রবীন্দ্রনাথ বাংলাকে নিয়ে যতটা গর্বিত ছিলেন, ভারতের বৈচিত্র্য নিয়েও ছিল তাঁর সমান গর্ব : প্রধানমন্ত্রী
দেশই সর্বাগ্রে – এই মানসিকতা সমাধানের দিশা দেখাতে পারে : প্রধানমন্ত্রী
বাংলা এক ভারত – শ্রেষ্ঠ ভারতের প্রেরণা : প্রধানমন্ত্রী
আত্মনির্ভর ভারত গঠনে জাতীয় শিক্ষা নীতি এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক : প্রধানমন্ত্রী

নয়াদিল্লি, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

 

পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল শ্রী জগদীপ ধনকড়জি, বিশ্বভারতীয় উপাচার্য প্রফেসর বিদ্যুৎ চক্রবর্তীজি, শিক্ষকগণ, কর্মচারীগণ এবং আমার প্রিয় প্রাণবন্ত নবীন বন্ধুরা!

 

গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে অদ্ভূত ঐতিহ্য ভারতমাতাকে সমর্পণ করেছেন তার অংশ হয়ে ওঠা, আপনাদের মতো সকল বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হওয়া অত্যন্ত প্রেরণার, আনন্দের এবং একটি নতুন প্রাণশক্তিতে ভরপুর হয়ে ওঠার উৎস। খুব ভালো হত যদি আমি এই পবিত্র মাটিতে নিজে এসে আপনাদের মাঝে এই অনুষ্ঠানে শরিক হতে পারতাম। কিন্তু যে ধরনের নতুন নিয়মে বেঁচে থাকতে হচ্ছে আর সেজন্য আজ মুখোমুখি দেখা না হলেও, দূর থেকে হলেও আপনাদের সবাইকে প্রণাম জানাই, এই পবিত্র মাটিকে প্রণাম জানাই। এবার কিছুদিন পরই আমার দ্বিতীয়বার আপনাদের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ হয়েছে। আপনাদের জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান উপলক্ষে সমস্ত নবীন বন্ধুদের, তাঁদের মা-বাবা এবং গুরুজনদের অনেক অনেক অভিনন্দন জানাই, অনেক অনেক শুভকামনা জানাই।

 

বন্ধুগণ,

 

আজ একটি অত্যন্ত পবিত্র উপলক্ষ, অত্যন্ত প্রেরণার দিন। আজ ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের জন্মজয়ন্তী। আমি সমস্ত দেশবাসীকে ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের জয়ন্তী উপলক্ষে অনেক অনেক শুভকামনা জানাই। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরজিও শিবাজি উৎসবের নামে বীর শিবাজিকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন –

 

“কোন দূর শতাব্দের কোন- এক অখ্যাত দিবসে

নাহি জানি আজি

মারাঠার কোন শৈলে অরণ্যের অন্ধকারে ব’সে,

হে রাজা শিবাজি,

তব ভাল উদ্ভাসিয়া এ ভাবনার তড়িৎ প্রভাবৎ

এসেছিল নামি –

‘একধর্মরাজ্যপাশে খণ্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারত

বেঁধে দেব আমি’।”

 

অর্থাৎ, এক শতাব্দীরও আগে কোনও এক নামহীন দিনে আমি সেদিনকে আর জানি না, কোনও পর্বতের উচ্চশিখরে, কোনও ঘন বনে, হে রাজা শিবাজি, আপনার মনে কি এই ভাবনা একটি বিদ্যুতের ঝলকের মতো আসেনি? এই ভাবনা কি আসেনি যে ছিন্নভিন্ন এই দেশের মাটিকে একসূত্রে বাঁধতে হবে? এজন্য কি আমার নিজেকে সমর্পণ করতে হবে? এই পংক্তিগুলিতে ছত্রপতি শিবাজির কাছ থেকে প্রেরণা নিয়ে ভারতের একতা, ভারতকে একসূত্রে গাঁথার আহ্বান ছিল। দেশের ঐক্যকে মজবুত করা এই ভাবনাগুলি আমাদের ভুললে চলবে না। প্রতি মুহূর্তে, জীবনের প্রত্যেক পদক্ষেপে দেশের একতা ও অখণ্ডতার এই মন্ত্রকে আমাদের মনে রাখতে হবে, আর এগুলি নিয়ে আমাদের বেঁচেও থাকতে হবে। এটাই তো আমাদের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বার্তা।

 

বন্ধুগণ,

 

আপনারা কেবলই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ নন, আপনারা একটি জীবন্ত পরম্পরার ধারক ও বাহক। গুরুদেব যদি বিশ্বভারতীকে নিছকই একটি বিশ্ববিদ্যালয় রূপে দেখতে চাইতেন তাহলে এর নাম গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি কিংবা অন্য কোনও নাম দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি এর নাম রেখেছেন বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি বলেছিলেন, “বিশ্বভারতী অন্যদেরকে ভারতের শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতির আতিথেয়তা এবং অপরকে গ্রহণ করার অধিকার ও দায়বদ্ধতাকে তুলে ধরে।”

 

বিশ্বভারতী থেকে গুরুদেবের প্রত্যাশা ছিল যে, এখানে যাঁরা শিখতে আসবেন, তাঁরা গোটা বিশ্বকে ভারত এবং ভারতীয়ত্বের দৃষ্টিতে দেখবেন। গুরুদেবের মডেল ব্রহ্ম, ত্যাগ এবং আনন্দ – এই মূল্যবোধগুলির প্রেরণায় গড়ে উঠেছিল। সেজন্য তিনি বিশ্বভারতীকে এমন একটি শিক্ষার জায়গা করে তুলেছেন যা ভারতের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে ধারণ করে, ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা করে এবং তা দিয়ে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতম ব্যক্তির সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য কাজ করে। এই শিষ্টাচার আমি আগে এখান থেকে পাশ করে বেরিয়ে যাওয়া ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে দেখেছি। আপনাদের কাছ থেকেও দেশ এটাই প্রত্যাশা করে।

 

বন্ধুগণ,

 

গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্য বিশ্বভারতী শুধুই জ্ঞান প্রদানকারী একটি প্রতিষ্ঠান ছিল না। এটা ভারতীয় সংস্কৃতির শীর্ষে পৌঁছনোর লক্ষ্যে একটা প্রচেষ্টা ছিল, যাকে আমরা বলি – নিজেকে পাওয়া। যখন আপনারা নিজেদের ক্যাম্পাসে প্রতি বুধবার উপাসনার জন্য মিলিত হতেন, তখন নিজের সঙ্গেই সাক্ষাৎকার সম্পন্ন হত। যখন আপনারা গুরুদেব দ্বারা শুরু করা এই সমারোহে মিলিত হতেন, তখন নিজের সঙ্গেই সাক্ষাৎকারের একটি সুযোগ হত। যখন গুরুদেব বলতেন – “আলো আমার আলো ওগো আলো ভুবন ভরা” তখন সেই আলোর জন্যই আহ্বান করতেন যা আমাদের চেতনাকে জাগ্রত করে। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানতেন, বৈচিত্র্য থাকবে, ভিন্ন ভিন্ন ভাবধারা থাকবে, কিন্তু এসব কিছুকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের নিজেদেরকেও খুঁজতে হবে। তিনি বাংলার জন্য লিখেছিলেন –

 

“বাংলার মাটি,

বাংলার জল

বাংলার বায়ু, বাংলার ফল

পূণ হউক, পূণ্য হউক, পূণ্য হউক

হে ভগবান।”

 

এর পাশাপাশি তিনি অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে ভারতের বৈচিত্র্যেরও গৌরব গান করতেন। তিনি বলতেন –

 

“হে মোর চিত্ত, পূণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে

এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।

হেথায় দাঁড়ায়ে দু’বাহু বাড়ায়ে নমি নরদেবতারে,...।”

 

আর এটা গুরুদেবেরই বিশাল দৃষ্টিভঙ্গি যে তিনি শান্তিনিকেতনের খোলা আকাশের নিচে বিশ্ব মানবকে দেখতেন। তিনি লিখেছেন –

 

“এসো কর্মী, এসো জ্ঞানী,

এসো জনকল্যাণী, এসো তাপসরাজ হে

এসো হে ধী শক্তি সম্পদ মুক্ত বোধ সমাজ হে”

 

হে শ্রমিক বন্ধুরা, হে জ্ঞানী বন্ধুরা, হে সমাজসেবীরা, হে সন্ন্যাসী, সমাজের সকল সচেতন ব্যক্তিগণ, আসুন সমাজের মুক্তির জন্য সবাই মিলে কাজ করি। আপনাদের ক্যাম্পাসে জ্ঞানপ্রাপ্তির জন্য এক মুহূর্ত যাঁরা কাটান, তাঁরা সৌভাগ্যবান কারণ তাঁরা গুরুদেবের এই দৃষ্টিভঙ্গি রপ্ত করে নিতে পারেন।

 

বন্ধুগণ,

 

বিশ্বভারতী তো নিজেই জ্ঞানের উন্মুক্ত সমুদ্র যার ভিত্তিই শিক্ষার জন্য রাখা হয়েছিল। জ্ঞানের সৃষ্টিশীলতার কোনও সীমা থাকে না। এই ভাবনা নিয়ে গুরুদেব এই মহান বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। আপনাদের এটাও সব সময় মনে রাখতে হবে যে জ্ঞান, ভাবনা-চিন্তা এবং দক্ষতা স্থির নয়, পাথরের মতো নয়, জীবন্ত। এটি সততঃ চলতে থাকা প্রক্রিয়া, আর এতে ‘কোর্স কারেকশন’-এর সুযোগও সব সময়েই থাকবে। কিন্তু জ্ঞান এবং শক্তি দুটি দায়িত্ব নিয়ে আসে।

 

যেভাবে শাসন ক্ষমতায় থেকে সংযম রক্ষা করতে হয় এবং সংবেদনশীল থাকতে হয়, তেমনই প্রত্যেক বিদ্বানকে, প্রত্যেক জ্ঞানীকে তাঁদের প্রতি দায়িত্ববান থাকতে হয় যাঁদের কাছে সেই শক্তি নেই। আপনারা জ্ঞান শুধু নিজের জন্য নয়, সমাজের জন্য, দেশের জন্য আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ঐতিহ্যস্বরূপ। আপনাদের জ্ঞান, আপনাদের দক্ষতা একটি সমাজকে, একটি গৌরবান্বিত করে তুলছে আর তা সমাজকে বদনাম এবং সর্বনাশের অন্ধকারে ধাক্কা দিতে পারে। ইতিহাস এবং বর্তমানে এইরকম অনেক উদাহরণ রয়েছে।

 

আপনারা দেখুন, যাঁরা বিশ্বে সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে, হিংসা ছড়াচ্ছে, তাঁদের মধ্যেও অনেক উচ্চশিক্ষিত দক্ষ মানুষ রয়েছেন। অন্যদিকে, এমন মানুষেরাও রয়েছেন যাঁরা করোনার মতো বিশ্বব্যাপী মহামারী থেকে বিশ্বকে মুক্তি দেওয়ার জন্য দিন-রাত জীবন বাজি রেখে কাজ করে যাচ্ছেন। হাসপাতালে কাজ করছেন, বিভিন্ন গবেষণাগারে কাজ করছেন।

এটা কেবল দর্শনের প্রশ্ন নয়। মূল বিষয় হল মানসিকতা। কোন মানসিকতা থেকে আপনি এটা করছেন, এর ওপর নির্ভর করে আপনার মানসিকতা ইতিবাচক না নেতিবাচক। সুযোগ দুটি ক্ষেত্রেই রয়েছে। পথও দুটি ক্ষেত্রেই উন্মুক্ত। আপনি সমস্যার অংশ হতে চান নাকি সমাধানের সেটা ঠিক করাই আপনার হাতে থাকে। যদি আপনারা সেই শক্তি, সেই সামর্থ্য, সেই বুদ্ধি, সেই বৈভবকে সৎ কাজে লাগাই তাহলে একরকম পরিণাম পাওয়া যাবে আর যদি দুষ্কর্মে লাগান তাহলে আরেক রকম পরিণাম পাওয়া যাবে। আমরা যদি কেবলই নিজেদের স্বার্থ দেখি, নিজেদের ভালো করার কথা ভাবি, তাহলে সব সময়েই চারদিকে সমস্যার পাহাড় দেখতে পাই, অসন্তোষ দেখতে পাই, আক্রোশ দেখতে পাই। স্বার্থের ওপর উঠে যদি দেশ সবার আগে, এই ভাবনা নিয়ে কাজ করতে থাকি, তাহলে প্রত্যেক সমস্যার মাঝে সমাধান খোঁজার ইচ্ছা জাগে আর সমাধান খুঁজেও পাওয়া যায়। খারাপ শক্তির মধ্যেও আপনাদের ভালো খোঁজার অথবা তাকে ভালোয় পরিবর্তন করার ইচ্ছা জাগবে আর আপনারা পরিস্থিতি বদলাতেও পারবেন। আপনারা নিজেরাই এক একজন মূর্তিমান সমাধান হয়ে উত্তরণের পথে এগিয়ে যাবেন।

 

আপনাদের ইচ্ছাশক্তি যদি পরিষ্কার হয় আর নিষ্ঠা যদি ভারতমাতার প্রতি থাকে, তাহলে আপনাদের প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি আচরণ, আপনাদের প্রত্যেক কৃতি কোনও না কোন সমস্যার সমাধানের দিকে এগিয়ে যাবে। সাফল্য এবং অসাফল্য আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ ঠিক করে না। আপনারা সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর যেমন ভেবেছিলেন তেমন পরিণাম নাও পেতে পারেন। কিন্তু তবুও সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পাবেন না। একজন নতুন প্রজন্মের মানুষ রূপে যখন কোনও সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পাবেন, তখনই আপনাদের জন্য সবচাইতে বড় সঙ্কট আসবে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস যদি চলে যায়, তাহলে মনে করবেন আপনাদের তারুণ্যও চলে যাবে। আপনারা আর নবীন থাকবেন না।

 

যতক্ষণ পর্যন্ত ভারতের যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে নতুন কিছু করা, ঝুঁকি নেওয়া এবং এগিয়ে যাওয়ার উদ্দীপনা থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমি যখন ভাবি ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশে এত বিপুল সংখ্যক নবীন প্রজন্মের মানুষ রয়েছেন তখন আমার ভরসা আরও মজবুত হয়, আমার বিশ্বাস আরও শক্তিশালী হয়। আর সেজন্য আপনাদের যে সমর্থন প্রয়োজন, যে আবহ প্রয়োজন তার জন্য আমি নিজে এবং আমার নেতৃত্বাধীন সরকার … শুধু তাই নয়, ১৩০ কোটি সঙ্কল্পে ভরপুর জনগণের স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকা দেশও আপনাদের সমর্থনে দাঁড়িয়ে আছে।

 

বন্ধুগণ,

 

বিশ্বভারতীর শতবার্ষিকীর ঐতিহাসিক ক্ষণে যখন আমি আপনাদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, তখন ভারতের আত্মসম্মান এবং আত্মনির্ভরতার জন্য আপনাদের প্রত্যেকের, দেশের প্রত্যেক নবীন প্রজন্মের মানুষের অবদানের কথা বলেছিলাম। এখান থেকে যাওয়ার পর জীবনের প্রতিটি পরবর্তী পর্যায়ে আপনাদের মতো নবীন মানুষেরা অনেক ধরনের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হবেন।

 

বন্ধুগণ,

 

আজ যেমন ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমরা গর্বিত, তেমনই আজ আমার ধর্মপালজির কথা মনে পড়ছে। আজ মহান গান্ধীবাদী ধর্মপালজিরও জন্মজয়ন্তী। তাঁর একটি গ্রন্থ হল ‘দ্য বিউটিফুল ট্রি – ইন্ডিজেনাস ইন্ডিয়ান এডুকেশন ইন দ্য এইটিনথ সেঞ্চুরি’।

 

আজ আপনাদের সঙ্গে কথা বলার মাধ্যমে এই পবিত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলার সময়ে আমার মনে হল যে তাঁর কথা অবশ্যই বলি। বাংলার মাটি, প্রাণশক্তিতে পরিপূর্ণ মাটির নবীন প্রজন্মের সঙ্গে যখন কথা বলছি। তখন আমার মনে স্বাভাবিকভাবেই ধর্মপালজির বিষয়ে কথা বলার ইচ্ছা জেগেছে। ধর্মপালজি তাঁর এই গ্রন্থে থমাস মুনরোর করা একটি জাতীয় শিক্ষা সার্ভের বর্ণনা করেছেন।

 

১৮২০-তে করা এই শিক্ষা সার্ভেতে এমন কিছু বিষয় রয়েছে যা আমাদের সবাইকে অবাক করে দেয়, আর গর্বেও ভরিয়ে দেয়। ওই সার্ভেতে ভারতে সাক্ষরতার হার অনেক উঁচু দেখানো হয়েছিল। সেই সার্ভেতে লেখা ছিল কিভাবে প্রতিটি গ্রামে একাধিক গুরুকুল ছিল। আর যে যে গ্রামে মন্দির ছিল, সেগুলি শুধুই পুজো-পাঠের জায়গা ছিল না। সেখানে শিক্ষাকে উৎসাহ প্রদানকারী একটি অত্যন্ত পবিত্র কাজের সঙ্গেও ওই মন্দিরগুলি যুক্ত থাকত। এই মন্দিরগুলি গুরুকুল পরম্পরাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। প্রত্যেক ক্ষেত্র, প্রত্যেক সরকারের সময় তখন মহাবিদ্যালয়গুলিকে অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে দেখা হত। তাঁদের কত বড় নেটওয়ার্ক ছিল! সেই সময় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও অনেক ছিল।

 

ভারতের জনগণের ওপর ব্রিটিশ এডুকেশন সিস্টেম চাপিয়ে দেওয়ার আগে থমাস মুনরো ভারতীয় শিক্ষা পদ্ধতি এবং ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার শক্তিকে অনুভব করেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন যে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কতটা সংবেদনশীল ও উজ্জীবিত। এটা ২০০ বছর আগের কথা বলছি। এই গ্রন্থে উইলিয়াম অ্যাডামের উল্লেখও রয়েছে, যিনি লিখে গেছেন যে, ১৮৩০-এ বাংলা এবং বিহারে ১ লক্ষেরও বেশি গ্রামীণ বিদ্যালয় ছিল।

বন্ধুগণ,

 

এই তথ্যগুলি আমি আপনাদের সামনে এজন্য বিস্তারিতভাবে তুলে ধরার কারণ হল, আপনাদের জানা প্রয়োজন যে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন ছিল, কতটা গৌরবপূর্ণ ছিল, কিভাবে তা প্রত্যেক মানুষের কাছে পৌঁছেছিল। আর তারপর ইংরেজ শাসনের সময় এবং পরবর্তী সময়ে আমরা কোথা থেকে কোথায় পৌঁছেছি, কী করুণ অবস্থা হয়েছে!

 

গুরুদেব বিশ্বভারতীতে যে শিক্ষা ব্যবস্থা বিকশিত করেছেন, যে পদ্ধতি বিকশিত করেছেন, তা ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিদেশি শিক্ষা ব্যবস্থার শৃঙ্খলমুক্ত করার ক্ষেত্রে, ভারতকে আধুনিক করে তোলার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল। আজ ভারতে যে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি রচনা করা হয়েছে, সেটাও পুরনো শৃঙ্খলগুলি ভাঙার পাশাপাশি, ছাত্রছাত্রীদের নিজস্ব সামর্থ্য প্রদর্শনের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়। এই শিক্ষানীতি আপনাদের ভিন্ন ভিন্ন বিষয় পড়ার স্বাধীনতা দেয়। এই শিক্ষানীতি আপনাদের মাতৃভাষায় পড়াশোনা করার বিকল্প দেয়। এই শিক্ষানীতি শিল্পোদ্যোগ এবং স্বনির্ভরতাকে উৎসাহ দেয়।

 

এই শিক্ষানীতি গবেষণা ও উদ্ভাবনে জোর দেয়। আত্মনির্ভর ভারত নির্মাণের জন্য এই শিক্ষানীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় তৈরি করবে। দেশে একটি শক্তিশালী গবেষণা ও উদ্ভাবনের পরিকাঠামো গড়ে তোলার জন্য সরকার নিয়মিত কাজ করছে। সম্প্রতি সরকার দেশ এবং বিশ্বের কয়েক লক্ষ জার্নালের ফ্রি অ্যাক্সেস দেশের গবেষকদের সামনে উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বছর কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটেও গবেষণার জন্য ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আগামী পাঁচ বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

 

বন্ধুগণ,

 

ভারতের আত্মনির্ভরতা দেশের কন্যাদের আত্মবিশ্বাস ছাড়া সম্ভব নয়। সেজন্যে দেশে লিঙ্গ অন্তর্ভুক্তিকরণ তহবিলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই নীতিতে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকেই ‘কার্পেন্ট্রি’ থেকে শুরু করে ‘কোডিং’ পর্যন্ত অনেক দক্ষতা উন্নয়নের প্রকল্প সামিল করা হয়েছে, যে দক্ষতাগুলি থেকে এতদিন মেয়েদেরকে দূরে রাখা হত। শিক্ষানীতি রচনার সময় মেয়েদের স্কুলছুটের হার বেশি হওয়ার কারণগুলি নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করা হয়েছে। সেজন্য পড়াশোনায় নিরন্তরতা বজায় রাখতে ডিগ্রি কোর্সে এন্ট্রি এবং একজিটের অপশন রেখে প্রত্যেক বছরের ক্রেডিট যাতে পাওয়া যায় তার একটি নতুন ধরনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

 

বন্ধুগণ,

 

বাংলা অতীতে ভারতের সমৃদ্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছে। আর এটা অত্যন্ত গৌরবের বিষয় যে বাংলা ‘এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারত’-এর প্রেরণাস্থল ছিল এবং কর্মস্থলও ছিল। বিশ্বভারতীর শতাব্দী সমারোহের অনুষ্ঠানে আলোচনার সময় আমি এই বিষয়ে বিস্তারিত বলেছিলাম। আজ যখন ভারত একবিংশ শতাব্দীর জ্ঞান-নির্ভর অর্থনীতির দিকে এগিয়ে চলেছে, তখনও সমস্ত দৃষ্টি আপনাদের ওপর রয়েছে, আপনাদের মতো নবীন প্রজন্মের মানুষদের ওপর রয়েছে, বাংলার জ্ঞান-সম্পদের ওপর রয়েছে, বাংলার প্রাণশক্তির প্রাচুর্য্যে ভরপুর নাগরিকদের ওপর রয়েছে। ভারতের জ্ঞান এবং ভারতের পরিচয়কে বিশ্বের কোণায় কোণায় পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বভারতীর বড় ভূমিকা রয়েছে।

 

এ বছর আমরা স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষে প্রবেশ করতে চলেছি। বিশ্বভারতীর প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পক্ষ থেকে দেশের জন্য সবচাইতে বড় উপহার হবে যদি ভারতের ছবিকে আরও উজ্জ্বল করার জন্য আপনারা সবাই মিলে, বিশেষ করে, আপনাদের চারপাশের নবীন প্রজন্মের অধিকাংশ মানুষকে সচেতন করেন। ভারত যেরকম, মানবতা, আত্মীয়তা ও বিশ্বকল্যাণের ভাবনা যেভাবে ভারতীয়দের রক্তের প্রতিটি কণায় প্রবাহিত হয়, তার অনুভব দেশের বাকি মানুষদের মনে সঞ্চারিত করতে, সমগ্র মানবজাতির মনে সঞ্চারিত করতে বিশ্বভারতীকে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির নেতৃত্বও দিতে হবে।

 

আমার অনুরোধ, আগামী ২৫ বছরের জন্য বিশ্বভারতীর শিক্ষার্থীরা সবাই মিলে একটি দৃষ্টিভঙ্গির তথ্যভাণ্ডার গড়ে তুলুন। যখন স্বাধীনতার শতবর্ষ পূর্ণ হবে, ২০৪৭-এ যখন ভারত তার স্বাধীনতার শততম বর্ষপূর্তি পালন করবে, তখন পর্যন্ত বিশ্বভারতীর ২৫টি সব থেকে বড় লক্ষ্য কী হবে, সেগুলি এই দৃষ্টিভঙ্গির তথ্যভাণ্ডারে রাখা যেতে পারে। আপনারা নিজেদের গুরুজনদের সঙ্গে ভাবনা-চিন্তা করুন, কিন্তু কোনও না কোন লক্ষ্য অবশ্যই নির্ধারিত করুন।

 

আজকাল অনেকেই নিজের নিজের ক্ষেত্রে অনেক গ্রামকে দত্তক নিয়ে থাকেন। এই ভাবনার সূত্রপাত কি প্রত্যেক গ্রামকে আত্মনির্ভর করে তোলার মাধ্যমে হতে পারে? পুজনীয় বাপু যে ‘গ্রাম-রাজ্য’-এর কথা বলতেন, ‘গ্রাম স্বরাজ’-এর কথা বলতেন, আমার নবীন প্রজন্মের বন্ধুরা, গ্রামের মানুষ, সেখানকার বিভিন্ন হস্তশিল্পী ও কৃষকদের তেমনি আত্মনির্ভর করে তুলুন। তাঁদের উৎপাদিত পণ্যকে বিশ্বের বড় বড় বাজারে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে অনুঘটক হয়ে উঠুন।

 

বিশ্বভারতী, যা বীরভূম জেলার বোলপুরের মূল ভিত্তি; এখানকার আর্থিক, প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক – সমস্ত গতিবিধি বিশ্বভারতী নির্ভর। বিশ্বভারতী এই এলাকার জন্য একটি জীবন্ত একক। এই অঞ্চলের জনগণ ও সমাজকে ক্ষমতায়িত করার মাধ্যমেই আপনাদের বৃহৎ দায়িত্ব পালন করতে হবে।

 

আপনারা নিজেদের প্রত্যেক প্রচেষ্টায় সফল হোন। আপনাদের সঙ্কল্পগুলি সিদ্ধিতে পরিবর্তিত হোক। যে উদ্দেশ্যগুলি নিয়ে বিশ্বভারতীতে পা রেখেছিলেন, যে শিষ্টাচারে সমৃদ্ধ হয়ে এবং যে জ্ঞান-সম্পদ নিয়ে আজ আপনারা বিশ্বভারতী থেকে বৃহত্তর কর্মবিশ্বে পা রাখছেন, সেই কর্মবিশ্ব আজ আপনাদের থেকে অনেক কিছু চায়, অনেক কিছু প্রত্যাশা করে। আর এই মাটি আপনাদেরকে এতদিন লালন-পালন করেছে, আপনাদের বিশ্বের প্রত্যাশা পূরণের যোগ্য করে তুলেছে, মানবজাতির প্রত্যাশা পূরণের যোগ্য করে তুলেছে। আপনারা আত্মবিশ্বাসে ভরপুর, আপনারা সঙ্কল্পের প্রতি দায়বদ্ধ, শিষ্টাচারে পুলকিত আপনাদের তারুণ্য। এইসব সম্পদ আপনাদের কাজে লাগবে, দেশের কাজে লাগবে; এগুলি আপনারা পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত করবেন। একবিংশ শতাব্দীর ভারত যেন বিশ্বমঞ্চে তার সঠিক স্থান পায় তা সুনিশ্চিত করতে আপনাদের সামর্থ্য অনেক বড় শক্তি রূপে উঠে আসবে এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আর আপনাদের মধ্যে থেকে আপনাদের সহযাত্রী হতে পারার সুবাদে আজ এই গৌরবপূর্ণ মুহূর্তে আমি নিজেকে ধনবান মনে করছি। আসুন, আমরা সবাই মিলে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে পবিত্র মাটি আমাদেরকে শিক্ষিত করেছে, শিষ্টাচারে ঋদ্ধ করেছে, সেই মাটির জন্য কাজ করতে এগিয়ে যাই, এটাই আমার আপনাদের প্রতি আহ্বান। সেজন্যে আপনাদের শুভকামনা জানাই।

 

আমার পক্ষ থেকে অনেক অনেক শুভকামনা। আপনাদের মা-বাবাদের আমার প্রণাম। আপনাদের গুরুজনদের আমার প্রণাম।

 

আমার পক্ষ থেকে অনেক অনেক ধন্যবাদ!

 

Explore More
৭৮ তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে নয়াদিল্লির লালকেল্লার প্রাকার থেকে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ১৫ই আগস্ট , ২০২৪

জনপ্রিয় ভাষণ

৭৮ তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে নয়াদিল্লির লালকেল্লার প্রাকার থেকে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ১৫ই আগস্ট , ২০২৪
Snacks, Laughter And More, PM Modi's Candid Moments With Indian Workers In Kuwait

Media Coverage

Snacks, Laughter And More, PM Modi's Candid Moments With Indian Workers In Kuwait
NM on the go

Nm on the go

Always be the first to hear from the PM. Get the App Now!
...
PM Modi meets the Amir of Kuwait
December 22, 2024

Prime Minister Shri Narendra Modi met today with the Amir of Kuwait, His Highness Sheikh Meshal Al-Ahmad Al-Jaber Al-Sabah. This was the first meeting between the two leaders. On arrival at the Bayan Palace, he was given a ceremonial welcome and received by His Highness Ahmad Al-Abdullah Al-Ahmad Al-Sabah, Prime Minister of the State of Kuwait.

The leaders recalled the strong historical and friendly ties between the two countries and re-affirmed their full commitment to further expanding and deepening bilateral cooperation. In this context, they agreed to elevate the bilateral relationship to a ‘Strategic Partnership’.

Prime Minister thanked His Highness the Amir for ensuring the well-being of over one million strong Indian community in Kuwait. His Highness the Amir expressed appreciation for the contribution of the large and vibrant Indian community in Kuwait’s development.

Prime Minister appreciated the new initiatives being undertaken by Kuwait to fulfill its Vision 2035 and congratulated His Highness the Amir for successful holding of the GCC Summit earlier this month. Prime Minister also expressed his gratitude for inviting him yesterday as a ‘Guest of Honour’ at the opening ceremony of the Arabian Gulf Cup. His Highness the Amir reciprocated Prime Minister’s sentiments and expressed appreciation for India's role as a valued partner in Kuwait and the Gulf region. His Highness the Amir looked forward to greater role and contribution of India towards realisation of Kuwait Vision 2035.

 Prime Minister invited His Highness the Amir to visit India.