মঞ্চে উপবিষ্ট সকল শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিবর্গ,
সার্ধশতবর্ষ উদযাপন সমারোহের সমাপন উৎসব আজ। বিগত এক বছর ধরে এই উদযাপনসমারোহের মাধ্যমে এলাহাবাদ উচ্চ আদালত নতুন জ্বালানি, নতুন প্রেরণা, নতুন সংকল্পআর নতুন ভারতের স্বপনকে সফল করতে আদালত কী কী করতে পারে – তা করে দেখিয়েছে। ভারতেরন্যায়বিশ্বে এটি তীর্থক্ষেত্র আর এই গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আপনাদের মধ্যে এসেআপনাদের শোনা ও বোঝার সুযোগ পেয়েছি, কিছু কথা বলার সুযোগ পেয়েছি, সেজন্য নিজেকেগৌরবান্বিত বোধ করছি।
একটু আগেই প্রধান বিচারপতি সাহে যখন তাঁর মনের কথা বলছিলেন, আমি খুব মনোযোগদিয়ে শুনছিলাম। আমি তাঁর প্রতিটি শব্দে ব্যথার ছোঁয়া অনুভব করছিলাম আর কিছু করারইচ্ছা জেগে উঠেছিল। ভারতের বিচারপতিদের নেতৃত্ব এমনই প্রভাবশালী! আমার বিশ্বাস,তাঁদের এই সংকল্প বাস্তবায়িত হবে। সরকারের দিক থেকে যতটা করার আমরা তা অবশ্যই করব!এলাহাবাদ উচ্চ আদালতের শতবর্ষ পূর্তি উদযাপন উৎসবে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ডঃ সর্বেপল্লিরাধাকৃষ্ণণ মহোদয় এখানে এসেছিলেন। তিনি সেদিন যে বক্তব্য রেখেছিলেন, তার একটিঅনুচ্ছেদ আমি পড়ে শোনাতে চাইব!
তিনি বলেছিলেন, “আইন একটি এমন জিনিস যা নিয়মিত বদলাতে থাকে, আইন জনগণেরস্বভাবের অনুকূল হওয়া উচিৎ, পারিবারিক মূল্যবোধের অনুকূল হওয়া উচিৎ, পরম্পরাগতমূল্যবোধের অনুকূল হওয়া উচিৎ আর পাশাপাশি আইনকে আধুনিক প্রবৃত্তিসমূহ আরপ্রতিস্পর্ধাগুলি মাথায় রাখা উচিৎ! আইনের সমীক্ষার সময় এসব কথা মনে রাখতে হবে। কীধরণের জীবন আমরা কাটাতে চাই! আইন বলতে কী বলতে চায়, আইনের অন্তিম লক্ষ্য কী? সকলেরমঙ্গল, কেবলই ধনীদের মঙ্গল নয়; দেশের সমস্ত নাগরিকের মঙ্গলই আইনের লক্ষ্য আরসেগুলির মধ্যে সেতুবন্ধন”।
আমি মনে করি, আজ থেকে ৫০ বছর আগে ডঃ রাধাকৃষ্ণণ এই মাটি থেকেই দেশের ন্যায়মহলকে,শাসকদেরকে একটি বার্তা দিয়েছিলেন, যা আজও প্রাসঙ্গিক এবং প্রশংসাযোগ্য। গান্ধীজিযেমন বলতেন, যদি একবার আমরা কোনও সিদ্ধান্ত নিই, তা হলে সেটা ঠিক কি ভুল তা মাপারমানদন্ড কী? যখনই কোনও সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে দ্বিধার সম্মুখীন হবেন, তখন ভারতের শেষপ্রান্তে বসে থাকা মানুষদের কথা ভাববেন, আর কল্পনা করবেন যে ওই সিদ্ধান্ত তাঁদেরজীবনে কী প্রভাব ফেলবে! যদি ইতিবাচক হয়, তা হলে দ্বিধাহীনভাবে এগিয়ে যান, আপনারসিদ্ধান্ত সঠিক হবেই!
এই মনোভাবকে আমরা কিভাবে জীবনের অঙ্গ করে তুলব, এহেন মহাপুরুষদের বাণীকিভাবে আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য হয়ে উঠবে? তবেই তা পরিবর্তনের পুরোধা হয়ে ওঠে।
অধিকাংশ উকিলরাই এই এলাহাবাদের মানুষের মনে তথা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনেব্রিটিশ শাসনের সামনে অভয়ের সুরক্ষাচক্র দিয়েছেন, সুরক্ষার কবচকুণ্ডল দিয়েছেন!তাঁরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে এক-দুই কিংবা পাঁচ জনের স্বার্থরক্ষার খাতিরেলড়লেও সেই লড়াই অভয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ঐ দৃষ্টান্ত থেকে কোটি কোটি মানুষ ভয়ডরহীনহয়ে উঠেছেন। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশইউকিল ছিলেন। সাধারণ মানুষের উপর হওয়া অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ন্যায়ের লড়াই করতেকরতেই তাঁদের মনে স্বাধীন দেশের আকাঙ্খা জন্মায়। প্রতিটি নাগরিকের মনে ছড়িয়ে দিতেপেরেছেন। সকলের মনে স্বাধীনতার স্বপন না জাগাতে পারলে স্বাধীনতার আন্দোলন এত তীব্রহতো না, আর ইংরেজরাও এত সহজে এই দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হ’ত না। গান্ধীজিরনেতৃত্বে এই আকাঙ্খা জনমনে এত তীব্র হয়ে ওঠে, এমনকি একজন ঝাড়ুদারও ভাবেন যে, তিনিদেশের স্বার্থে ঝাড়ু দিচ্ছেন, তিনি ঝাড়ু হাতেই স্বাধীনতার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।যাঁরা প্রৌঢ়, শিক্ষার কাজ করতেন, তাঁরাও খাদিবস্ত্র পরে আন্দোলনে শরিক হয়েছেন।এভাবে এলাহাবাদ তথা দেশের অন্যান্য আদালতের উকিলদের সুযোগ্য নেতৃত্বে দেশ একসময়স্বাধীন হলে দেশের শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতেও এঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকরেছেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৭০ বছর পেরিয়ে গেছে। ২০২২ সালে আমরা ৭৫ বছর পূর্তিউৎসব পালন করবো। তখন এলাহাবাদ দেশকে কী প্রেরণা জোগাবে? স্বাধীনতার ৭৫ বছরপূর্তিতে আপনারা দেশকে কোন্ উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়ার সংকল্প গ্রহণ করেছেন? আজআপনাদের সেই রোডম্যাপ দেশের জনগণের সামনে তুলে ধরতে না পারলে মানুষের মনে পরিণামসম্পর্কে আশঙ্কা জন্ম নেবে।
১২৫ কোটি ভারতবাসীর নিজস্ব শক্তি রয়েছে। আমাদের সামাজিক সংগঠনগুলি, আমাদেরসামাজিক জীবন ও সরকারের সঙ্গে যুক্ত মানুষজন এই সার্ধশতবর্ষ উদযাপন সমারোহ থেকেপ্রেরণা নিয়ে সংকল্প গ্রহণ করতে পারি, আমরা যে যে ধরনের কাজের দায়িত্ব পালন করছি,সেটাকে নতুন উদ্যমে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করব। তবেই মহাত্মা গান্ধী, ডঃ রাধাকৃষ্ণণএবং আজ যিনি এলাহাবাদ উচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি রয়েছেন, সকলের স্বপ্নকে সফলকরতে পারব। প্রধান বিচারপতির মনের কষ্ট লাঘব করতে পারব। প্রধান বিচারপতির মূল্যবোধআর আপনাদের সকলের মনে যে আগুন রয়েছে, সেই আগুনের সম্মেলনে এক নতুন জ্বালানি দেশেরমানুষের মনে পরিবর্তনের ইন্ধন যোগাতে সক্ষম বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমি এই মঞ্চেরমাধ্যমে দেশবাসীকে আহ্বান জানাই। আসুন, স্বাধীনতা সংগ্রামীরা যেরকম দেশের স্বপ্নদেখে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, আগামী ২০২২ সালে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির আগেই আমরাদেশকে সেই উচ্চতায় পৌঁছে দিই। আর সেজন্য আমাদের প্রত্যেককে নিজের কাজটি পূর্ণদায়িত্ব নিয়ে ভালভাবে করতে হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ১২৫ কোটি দেশবাসী এক পা এগোলেদেশ ১২৫ কোটি পা এগিয়ে যাবে। এই শক্তিকে আমরা কিভাবে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতেপারি, সেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব।
সময় বদলে গেছে। যুগ বদলেছে। ২০১৪ সালে যখন নির্বাচনী প্রচারে দেশের নানাপ্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছিলাম, তখন দেশের অনেক অঞ্চলে আমি অপরিচিত মানুষ ছিলাম। একটিছোট উৎসবে আমাকে অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছিল। আমি বলেছিলাম, আমি দায়িত্ব পেলেকতগুলি আইন প্রণয়ন হবে জানি না, কিন্তু প্রত্যেকদিন কমপক্ষে একটি করে আইন বাতিলকরব। তখন দেশে এত অজস্র পরস্পর বিরোধী আইন ছিল যে, সরকারগুলি কাজ করতে চাইলেও কাজকরতে পারছিল না। সাধারণ মানুষও এর ফলে বিলম্বিত বিচার প্রক্রিয়ার শিকার হচ্ছিলেন।আমি কথা রেখেছি। প্রতিদিন একটিরও বেশি, ইতিমধ্যেই প্রায় ১,২০০ অপ্রয়োজনীয় বাপরস্পর বিরোধী আইন বাতিল করতে পেরেছি। এভাবে আমরা দেশের আইন ব্যবস্থাকে যত সরলকরতে পারব বিচার প্রক্রিয়াও তত দ্রুত হবে, পরিবর্তিত সময়ে প্রযুক্তির অবদানঅনস্বীকার্য। প্রধান বিচারপতি বলছিলেন, নথির প্রয়োজন নেই, বৈদ্যুতিন মাধ্যমে ফাইলসেকেন্ডের মধ্যে এক জনের কাছ থেকে অন্যজন পেতে পারেন। ভারত সরকার তাই ডিজিটালইন্ডিয়ার মাধ্যমে ভারতের বিচার-ব্যবস্থাকে আধুনিক ‘ইনফরমেশন কমিউনিকেশন টেকনোলজি’বা ‘আইসিটি’র মাধ্যমে শক্তিশালী ও সরল করার কাজে হাত দিয়েছে। আজ যাঁরা বিচারপতিতাঁরা যখন উকিল ছিলেন, এমনকি কয়েক বছর আগেও যে কোনও মামলা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেঘন্টার পর ঘন্টা বিভিন্ন আইনের বই ঘাঁটতে হ’ত।
আজকের উকিলদের এতো পরিশ্রম করতে হয় না। ‘গুগল গুরু’র কাছে জানতে চাইলেদ্রুত স্ক্রিনে ভেসে ওঠে যে ১৯৮৯ সালে অমুক মামলায় বিচারপতি এ ধরনের সিদ্ধান্তনিয়েছিলেন, কিংবা পরে এক্ষেত্রে নতুন ও সরল কোনও আইন পাশ হয়েছে। ফলে, অত্যাধুনিকতথ্যসমৃদ্ধ নবীন উকিল প্রজন্মের বিতর্কের উৎকর্ষ বেড়েছে। এই উৎকর্ষ বিচারপ্রক্রিয়াকেও ক্রমে সরল ও ক্ষুরধার করে তুলছে। বিচার প্রক্রিয়া কম প্রলম্বিতহচ্ছে। দেখতে হবে, মক্কেলদেরও যেন আর শুধু তারিখ নেওয়ার জন্য সবকাজ ফেলে আদালতেছুটতে না হয়। নতুন তারিখের প্রয়োজন হলে আদালতই তা বিচারপ্রার্থীর মোবাইল ফোনেএসএমএস-এর মাধ্যমে জানিয়ে দেবে। এই প্রক্রিয়া কবে শুরু হবে?
আজ কোনও আধিকারিক কোথাও চাকরি করেন। তিনি আগে যেখানে ছিলেন তখনকার একটিমামলা আদালতে উঠলে তাঁকে আজ নতুন কাজের জায়গা ছেড়ে সরকারি খরচে আদালতে হাজিরা দিতেদূরবর্তী শহরে যেতে হয়। এক্ষেত্রে কি আমরা ভিডিও কনফারেন্সিং-এর মাধ্যমেবিচারপ্রক্রিয়া সারতে পারি না? এতে সরকারি কাজ বিঘ্নিত হবে না, সময় এবং অর্থসাশ্রয় হবে। বিচারাধীন বন্দীদের আদালতে এনে হাজিরা দিতে যে যাতায়াতের এবংসুরক্ষাবাবদ খরচ হয়, তাও বাঁচানো যেতে পারে!
এখন যোগীজি মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। তিনি হয়তো ভিডিও কনফারেন্সিং-এর মাধ্যমেআদালতে বন্দীদের হাজির করে সরকারের সময় ও অর্থ বাঁচানোর ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণকরবেন। ভারত সরকার চায়, এভাবে আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে বিচার-ব্যবস্থা আধুনিকহয়ে উঠুক। প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হোক। আমি দেশের নবীন প্রজন্মের ‘স্টার্টআপ’ প্রযুক্তিবিদ ও ব্যবসায়ীদের বলব আপনারা নতুন নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমেবিচার-ব্যবস্থাকে আরও কিভাবে সরলীকৃত করা যায়, সময় ও অর্থ সাশ্রয় করা যায় তাদেখুন। যাতে দেশের ভবিষ্যৎ বিচার প্রক্রিয়া আপনাদের উদ্ভাবনে সমৃদ্ধ হয়। আমরাচেষ্টা করলে অবশ্যই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠতে পারব বলে আমার বিশ্বাস।
আমি আরেকবার দিলীপজি ও তাঁর গোটা টিমকে, সম্মাননীয় বিচারপতিদেরকে, সমাগতঅতিথিদেরকে এই সার্ধশতবার্ষিকী উদযাপন সমারোহের সমাপনকালে অনেক অনেক শুভেচ্ছাজানাই। আমি বিশ্বাস করি যে, আগামী ২০২২ সালে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তিকে মাথায়রেখে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্বপ্ন সফল করার সংকল্প নিয়ে আমরা আজ থেকেই সমস্তশক্তি নিয়ে লেগে পড়বো। দেশকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেব। নবীন ভারতের নবীন প্রজন্মেরজন্য যে স্বপ্ন আমরা দেখি তা বাস্তবায়নের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বো। এই আশা নিয়ে আপনাদেরসকলকে কৃতজ্ঞতা জানাই।
ধন্যবাদ।