপ ক্ষেত্রে ভারত তৃতীয় বৃহত্তম দেশ হিসেবে উঠে এসেছে।
বন্ধুগণ,
‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ মন্ত্রে আমরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পৌঁছে দিচ্ছি, যাতে সরকারি প্রকল্পগুলি থেকে কেউ বঞ্চিত না হন। তাই, সরকার সরাসরি মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। প্রশাসনের এই মডেলটি বৈষম্য এবং দুর্নীতির অবসান ঘটিয়েছে। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারত গত ১০ বছরে ২৫ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যের নাগপাশ থেকে মুক্ত করেছে। এই সাফল্য অর্জনে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক মডেলটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বন্ধুগণ,
সরকার স্বচ্ছতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছে। তার সুফল এখন পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে ১৩০ কোটির বেশি দেশবাসীর ডিজিটাল প্রমাণপত্র রয়েছে যার সঙ্গে তাঁরা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে এবং মোবাইল নম্বরের যোগসূত্র ঘটিয়েছেন। এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমরা প্রত্যক্ষ সুবিধা হস্তান্তরের মাধ্যমে গত এক দশক ধরে ৪০হাজার কোটি মার্কিন ডলারের সমতুল অর্থ সুবিধাপ্রাপকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। এর ফলে, দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। ৩৩শো কোটি মার্কিন ডলারের সমতুল অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হয়েছে।
বন্ধুগণ,
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রসঙ্গে ভারতের একটি নিজস্ব উদ্যোগ আছে। আমরা সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জলবিদ্যুৎ, জৈব-জ্বালানি এবং পরিবেশ-বান্ধব হাইড্রোজেনকে কিভাবে কাজে লাগানো যায়, সেদিকগুলি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছি। প্রকৃতির বিভিন্ন চাহিদা পূরণ করা আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ। আমরা প্রকৃতি থেকে যা গ্রহণ করি তা্র সমপরিমান জিনিস তাকে ফিরিয়ে দিই। ভারত পরিবেশ-বান্ধব জীবনশৈলী বা ‘মিশন লাইফ’-এর পথ অনুসরণ করছে। এছাড়াও আমরা কার্বন নিঃসরণ কমাতে পরিবেশ-বান্ধব উদ্যোগ গ্রহণ করেছি, যা নিয়ে দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত সিওপি-২৮-এ বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
বন্ধুগণ,
ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে সরকার বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেছে। জাতীয় স্তরে সার্বভৌমত্ব এবং আন্তর্জাতিক স্তরে একে অন্যের সঙ্গে সমন্বয় বজায় রেখে চলাচল করার মধ্যে একটি ভারসাম্য কিভাবে বজায় রাখা যায়? কেমনভাবে আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থকে অক্ষুণ্ণ রেখে আন্তর্জাতিক নিয়মগুলিকে মেনে চলব? জাতীয় উন্নয়নের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক স্তরের উন্নয়নের জন্য কিভাবে আমরা অবদান রাখব? আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের থেকে শিক্ষা নিয়ে কিভাবে বিশ্বজনীন মূল্যবোধকে সম্মান জানাব? আমাদের সমাজকে রক্ষা করার পাশাপাশি ডিজিটাল প্রযুক্তিকে কিভাবে ব্যবহার করব? আন্তর্জাতিক স্তরে সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় সকলে মিলে কেমন করে কাজ করব? আমরা আজ জাতীয় স্তরে বিভিন্ন পরিবর্তন নিয়ে আসছি। তাহলে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলিতেও কি সংস্কারের প্রয়োজন নেই? আমরা যখন আমাদের সরকারের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করি, তখন এই প্রশ্নগুলি নিয়েও আলোচনা করা উচিত।
আমরা ঐক্যবদ্ধ, সহযোগিতামূলক এবং সর্বাঙ্গীণ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মূল্যবোধকে সম্মান করব।
বিশ্বের উন্নয়নের স্বার্থকেও রক্ষা করে আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় গ্লোবাল সাউথ-এর সক্রিয় অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করতে হবে।
আমরা গ্লোবাল সাউথ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির বিভিন্ন উদ্বেগের কথা শুনব এবং সেগুলি সমাধানের চেষ্টা চালাব।
পিছিয়ে পড়া দেশগুলির জন্য আমাদের সম্পদ ও দক্ষতাকে ভাগ করে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
কৃত্রিম মেধা, ক্রিপ্টো-কারেন্সি এবং সাইবার অপরাধের মতো সমস্যাগুলির মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ম তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি।
আমরা আমাদের জাতীয় সার্বভৌমত্বকে যেমন রক্ষা করব, পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইনের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল থাকব।
এই নীতিগুলি যদি আমরা অনুসরণ করি, তাহলে বিভিন্ন সরকার যে সমস্যাগুলির সম্মুখীন হয় সেগুলিকে যেমন সমাধান করা যাবে, পাশাপাশি বিশ্বজনীন এক ভ্রাতৃত্ববোধও গড়ে তোলা সম্ভব হবে। ‘বিশ্ব-মিত্র’ হিসেবে ভারত এই নীতিগুলিকে অনুসরণ করবে। জি-২০ গোষ্ঠীর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময়েও আমরা এই ভাবনাকে অনুসরণ করে ‘এক বিশ্ব, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ’ নীতিকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছি।
বন্ধুগণ,
আজ এই আলোচনাচক্রে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা আমরা উপস্থাপিত করছি। সকলে মিলে একসঙ্গে কাজ করা যেমন জরুরি, পাশাপাশি অন্যের থেকে শিক্ষালাভও গুরুত্বপূর্ণ। এই শীর্ষ সম্মেলনের মূল লক্ষ্য এটিই। আমাদের বিশ্বের ভবিষ্যতের জন্য এখানে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এই আশা রেখে আমি অংশগ্রহণকারী সকলকে আমার শুভকামনা জানাই!
ধন্যবাদ।
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
প্রধানমন্ত্রী মূল ভাষণটি হিন্দিতে দিয়েছিলেন