নমস্কার,
আপনাদের সবাইকে নগরোন্নয়নের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আয়োজিত এই বাজেট পরবর্তী ওয়েবিনারে স্বাগত।
বন্ধুগণ,
এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, স্বাধীনতার পর এত বছরে আমাদের দেশে হাতে গোণা কয়েকটি মাত্র সুপরিকল্পিত নগর গড়ে উঠেছে। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে যদি ৭৫টি নতুন এবং বড় সুপরিকল্পিত নগর গড়ে উঠতো, তা হলে আজ ভারতের চেহারা অন্যরকম হ’ত। কিন্তু, এখন একবিংশ শতাব্দীতে যেভাবে ভারত দ্রুতগতিতে উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলেছে, আগামী দিনে ভারতে অনেক সুপরিকল্পিত নতুন শহর গড়ে তোলা অনিবার্য হয়ে উঠবে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে নগরোন্নয়নের দুট প্রধান দিক রয়েছে। নতুন শহরগুলির উন্নয়ন আর পুরনো শহরগুলিতে পুরনো ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ। এই দৃষ্টিকোণকে সামনে রেখে আমাদের সরকার প্রত্যেক বছরের বাজেটে নগরোন্নয়নকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে। এবারের বাজেটে নগর পরিকল্পনার মাপদন্ডগুলির জন্য ১৫ হাজার কোটি টাকা উৎসাহ ভাতার বাজেট বরাদ্দও নির্ধারিত করা হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, এর মাধ্যমে দেশে সুপরিকল্পিত এবং সুব্যবস্থিত নগরায়নে নতুন সূত্রপাত হবে, এই প্রক্রিয়ায় গতিসঞ্চার হবে।
বন্ধুগণ,
আপনাদের মতো বিশেষজ্ঞরা সকলে জানেন যে, নগরোন্নয়নে নগর পরিকল্পনা এবং নগর শাসন উভয়েরই অত্যন্ত বড় ভূমিকা থাকে। শহরগুলির বাজে পরিকল্পনা অথবা ভালো পরিকল্পনা হলেই তার বাস্তবায়ন না হওয়া। দুটিই আমাদের উন্নয়নযাত্রার সামনে বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। নগর পরিকল্পনার মাধ্যমে ভবিষ্যতের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা থেকে শুরু করে যানবাহন পরিকল্পনা, নগর পরিকাঠামো পরিকল্পনা, জল ব্যবস্থাপনা – এই সকল ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করতে হবে।
এই ওয়েবিনারের ভিন্ন ভিন্ন অধিবেশনে আপনারা অবশ্যই তিনটি প্রশ্নকে অগ্রাধিকার দেবেন। প্রথমত, রাজ্যগুলিতে নগর পরিকল্পনা বাস্তুব্যবস্থাকে কিভাবে শক্তিশালী করা যায়; দ্বিতীয়ত, বেসরকারি ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞতাকেও কিভাবে নগর পরিকল্পনায় যথার্থভাবে কাজে লাগানো যায় এবং তৃতীয়ত, এ ধরনের কোনও ‘সেন্টার অফ এক্সেলেন্স’ কিভাবে গড়ে তোলা যায়, যেখানে নগর পরিকল্পনাকে একটি নতুন মাত্রা প্রদান করা যাবে।
প্রত্যেক রাজ্য সরকারকে এবং দেশের সমস্ত নগর প্রশাসনকে সর্বদাই একটি কথা মনে রাখতে হবে। তারা যদি সুপরিকল্পিতভাবে শহরের প্রতিটি এলাকার উন্নয়ন করতে পারে, তবেই তারা দেশের উন্নয়নে নিজেদের অবদান রাখতে পারবে। আমাদের একটা জিনিস খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে যে, স্বাধীনতার অমৃতকালে নগর পরিকল্পনাই আমাদের শহরগুলির ভাগ্য নির্ধারণ করবে। আর ভারতে সুপরিকল্পিত শহরগুলি ভারতের উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। যখন পরিকল্পনা সুন্দর হবে, তখন আমাদের শহর পরিবেশের দিক থেকে এবং জল সংরক্ষণের দিক থেকে স্থিতিস্থাপক হয়ে উঠবে।
বন্ধুগণ,
এই ওয়েবিনারে নগর পরিকল্পনা এবং নগর শাসনের যত বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, তাঁদের প্রতি আমার একটি বিশেষ অনুরোধ রয়েছে। আপনাদের বেশি করে উদ্ভাবক ভাবনাকে গুরুত্ব দিতে হবে। জিআইএস বা ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থা ভিত্তিক মাস্টার প্ল্যান রচনা থেকে শুরু করে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের পরিকল্পনার বিভিন্ন উপায় খুঁজে বের করা, দক্ষ মানবসম্পদ, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং বা সামর্থ্য গড়ে তোলা – এই প্রতিটি ক্ষেত্রের নিজস্ব বড় ভূমিকা থাকতে পারে। আপনাদের বিশেষজ্ঞতা যেন আজ স্বশাসিত স্থানীয় নগর প্রশাসনগুলিকে সমৃদ্ধ করে তোলে। এই প্রয়োজন আপনাদের জন্য অনেক নতুন নতুন সুযোগ গড়ে তুলবেই।
বন্ধুগণ,
নগরগুলির উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হ’ল যানবাহন পরিকল্পনা। আমাদের শহরগুলির যাতায়াত ব্যবস্থা যেন বাধাহীন থাকে, তা সুনিশ্চিত করতে হবে। আপনারা সবাই জানেন যে, ২০১৪ সালের আগে দেশে মেট্রো যোগাযোগ ব্যবস্থা কেমন ছিল। আমাদের সরকার অনেক শহরে মেট্রো রেল সম্প্রসারণের কাজ করেছে। আজ আমরা মেট্রো নেটওয়ার্কের ক্ষেত্রে অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে আছি। এখন প্রয়োজন হ’ল এই নেটওয়ার্ককে আরও শক্তিশালী করা এবং দ্রুতগতিতে প্রান্তিকতম স্থানে পৌঁছে দেওয়া। আর সেজন্য দক্ষ যানবাহন পরিকল্পনার প্রয়োজন রয়েছে। শহরগুলিতে সড়ক প্রশস্তিকরণ থেকে শুরু করে পরিবেশ-বান্ধব যাতায়াত ব্যবস্থা, এলিভেটেড রোড, জংশন ইমপ্রুভমেন্ট – এই সকল ব্যবস্থাকে সংহত যানবাহন পরিকল্পনার অঙ্গ করে তুলতে হবে।
বন্ধুগণ,
আজ ভারত বৃত্তীয় অর্থনীতিকে নগরোন্নয়নের বড় ভিত্তি করে তুলছে। আমাদের দেশে প্রত্যেক দিন হাজার হাজার টন পৌর বর্জ্য নিষ্কাশিত হয়। এর মধ্যে থাকে ব্যাটারি বর্জ্য, বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিন বর্জ্য, টায়ার ইত্যাদির অটো মোবাইল বর্জ্য আর কম্পোস্ট সার তৈরি করা যেতে পারে – এ ধরনের বর্জ্য। ২০১৪ সালে দেশে যেখানে মাত্র ১৪-১৫ শতাংশ বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ হ’ত, আজ সেখানে ৭৫ শতাংশ বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ হচ্ছে। আগে থেকে এই উদ্যোগ নেওয়া হলে আমাদের শহরগুলির বাইরে বড় বড় বর্জ্যের পাহাড় গড়ে উঠতো না।
আজ বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে এই বর্জ্যের পাহাড়গুলি থেকেও শহরগুলিকে মুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এতে বেশ কিছু নতুন শিল্পোদ্যোগের জন্য পুনর্ব্যবহার ও বৃত্তীয় অর্থনীতি গড়ে তোলার অনেক সুযোগ রয়েছে। ইতিমধ্যেই এক্ষেত্রে বেশ কিছু স্টার্টআপ খুব ভালো কাজ করছে। আমাদের প্রত্যেকেরই উচিৎ এদের পাশে দাঁড়ানো। প্রত্যেক শিল্পোদ্যোগেরই উচিৎ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সম্পূর্ণ সম্ভাবনাকে ব্যবহার করা। আমরা অমৃত যোজনার সাফল্যের পর শহরগুলিতে পরিশ্রুত পানীয় জল সরবরাহের জন্য ‘অমৃত ২.০’ প্রকল্প চালু করেছিলাম। এই প্রকল্পের পাশাপাশি এখন আমাদের জল ও পয়ঃপ্রণালী পরম্পরাগত মডেলের থেকে উন্নত পরিকল্পনা নিয়ে ভাবতে হবে। আজ কিছু শহরে ব্যবহৃত জল পরিশুদ্ধকরণের মাধ্যমে শিল্পোদ্যোগে ব্যবহারের উপযোগী করে পাঠানো হয়েছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার এই ক্ষেত্রেও বেসরকারি শিল্পদ্যোগের জন্য অপার সম্ভাবনা গড়ে উঠছে।
বন্ধুগণ,
আমাদের নতুন শহরগুলি যেন বর্জ্য মুক্ত হয়, জল সংরক্ষণ সুনিশ্চিত হয়, পরিশ্রুত পানীয় জল সরবরাহ বজায় থাকে আর সমস্ত ব্যবস্থাই যেন পরিবেশের অনুকূল স্থিতিস্থাপক হয়। এর জন্য আমাদের টিয়ার-২ এবং টিয়ার-৩ শহরগুলিতেও নগর পরিকাঠামো এবং পরিকল্পনায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বাস্তু শাস্ত্র থেকে শুরু করে জিরো ডিসচার্জ মডেল, শক্তি উৎপাদনের নেট পজিটিভিটি, জমি ব্যবহারে দক্ষতা, ট্রানজিট করিডর এবং গণপরিষেবায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার সমস্ত ক্ষেত্রেই আজ আমাদের ভবিষ্যৎ নগরগুলির জন্য নতুন পরিভাষা ঠিক করা আর নতুন নতুন মাপদন্ড তৈরি করার সময় এসেছে। আমাদের এটা দেখতে হবে যে, নগর পরিকল্পনাটি আমাদের ছেলেমেয়েদের ও শিশুদের কথা মাথায় রেখে করা হচ্ছে কিনা! শিশুদের খেলাধূলার জায়গা থেকে শুরু করে সাইকেল চালানোর পরিসর যথেষ্ট রয়েছে কিনা – সেটা দেখেই আমাদের নগর পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে হবে।
বন্ধুগণ,
শহরগুলির উন্নয়নের সময় এই বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে যে, এই উন্নয়নে শহরের বাসিন্দাদের উন্নয়নের সম্ভাবনা কতটা সম্পৃক্ত রয়েছে। অর্থাৎ, আমরা যত পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়ন করছি, সেগুলি আমাদের শহরগুলিতে বসবাসকারী মানুষের জীবনকে সহজ ও সুগম করে তুলছে কিনা, তাঁদের নিজেদের উন্নয়নে সাহায্য করছে কিনা! এবারের বাজেটে পিএম আবাস যোজনা খাতে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা খরচ করার দায়বদ্ধতা রাখা হয়েছে।
যখনই কোনও বাড়ি তৈরি হয়, তখন এর সঙ্গে সিমেন্ট, ইস্পাত, রং, আসবাবপত্র এরকম বেশ কিছু শিল্পোদ্যোগ ও ব্যবসাও উপকৃত হয়। আপনারা কল্পনা করতে পারেন যে, পিএম আবাস যোজনা খাতে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা খরচ করার এই দায়বদ্ধতা কত শিল্পোদ্যোগকে চাঙ্গা করে তুলবে। আজ নগরোন্নয়নের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতমুখী প্রযুক্তির ভূমিকা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের স্টার্টআপগুলি, আমাদের শিল্পোদ্যোগগুলির উচিৎ এই লক্ষ্যে ভাবনাচিন্তা করা এবং দ্রুতগতিতে কাজ করা। তবেই তারা উদ্ভুত সম্ভাবনাগুলিকে কাজে লাগিয়ে নিজেরা উপকৃত হবেন আর নতুন নতুন সম্ভাবনার জন্ম দেবেন। টেকসই গৃহ নির্মাণ প্রযুক্তি থেকে শুরু করে টেকসই নগর নির্মাণ প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের নতুন নতুন সমাধান খুঁজতে হবে।
বন্ধুগণ,
আমি আশা করি যে, আপনারা সবাই এই বিষয়গুলি নিয়ে ভাববেন। এগুলি ছাড়াও আরও অনেক বিষয় থাকতে পারে। সেগুলি নিয়ে গভীরভাবে আলাপ-আলোচনা করবেন। উন্নত নগর পরিকল্পনার ভাবনাকে মাথায় রেখে সমস্ত সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার যথাযথ পথচিত্র রচনা করবেন।
এই ভাবনা নিয়ে, আপনাদের সকলকে আরেকবার অনেক অনেক শুভকামনা। অনেক অনেক ধন্যবাদ!