মাননীয় চেয়ারম্যান মহোদয়,
আজকের দিনটি আমাদের সকলের জন্য একটি স্মরণীয় ও ঐতিহাসিক দিন। এর আগে লোকসভায়ও আমার অনুভূতি প্রকাশের সুযোগ পেয়েছি। এখন রাজ্যসভাতেও আজ আপনি আমাকে সেই সুযোগ দিয়েছেন, আমি আপনার কাছে এর জন্য কৃতজ্ঞ।
মাননীয় চেয়ারম্যান মহোদয়,
আমাদের সংবিধানে, রাজ্যসভাকে উচ্চকক্ষ হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। সংবিধান প্রণেতাদের উদ্দেশ্য ছিল যে এই সভা যেন রাজনীতির বিশৃঙ্খলার ঊর্ধ্বে উঠে গুরুতর, বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার কেন্দ্রে পরিণত হয় আর দেশকে দিকনির্দেশ দেওয়ার শক্তি যেন এখান থেকেই আসে। এটিও দেশের একটি স্বাভাবিক প্রত্যাশা আর গণতন্ত্রের সমৃদ্ধিতে এই সভার অবদান প্রতিনিয়ত আরও মূল্য সংযোজন করতে পারে।
মাননীয় চেয়ারম্যান মহোদয়,
এই সভায় অনেক মহাপুরুষ বসেছেন। আমি হয়তো তাঁদের সবার নাম উল্লেখ করতে পারব না, কিন্তু লাল বাহাদুর শাস্ত্রীজি, গোবিন্দ বল্লভ পন্থ সাহেব, লাল কৃষ্ণ আডবাণী জি, প্রণব মুখার্জি সাহেব, অরুণ জেটলি জি, এমন অসংখ্য পণ্ডিত, সৃজনশীল লেখক এবং সার্বজনিক জীবনে যাঁরা বছরের পর বছর ধরে তপস্যা করেছেন, তাঁরা এই সভাকে অলংকৃত করেছেন এবং দেশকে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছেন। এমন অনেক সদস্য ছিলেন যাঁরা একভাবে ব্যক্তি হিসেবে, একটি প্রতিষ্ঠানের মতো, একটি স্বাধীন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক হিসেবে, তাঁদের নিজস্ব সামর্থ্য দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছেন। সংসদীয় ইতিহাসের শুরুর দিনগুলিতে, ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণ রাজ্যসভার গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছিলেন যে, ‘সংসদ শুধু আইন প্রণয়ন নয়, এটি একটি সুচিন্তিত স্বেচ্ছাসেবার সংস্থা’। রাজ্যসভার কাছে দেশের জনগণের উচ্চ প্রত্যাশা রয়েছে, সর্বোত্তম প্রত্যাশা রয়েছে এবং তাই মাননীয় সদস্যদের মধ্যে মাঝে বসে দেশের গুরুতর সমস্যাগুলি সম্পর্কে শোনা এবং সেগুলির সমাধান নিয়ে আলোচনা করা একটি অত্যন্ত আনন্দদায়ক সুযোগ। নতুন সংসদ ভবন শুধু একটি নতুন ভবন নয়, এটি একটি নতুন সূচনার প্রতীক। আমরা ব্যক্তিগত জীবনেও দেখি যে আমরা যখন কোনও নতুন জিনিসের সঙ্গে যুক্ত হই তখন আমাদের মনে প্রথম যে চিন্তা আসে তা হল যে এখন আমি একটি নতুন পরিবেশের সর্বোত্তম ব্যবহার করব, আমি তার সবচেয়ে ইতিবাচক পরিবেশে কাজ করব, এটাই আমাদের স্বভাব। আর অমৃত কালের শুরুতে এই ভবনের নির্মান আর আজ এই ভবনে আমাদের সকলের প্রবেশ – এই ঘটনাই আজ আমাদের দেশের ১৪০ কোটি নাগরিকের মনে আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রক্রিয়ায় নতুন প্রাণশক্তি জোগাবে। সৃষ্টি করবে নতুন আশা ও নতুন বিশ্বাস।
মাননীয় চেয়ারম্যান মহোদয়,
আমাদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। কারণ দেশ, যেমনটি আমি আগেই বলেছিলাম, বেশি দিন আর অপেক্ষা করতে পারবে না কেউ। একটা সময় ছিল যখন সাধারণ মানুষ ভাবতো যে আমাদের বাবা-মাও এভাবে বেঁচে ছিলেন, আমরাও তাই করবো, এটাই আমাদের ভাগ্যে ছিল, আমরাও কোনমতে দিন কাটিয়ে যাব। আজকের সমাজজীবনে এবং বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের চিন্তাধারা সেরকম নয় এবং তাই আমাদেরকেও সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্খা পূরণের জন্য নতুন চিন্তা ও নতুন শৈলী নিয়ে নিজেদের কাজের পরিধি বাড়াতে হবে। আমাদের চিন্তা-ভাবনা সীমাকেও বাড়াতে হবে আর আমাদের কর্মকুশলতা যত বাড়বে, দেশের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আমাদের অবদানও তত বৃদ্ধি পাবে।
মাননীয় চেয়ারম্যান মহোদয়,
আমি বিশ্বাস করি যে এই নতুন ভবনে, এই উচ্চকক্ষে, আমরা আমাদের আচার-আচরণ এবং ব্যবহার দিয়ে সংসদীয় শুচিতার প্রতীক রূপে দেশের বিধানসভাগুলিকে, দেশের সমস্ত স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলিকে এবং অন্যান্য বাকি ব্যবস্থাকে প্রেরণা জোগাতে পারি, আর আমি মনে করি, আমি বিশ্বাস করি যে এই স্থানটি এমনই যে এর সর্বাধিক সামর্থ্য রয়েছে আর তা থেকে দেশের লাভ হওয়া উচিত, দেশের জনপ্রতিনিধিদেরও লাভ হওয়া উচিত, তা তিনি গ্রামপ্রধান রূপে নির্বাচিত হয়ে থাকুন কিম্বা তিনি সংসদে নির্বাচিত হয়ে আসুন। আমরা এখান থেকে এই ঐতিহ্যকে কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি সে কথাই বিবেচনা করবো!
মাননীয় চেয়ারম্যান মহোদয়,
গত ৯ বছর ধরে আমরা আপনাদের সকলের সহযোগিতায় দেশকে সেবা করার সুযোগ পেয়েছি। অনেক বড় বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, আর এগুলির মধ্যে এমন অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যেগুলি কয়েক দশক ধরে ঝুলে ছিল। এরকম কিছু সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে, যেগুলি অত্যন্ত কঠিন বলে বিবেচিত হত এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সেগুলিকে স্পর্শ করাও খুব অন্যায় বলে বিবেচিত হত। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা কিছুটা সাহস দেখিয়ে সেই সিদ্ধান্তগুলি নিয়েছি। রাজ্যসভায় আমাদের যথেষ্ট সংখ্যা ছিল না, তবে আমাদের বিশ্বাস ছিল যে রাজ্যসভা পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেবে। এবং আজ আমি সন্তোষের সাথে বলতে পারি যে আমাদের সংখ্যাগত শক্তি আমাদের উদার চিন্তার ফলাফলের তুলনায় কম হওয়া সত্ত্বেও, এই রাজ্যসভার মাননীয় সংসদ সদস্যদের বিচক্ষণতা, পাখির দৃষ্টিতে পরিস্থিতিকে বোঝার ক্ষমতা এবং রাষ্ট্রহিতের প্রতি দায়িত্বশীলতার কারণে তাঁরা দলমতের উর্দ্ধে উঠে আমাদের সমর্থন করেছেন। হ্যাঁ, আপনাদের সকলের সহযোগিতাতেই আমরা অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়েছি। এই ধরনের কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং রাজ্যসভার মর্যাদা বৃদ্ধির কাজ সদস্য সংখ্যার জোরে নয়, মাননীয় সদস্যদের প্রজ্ঞার জোরে এগিয়েছে। এর চেয়ে বড় তৃপ্তি আর কী হতে পারে? আর সেজন্য আমি এই সভার সংশ্লিষ্ট সকল মাননীয় সংসদ সদস্যদের ধন্যবাদ জানাই, যাঁরা আজ উপস্থিত আছেন এবং যাঁরা আগে ছিলেন – প্রত্যেককে কৃতজ্ঞতা জানাই।
মাননীয় চেয়ারম্যান মহোদয়,
গণতন্ত্রে কে ক্ষমতায় আসবে, কে আসবে না, কে কখন আসবে, এই ক্রম তো চলতেই থাকে। এটা খুবই স্বাভাবিক এবং এটাই গণতন্ত্রের স্বাভাবিক প্রকৃতি ও প্রবণতা। কিন্তু যখনই দেশের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রসঙ্গ এসেছে, আমরা সবাই মিলে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছি।
মাননীয় চেয়ারম্যান মহোদয়,
রাজ্যসভা এক প্রকার রাজ্যগুলিরও প্রতিনিধিত্ব করে। এক প্রকার সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। আর আজকাল যখন প্রতিযোগিতামূলক – সহযোগিতামূলক যুক্তরাজ্য ব্যবস্থার দিকে জোর দেওয়া হচ্ছে, তখন আমরা দেখছি যে, পারস্পরিক সহযোগিতার এমন অনেক বিষয় প্রাধান্য পাচ্ছে, যার ফলে দেশ এগিয়ে চলেছে। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর সঙ্কট অনেক বড় ছিল। তখন বিশ্ববাসী অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। আমরাও অনেক সমস্যার মুখোমুখী হয়েছি। কিন্তু, আমাদের এই যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার শক্তি এমনই যে কেন্দ্র ও রাজ্যগুলি মিলেমিশে যে যতটা পেরেছে, দেশকে এত বড় সঙ্কট থেকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এটাই আমাদের সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার শক্তিকে আরও শক্তিশালী করেছে। আমাদের এই যে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার শক্তি, তা দিয়ে আমরা এরকম অনেক সঙ্কটের মোকাবিলা করেছি। আর আমরা শুধু সঙ্কটের সময়েই নয়, উৎসবের সময়ও বিশ্বের সামনে ভারতের সেই শক্তিকে তুলে ধরেছি, যার মাধ্যমে বিশ্ববাসী প্রভাবিত হয়েছেন। ভারতের বিবিধতা, ভারতের এত রাজনৈতিক দল, ভারতের এত সংবাদ , ভারতের নানা প্রান্তে এতরকম খাদ্যাভাস, বৈচিত্র্যময় পোশাক-আশাক, নানা ভাষা ও অসংখ্য কথ্য ভাষা – এইসব কিছুর শক্তি জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনগুলিতে পরিস্ফুট হয়েছে। রাজ্যগুলিতেই তো অধিকাংশ শীর্ষ সম্মেলন হয়েছে। দিল্লিতে অনেক দেরীতে হয়েছে। তার আগে দেশের ৬০টি শহরে ২২০-রও বেশি শীর্ষ সম্মেলন আয়োজিত হয়েছে। আর প্রতিটি রাজ্য এক্ষেত্রে অত্যন্ত উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে নিজেদের সর্বস্ব উজার করে এই সম্মেলনের আয়োজন করেছে। তাঁদের আতিথেয়তা এবং বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা অতিথিদের মুগ্ধ করেছে, তাঁদের মন জয় করেছে। আর প্রতিটি রাজ্য স্বেচ্ছায় যেভাবে এই অনুষ্ঠানগুলির আয়োজন করেছে, সেখানে তাঁরা প্রত্যেকেই বিশ্বকে নতুন পথ দেখানোর সামর্থ্য দেখিয়েছে। আর এটাই আমাদের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার আসল শক্তি। আর এই যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কারণেই, এই সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কারণেই আমরা এত উন্নতি করতে পারছি।
মাননীয় চেয়ারম্যান মহোদয়,
আমাদের এই নতুন সংসদ ভবনে এই যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ছাপ স্পষ্টভাবে পরিস্ফুট হয়েছে। কারণ, এই ভবন নির্মাণের সময় রাজ্যগুলির কাছে আবেদন করা হয়েছিল, যাতে তারা এই ভবনের সাজসজ্জার জন্য রাজ্যের ঐতিহ্যমণ্ডিত কিছু শিল্পকৃতি পাঠায়। যাতে সেগুলি দেখে বোঝা যায় যে, এই সংসদ ভবন সকল রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করছে। ফলে আপনারা এখন দেখতে পাচ্ছেন, প্রত্যেক রাজ্য অসাধারণ সব শিল্পকৃতি পাঠিয়েছে। আমাদের প্রতিটি দেওয়াল সেই শিল্পকৃতিতে সুসজ্জিত হয়ে উঠেছে। রাজ্যগুলি নিজেদের পছন্দ মতো তাদের রাজ্যের শ্রেষ্ঠ শিল্পকৃতিই পাঠিয়েছে। ফলে, এখানে যে আবহ গড়ে উঠেছে, তা একদিকে যেমন রাজ্যগুলির বৈচিত্র্যকে তুলে ধরেছে, অন্যদিকে আমাদের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মাধুর্য ফুটে উঠেছে।
মাননীয় চেয়ারম্যান মহোদয়,
প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে দ্রুত বদলে দিচ্ছে। আগে প্রযুক্তির পরিবর্তন আসতে ৫০-৫০ বছর লেগে যেত। আর আজকাল কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এসে যাচ্ছে। আধুনিকতা আজ অনিবার্যতায় পর্যবসিত হয়েছে। আর আধুনিকতার সঙ্গে ভারসাম্য রাখতে আমাদের নিজেদেরকেও নিরন্তর সক্রিয়ভাবে স্ব-শিক্ষিত করে তুলতে হবে, এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমরা যখনই সময় ও সুযোগ পাবো, তখনই যেন আধুনিকতার সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি – তবেই আমরা সময়ের সঙ্গে সাযুজ্য রাখতে পারবো।
মাননীয় চেয়ারম্যান মহোদয়,
পুরনো সংসদ ভবনে, যেটিকে আপনি একটু আগেই ‘সংবিধান সদন’ নাম দিয়েছেন; সেখানে আমরা অত্যন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে স্বাধীনতার ‘অমৃত মহোৎসব’ পালন করেছি। সেই সংসদ ভবন আমাদের ৭৫ বছরের সফরকে প্রত্যক্ষ করেছে আর নতুন দিশা ও সংকল্প নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টাকেও দেখেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, এই নতুন সংসদ ভবনে আমরা যখন স্বাধীনতার শতাব্দী পালন করবো, সেই স্বর্ণ শতাব্দী ‘বিকশিত’ ভারতের শতাব্দী হবে। পুরনো ভবনে আমরা নিজেদের বিশ্বের পঞ্চম অর্থনীতির দেশে পরিণত করতে পেরেছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, নতুন সংসদ ভবনে আমরা দেশকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ তিনটি অর্থনীতির দেশের অন্যতম করে তুলতে পারবো। পুরনো সংসদ ভবনে গরীব কল্যাণে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, অনেক কাজ হয়েছে। এই নতুন সংসদ ভবনে আমরা দারিদ্র্য দূরীকরণ অভিযানকে ১০০ শতাংশ সফল করে তুলবো। দেশের গরীব মানুষরা আবার তাঁদের পূর্ণ অধিকার ফিরে পাবেন।
মাননীয় চেয়ারম্যান মহোদয়,
এই নতুন সংসদ ভবনের দেওয়ালগুলির পাশাপাশি, আমাদের নিজেদেরকেও এখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে রপ্ত করে তুলতে হবে। কারণ, এখন সবকিছু আমাদের সামনে রাখা আই-প্যাডে রয়েছে। আমি সমস্ত মাননীয় সদস্যদের কাছে আবেদন রাখছি যে, আপনারা কিছুটা সময় বের করে নিজেদেরকে এই উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত করান। এর ব্যবহার শিখুন, জানুন। এই প্রযুক্তি যত ভালো ব্যবহার জানতে পারবেন, আপনাদের তত বেশি সুবিধা হবে। নিজের আসনে বসে সবকিছু নিজের স্ক্রিনে রেখে নিজেদের অভিব্যক্তিকে আরও ভালোভাবে পরিস্ফুট করতে পারবেন। এখন লোকসভায় এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিকে যাঁরা অপারেট করছেন, তাঁদের কাছেও অনুরোধ যে, আপনারা অন্যান্য মাননীয় সদস্যদের দিকে আপনাদের হাত বাড়িয়ে দিন, তাঁরা এই প্রযুক্তি ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারছেন না। আমার বলার উদ্দেশ্য হ’ল – এটা আমাদের সকলের দায়িত্ব, কিছুটা সময় বের করে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে হবে। যত দ্রুত আপনারা এই কাজটা করতে পারবেন, আপনাদের কাজ তত ত্বরান্বিত হবে।
মাননীয় চেয়ারম্যান মহোদয়,
আজ আমরা ডিজিটাল যুগে বাস করছি। আমাদের এই প্রথম সংসদ ভবনেও প্রতি পদক্ষেপে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। শুরুতে শিখতে কিছুটা সময় লাগবে, কিন্তু এই প্রযুক্তি অত্যন্ত ‘ইয়ুজার ফ্রেন্ডলি’। যে কেউ চেষ্টা করলেই দ্রুত রপ্ত করে নিতে পারবেন। আসুন, আমরা সকলে চেষ্টা করি। আমরা যে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’কে একপ্রকার আন্তর্জাতিক স্তরে গেম চেঞ্জার বা বিশ্ব ক্রমে প্রথম সারিতে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি, সেক্ষেত্রে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের যাত্রাপথকে মসৃণ করবে; নতুন নতুন ভাবনা, নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনা, নতুন প্রাণশক্তি নিয়ে দ্রুত এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
মাননীয় চেয়ারম্যান মহাশয়
আজ নতুন সংসদ ভবন দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের সাক্ষী হয়ে উঠছে। একটু আগেই লোকসভায় একটি বিল পেশ করা হয়েছে। সেখানে তর্ক-বিতর্কের পর, সেটি এখানেও আসবে। নারী শক্তির ক্ষমতায়নকে দিশা প্রদানের জন্য বিগত অনেক বছর ধরে যত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ আজ আমরা সবাই মিলে নিতে চলেছি। আমাদের সরকার গোড়া থেকে চেষ্টা করেছে , জনগণের ‘ইজ অফ লিভিং’ এবং ‘কোয়ালিটি অফ লাইফ’ উন্নত করতে। আমরা যখন ‘ইজ অফ লিভিং’ এবং ‘কোয়ালিটি অফ লাইফ’ – এর কথা বলি, তখন আমি মনে করি, এর প্রথম দাবিদার আমাদের বোনেরা, আমাদের মহিলারা। কারণ, তাঁদেরকেই দৈনন্দিন জীবনে সবচেয়ে বেশি সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়। সেজন্য আমরা দেশ গঠনেও তাঁদের ভূমিকা বৃদ্ধির চেষ্টা করছি। তাঁরাও যেন সমান দায়িত্ব পালন করতে পারেন। অনেক নতুন নতুন ক্ষেত্রে আজ মহিলাদের শক্তি এবং মহিলাদের অংশীদারিত্ব নিরন্তর সুনিশ্চিতভাবে তাঁরা প্রমাণ করে চলেছেন। আমরাও আমাদের বোনেদের, এমনকি খনিতে কাজ করার অধিকার প্রদানের সিদ্ধান্তও নিয়েছি। এটা আপনাদের সকলের সহযোগিতাতেই সম্ভব হয়েছে। আমরা সমস্ত স্কুলের দরজা মেয়েদের জন্য খুলে দিয়েছি। কারণ, মেয়েদের মধ্যে সামর্থ্য রয়েছে, সেই সামর্থ্যকে আজ উন্মোচনের সুযোগ দেওয়া উচিৎ। তাঁদের জীবনে সমস্ত ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’র যুগ সমাপ্ত হয়েছে। এবার আমরা তাঁদের যত সুবিধা দেব, আমাদের মাতৃশক্তি - আমাদের মেয়ে ও বোনেরা তত বেশি সামর্থ্য দেখাবে। ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ অভিযান আজ আর নিছকই সরকারি কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ নয়। গোটা সমাজ একে আপন করে নিয়েছে। আর এর ফলে আমরা দেখেছি যে, সমাজে মেয়েদের মান-সম্মান অনেক বেড়েছে। আমাদের চালু করা মুদ্রা যোজনা থেকে শুরু করে জন ধন যোজনার মতো প্রতিটি প্রকল্প মহিলাদের বেশি উপকৃত করেছে। অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকরণের মাধ্যমে আজ ভারতে সমস্ত অর্থনৈতিক গতিবিধিতে মহিলাদের সক্রিয় অবদান পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমি মনে করি যে এই পরিবর্তন, তাঁদের পারিবারিক জীবনেও তাঁদের সামর্থ্যকে অধিক বিকশিত করেছে। এই সামর্থ্যকে এখন রাষ্ট্র জীবনেও তুলে ধরার সময় এসেছে। আমরা চেষ্টা করছি, যাতে আমাদের মা ও বোনেদের স্বাস্থ্য আরও ভালো থাকে। আমরা জানি যে, আগে রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারের জন্য কিভাবে সংসদ সদস্যদের পেছনে পেছনে ঘুরতে হত। গরীব পরিবারগুলির এই সমস্যা দূর করতে আমরা উজ্জ্বলা যোজনা শুরু করে দরিদ্র মা ও বোনেদের বাড়িতে বাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার পৌঁছে দিয়েছি। মহিলাদের সম্মান বৃদ্ধির জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা নানা রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির অঙ্কের শিকার হওয়া তিন তালাকের বিষয়টি সমাধান করেছি। এত বড় মানবিক সিদ্ধান্ত আমরা দলমত নির্বিশেষে সমস্ত মাননীয় সাংসদদের সাহায্যেই করতে পেরেছি। আমরা মহিলাদের সুরক্ষার অনুকূলে কড়া আইন প্রণয়নের কাজও আপনাদের সকলের সহযোগিতাতেই করতে পেরেছি। ‘উইমেন লেড ডেভেলপেমেন্ট’ বা মহিলা নেতৃত্বাধীন উন্নয়ন এবারের জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয় ছিল। বিশ্বের অনেক দেশের জন্য এই মহিলা নেতৃত্বাধীন উন্নয়নের বিষয়টি একদমই নতুন ছিল। তাঁরা এ ব্যাপারে অনভিজ্ঞ ছিলেন। আলোচনার সময় তাঁদের কন্ঠে কিছুটা ভিন্ন সুর শোনা গেছে। কিন্তু জি-২০’র ‘ডিক্লারেশন’ – এ সবাই এই ‘উইমেন লেড ডেভেলপমেন্ট’ – এর বিষয়টিকে মেনে নিয়েছেন। আর এজন্য আমরা সবাই গর্ব করতে পারি যে, এই প্রস্তাব ভারতের পক্ষ থেকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছেছিল।
মাননীয় চেয়ারম্যান মহোদয়,
এই প্রেক্ষিতে দীর্ঘকাল ধরে বিধানসভাগুলির ও লোকসভার প্রত্যক্ষ নির্বাচনে আমাদের বোনেদের অংশীদারিত্ব সুনিশ্চিত করার বিষয়টি উঠে এসেছে। দীর্ঘকাল ধরেই তাঁদের জন্য আসন সংরক্ষণ নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলেছে। প্রত্যেকেই কিছু না কিছু চেষ্টা করেছেন। ১৯৯৬ সালে প্রথম এই প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল। আর অটলজীর নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় তো কয়েকবার বিলও আনা হয়েছিল। কিন্তু, তখন আমরা সংখ্যায় কম ছিলাম। উগ্র বিরোধিতার আবহ ছিল। সেজন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে খুব অসুবিধা হয়েছে। কিন্তু, আজ যখন আমরা নতুন সংসদ ভবনে এসেছি, নতুন সবকিছুর একটি উৎসাহ ও উদ্দীপনা থাকে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, দীর্ঘকাল ধরে যে বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে, এখন আমরা যেন সেটিকে আইনে পরিণত করে আমাদের দেশের উন্নয়ন যাত্রায় নারী শক্তির অংশীদারিত্ব সুনিশ্চিত করি - এখন সেই সময় এসেছে। আর সেজন্য ‘নারী শক্তি বন্দন অধিনিয়ম’কে সংবিধান সংশোধনী রূপে সরকার আজ লোকসভায় পেশ করেছে। আগামীকাল লোকসভায় এটি নিয়ে আলাপ-আলোচনা হবে। আর তারপর রাজ্যসভাতেও আসবে। আপনাদের সকলের প্রতি আমার অনুরোধ যে, এটি এমনই একটি বিষয়, যদি আমরা এটিকে সর্বসম্মতিতে এগিয়ে নিয়ে যাই, তা হলে বাস্তবে আমাদের শক্তি অনেক গুণ বৃদ্ধি পাবে। আমার সমস্ত সাংসদদের কাছে অনুরোধ যে, যখনই এই বিলটি রাজ্যসভায় আপনাদের সবার সামনে আসবে, আপনারা সকলে সর্বসম্মতি প্রদানের মাধ্যমে এটিকে আইনে পরিণত করতে সাহায্য করুন। আগামী এক-দুই দিনের মধ্যেই এটা আসবে। আপনাদের কাছ থেকে এই সহযোগিতা প্রত্যাশা করে আমার বক্তব্য এখানেই শেষ করছি ।
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
धन्यवाद।