নমস্কার!
মহামান্যগণ,
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদজি,
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাজি,
কৃষিমন্ত্রী ডঃ মহম্মদ আব্দুর রেজ্জাকজি,
ম্যাডাম শেখ রেহানাজি,
অন্য গণ্যমান্য অতিথিগণ,
সোনার বাংলাদেশের প্রিয় বন্ধুরা,
আপনাদের সকলের এই ভালবাসা আমার জীবনের অমূল্য মুহূর্তগুলির অন্যতম। আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রার এই গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আপনারা আমাকেও সামিল করেছেন। আজ বাংলাদেশের জাতীয় দিবস এবং স্বাধীনতার ৫০তম বছর। এ বছরই ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীরও ৫০ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। এ বছরটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষও। এই সময়ে উভয় দেশের সম্পর্ক আরও মজবুত হচ্ছে।
মহামান্যগণ,
রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদজি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাজি এবং বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা জানাই। আপনারা আপনাদের এই গৌরবময় মুহূর্তে, এই উৎসবে অংশীদার হওয়ার জন্য ভারতকে ভালবাসামাখা আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমি সমস্ত ভারতবাসীর পক্ষ থেকে আপনাদের সবাইকে, বাংলাদেশের সমস্ত নাগরিকদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই। আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানজিকে সাদর শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করছি যিনি বাংলাদেশের জনগণের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছেন। ভারতবাসীর জন্য এটা গর্বের বিষয় যে আমরা শেখ মুজিবুর রহমানজিকে ‘গান্ধী শান্তি সম্মান’-এ ভূষিত করার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমি এখানে এই সুন্দর অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী সমস্ত শিল্পী ও কলাকুশলীদেরও প্রশংসা করছি।
বন্ধুগণ,
আমি আজ স্মরণ করছি বাংলাদেশের সেই লক্ষ লক্ষ পুত্র-কন্যাদের যাঁরা নিজের দেশ, নিজের ভাষা, নিজের সংস্কৃতির জন্য অনেক অত্যাচার সহ্য করেছেন, অনেক রক্ত দিয়েছেন, নিজেদের জীবন বাজি রেখেছেন। আমি আজ স্মরণ করছি মুক্তিযুদ্ধের শূরবীরদের। আমি আজ স্মরণ করছি শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে, শিক্ষাবিদ রফিকুদ্দিন আহমেদকে, ভাষা শহীদ সালাম – রফিক – বরকত - জব্বার এবং সফিউরজিকে!
আমি আজ ভারতীয় সেনাবাহিনীর সেই বীর জওয়ানদেরও প্রণাম জানাচ্ছি যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের ভাই-বোনেদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের রক্ত দিয়েছেন, জীবন দিয়েছেন আর স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছেন। ফিল্ড মার্শাল শ্যাম মানেকশ’, জেনারেল অরোরা, জেনারেল জেকব ও ল্যান্স নায়েক অ্যালবার্ট এক্কা, গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং, ক্যাপ্টেন মোহন নারায়ণ রাও সাওয়ান্ত এরকম অসংখ্য কত না বীর ছিলেন যাঁদের নেতৃত্ব ও সাহসের কথা আমাদের প্রেরণা জোগায়। বাংলাদেশ সরকার এই মহান বীরদের স্মৃতিতে আশুগঞ্জে যুদ্ধ স্মারক স্থাপন করেছে।
আমি সেজন্য আপনাদের কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে মুক্তিযুদ্ধে সামিল অনেক ভারতীয় সৈনিক আজ বিশেষ আমন্ত্রণ পেয়ে এই অনুষ্ঠানেও আমার সঙ্গে এসে উপস্থিত হয়েছেন। বাংলাদেশের আমার ভাই ও বোনেরা, এখানকার নবীন প্রজন্মকে আমি আরেকটি কথা মনে করাতে চাইব, আমি অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে মনে করাতে চাইব, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং সেই সংগ্রামে সামিল হওয়া আমার জীবনেরও প্রথম আন্দোলনগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল। আমার বয়স তখন ২০-২২ বছর, যখন আমি এবং আমার অনেক বন্ধু বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার জন্য সত্যাগ্রহ করেছিলাম।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থনে তখন আমি কারাবরণও করেছিলাম এবং কারান্তরালে থাকার সুযোগও হয়েছিল। অর্থাৎ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যতটা ব্যগ্রতা এদিকে ছিল, ততটাই ব্যগ্রতা ওদিকেও ছিল। এখানে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যে জঘন্য অপরাধ এবং অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছিল, সেসব চিত্র আমাদেরকেও বিচলিত করে তুলছিল। অনেকদিন ঠিকভাবে ঘুমোতেও দেয়নি।
গোবিন্দ হালদারজি লিখেছিলেন,
“এক সাগর রক্তের বিনিময়ে,
বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা,
আমরা তোমাদের ভুলবো না,
আমরা তোমাদের ভুলবো না!”
অর্থাৎ, যাঁরা নিজেদের রক্তের সাগর বইয়ে দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, আমরা তাঁদের ভুলবো না। বন্ধুগণ, এক নিরঙ্কুশ সরকার নিজের দেশের নাগরিকদেরই গণ-সংহার করছিল। তাঁদের ভাষা, তাঁদের কন্ঠস্বর, তাঁদের পরিচিতিকে কচুকাটা করছিল। ‘অপারেশন সার্চ লাইট’-এর সেই ক্রুরতা, দমন এবং অত্যাচার সম্পর্কে বিশ্বে ততটা সমালোচনা হয়নি যতটা সমালোচনা হওয়া উচিৎ ছিল।
বন্ধুগণ,
এই সবকিছুর মাঝে এ দেশের জনগণ এবং ভারতবাসীর জন্য আশার কিরণ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর সাহস, তাঁর নেতৃত্ব এটা ঠিক করে দিয়েছিল যে, কোনও শক্তি আর বাংলাদেশকে গোলাম বানিয়ে রাখতে পারবে না।
বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন :
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
অর্থাৎ, এবার লড়াই হবে মুক্তির জন্য, এবার লড়াই হবে স্বাধীনতার জন্য। তাঁর নেতৃত্বে এ দেশের সাধারণ মানুষ, পুরুষ কিংবা স্ত্রী, কৃষক, নব-যুবক, শিক্ষক, শ্রমিক – সবাই একসঙ্গে মুক্তিবাহিনীতে সামিল হয়েছিলেন।
আর সেজন্য আজকের এই উপলক্ষ মুজিব বর্ষে বঙ্গবন্ধুর দর্শন, তাঁর আদর্শ এবং তাঁর সাহসকে মনে করার দিন। এই সময় চিরবিদ্রোহীকে, মুক্তিযুদ্ধের ভাবনাকে আরেকবার মনে করার সময়। বন্ধুগণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি ভারতের কোণায় কোণায়, প্রত্যেক রাজনৈতিক দল, সমাজের প্রত্যেক অংশের মানুষের সমর্থন ছিল।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীজির এই প্রচেষ্টা এবং তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সর্বজনবিদিত। সেই সময় ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর, অটলবিহারী বাজেপেয়ীজি বলেছিলেন, “আমরা শুধুমাত্র মুক্তি সংগ্রামে আমাদের জীবন আহুতি প্রদানকারীদের সঙ্গে সঙ্গ দিয়ে লড়াই করছিলাম না, আমরা ইতিহাসকে একটি নতুন দিশা প্রদানের প্রচেষ্টাও করছিলাম। আজ বাংলাদেশে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি ভারতীয় সৈনিকদের রক্তও প্রবাহিত হচ্ছে। এই রক্ত এমন সম্পর্ক গড়ে তুলবে যা কোনরকম চাপে ভাঙবে না, যা কোনরকম কূটনীতির শিকার হবে না।”
আমাদের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী, আমাদের প্রিয় প্রণবদা বঙ্গবন্ধুকে একজন ‘টায়ারলেস স্টেটসম্যান’ বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ধৈর্য, দায়বদ্ধতা ও আত্মসংযমের প্রতীক।”
বন্ধুগণ,
এটা অত্যন্ত আনন্দদায়ক সংযোগ যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০তম বছর আর ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বছরের পর্যায় প্রায় একসঙ্গে এসেছে। আমাদের উভয় দেশের জন্য একবিংশ শতাব্দীতে আগামী ২৫ বছরের যাত্রাপথ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের ঐতিহ্যও এক, আমাদের উন্নয়নও একই গতিতে চলবে। আমাদের লক্ষ্যও এক, আমাদের সমস্যাগুলিও এক। আমাদের মনে রাখতে হবে যে বাণিজ্য এবং শিল্পে আমাদের যেমন সমতুল সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনই সন্ত্রাসবাদের মতো সমতুল বিপদও রয়েছে। যে ভাবনা এবং শক্তিগুলি এ ধরনের অমানবিক ঘটনা ঘটায়, তারা এখনও সক্রিয়।
আমাদের তাদের থেকে সাবধান থাকতে হবে এবং তাদের মোকাবিলার জন্য সংগঠিতও থাকতে হবে। আমাদের উভয় দেশের গণতন্ত্রের শক্তি রয়েছে, এগিয়ে যাওয়ার স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। ভারত এবং বাংলাদেশ একসঙ্গে মিলে এগিয়ে যাবে এটাই এই গোটা অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
আর সেজন্য আজ ভারত এবং বাংলাদেশ উভয় দেশের সরকার এই সংবেদনশীলতাকে বুঝে, এই লক্ষ্যে সার্থক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা দেখিয়ে দিয়েছি যে পারস্পরিক বিশ্বাস এবং সহযোগিতার মাধ্যমে প্রত্যেক সমস্যার সমাধান হতে পারে। আমাদের স্থলসীমা চুক্তি এর উজ্জ্বল সাক্ষী। করোনার এই কঠিন সময়েও উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে।
আমরা মিলিতভাবে ‘সার্ক কোভিড ফান্ড’ চালু করেছি। আমাদের মানবসম্পদকে প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছি। ভারত অত্যন্ত আনন্দিত যে ভারতে তৈরি টিকা আমাদের বাংলাদেশের ভাই ও বোনেদের কাজে লাগছে। আমার মনে আছে, এ বছর ২৬ জানুয়ারিতে যে দৃশ্য দেখেছি, ভারতের সাধারণতন্ত্র দিবসে বাংলাদেশের সশস্ত্র সেনার তিনটি বাহিনীর সৈনিকরা ‘শোন একটি মুজিবুরের থেকে’ গানের তালে দিল্লির রাজপথে প্যারেড করেছিল।
ভারত এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সদ্ভাবপূর্ণ, পারস্পরিক বিশ্বাস পূর্ণ এমনই অসংখ্য মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছে। বন্ধুগণ, ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ককে শক্তিশালী করার জন্য উভয় দেশের নবীন প্রজন্মের মধ্যে উন্নততর যোগাযোগ গড়ে ওঠা অত্যন্ত প্রয়োজন। ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের ৫০ বছর উপলক্ষে আমি বাংলাদেশের ৫০ জন নবীন শিল্পোদ্যোগীকে ভারতে আমন্ত্রণ জানাতে চাই।
তাঁরা ভারতে আসবেন, আমাদের স্টার্ট-আপ এবং উদ্ভাবন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হবেন, ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করবেন। আমরাও তাঁদের কাছ থেকে শিখব, তাঁরাও শেখার সুযোগ পাবেন। আমি এর পাশাপাশি বাংলাদেশের নবীন প্রজন্মের জন্য সুবর্ণ জয়ন্তী ছাত্র বৃত্তিও ঘোষণা করছি।
বন্ধুগণ,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানজি বলেছিলেন, “বাংলাদেশ ইতিহাসে, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকবে। বাংলাকে দাবিয়ে রাখতে পারে এমন কোনও শক্তি নেই। বাংলাদেশ অবশ্যই স্বাধীন হবে।”
অর্থাৎ, কারোর এত শক্তি নেই যে বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখতে পারে। বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণায় ছিল বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরোধীদের জন্য সতর্কতাবাণী আর বাংলাদেশের সামর্থ্য সম্পর্কে বিশ্বাস। আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে আজ শেখ হাসিনাজির নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বে নিজের পরাক্রম দেখাচ্ছে। বাংলাদেশ গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে যাদের আপত্তি ছিল, বাংলাদেশের অস্তিত্ব নিয়ে যাদের আশঙ্কা ছিল, তাদের সকলকে আজ বাংলাদেশ ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে।
বন্ধুগণ,
আমাদের সঙ্গে কাজি নজরুল ইসলাম এবং গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমান ঐতিহ্যের প্রেরণা রয়েছে।
গুরুদেব বলেছিলেন -
“কাল নাই,
আমাদের হাতে;
তাড়াতাড়ি করো তাই,
সবে মিলে;
দেরী কারো নাহি
সহে,
কভু”
অর্থাৎ, আমাদের নষ্ট করার মতো কোনও সময় নেই। আমাদের পরিবর্তনের জন্য এগিয়ে যেতে হবে। এখন আমরা আর দেরি করতে পারব না। একথা ভারত ও বাংলাদেশ – উভয়ের জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য।
আমাদের কোটি কোটি জনগণের জন্য, তাঁদের ভবিষ্যতের জন্য, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধের জন্য, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য, আমাদের লক্ষ্য এক। সেজন্য আমাদের প্রচেষ্টাও এভাবেই একজোট হওয়ার। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ভারত-বাংলাদেশ মিলেমিশে দ্রুতগতিতে উন্নতি করবে।
আমি আরেকবার এই পবিত্র উৎসব উপলক্ষে বাংলাদেশের সকল নাগরিককে অনেক অনেক শুভকামনা জানাই, আর হৃদয় থেকে আপনাদের সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই।
ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চিরজীবী হোক।
এই শুভকামনা জানিয়ে আমি আমার বক্তব্য সম্পূর্ণ করছি।
জয় বাংলা!
জয় হিন্দ!