নমস্কার!
মহামণ্ডলেশ্বর কঙ্কেশ্বর দেবীজি আর রামকথা আয়োজনের সঙ্গে জড়িত সকল মহানুভব ব্যক্তিবর্গ, গুজরাটের এই ধর্মস্থানে উপস্থিত সকল সাধু, সন্ন্যাসী, মহন্ত, মহামণ্ডলেশ্বর এইচ সি নন্দা ট্রাস্টের মাননীয় সদস্যগণ, অন্যান্য বিদ্বান এবং শ্রদ্ধালু ভক্তগণ, ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ!
হনুমান জয়ন্তীর পবিত্র অনুষ্ঠান উপলক্ষে আপনাদের সবাইকে, সমস্ত দেশবাসীকে অনেক অনেক শুভকামনা জানাই। এই পবিত্র অনুষ্ঠান উপলক্ষে আজ মোরবি-তে হনুমানজির এই বিশাল ও অনিন্দ্যসুন্দর মূর্তির আবরণ উন্মোচন হয়েছে। এটি দেশের এবং সারা পৃথিবীর হনুমান ভক্ত ও রাম ভক্তদের জন্য অত্যন্ত সুখদায়ক ঘটনা। আপনাদের সবাইকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা!
বন্ধুগণ,
‘রামচরিত মানস’-এ বলা হয়েছে –
“দিনু হরি কৃপা মিলহিঁ নহীঁ সন্তা!”
অর্থাৎ, ঈশ্বরের কৃপা ছাড়া সাধুদের দর্শন দুর্লভ হয়। আমার অত্যন্ত সৌভাগ্য যে বিগত কয়েক দিনের মধ্যেই আমি মা অম্বাজি, উমিয়া মাতা ধাম, মা অন্নপূর্ণা ধামের আশীর্বাদ গ্রহণের সুযোগ পেয়েছি। আজকে এখন আমার মোরবি-তে হনুমানজির এই অনিন্দ্যসুন্দর মূর্তির আবরণ উন্মোচন অনুষ্ঠানে যুক্ত হওয়ার, সাধু-সন্ন্যাসীদের সমাগমে অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্য হল।
ভাই ও বোনেরা,
আমাকে বলা হয়েছে যে হনুমানজির এ ধরনের ১০৮ ফুট উঁচু মূর্তি ক্রমে দেশের চারটি ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তে স্থাপন করা হচ্ছে। সিমলাতে এমনই আরও একটি অনিন্দ্যসুন্দর প্রতিমা আমরা বিগত কয়েক বছর ধরে দেখছি। আজ এটি এ ধরনের দ্বিতীয় মূর্তি মোরবি-তে প্রতিষ্ঠিত হল। আরও দুটি এ ধরনের হনুমানজির মূর্তি দক্ষিণ ভারতের রামেশ্বরম এবং পশ্চিমবঙ্গে স্থাপন করার কাজ চলছে। এরকম আমাকে বলা হয়েছে।
বন্ধুগণ,
এটি নিছকই হনুমানজির মূর্তি স্থাপনের সঙ্কল্প নয়, এই অভিযান, এই নির্মাণ আমাদের ‘এক ভারত শ্রেষ্ঠ ভারত’ সঙ্কল্পের অংশ। হনুমানজি তাঁর ভক্তি দিয়ে, তাঁর সেবাভাব দিয়ে, সবাইকে সবসময় নিজের সঙ্গে যুক্ত রাখেন। প্রত্যেকেই হনুমানজির কাছ থেকে প্রেরণা গ্রহণ করতে পারেন। হনুমানজি সেই শক্তি এবং সম্বল, যিনি সমস্ত বনবাসী প্রজাতিকে এবং বন-বন্ধুদের অস্মিতা, মান এবং সম্মানের অধিকার প্রদান করেছেন। সেজন্য আমাদের ‘এক ভারত শ্রেষ্ঠ ভারত’-এর অভিযানেও হনুমানজি একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র।
ভাই ও বোনেরা,
এভাবেই রামকথার আয়োজনও দেশের ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তে ক্রমাগত অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ভাষা কিংবা কথ্যভাষা – যে ভাষাতেই হোক না কেন, যে কোনওভাবেই হোক না কেন, এই রামকথার সঙ্গে সকলের ভাবনা যুক্ত হওয়া কম কথা নয়। এই অনুষ্ঠান প্রভু ভক্তির সঙ্গে মানুষকে একাকার করে দিচ্ছে। এটাই তো ভারতীয় আস্থার, আমাদের আধ্যাত্মের, আমাদের সংস্কৃতির, আমাদের পরম্পরার আসল শক্তি। এই মনোভাব দাসত্বের কঠিন কালখণ্ডেও দেশের ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তকে, ভিন্ন ভিন্ন জাতি-ধর্মের মানুষকে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত রেখেছে। এই মনোভাব স্বাধীনতার রাষ্ট্রীয় সঙ্কল্পের জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী করেছে। এই মনোভাব হাজার হাজার বছর ধরে পরিবর্তিত পরিস্থিতি সত্ত্বেও ভারতের এই দর্শনকে অটল রাখার মাধ্যমে আমাদের সভ্যতা, আমাদের সংস্কৃতি রক্ষার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে আসছে।
ভাই ও বোনেরা,
আমাদের আস্থা, আমাদের সংস্কৃতির ধারা সদ্ভাবের, সমভাবের, সমাবেশের, ঐক্যবদ্ধতার। সেজন্য যখন অন্যায় ও কু-র ওপর সু বা ভালোকে স্থাপন করার প্রয়োজন হয়, তখন প্রভু রাম নিজে সক্ষম হয়েও, নিজেই সবকিছু করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও, তিনি এই ধর্মযুদ্ধে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে, ‘সবকা সাথ’ নীতি পালন করে, সবাইকে যুক্ত করার, সমাজের প্রত্যেক অংশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার, ছোট, বড় সমস্ত জীবকেও সঙ্গে নেওয়ার, তাঁদের সাহায্য নেওয়ার, তাঁদেরকে ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণ করানোর মাধ্যমে এই পূণ্য কাজ সম্পন্ন করেছেন, আর এটাই তো ‘সবকা সাথ, সবকা প্রয়াস’। এই ‘সবকা সাথ, সবকা প্রয়াস’-এর উত্তম প্রমাণ প্রভু রামের এই জীবনলীলাও; যেখানে হনুমানজি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সূত্র ধারণ করেছেন। ‘সবকা প্রয়াস’-এর এই ভাবনা দিয়েই স্বাধীনতার অমৃতকালকে আমাদের উজ্জ্বল করতে হবে, রাষ্ট্রীয় সঙ্কল্পগুলিকে সিদ্ধিতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
আজ যখন মোরবি-তে, কেশবানন্দ বাপুজির তপভূমিতে আপনাদের সকলের দর্শন পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে, তখন আমরা সৌরাষ্ট্রে দিনে প্রায় ২৫ বার শুনে থাকি যে, আমাদের এই সৌরাষ্ট্রের মাটি সন্ন্যাসীদের মাটি, সূরাদের মাটি, দাতাদের মাটি, সন্ত, সূরা এবং দাতাদের এই মাটি আমাদের কাঠিয়াবারকে গুজরাটের আরও এক ধরনের নিজস্ব ভারতের পরিচয় তুলে ধরে। আমার জন্য ‘খোখরা হনুমান ধাম’ নিজের বাড়ির মতোই একটি আপন জায়গা। এর সঙ্গে আমার সম্পর্ক বরাবরই নিজের মর্ম আর কর্মের। একটা প্রেরণার সম্পর্ক। অনেক বছর আগে যখনই আমি মোরবি-তে আসতাম, তখনও এখানে এখনকার মতই নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলত, আর সন্ধ্যার সময় যখন মনে ভক্তিভাব জাগত, তখন এই হনুমান ধামে চলে আসতাম। হনুমান ধামের পূজনীয় বাপুজির কাছে বসে পাঁচ থেকে পনেরো মিনিট সময় কাটাতাম, তাঁর হাত থেকে কিছু প্রসাদ নিয়ে যেতাম, আর যখন মৎসু বাঁধের দুর্ঘটনা হল, তখন তো এই হনুমান ধাম অনেক গতিবিধির কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল আর সেজন্য আমার এই হনুমান ধাম ও বাপুজির সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই দিনগুলিতে আমি যখন দেখতাম, চারপাশের লোকালয় থেকে মানুষ সেবাভাব নিয়ে এগিয়ে আসছেন, তখন থেকেই আমার মনে এই স্থানটি একটি আপনত্বে ভরিয়ে দেওয়া কেন্দ্র হয়ে ওঠে, যেখান থেকে মোরবি-র প্রতিটি বাড়িতে সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার কাজ হয়। একজন সামান্য স্বয়ংসেবক রূপে আমি দীর্ঘকাল আপনাদের সঙ্গে যুক্ত থেকে সেই দুঃখের দিনগুলিতে আপনাদের হয়ে কাজ করেছি। এখানে যত ধর্মীয় ও দান-ধ্যানের কর্মকাণ্ড চলত এতে বারবার সামিল হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। সেই সময় পূজনীয় বাপুজির সঙ্গে অনেক কথা হত। সেসব কথায় থাকত মোরবি-কে অনিন্দ্যসুন্দর করে গড়ে তোলার স্বপ্ন। ঈশ্বরের ইচ্ছা ছিল আর তাঁর নিজের কাছে এটিকে অনিন্দ্যসুন্দর করে দিয়ে যাওয়ার একটা চ্যালেঞ্জ ছিল, একথা বাপুজি প্রায়ই বলতেন। তিনি আরও বলতেন যে, এখন আমাদের থামলে চলবে না, সবাইকে মিলেমিশে কাজ করতে হবে। বাপুজি কম কথার মানুষ ছিলেন, কিন্তু অত্যন্ত সরল ভাষায় আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে মর্মস্পর্শী কথা বলতেন। এটাই ছিল পূজনীয় বাপুজির প্রধান বৈশিষ্ট্য। তারপরও অনেকবার তাঁর দর্শনের সৌভাগ্য হয়েছে, আর যখন ভুজ তথা কচ্ছ-এ ভূমিকম্প এল, আমি একথা বলতে পারি, তখন মোরবি-র সেই দুর্ঘটনা থেকে আমি যে শিক্ষা পেয়েছিলাম, সেই শিক্ষা অত্যন্ত কাজে লেগেছিল। এমন পরিস্থিতিতে কিভাবে কাজ করতে হবে তার যে অভিজ্ঞতা আমি মোরবি-র দুর্ঘটনা থেকে অর্জন করেছিলাম, সেই অভিজ্ঞতা ভূমিকম্পের সময় দ্রুত ত্রাণ ও উদ্ধার কাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত উপযোগী হয়েছে। সেজন্য আমি এই পবিত্র মাটির কাছে বিশেষভাবে ঋণী কারণ, যখনই বড় সেবা করার সুযোগ পাই, তখন মোরবি-র জনগণ আজও সেই সেবাভাব নিয়ে কাজ করার প্রেরণা যোগান, আর ভূমিকম্পের পর কচ্ছ-এর যে অবস্থা হয়েছিল তা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আজ কচ্ছ-কে আমরা যে জায়গায় দাঁড় করিয়েছি, ওই বিপর্যয়ের সময়ে গুজরাটিদের যে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি দেখেছি, অনুভব করেছি; আমার জীবনে মোরবি-র মানুষই প্রথম সেই শক্তি সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন। আজ আপনারা দেখুন, চিনেমাটির নানা বাসন ও অন্যান্য পণ্য, টাইলস-এর নানা পণ্য, ঘড়ি তৈরি কাজ – এই সকল ক্ষেত্রে মোরবি এমন একটি শিল্প উৎপাদনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে যা আগে কেউ কল্পনাও করেনি। আগে মৎসু বাঁধের চারপাশে ইঁটভাটা ছাড়া আর কিছুই দেখা যেত না। বড় বড় চিমনি আর অসংখ্য ইঁটভাটা। আজ সেগুলিকেই আমরা মোরবি-র খ্যাতি ও সম্মান বৃদ্ধিতে কাজে লাগিয়েছি। আমি তো আগেও বলতাম যে একদিকে মোরবি আর অন্যদিকে রাজকোট আর তৃতীয় দিকে জামনগর। জামনগরের পিতল শিল্প, রাজকোটের ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প, আর মোরবির ঘড়ি শিল্প, সেরামিক শিল্প – এই তিন ধরনের শিল্পোদ্যোগের ত্রিকোণের দিকে, ত্রিভূজের দিকে যখন তাকাই, তখন মনে হয় যে আমাদের রাজ্যে একটি নতুন ‘মিনি জাপান’ সাকার হয়ে উঠছে। একথা আজ আমি বলছি কারণ আমি দেখতে পাচ্ছি সৌরাষ্ট্রের মধ্যে এখন এ ধরনের শিল্প ত্রিভূজ ক্রমে সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে আর এখন তো এর পেছনে কচ্ছ-এরও অংশীদারিত্ব ক্রমবর্ধমান। এর ব্যবহার আমরা যত বেশি করব, আর যেভাবে মোরবি-তে পরিকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে তা মুখ্য রূপে সকলের প্রচেষ্টায়। এর সঙ্গে ‘সবকা সাথ’ যুক্ত হয়েছে। এই অর্থে মোরবি, জামনগর, রাজকোট আর এদিকে কচ্ছ – একভাবে কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করা একটি সামর্থ্যবান ছোট ছোট শিল্পোদ্যোগের সক্রিয় কেন্দ্র হয়ে উঠেছে, বিকশিত হয়েছে। আমাদের চোখের সামনেই দেখতে দেখতে মোরবি ক্রমে একটি বড় শহরের রূপ নিতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই মোরবি দেশে একটি নিজস্ব পরিচয় গড়ে তুলেছে আর আজ বিশ্বের অনেক দেশে মোরবি-তে উৎপাদিত পণ্য পৌঁছে যাচ্ছে। এর ফলে মোরবি-র একটি স্বতন্ত্র ছাপ তৈরি হয়েছে আর এই ছাপ এই মাটিতে যত সাধু, সন্ন্যাসী, সন্ত, মহন্ত, মহাত্মারা ছিলেন এবং আজও আছেন, তাঁদের আশীর্বাদে, তাঁদের সাধারণ অনাড়ম্বর জীবনযাপনের, তাঁদের তপস্যার মাধ্যমে আমাদেরকে যে লক্ষ্য নির্ধারণের প্রেরণা দিয়ে গেছেন, এগুলি তারই পরিণাম। আপনারা গুজরাটের যেদিকেই তাকান, সেখানে শ্রদ্ধা এবং আস্থার অনেক অসংখ্য পীঠ দেখতে পাবেন। সারা রাজ্যে দাতাদের কোনও অভাব নেই। কোনও না কোনও শুভ কাজ নিয়ে যদি এগিয়ে যান তাহলে আপনার কাজে অর্থ যোগাতে দাতাদের লম্বা লাইন দেখা যাবে। এরাজ্যে কে কার আগে দান করবেন তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। এভাবেই আজ কাঠিয়াওয়ার এক প্রকার যাত্রা ধামের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। আজ একথা বলতে পারি যে, আজ গুজরাটের কোনও এমন জেলা বাকি নেই যেখানে মাসে একবার হলেও হাজার হাজার মানুষ বাইরে থেকে আসেন না! যদি আমরা হিসেব করি, এই যাত্রাকে আমরা তীর্থ ভ্রমণও বলতে পারি, আবার পর্যটনও বলতে পারি। এই দুটো মিলিয়ে আমি বলি ‘তীর্থাটন’। এই ‘তীর্থাটন’ কাঠিয়াওয়ারকে একটি নতুন শক্তি যুগিয়েছে। আমাদের সমুদ্র তটগুলিও এখন মানুষের ভিড়ে গুঞ্জরিত। গতকাল আমি উত্তর-পূর্ব ভারতের ভাই ও বোনেদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেখানে উত্তর-পূর্ব ভারতের সিকিম, ত্রিপুরা, মণিপুরের অনেকের সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছে। তাঁরা অনেকেই বলেছেন যে কিছুদিন আগেই তাঁরা গুজরাট ঘুরতে এসেছিলেন আর অনেকে তো মেয়ে বিয়ের সাজসজ্জা সহকারে এসেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ এবং রুকমনির বিবাহে রুকমনির পক্ষ থেকে সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে এসে তাঁরা এখানকার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। এ ধরনের ঘটনা আমাদের শক্তি যোগায়, আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। যে মাটিতে ভগবান কৃষ্ণের বিয়ে হয়েছিল, সেই মাধবপুরের মেলাতে গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষেরা এসে ভিড় করেছিলেন। পূর্ব এবং পশ্চিমের এই অদ্ভূত মিলন দেশের ঐক্য ও সংহতির একটি নতুন উদাহরণ স্থাপন করেছে। ওখান থেকে যে মানুষেরা এসেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে নিয়ে আসা, হস্তশিল্পের পণ্য এখানে খুব বিক্রি হয়েছে। ফলে, পরবর্তীকালেও উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে মাধবপুর মেলায় বহু সংখ্যক মানুষের আগমনের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন আমার মনে হয়, মাধবপুরের এই মেলা গুজরাটে যতটা প্রসিদ্ধ তার থেকে বেশি পূর্ব ভারতে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠবে। এভাবেই কোনও অঞ্চলের আর্থিক গতিবিধি বৃদ্ধি পায়। আপনারা এখানে কচ্ছ-এর রান-এ যে রানোৎসবের আয়োজন করেছেন, সেখানে যেতে হলে প্রত্যেককেই মোরবি হয়ে যেতে হবে। অর্থাৎ, মোরবি রানোৎসবে আসা-যাওয়া করা পর্যটকদের পদস্পর্শে ধন্য হবে, উপকৃত হবে। এর প্রমাণ এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি। ইতিমধ্যেই মোরবি-র হাইওয়ের দু’পাশে অনেক নতুন নতুন হোটেল তৈরি হয়েছে। কারণ, কচ্ছ-এ যত বড় জমায়েত হয়েছে, যত বেশি মানুষ এসেছেন, তাঁদের আসায় মোরবি-ও লাভবান হয়েছে, আর যখন এলাকার উন্নয়ন হয়, যখন এই ধরনের মৌলিক উন্নয়ন হয়, তখন দীর্ঘ সময় ধরে সেখানকার মানুষের সুখের কারণ হয়ে ওঠে। দীর্ঘ সময় ধরে প্রশাসন ও ব্যবস্থার একটা অংশ হয়ে ওঠে, আর এখন আমরা গিরনারে রোপওয়ে তৈরি করেছি। আজ এরকম অনেকেই আছেন, যাঁদের বয়স হয়ে গেছে, বৃদ্ধ হয়ে গেছেন, অনেককাল আগে গিরনার যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন, কিন্তু অনেকটা চড়াই অতিক্রম করে যেতে হবে বলে যেতে পারেননি। তাঁরা এখন এই রোপওয়ের মাধ্যমে যেতে পারবেন। আমাকে অনেকেই বলেছেন যে এখন ৮০-৯০ বছর বয়সী বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে আসেন। এভাবে গিরনার তাঁদের পদস্পর্শে, তাঁদের আশীর্বাদে ধন্য হয়। এর পাশাপাশি যে শ্রদ্ধার উৎস রয়েছে, সেটা তো আছেই। কিন্তু, বেশি সংখ্যক মানুষ সেখানে গেলে স্থানীয় মানুষের রোজগার বাড়ে, আর ভারতের এত বড় শক্তি রয়েছে যে, আমরা কোনও ঋণ না নিয়ে ভারতের পর্যটনকে উন্নত করে তোলার ক্ষমতা রাখি। পর্যটনকে সঠিক অর্থে প্রচারিত, সম্প্রসারিত করতে পারি। সেজন্য প্রথম শর্ত হল আমাদের তীর্থক্ষেত্রগুলিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হতে হবে। প্রতিটি তীর্থক্ষেত্রের স্থানীয় মানুষেরা যেন পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে আধুনিক শিক্ষাপ্রাপ্ত হন। আগে আমরা জানতাম, মন্দিরে প্রসাদ পেতে অনেক সমস্যা হয়। কিন্তু এখন তো দেখছি মন্দিরের প্রসাদও প্যাকেটে পাওয়া যায়। এসব দেখে যখন আমি বললাম যে, প্যাকেটে প্লাস্টিকের ব্যবহার করা চলবে না, তখন সমস্ত মন্দির প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে। আজ গুজরাটের অধিকাংশ মন্দিরে প্লাস্টিকের প্যাকেটে প্রসাদ দেওয়া হয় না। এর অর্থ হল যে, আমাদের মন্দির এবং সাধু-সন্ন্যাসীরা, সন্ত-মহন্তরা যেভাবে সমাজ বদলায়, যেভাবে মানুষের ধ্যান-ধারণা বদলায়, সেই সংযোগের হিসেবে কিভাবে জনগণকে সেবা করতে হবে সেকথা মাথায় রেখেই ক্রমাগত কাজ করে যান। তাঁরাও সময়ের চাহিদা অনুসারে পরিবর্তন আনতে থাকেন। তাঁদের এই পদক্ষেপ থেকে আমাদের সকলেরই শেখা উচিৎ। এই শিক্ষা আমাদের জীবনে প্রয়োগ করা উচিৎ। তবেই আমরা আন্তরিকভাবে সবচাইতে বেশি লাভবান হব। এখন আমাদের দেশে স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের সময়। অনেক মহাপুরুষ এই দেশকে স্বাধীন করার জন্য আত্মবলিদান দিয়েছেন। কিন্তু তার আগেও আমাদের একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, ১৮৫৭ সালের আগে এই সাধু, সন্ন্যাসী, সন্ত, মহন্তরাই স্বাধীনতার জন্য সমগ্র ভারতে একটি প্রেক্ষিত তৈরি করেছিলেন, একটি আধ্যাত্মিক চেতনার বাতাবরণ তৈরি করেছিলেন। এ দেশের সাধু-সন্ন্যাসী, সন্ত-মহন্ত, ঋষি-মুনি, ভক্ত ও আচার্যরা যে ভক্তিযুগ শুরু করেছিলেন, সেই ভক্তিযুগ ভারতের আত্মগরিমার চেতনাকে প্রজ্জ্বলিত করেছে। সেই চেতনাই স্বাধীনতার আন্দোলনে একটি নতুন শক্তি যুগিয়েছে। সেজন্য আমাদের দেশের সাধু-সন্ন্যাসীদের শক্তি, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে যে একটা সামর্থ্য ছিল, যাঁরা আমাদের সর্বদাই – ‘সর্বজন হিতায়, সর্বজন সুখায়, সর্বজন কল্যাণ’ কল্পে সমাজ জীবনে কিছু না কিছু কাজ করে গেছেন, আর সেজন্যই আজ হনুমানজিকে স্মরণ করার অর্থ হল সেবাভাব ও সমর্পণভাবকে মর্যাদা দেওয়া। হনুমানজি তো আমাদের এটাই শিখিয়েছেন। হনুমানজির ভক্তি সেবা পূর্তিরই একটি রূপ। হনুমানজির ভক্তি সমর্পণেরই একটি রূপ। হনুমানজি শুধুই চমৎকার কিছু করে দেখানো বা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মানুষকে আকর্ষিত করার কাজ করেননি, হনুমানজি সাধারণ মানুষের দুঃখ মেটানো, সাধারণ মানুষের মনে সাহস জাগানো, তাঁদের মনে পরাক্রম জাগানোর মাধ্যমে নিজের সেবাধর্মকে উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। আজও যখন আমরা স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে অমৃত মহোৎসব পালন করছি, তখন আমাদের মনে সেবাভাব যতটা প্রবল হবে, পরোপকারের স্পৃহা যতটা জাগবে, ততটাই আমরা সমাজ জীবনকে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করার মতো সমন্বয়ধর্মী করে তুলতে পারব। এই দেশ তত বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠবে। আর আজ ভারত যেরকম আছে, সেরকম থাকলে একদমই চলবে না। সেজন্য আমরা জেগে থাকি কিংবা ঘুমিয়ে থাকি, শয়নে, জাগরণে এগিয়ে যাওয়ার চিন্তা করার ছাড়া উপায় নেই। আজ বিশ্বের পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে সারা পৃথিবী এখন বলতে শুরু করেছে, “আমাদের আত্মনির্ভর হয়ে উঠতে হবে।” এখন যখন আমরা সাধু-সন্ন্যাসীদের মধ্যে বসেছি, তখন আমাদের উচিৎ মানুষের কাছে এই আবেদন পৌঁছে দেওয়া। প্রত্যেকেই যেন আজ ‘লোকালের জন্য ভোকাল’ হোন, প্রত্যেকেই যেন স্থানীয় পণ্যের জন্য আওয়াজ ওঠান। আমি ঠিক বলছি তো? আমাদের এখন ‘লোকাল ফর ভোকাল’-এর জন্য কথা বলা উচিৎ কি উচিৎ নয়? যেসব পণ্য আমাদের দেশে তৈরি হয়, আমাদের দেশের মানুষ তৈরি করেন, আমাদের দেশের মানুষের পরিশ্রম দিয়ে তৈরি পণ্যই আমাদের ব্যবহার করা উচিৎ। আমরা যদি এরকম আবহ সারা দেশে গড়ে তুলতে পারি, তাহলে কল্পনা করুন ,কত কত মানুষের কর্মসংস্থান হবে। বাইরে থেকে আনা জিনিস, বিদেশ থেকে আমদানী করা দামী জিনিস ব্যবহার করতে কারও কারও হয়তো বেশি ভালো লাগে, কিন্তু লক্ষ্য করে দেখবেন, সেগুলির সঙ্গে আমাদের দেশীয় পণ্যের তুলনায় বড়জোর ১৯-২০ পার্থক্য। কিন্তু যে জিনিস ভারতের মানুষ তৈরি করেছেন, ভারতের টাকায় তৈরি হয়েছে, যে পণ্যে ভারতের শ্রমিকদের, শিল্পী কিংবা কর্মীদের ঘামের গন্ধ আছে, ভারতের মাটির সুরভী আছে, সেই পণ্যের গৌরব এবং তা ব্যবহারের আনন্দই ভিন্ন হয়। আমাদের সাধু-সন্ন্যাসী এবং সন্ত-মহন্তরা যেখানেই যান, তাঁরা কিন্তু ভারতে তৈরি হওয়া পণ্য কিনতেই বেশি আগ্রহী থাকেন। তাহলেও ভারতে কর্মসংস্থানের জন্য আমাদের এই পদক্ষেপ নিতে হবে। সবাই দেখবেন, যত বেশি ভারতীয় পণ্য কেনা যায়! আমরা যখন হনুমানজির প্রশংসা করি, আর বলি, হনুমানজি এটা করেছেন, ওটা করেছেন, কিন্তু হনুমানজি কী বলেছেন সেটাকে আমাদের জীবনের প্রেরণা করে তুলতে হবে।
হনুমানজি প্রায়ই বলতেন – “সো সব তব প্রতাপ রঘুরাঈ, নাথ ন কছু মোরী প্রভূতাই!”
অর্থাৎ, আমাদের সমস্ত কাজ, আমাদের সমস্ত সাফল্যের শ্রেয় তিনি সর্বদাই প্রভূ রামকে দিয়েছেন। তিনি কখনই বলেননি যে এসব কিছু আমার কারণে হয়েছে। তিনি সব সময় বলে গেছেন যা কিছু হয়েছে তা প্রভূ রামের কারণে হয়েছে। আজও ভারত যেখানে পৌঁছেছে, ভবিষ্যতে যেখানে পৌঁছনোর সঙ্কল্প নিয়ে এগোতে চায়, তার একটাই রাস্তা – আমরা সবাই ভারতের নাগরিক … আর এটাই আমাদের আসল শক্তি। আমার জন্য তো আমার দেশের ১৩০ কোটি মানুষই রামের স্বরূপ। জনগণকেই আমি রাম বলে মনে করি। তাঁদের সঙ্কল্প নিয়েই দেশ এগিয়ে চলেছে। তাঁদের আশীর্বাদেই দেশ এগিয়ে চলেছে। এই মনোভাব নিয়েই আমরা কাজ করে চলেছি। এই মনোভাব নিয়েই আমি আরও একবার এই শুভ অনুষ্ঠান উপলক্ষে আপনাদের সবাইকে অনেক অনেক শুভকামনা জানাই। হনুমানজির শ্রীচরণে প্রণাম জানাই।
অনেক অনেক ধন্যবাদ!