ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ,
বিশিষ্ট প্রতিনিধিবর্গ,
নমস্কার!
ভারতে স্বাগত।
বন্ধুরা,
আপনারা, ব্যবসাজগতের নেতারা, এমন এক সময়ে ভারতে এসেছেন, যখন আমাদের সারা দেশে এক উৎসবমুখর পরিবেশ রয়েছে। ভারতে প্রতি বছর উৎসবের যে মরশুম চলে, তা এবার কিছুটা এগিয়ে এসেছে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ, এমনকি ব্যবসায়িক মহলও উৎসবের এই সময়ে উদযাপনে মেতে ওঠে। এই বছর চাঁদে চন্দ্রযানের সফল অবতরণকে কেন্দ্র করে উৎসব শুরু হয়ে গেছে ২৩ অগাস্ট থেকে। ভারতের চন্দ্র অভিযানের এই সাফল্যে আমাদের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। একইসঙ্গে ভারতীয় শিল্পমহলও এই অভিযানকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেছে। চন্দ্রযানে ব্যবহৃত বহু উপাদান নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে তৈরি করে দিয়েছে আমাদের শিল্পমহল, বেসরকারি কোম্পানী এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি সংস্থাগুলি। সেদিক থেকে দেখলে এই সাফল্য যতটা বিজ্ঞানের, ততটা শিল্পমহলেরও। আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, ভারতের পাশাপাশি সারা বিশ্ব এই সাফল্য উদযাপন করছে। এই উদযাপন হল দায়িত্বশীল মহাকাশ কর্মসূচি পরিচালনার। এই উদযাপন দেশের উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হওয়ার। এই উদযাপন উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গির। এই উদযাপন হল মহাকাশ প্রযুক্তিতে সাম্য ও সুস্থিতি আনার। এটাই বি২০ শীর্ষ সম্মেলনের মূল ভাবনা – RAISE. এখানে R হল রেসপনসিবিলিটি অর্থৎ দায়িত্বশীলতা, A হল অ্যাকসিলারেন্স অর্থাৎ গতি বৃদ্ধি, I হল ইনোভেশন অর্থাৎ উদ্ভাবন, S হল সাসটেনেবিলিটি অর্থাৎ সুস্থিতি এবং E হল ইক্যুয়ালিটি অর্থাৎ সাম্য। এক কথায় বললে, এটাই হল মানবতা। এটাই এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ।
বন্ধুরা,
বি২০-র মূল ভাবনায় ‘RAISE’ এর মধ্যে যে I রয়েছে তা যেমন ইনোভেশন বা উদ্ভাবনকে সূচিত করে, তেমনি এর আর এক অর্থ হল ইনক্লুসিভনেস বা অন্তর্ভুক্তিকরণ। সেই ভাবনা থেকেই আমরা আফ্রিকান ইউনিয়নকে জি২০-র স্থায়ী সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছি। বি২০-তেও আফ্রিকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। ভারত মনে করে, এই ফোরাম যত বেশি করে অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়ে উঠবে, এর প্রভাব ততই বৃদ্ধি পাবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায়, বিকাশের সুস্থিতিতে এবং যে সিদ্ধান্তগুলি এখানে নেওয়া হচ্ছে তার সফল বাস্তবায়নে সহায়ক হবে।
বন্ধুরা,
বলা হয় যে, যেকোনো সঙ্কট ও প্রতিকূলতা কিছু শিক্ষা নিয়ে আসে, আমাদের মূল্যবান কিছু শিক্ষা দেয়। মাত্র ২-৩ বছর আগে সারা বিশ্ব অতিমারির সম্মুখীন হয়েছিল, ১০০ বছরের মধ্যে এমন সঙ্কট আর আসেনি। এই সঙ্কট প্রতিটি দেশ, প্রতিটি সমাজ, প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিটি কর্পোরেটকে একটি মূল্যবান শিক্ষাও দিয়েছে। তা হল, আমাদের এখন পারস্পরিক আস্থা নির্মাণে সব থেকে বেশি মনোযোগী হতে হবে। করোনা অতিমারির সময়ে বিশ্বজুড়ে এই পারস্পরিক আস্থা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। অবিশ্বাসের এই আবহে যে দেশ আপনাদের সামনে সংবেদনশীলতা, নম্রতা ও বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তা হল ভারত। শতাব্দীর বৃহত্তম সঙ্কটের মধ্যে বিশ্বকে ভারতের অমূল্য দান হল বিশ্বাস, পারস্পরিক আস্থা।
করোনার সময়ে যখন বিশ্বের প্রয়োজন ছিল, তখন ভারত বিশ্বের ফার্মেসি হয়ে দেড়শোটিরও বেশি দেশে ওষুধ সরবরাহ করেছিল। করোনা মোকাবিলার জন্য বিশ্বের যখন টিকার প্রয়োজন ছিল, ভারত তখন টিকার উৎপাদন বাড়িয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে। ভারতের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তার কাজের মধ্য দিয়েই ফুটে উঠেছে। আজ যখন দেশের ৫০টিরও বেশি শহরে জি২০ বৈঠকের আয়োজন করা হয়, তখন আপনারা সেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধেরই প্রতিফলন দেখতে পান। সেজন্যই ভারতের সঙ্গে আপনাদের অংশীদারিত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ভারত আজ বিশ্বের তরুণ প্রতিভার আঁতুড়ঘর। চতুর্থ প্রজন্মের শিল্প ক্ষেত্রে ভারত আজ ডিজিটাল বিপ্লবের মুখ হয়ে উঠেছে। ভারতের সঙ্গে আপনাদের বন্ধুত্ব যত সুদৃঢ় হবে, ততই বেশি করে সব পক্ষ সমৃদ্ধির দিকে এগোবে। আপনারা সকলেই জানেন, ব্যবসা এমন এক মাধ্যম যা সম্ভাবনাকে সমৃদ্ধিতে, প্রতিবন্ধকতাকে সুযোগে এবং আকাঙ্ক্ষাকে সাফল্যে রূপান্তরিত করার ক্ষমতা রাখে। ছোট হোক বা বড়, বিশ্বব্যাপী বা স্থানীয়, ব্যবসা সবার জন্য সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি নিশ্চিত করে। বিশ্বের ভবিষ্যৎ বিকাশ, ব্যবসার ভবিষ্যতের উপর নির্ভরশীল।
বন্ধুরা,
কোভিড ১৯-এর আগে এবং পরে বিশ্বে বহু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন কিছু পরিবর্তন এসেছে, যা অমোঘ। আগে যেভাবে দেখা হতো, এখন আর বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলকে সেভাবে দেখা সম্ভব নয়। বলা হতো, বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খল যতক্ষণ দক্ষভাবে কাজ করছে, ততক্ষণ চিন্তা করার কিছু নেই। কিন্তু দেখা গেলো, যখন বিশ্বের সব থেকে বেশি প্রয়োজন, তখনই এই সরবরাহ শৃঙ্খল সম্পূর্ণ ভেঙে পড়তে পারে। বিশ্ব যখন আজ এর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দিহান, তখন আমি আপনাদের আশ্বস্ত করে বলতে পারি, বন্ধুরা, ভারতই এই সমস্যার সমাধান। দক্ষ ও বিশ্বস্ত বিশ্ব সরবরাহ শৃঙ্খল গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভারত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। একে মজবুত করতে বিশ্বের ব্যবসাগুলিরও দায়িত্ব আছে। হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করলে আমরা অবশ্যই সফল হবো।
বন্ধুরা,
জি২০ দেশগোষ্ঠীর মধ্যে বিতর্ক ও আলোচনার এক প্রাণবন্ত মঞ্চ হিসেবে বিজনেস-২০-র আত্মপ্রকাশ ঘটায় আমি আনন্দিত। আমরা যখন বিশ্বের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সমাধান নিয়ে এই মঞ্চে আলোচনা করছি, তখন সুস্থিতিকে আমাদের বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে সুস্থিতিকে কেবল বিধিনিয়মের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলেই হবে না, একে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তুলতে হবে। বিশ্বব্যাপী ব্যবসাগুলি যাতে এই লক্ষ্যে বিশেষ পদক্ষেপ নেয় সেজন্য আমি তাঁদের কাছে আবেদন জানাচ্ছি। সুস্থিতি নিজেই একটি সুযোগ এবং ব্যবসায়িক মডেল। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে আমি বিষয়টা আপনাদের বোঝানোর চেষ্টা করছি। রাষ্ট্রসঙ্ঘ চলতি বছরটিকে আন্তর্জাতিক মিলেট বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছে। মিলেট শুধু এক অসাধারণ খাদ্যশস্যই নয়, এটি পরিবেশবান্ধব এবং ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের সহায়ক। এর থেকে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পেরও ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যভাবে বলতে গেলে, এই খাদ্যশস্য জীবনধারা এবং অর্থনীতি, দুইয়ের ক্ষেত্রেই চমৎকার সুযোগ এনে দেয়। বৃত্তাকার অর্থনীতিতে এই ধারণার প্রয়োগ, ব্যবসার জন্য প্রভূত সুযোগ সৃষ্টি করে। ভারতে আমরা দূষণমুক্ত জ্বালানির উপর বিশেষ জোর দিয়েছি। সৌরশক্তির ক্ষেত্রে আমরা যে সাফল্য অর্জন করেছি, গ্রীন হাইড্রোজেনের ক্ষেত্রেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটানোর লক্ষ্য আমাদের রয়েছে। ভারত এই প্রয়াসে সারা বিশ্বকে সঙ্গে নিতে চায়। সেজন্যই আন্তর্জাতিক সৌর জোট গঠন করা হয়েছে।
বন্ধুরা,
করোনা পরবর্তী বিশ্বে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, মানুষ এখন তাঁদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন হয়ে উঠেছেন। শুধু খাওয়ার টেবিলেই নয়, আমাদের কেনাকাটা, আমাদের খাদ্যাভ্যাস, আমাদের বিভিন্ন কাজকর্মের উপরেও এর প্রভাব পড়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা আগে ভেবে নিই, স্বাস্থ্যের উপর এর কী প্রভাব পড়বে। দীর্ঘমেয়াদে যাতে কোনো অস্বস্তি ও অসুবিধার সম্মুখীন হতে না হয়, তা নিয়ে আমরা সকলেই সচেতন। আমরা শুধু বর্তমান নিয়েই ভাবছি না, ভবিষ্যৎ প্রভাব নিয়েও চিন্তাভাবনা করছি। আমি মনে করি, এই একই দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বের প্রতিও দেখানো উচিত। আমি যেমন নিজের স্বাস্থ্য এবং প্রাত্যহিক সুস্থতা নিয়ে সচেতন, ঠিক সেই রকমই পৃথিবীর স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা করা উচিত। কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাদের ভাবা দরকার, পৃথিবীর উপর তার কী প্রভাব পড়তে পারে। এই দর্শন থেকেই মিশন লাইফ অর্থাৎ পরিবেশবান্ধব জীবনযাত্রার সূচনা। এর লক্ষ্য হল, বিশ্বজুড়ে পরিবেশ সংরক্ষকদের নিয়ে এক আন্দোলন শুরু করা। জীবনযাত্রা সম্পর্কিত যে কোনো সিদ্ধান্তেরই প্রভাব পড়ে ব্যবসায়িক জগতের উপর। জীবনযাত্রা এবং ব্যবসা, উভয়ই যখন পরিবেশবান্ধব হয়ে উঠবে, তখন বহু সমস্যা আপনা আপনিই মিটে যাবে। তাই আমাদের জীবন ও ব্যবসাকে পরিবেশের সঙ্গে সমমুখী করতে হবে। ভারত ব্যবসা ক্ষেত্রে গ্রীন ক্রেডিট বা পরিবেশ সংক্রান্ত ঋণের একটি কাঠামো প্রস্তুত করেছে। দীর্ঘকাল ধরে আমরা কার্বন ক্রেডিটের ধারণার মধ্যে জট পাকিয়ে রয়েছি, আবার অনেকে আছেন যাঁরা কার্বন ক্রেডিটের সুবিধা ভোগ করছেন। আমি বিশ্বের সামনে গ্রীন ক্রেডিটের ধারণা পেশ করেছি। এটি পৃথিবীকে নিয়ে ইতিবাচক কাজকর্মের উপর জোর দেবে। বিশ্বের প্রথম সারির ব্যবসায়িক নেতাদের আমি এই আন্দোলনে যোগ দেওয়ার এবং একে বিশ্বব্যাপী করে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি।
বন্ধুরা,
প্রথাগত ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েও আমাদের ভাবনা চিন্তা করতে হবে। নিজেদেরকে কেবলমাত্র পণ্য, ব্র্যান্ড এবং বিক্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না; সেটা যথেষ্ট নয়। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমাদের এমন এক বাস্তুতন্ত্র গড়ে তুলতে হবে, যার সুফল আমরা দীর্ঘ মেয়াদেও পাবো। যেমন ধরুন, সাম্প্রতিককালে ভারত যেসব নীতির বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে, তার সুবাদে ১৩ কোটিরও বেশি মানুষকে মাত্র ৫ বছরের মধ্যে দারিদ্রের করাল গ্রাস থেকে বের করে আনা সম্ভব হয়েছে। দারিদ্রসীমার উপরে উঠে আসা এই নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণী সব থেকে বড় উপভোক্তা হয়ে উঠেছে। কারণ তারা নতুন আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এসেছে। এই নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণী ভারতের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, সরকারের দরিদ্র সহায়ক শাসন শুধু গরিব মানুষের কল্যাণই করেনি, মধ্যবিত্ত এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি সংস্থাগুলিও এর থেকে উপকৃত হয়েছে। একবার ভাবুন, এই দরিদ্র সহায়ক শাসন ব্যবস্থা চলতে থাকলে আগামী ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী কতটা উন্নতি করবে। তাই, প্রতিটি ব্যবসার উচিত আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করা। মধ্যবিত্তের ক্রয় ক্ষমতা বাড়তে থাকায় এটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ব্যবসার উপর সরাসরি এর প্রভাব পড়ছে। আমাদের শিখতে হবে, কিভাবে দু’দিকের প্রতি মনোযোগের ভারসাম্য রাখা যায়। যদি আমরা কেবল আত্মকেন্দ্রিক হয়ে থাকি, তাহলে আমরা নিজেদের বা বিশ্বের, কারোর উপকারই করতে পারবো না। গুরুত্বপূর্ণ কাঁচা মাল, দুষ্প্রাপ্য কাঁচা মাল এবং বিভিন্ন ধরণের ধাতুর ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতা আমাদের হচ্ছে। এই উপকরণগুলি বিশ্বের কিছু জায়গায় প্রচুর পরিমাণে আছে, আবার কোথাও একদমই নেই। কিন্তু সমগ্র মানবজাতিরই এগুলির প্রয়োজন। যার কাছে এই উপকরণ আছে, সে যদি বিশ্বের প্রতি নিজের দায়িত্ব পালন না করে, তাহলে তা ঔপনিবেশিকতার নতুন মডেলের সৃষ্টি করবে। এটা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়।
বন্ধুরা,
কোনো লাভজনক বাজারকে টিঁকিয়ে রাখতে হলে সেখানে উৎপাদক ও গ্রাহকদের স্বার্থের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। জাতিগুলির ক্ষেত্রেও এই নিয়ম প্রযোজ্য। অন্য দেশগুলিকে শুধু বাজার হিসেবে দেখলে হবে না, তাহলে আজ হোক বা কাল, উৎপাদক দেশেরও ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী। এগিয়ে যাওয়ার একটাই পথ রয়েছে, তা হল সবাইকে অগ্রগতির সমান অংশীদার করে তোলা। এখানে বিশ্বের ব্যবসায়িক জগতের নেতৃস্থানীয় অনেকে রয়েছেন। ব্যবসাকে আরও বেশি গ্রাহক-কেন্দ্রীক করে তোলার জন্য আমরা কি চিন্তা ভাবনা করতে পারিনা? গ্রাহক কোনো ব্যক্তি হতে পারে, অথবা কোনো দেশ। তাদের স্বার্থ অবশ্যই আমাদের মাথায় রাখতে হবে। এজন্য আমরা কি একটি বার্ষিক প্রচারাভিযানের কথা ভাবতে পারি? গ্রাহকদের কল্যাণ ও বাজারের ভালোর জন্য বিশ্বব্যাপী ব্যবসাগুলি কি একত্রিত হয়ে শপথ নিতে পারেনা?
বন্ধুরা,
বিশ্বব্যাপী ব্যবসাগুলি কি বছরে একটি দিন গ্রাহকদের জন্য উৎসর্গ করতে পারে না? আমরা গ্রাহকদের অধিকার নিয়ে কথা বলি, বিশ্বজুড়ে উপভোক্তা অধিকার দিবসও পালন করা হয়। কিন্তু আমরা কি চক্রের পরিবর্তন ঘটিয়ে কার্বন ক্রেডিট থেকে গ্রীন ক্রেডিটে পৌঁছতে পারি? প্রতি বছর বাধ্যতামূলকভাবে উপভোক্তা অধিকার দিবস পালন করার বদলে আমরা গ্রাহকদের পরিচর্যা নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করতে পারি। একবার ভাবুন, যদি একটি গ্রাহক পরিচর্যা দিবস পালন করা হয়, তাহলে তার কতটা ইতিবাচক প্রভাব সবার উপর পড়বে। গ্রাহক পরিচর্যার দিকে মনোযোগ দেওয়া হলে গ্রাহক অধিকার সম্পর্কিত বহু সমস্যা নিজে থেকেই মিটে যাবে। আমি আপনাদের সবাইকে আন্তর্জাতিক উপভোক্তা পরিচর্যা দিবস নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার অনুরোধ জানাচ্ছি। এই ধরনের উদ্যোগ ব্যবসা ও গ্রাহকদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থাকে সুদৃঢ় করবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, গ্রাহকরা কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্ব বাণিজ্যে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দেশে তাঁরা ছড়িয়ে রয়েছেন।
বন্ধুরা,
আজ যখন বিশ্বের প্রথম সারির ব্যবসায়িক নেতৃবৃন্দ এখানে সমবেত হয়েছেন, তখন সেইসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসছে, যা ব্যবসা এবং মানবতার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদের সমবেতভাবে খুঁজতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন, জ্বালানি সঙ্কট, খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলের ভারসাম্যহীনতা, জলসঙ্কট বা সাইবার নিরাপত্তা – বিষয় যাই হোক না কেন, এগুলি ব্যবসার উপর গভীর প্রভাব ফেলে। এইসব চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় আমাদের যৌথভাবে উদ্যোগী হতে হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন সমস্যা মাথাচাড়া দিচ্ছে, যা ১০-১৫ বছর আগেও আমরা কেউ কল্পনা করতে পারিনি। যেমন ধরুন ক্রিপটোকারেন্সি আজ যে চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে রাখছে, তার মোকাবিলায় সুসমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের উদ্বেগ ও সমস্যা নিয়ে ভাবনা চিন্তার জন্য বিশ্বব্যাপী একটি কাঠামো গড়ে তোলা দরকার বলে আমার মনে হয়।
কৃত্রিম মেধা নিয়েও একইধরনের দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। সারা বিশ্ব আজ কৃত্রিম মেধা নিয়ে উত্তেজনায় ভরপুর। কিন্তু এই উত্তেজনার মধ্যেও কিছু নৈতিক বিবেচনা করা দরকার। দক্ষতা ও তার ঘষামাজা, অ্যালগোরিদমিক পক্ষপাত এবং সমাজে কৃত্রিম মেধার প্রভাব নিয়ে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আমাদের সম্মিলিতভাবে এই সমস্যাগুলির উত্তর খুঁজতে হবে। নীতিসম্মত কৃত্রিম মেধার প্রসারে ব্যবসায়িক বিশ্ব ও সরকারগুলিকে একযোগে কাজ করতে হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে, তা আমাদের বিশ্লেষণ করতে হবে। যত দিন যাচ্ছে, ততই বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার অভিঘাত বাড়ছে, সেগুলি আরও বেশি করে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিশ্বব্যাপী কাঠামো গড়ে তুলে এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করা দরকার। আর বন্ধুরা, এমন নয় যে, এই চ্যালেঞ্জগুলি এই প্রথম আমাদের সামনে এলো। যখন বিমান ক্ষেত্রের বিকাশ ঘটছিল, যখন আর্থিক ক্ষেত্রের অগ্রগতি হচ্ছিল, তখনও সামনে আসা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় বিশ্বস্তরের একটি কাঠামো স্থাপন করা হয়েছিল। নতুন চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলায় বি২০-কে আমি আলোচনা ও চিন্তাভাবনা করার অনুরোধ জানাচ্ছি।
বন্ধুরা,
ব্যবসা আজ সমস্ত সীমান্ত ও সীমারেখা পার হয়ে গেছে। এখন সময় এসেছে ব্যবসাকে আরও বৃহত্তর ক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়ার। প্রাণবন্ত সরবরাহ শৃঙ্খল গঠন ও সুস্থিতির উপর জোর দিয়েই একমাত্র এটা করা সম্ভব। আমি নিশ্চিত যে বি২০ শীর্ষ সম্মেলন এক সম্মিলিত রূপান্তরের ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে। মনে রাখবেন, সংযুক্ত বিশ্ব বলতে কেবলমাত্র প্রযুক্তির দ্বারা সংযুক্ত হওয়াই বোঝায় না। এটা কেবলমাত্র অভিন্ন সামাজিক মঞ্চ গড়ে তোলার বিষয়ও নয়। এটা হল অভিন্ন উদ্দেশ্য, অভিন্ন বিশ্ব, অভিন্ন সমৃদ্ধি এবং অভিন্ন ভবিষ্যতের অভিজ্ঞান।
ধন্যবাদ।