আমি সবার আগে এই সুরম্য এবং অত্যাধুনিক পরিষেবাযুক্ত ভবনটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আপনাদের সবাইকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানাই। এই সংগঠন ১৫০ বছরের পুরনো। অর্থাৎ ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ইতিমধ্যেই নিজেই প্রত্নতত্ত্বের বিষয় হয়ে উঠেছে। ১৫০ বছরের অভিজ্ঞতা কিভাবে বিকশিত হয়েছে, নতুন কি অঙ্কুরিত হয়েছে – এর অনুসন্ধানের মাধ্যমে ইতিহাসে কী কী উপাদান সংযোজিত হয়েছে! যে কোনও সংস্থার পক্ষেই ১৫০ বছরের জীবন একটা অত্যন্ত বড় সময়।
আমি জানি না যে, ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কাছে তার ১৫০ বছরের সাফল্যের ইতিহাস রয়েছে কিনা! যদি থেকে থাকে, তা হলে খুব ভালো কথা। কিন্তু যদি না থাকে, তা হলে এই কাজটাও আপনাদের করতে হবে। অনেক মহান ব্যক্তি এই সংস্থার দায়িত্ব পালন করেছেন। কেমন কল্পনা থেকে এই সংস্থার জন্ম হয়েছিল, কিভাবে এটি বিস্তারলাভ করেছে, ধাপে ধাপে কি ধরণের প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে এই সংস্থা কাজ করেছে – এরকম অনেক বিষয় হবে, ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের এরকম অনেক অবদান তৎকালীন সমাজকে কিভাবে প্রভাবিত করেছিল, কিভাবে বিশ্বের এই ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত পণ্ডিতদের এই সংস্থা আকর্ষিত করেছে। আমি জানি যে, ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে অনেক অনুসন্ধান গোটা বিশ্বে পুরাতাত্ত্বিক অনুমান থেকে বাস্তব ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়ে উঠেছে। আমরা জানি যে, বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে মহাকাশ প্রযুক্তি এখন অনেক প্রক্রিয়াকেই সহজ করে দিয়েছে। অনেক পুরনো ধ্যান-ধারণাকে নস্যাৎ করে দিয়ে প্রযুক্তি ইতিহাসের পুনঃরচনা করছে। যেমন – অনেক ঐতিহাসিক-ই সরস্বতী নদীর অস্তিত্বকে স্বীকার করতেন না। কিন্তু মহাকাশ প্রযুক্তি প্রমাণ করে দিয়েছে যে, এই ধারণা কল্পনা-নির্ভর ছিল না। মহাকাশ প্রযুক্তি সরস্বতী নদী কোথা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল, তা দেখিয়ে দিয়েছে। আগে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিবাদ ছিল যে, আর্যরা বাইরে থেকে ভারতে এসেছিল কিনা! নতুন প্রযুক্তি এই বিষয়টিতেও আলোকপাত করছে।
আমি মনে করি যে, পুরনো শিলালিপি বা কিছু পুরাতাত্ত্বিক বস্তু নিছকই পাথর নয়, এখানকার প্রত্যেক পাথর কথা বলে, ইতিহাসের সাক্ষ্য দেয়। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান থেকে পাওয়া এই উপাদানগুলি মানুষের শৌর্য, পরাক্রম এবং স্বপ্নকে তুলে ধরতে সক্ষম। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকরা খালি মাঠে কাজ শুরু করেন। বছরের পর বছর যেদিকে মানুষ ফিরেও তাকাননি, সেরকম স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিকরা নিবিড় অন্বেষণে থাকেন। বৈজ্ঞানিকরা যেমন গবেষণাগারে ভবিষ্যতের কল্পনাকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে কাজ করে যান, প্রত্নতাত্ত্বিকরাও তেমনই মনুষ্যবিহীন পাহাড়, অরণ্য, গিরিপথ ও গিরিকন্দরে নিজেদের অস্তিত্ব ভুলে বছরের পর বছর এমনকি ১০-২০ বছরও কাটিয়ে দেন। বৈজ্ঞানিকদের আবিষ্কার যেমন হঠাৎ-ই বিশ্বকে চমকে দেয়, পুরাতাত্ত্বিকদের অন্বেষণলব্ধ গবেষণাপত্র তেমনই বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আমাদের চণ্ডীগড়ের উপকন্ঠে একটি ছোট টিলা ছিল, ফ্রান্সের কয়েকজন জীব বিজ্ঞানী ও প্রত্নতাত্ত্বিক সেখানে দীর্ঘকাল অন্বেষণ করে বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো, লক্ষ লক্ষ বছর আগের প্রাণীর জীবাশ্ম খুঁজে পায়। ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি ভারত সফরে এসে আমাকে অনুরোধ করেন যে, তাঁদের দেশের বিজ্ঞানীরা ওখানে কেমন কাজ করছেন, তা তিনি গিয়ে দেখতে চান। আমি তাঁকে নিয়ে সেখানে গিয়েছিলাম।
প্রত্নতত্ত্ববিদরা আমাদের অনেক প্রচলিত ধারণা বদলে দিতে পারেন। ইতিহাসকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সামর্থ্য তাঁরা পাথর থেকে খুঁজে পান। শুরু হয়তো অনেকে মেনে নেন না, আর আমাদের দেশে তো এরকম কোনও কিছু মেনে না নেওয়ার অভ্যাস রয়েছেই! কিন্তু তাঁরা যখন মেনে নিতে বাধ্য হন, ততদিনে এর মূল্য অনেকটাই কমে যায়।
বিশ্বে যাঁদের কাছে কিছু থাকে না, তাঁরা যেটা আছে, সেটাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। আমি একবার আমেরিকায় সরকারি আমন্ত্রণে দেশের প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসাবে গিয়েছিলাম, সফরসূচি ঠিক করার আগে আমাকে একটি ফর্ম ভর্তি করতে হয়েছিল, তাতে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, কোথায় কোথায় যেতে চাই, কী জানতে চাই, কী দেখতে চাই? আমি লিখেছিলাম যে, একটি ছোট গ্রামের হাসপাতাল এবং একটি বিদ্যালয় দেখতে চাই। আর লিখেছিলাম, আপনাদের দেশের সবচেয়ে পুরনো জিনিস, যা নিয়ে আপনারা গর্ব করেন, সেটি দেখতে চাই। হাসপাতাল ও বিদ্যালয় দেখার পর তাঁরা আমাকে সম্ভবত পেনসিলভেনিয়া স্টেটে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে একটি বড় প্রস্তরখন্ড দেখিয়ে তাঁরা অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন, এটি ৪০০ বছরের। তাঁদের জন্য এটা অত্যন্ত পুরনো আর গর্বের বিষয়। কিন্তু আমাদের দেশে ২-৫ হাজার বছর পুরনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে। এতটাই বেশি রয়েছে যে, এগুলি কোনও গুরুত্ব পায় না।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ ধরণের মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসা উচিৎ ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই ধরণের দাসত্বসুলভ ভাবনাই ভারতকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরেছিল। যতদিন পর্যন্ত আমাদের ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব অনুভব না করব, ততদিন এর সাক্ষ্যগুলিকে সামলে রাখা ও সাজিয়ে রাখার মানসিকতা গড়ে উঠবে না। গর্ব থেকেই মানুষ কোনও কিছুকে সাজিয়ে মাথায় করে রাখে। আমার সৌভাগ্য, যে গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছি তার একটা ইতিহাস আছে। মানবসভ্যতা শতাব্দীর পর শতাব্দীকাল ধরে নিরন্তর বিকশিত হয়ে আসছে। প্রখ্যাত চিনা পর্যটক হিউ এন সাঙ-এর ভারত সফরের বর্ণনা অনুযায়ী আমার গ্রামে বৌদ্ধদের একটি বড় বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। আমাদের গ্রামের স্কুলে একজন শিক্ষক ছিলেন, তিনি আমাদের বলতেন, তোমরা যেখানেই দেখবে কোনও পাথরে কোনও রকম খোদাইয়ের কাজ হয়েছে, সেই পাথরের টুকরোগুলিকে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসবে। আমাদেরও অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল যে, কোনও পাথরে একটি বা দুটি অক্ষরও খোদাই করা দেখতাম, তা হলে সেই টুকরোটি এনে বিদ্যালয়ের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় রাখতাম। তখন আমরা বুঝতে পারিনি যে, এই শিক্ষক আমাদের মনে কেমন সুন্দর সংস্কার প্রোথিত করছেন, কিভাবে আমাদের সচেতন করে তুলছেন। পথের পাশে পড়ে থাকা যে কোনও পাথরের কতটা মূল্য হতে পারে! পরে এসব বুঝেছি।
আমেদাবাদে ডঃ হরিভাই গোধানি নামে একজন হাতুড়ে ডাক্তার ছিলেন। কিন্তু একটি ভিন্ন কারণে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। আমি শুনেছিলাম যে, তিনি একজন সখের প্রত্নতাত্ত্বিক। পাহাড়ে ও অরণ্যে প্রত্বতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ করতে গিয়ে তিনি ২০টি ফিয়েট গাড়ি নষ্ট করেছেন। তখন তাঁর কাছে গিয়ে শুনলাম যে, প্রত্যেক শনি ও রবিবারে তিনি জঙ্গলের মধ্যে একটি পাথুরে এলাকায় চলে যান। ঐ বন্ধুরপথে চলতে গিয়ে এক বছরের মধ্যেই তাঁর গাড়ি খারাপ হয়ে যায়। একজন সাধারণ মানুষের কত বড় নেশা ভাবুন! আর তাঁর প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহও ছিল অসাধারণ। তিনি আমাকে কয়েকটি স্লাইড দেখিয়েছিলেন। আমার বয়স কম ছিল, কিন্তু অনুসন্ধিৎসা ছিল সীমাহীন। তিনি আমাকে একটি খোদাই করা পাথর দেখিয়েছিলেন, যেটাতে একজন গর্ভবতী মহিলার শারীরিক আকৃতি খোদাই করা ছিল। তিনি বলেছিলেন, ঐ পুরাকীর্তিটি কমপক্ষে ৮০০ বছরের পুরনো। এতে একজন গর্ভবতী মহিলাকে শল্য চিকিৎসার সুবিধার জন্য একদিক থেকে পেটের ভেতরের দৃশ্যও খোদাই করা ছিল। এমনকি চামড়ার ক’টি স্তর থাকে, তাও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খোদিত করা ছিল। গর্ভে শিশুটি কিভাবে শুয়ে থাকে, তাও সুন্দরভাবে খোদাই করা ছিল।
আমাকে কেউ বলছিলেন যে, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান মাত্র কয়েকশো বছর পুরনো। তা হলে আমাদের খোদাই শিল্পীরা ৮০০ বছর পুরনো শিল্পকৃতীতে এত পুঙ্খানুপুঙ্খ খোদাই কি করে করেছিলেন। আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রের জ্ঞানের সঙ্গে ঐ খোদিত পুরাকীর্তির বিবরণ প্রায় হুবহু মিলে যায়।
অর্থাৎ আমাদের ঐতিহ্য কত পুরনো, আমাদের বিজ্ঞান কত প্রাচীন, তার সাক্ষ্য বহন করে ঐ পুরাকীর্তি। যাঁরা এ বিষয়ে আগ্রহী, তাঁরা হয়তো এটা অনুভব করেন। সারা পৃথিবীতে পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি গণঅংশীদারিত্বের মাধ্যমে সংরক্ষিত হয়। বিশ্বের যে কোনও সৌধ দেখতে যান, দেখবেন যে, অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীরা সেখানে স্বেচ্ছাসেবক হয়ে ইউনিফর্ম পরে গাইডের কাজ করছেন। আমাদের দেশের বয়স্ক নাগরিকদের ক্লাবগুলি এই ধরণের দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে। আপনারা সেবাভাব নিয়ে এই ধরণের কাজ করলে তবেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিজেদের ঐতিহ্য সম্পর্কে এবং ঐতিহ্যের সংরক্ষণ সম্পর্কে সচেতন করতে পারবেন। সরকারি কর্মচারীরা তো তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন। একজন চৌকিদার যত তটস্থই হন না কেন, যতক্ষণ পর্যন্ত দর্শনার্থীদের মধ্যে একটিও গাছের দাল কিংবা পাতা না ছেঁড়ার মানসিকতা তৈরি না হয়, একা চৌকিদারের পক্ষে ততক্ষণ সুস্থভাবে কোনও বাগানের দেখভাল করা সম্ভব নয়। আর সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে শতাব্দীর পর শতাব্দীকাল পেরিয়ে গেলেও কোনও জিনিস নষ্ট হবে না। গণঅংশীদারিত্বের শক্তি এখানেই। সেজন্যে আমাদের সমাজ জীবনে এই স্বভাবগুলি রপ্ত করা এবং এ ধরণের পরিষেবা প্রদানের জন্য সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো – তা হলেই অনেক বড় কাজ হবে।
আমাদের দেশের বেসরকারি ক্ষেত্রের আধিকারিকদেরও অনুরোধ জানাতে পারি যে, মাসে ১০-১৫ ঘন্টা স্বেচ্ছা সেবকের কাজ করুন। ধীরে ধীরে মূল্যবোধ সমাজ জীবনে ছড়িয়ে যাবে। এই রক্ষণাবেক্ষণের কাজে পর্যটন বিভাগ ও সংস্কৃতি বিভাগকেও যুক্ত করা যেতে পারে, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির অন্যান্য বিভাগও যুক্ত হতে পারে।
মনে করুন, দেশের ১০০টি শহর ঐতিহ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত মূল্যবান। সেগুলি পর্যটকদের আকর্ষণ স্থল। সেই শহরের শিশুদের পাঠ্যক্রমে ঐ শহরের ইতিহাস ও প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব সম্বন্ধে পড়ানো হোক। আগ্রার ছেলেমেয়েদের পাঠ্যক্রমে তাজমহল সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ থাকলে পরবর্তীকালে তারা পর্যটন সহায়ক নাগরিক হয়ে উঠবে। এছাড়া, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ঐ শহরগুলি নিয়ে পড়াশুনার জন্য অনলাইন সার্টিফিকেট কোর্স চালু করা যেতে পারে। যাঁরা এসব নিয়ে পড়াশুনা করবেন, তাঁরা ভবিষ্যতে উন্নতমানের পর্যটন গাইড হয়ে উঠবেন।
আমি একবার টিভি চ্যানেলের আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তখন আমি প্রধানমন্ত্রী ছিলাম না। আমি তাঁদের অনুরোধ করেছিলাম যে, শিশু ও কিশোরদের জন্য সঙ্গীত, নৃত্য, অভিনয় ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক মেধা-অন্বেষণের ব্যবস্থা করতে। প্রতিযোগিতা চলাকালীন ঐ বিষয়গুলির শ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞরা নির্বাচিত শিশু-কিশোরদের উন্নতমানের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রতিযোগিতার জন্য তৈরি করবে। একই রকমভাবে ট্যুরিস্ট গাইডের পোশাক পরে কিভাবে বিভিন্ন পর্যটন স্থানের প্রতি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করা যায়, সে বিষয়েও শিশু-কিশোরদের আগে প্রশিক্ষণ ও প্রতিযোগিতার আয়োজন করার কথা বলেছিলাম।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকলে যে কোনও অঞ্চলেরই পর্যটক আকর্ষণ বাড়ে, সেই ইতিহাস পর্যটকদের বলার মতো লোক চাই। আমি একবার কচ্ছের ঊষর ভূমিকে মরু পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম। সেজন্য প্রথমে শিশু-কিশোরদের গাইডের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি কচ্ছের রান থেকে লবণ উৎপাদনের পদ্ধতি শেখানো শুরু করা হয়। আপনারা শুনলে অবাক হবেন যে, অষ্টম-নবম শ্রেণীর ছেলেমেয়েরা ঊষর ভূমির লবণের গুরুত্ব ও তার উৎপাদন প্রক্রিয়ার পাশাপাশি এর ইতিহাস এবং ব্রিটিশের ভূমিকা এত সুন্দর বোঝাতে থাকে যে পর্যটকের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ঐ ছেলেমেয়েদের সবারই এখন পর্যটন নির্ভর কর্মসংস্থান হয়েছে। প্রযুক্তি দ্রুত বদলাচ্ছে। মহাকাশ প্রযুক্তির মাধ্যমে হাজার মাইল উপর থেকে দিল্লির কোন গলিতে কোথায় কোন স্কুটার পার্ক করা হয়েছে, তার নম্বর প্লেটের ছবি নেওয়া যায়। আর আমাদের মনুমেন্টের বোর্ডে লেখা রয়েছে – ছবি তোলা নিষেধ। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী বদলাতে হবে।
আমি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলাম, নির্মীয়মান সর্দার সরোবর বাঁধ দেখতে অনেককে আসতে দেখেছি। কিন্তু তাঁরা ছবি তোলা নিষেধ তোলায়, মনে কষ্ট নিয়ে ফিরে যেতেন। পর্যটকদের কাছে আমি সেকথা শুনে উল্টো আদেশ দিই। আমি বলি যে, আপনারা ছবি তুলে ওয়েবসাইটে আপলোড করতে পারেন। শ্রেষ্ঠ ছবিটিকে পুরস্কৃত করা হবে। পরবর্তীকালে এই ছবি তোলার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেলে আমরা বাঁধ দেখতে আসা মানুষের জন্য টিকিটের ব্যবস্থা করি, আর ঘোষণা করি যে, ঐ টিকিটের রেজিস্ট্রেশন নম্বর অনুযায়ী ৫ লক্ষতম যাত্রীকে সম্মানিত করা হবে। কিছুদিনের মধ্যেই সেই সম্মান তুলে দিতে গিয়ে অবাক হয়ে দেখি, কাশ্মীরের বারামুলা জেলার এক দম্পতি আমার থেকে পুরস্কার নিতে এসেছেন। সেখানেও আমরা স্কুলের ছেলেমেয়েদের গাইডের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ করেছিলাম। বাঁধ নির্মাণ কবে থেকে শুরু হয়েছে, এর পক্ষে ও বিপক্ষে কী ধরণের আন্দোলন হয়েছে, কত টন সিমেন্ট, বালি, লোহা লেগেছে, কী পরিমাণ জল জমা হয়, কীভাবে ছাড়া হয়, বিশেষ করে ওই অঞ্চলের জনজাতি পরিবারের শিশু-কিশোররা এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন সাফল্যের সঙ্গে গাইডের কাজ করছে। এভাবেই দেশের ১০০টি শহরে শিশু-কিশোরদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আমরা পর্যটন-বান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার পাশাপাশি এক বিরাট সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান ব্যবস্থা করতে পারি। আমাদের হাজার হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ইতিহাস নবীন প্রজন্মের নখদর্পণে থাকলে তাঁরা কখনই বিপথগামী হবে না। আমাদের পূর্বজরা যা ছেড়ে গেছেন, বিশ্ববাসীকে শুধু গর্বের সঙ্গে সেগুলি দেখাতে পারলেই দেশের নবীন প্রজন্মকে আর কিছু করতে হবে না। ভারতের পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা এতটাই। আমরা এমন সন্তান নই যে, পূর্বজদের ঐতিহ্য ও পরাক্রমকে ভুলে যাব। এগুলি রক্ষা করাও তো আমাদের দায়িত্ব। সেই সংরক্ষণকে আমরা যাতে মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে কর্মসংস্থানে বদলে দিতে পারি, আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যেতে পারি – ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নতুন ভবনটির উদ্বোধনে এরকম নতুন ভাবনাই প্রজ্জ্বলিত হোক। আপনাদের অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানাই।
অনেক অনেক ধন্যবাদ।