মঞ্চে উপস্থিত সকল সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ এবং বিপুল সংখ্যায় উপস্থিত ভাই ও বোনেরা,
কেমন আছেন? আমি দেখতে পাচ্ছি যে, এত বড় প্যান্ডেলেও স্থান সংকুলান হচ্ছে না, ওখানে অনেকে রোদে দাঁড়িয়ে আছেন। আপনারা সবাই এত বিপুল সংখ্যায় আশীর্বাদ দিতে এসেছেন, সেজন্য আমরা সবাই আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আজ আপনারা আমাকে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার প্রকল্প উদ্বোধন কিংবা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সুযোগ করে দিয়েছেন। আপনারা আমাকে এই যে সম্মান দিয়েছেন, এর জন্যও সমবায় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত আমার সমস্ত কৃষক পরিবারকে সাদর প্রণাম ও ধন্যবাদ জানাই।
আজা বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশে আমূল ব্র্যান্ডের একটি বিশেষ পরিচয় গড়ে উঠেছে। বিশ্বের অনেক দেশে সফরে গিয়ে সেদেশের ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর, তাঁদের দেশে আমূল প্রোডাক্ট পাঠানোর ব্যবস্থা করা যায় কিনা – এ ধরণের অনুরোধ শুনে অবাক হয়েছি। আর এসব অনুরোধ শুনে গর্বিত হয়েছি যে, সাত দশক ধরে কৃষকদের সমবায় আন্দোলনের সাফল্যই দেশে-বিদেশে আমূলকে এত বিখ্যাত করে তুলেছে। অনেকের কাছেই এখন আমূল একটি প্রেরণা, একটি অনিবার্যতায় পর্যবসিত হয়েছে – এই সিদ্ধি কম কথা নয়। এটি অনেক বড় সাফল্য। আমূল নিছকই কোনও উৎপাদনকারী সংস্থা নয়, শুধু দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ নয়; এটি একটি বিকল্প অর্থনীতির মডেল হিসাবেও সুপ্রতিষ্ঠিত। একদিকে সমাজবাদী অর্থনীতি, অন্যদিকে পুঁজিবাদী অর্থনীতি, একদিকে সরকার নিয়ন্ত্রিত অর্থ ব্যবস্থা, অন্যদিকে ধনী ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রিত অর্থ ব্যবস্থা – বিশ্ব এই দুই অর্থ ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু আমাদের দেশে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের মতো মহাপুরুষরা এমন একটি বীজ বপণ করে গেছেন, যা আজ তৃতীয় অর্থ ব্যবস্থার রূপ ধারণ করে মহীরূহে পরিণত হয়েছে। এতে সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে না, ধনী ব্যবসায়ীদেরও নিয়ন্ত্রণ থাকে না; তা সমবায় আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কৃষক ও সাধারণ মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন অর্থ ব্যবস্থা রূপে অঙ্কুরিত হয়, বৃদ্ধি পায় এবং সকলেই এর অংশীদার হন।
এই অর্থ ব্যবস্থার অভিনব মডেলটি সমাজবাদ ও পুঁজিবাদকে একটি সার্থক বিকল্প প্রদান করে। আমরা সবাই ভালোভাবে জানি যে, স্বাধীনতার প্রায় এক বছর আগে এই আমূলের একটি আইনসম্মত রূপ গড়ে উঠেছিল, কিন্তু সমবায় আন্দোলন তার আগে থেকেই চলছিল। খুব কম মানুষই জানেন যে, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল যখন আমেদাবাদ মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান ছিলেন, তখন আমেদাবাদের কর্পোরেশন ছিল না, নগরপালিকা ছিল …… সেই নগরপালিকায় সর্দার সাহেব দরিয়াপুর থেকে নির্বাচনে জিতে এসেছিলেন, সেই দরিয়াপুর থেকে আগে কৌশিকভাই জিততেন, কিন্তু সেবার সর্দার সাহেব মাত্র এক ভোটে কৌশিকভাইকে হারিয়ে নির্বাচনে জেতার পর মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান হয়েছিলেন।
তিনি চেয়ারম্যান থাকার সময়েই গুজরাটে প্রথমবার নগরোন্নয়নের পরিকল্পনা পেশ করা হয়েছিল। আর তখনই তিনি প্রথমবার ‘কো-অপারেটিভ হাউসিং সোসাইটি’র প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। এটি ছিল সমবায়-ভিত্তিক গৃহ নির্মাণের কাজ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির জন্য গৃহ নির্মাণের প্রস্তাব। এই প্রস্তাব পাশ হওয়ার পর সর্দার সাহেব গুজরাটের ওয়রদেশ-এ প্রথম হাউসিং সোসাইটি নির্মাণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ঐ মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি প্রীতম রায় দেশাইকে। তাঁরই নেতৃত্বে ঐ কো-অপারেটিভ হাউসিং সোসাইটি গড়ে ওঠার পর ১৯২৭ সালে ২৮ জানুয়ারি সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল সেটির উদ্বোধন করেছিলেন। এই উদ্বোধনের মাধ্যমেই দেশের সামনে একটি নতুন উন্নয়নের মডেল দৃষ্টান্ত হিসাবে স্থাপিত হয়। সর্দার সাহেব প্রীতম রায় দেশাইয়ের নামেই সেই সোসাইটির নাম রাখেন প্রীতম নগর। আজও আমেদাবাদে ঐ প্রীতমনগর সমবায় আন্দোলনের প্রথম সফল প্রয়োগ রূপে গোটা দেশকে পথ দেখাচ্ছে। সেই আন্দোলন পরবর্তী সময়ে গুজরাট ও মহারাষ্ট্রে আরও সাফল্যলাভ করে; সে সময়ে ছিল বৃহৎ মহারাষ্ট্র। এই গোটা অঞ্চলে সমবায় নিছকই একটি ব্যবস্থা নয়, নিয়ম-নির্ধারিত কোনও সৃষ্টি নয়, একটি সংস্কার রূপে এখানকার মানুষের মনে স্থান করে নেয়। আর তারই পরিণাম স্বরূপ আজ গুজরাট সমবায় আন্দোলনে সারা দেশের সামনে দৃষ্টান্ত স্বরূপ সাফল্য অর্জন করেছে।
আমূলের আগে উত্তর গুজরাটে এই দুগ্ধ সমবায় আন্দোলন শুরু হয়েছিল। দুগ্ধসাগর ডেয়ারি এবং বনাস ডেয়ারি বেশ সুনাম অর্জন করে। আমি মনে করি, এই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষদের নেতৃত্বে সমবায় আন্দোলন আগে যে গুজরাটে প্রতি ১০ বছরের মধ্যে ৭ বছরই খরাক্রান্ত হয়ে পড়তো, এখানকার কৃষক ও পশুপালকদের অনেকটাই সেই পরিস্থিতির মোকাবিলায় সাহায্য করবে।
পরবর্তী সময়ে এমন সময়ও আসে, যখন কোনও না কোনও কারণে গান্ধীনগরে ক্ষমতাসীন রাজ্য সরকার এই সমবায় আন্দোলন ও ডেয়ারি উদ্যোগকে খর্ব করার জন্য আইন প্রণয়ন করে। ফলে, কচ্ছ-সৌরাষ্ট্রে ডেয়ারি গড়ে তোলা ও পরিচালনা করা বোঝাস্বরূপ হয়ে ওঠে। অথচ গুজরাটে অধিকাংশ পশুপালকরাই থাকেন কচ্ছ-সৌরাষ্ট্রে। গুজরাটের জনগণ যখন আমাদের হাতে রাজ্যের প্রশাসন তুলে দেন, তখন আমরা আবার এই চিত্রটি বদলে দিই। ডেয়ারি উদ্যোগে আবার সুদিন ফিরে আসে।
কেউ কেউ নিজেদের ভীষণ জ্ঞানী বলে মনে করেন, কিন্তু তাঁদের এক্তিয়ারের বাইরে কিছু উপস্থিত হলে মনের অহঙ্কার থেকে সেটাকে স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকেন না, বিরোধিতারও সাহস নেই আর সেজন্য বিদ্রুপ করার পথ অনুসরণ করেন।
আমার মনে পড়ে, যখন কচ্ছ-এ ‘হোয়াইট ডেজার্ট – রান উৎসব’ চালু করছিলাম, ভয়ানক ভূমিকম্পের পর কচ্ছের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে বহুবিধ প্রকল্প রচনার মাধ্যমে ঐ বিধ্বস্ত অঞ্চলটিকে উন্নয়নের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে চাইছিলাম, তখন আমার একটি ভাষণে বলেছিলাম যে, উটের দুধে অনেক বেশি পুষ্টিমূল্য থাকে। আমাদের শিশুদের পুষ্টি বিকাশে উটের দুধ উপযোগী ভূমিকা পালন করতে পারে। জানি না কেন, তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একথা বলে কি পাপ করেছিল যে, তাকে নিয়ে উট ও উটের দুধ মিলিয়ে কার্টুন ছাপা হ’ত, সংবাদ মাধ্যমে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা হ’ত, জনসভায় আজেবাজে মন্তব্য করা হ’ত। আজ আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে, আমূল উৎপাদিত উটের দুধ থেকে তৈরি চকোলেটের চাহিদা ক্রমবর্ধমান। একটু আগেই রামসিং ভাই আমাকে বলছিলেন যে, এখন উটের দুধের দাম গরুর দুধের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে।
কখনও অজ্ঞানতার বশে মানুষ কী কী করতে পারে, এটা তার উদাহরণ। এখন মরু অঞ্চলে বসবাসকারী উটপালকেরা এত বড় বাজার পেলে তাঁদের উপার্জন বৃদ্ধি পাবে, আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে আমূল আজ আমার এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করেছে। আমি মনে করতাম যে আমাদের দেশে পুষ্টি বৃদ্ধির জন্যে অনেক কাজ করার প্রয়োজন রয়েছে।
আমি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলাম, তখনও পুষ্টি আন্দোলন গড়ে তুলতে অনেক উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কারণ আমার মতে, মা ও শিশুর পুষ্টি বৃদ্ধি হলে দেশ স্বাস্থ্যবান হবে।
আরেকটি কারণে আমি আজ খুব খুশি, এখানে আজ সৌরশক্তি এবং সমবায় আন্দোলনের সমন্বয়সাধন করা হয়েছে। ক্ষেতে ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি এখন বিদ্যুৎ-ও উৎপাদিত হবে। যে ১১ জন কৃষক একত্রে সমবায় সমিতি গড়ে তুলে চাষের ক্ষেতকে ব্যবহার করে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করছেন, আমি তাঁদের অভিনন্দন জানাই। নীতি পরিবর্তনের মাধ্যমে তাঁদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বর্তমান রাজ্য সরকার কিনে নিচ্ছে। আমাকে বলা হয়েছে যে, এই সৌরবিদ্যুৎ থেকে এই কো-অপারেটিভ এক বছরে ৫০ হাজার টাকা অতিরিক্ত উপার্জন করবে। সমবায় ক্ষেত্রে এই চতুর্মুখী বিকাশ কৃষকদের মনে যে কোনও মুহূর্তে যে কোনও ধরণের সমস্যা মোকাবিলার সাহস গড়ে তুলছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হ’ল জন ধন, বন ধন এবং গোবর্ধন। বর্জ্য থেকে সম্পদ, পশুর মলমূত্র থেকেও সম্পদ আহরণের জন্য গোবর থেকে গ্যাস উৎপাদন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার উৎপাদন। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ড্যাকর উমরেথের কাছাকাছি ১০-১২টি গ্রাম থেকে গোবর সংগ্রহ করে আমাদের একজন উৎসাহী আধিকারিক প্রথম একটি প্রকল্প চালু করেছিলেন। সেই প্রকল্প থেকে গোবর গ্যাস উৎপাদন করে তিনি ঐ ১০-১২টি গ্রাম ছাড়াও আশেপাশের আরও গ্রামে গ্যাস সরবরাহ শুরু করেছিলেন। আজ যেমন ১১ জন কৃষক একত্রিত হয়ে একটি সৌর পাম্পের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিক্রি করতে পারছেন, তেমনই প্রত্যেক ১০-১১টি গ্রাম একত্রিত হয়ে এই ধরণের বড় গোবর্ধন আন্দোলন গড়ে তুলে উপার্জন বৃদ্ধি করতে পারেন।
আমি আজ চরোতর-এর মাটিতে এসেছি, সর্দার সাহেবের তপস্যায়, অনেক সমবায় আন্দোলনের নেতাদের তপস্যায় এখানকার জনমানসে যে সংস্কার গড়ে উঠেছে, আশা করি আগামীদিনে আমূল পথ দেখাবে, গোবর্ধন যোজনা পথ দেখাবে, গোবর্ধন যোজনাই সঠিক অর্থে স্বচ্ছ ভারত অভিযানেরই অংগ, বর্জ্য থেকে সম্পদ আহরণ হবে, পরিবেশবান্ধব জ্বালানী উৎপাদিত হবে; বিদেশ থেকে যা বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয় – তার উপর নির্ভরতা কমবে। ফলে যে অর্থ সাশ্রয় হবে তা দিয়ে দেশের মানুষকে সেবা করার সুযোগও বাড়বে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আগামীদিনেও আপনারা এরকম নিজেদের দেশের সামনে আরও দৃষ্টান্ত স্থাপনে সক্ষম হবে।
আর দু’বছর পর আমূল-এর ৭৫ বছর পূর্ণ হবে, আর ২০২২এ ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ হবে। আমি অনুভব করেছি যে আমূল কখনও থামতে পারে না, নতুন ভাবনা, নতুন উদ্যম, নতুন কিছু করার সাহসই আমূল-এর প্রকৃতি। এখানকার সমস্ত সদস্য, এখানকার কর্মসংস্কৃতি, এই ব্যবস্থাকে নেতৃত্ব প্রদানকারীদের পেশাদারিত্ব, এখানকার সমবায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে আমি ভালভাবে চিনি। আমি তাঁদের সকলের সঙ্গে অনেক বছর ধরে যুক্ত। তাঁরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত সাহসী এবং নতুন কিছু করা তাঁদের স্বভাবজাত।
আমি আমূলের সমস্ত পেশাদারদের সমবায় আন্দোলনের সমস্ত নেতাদের একটি অনুরোধ জানাতে এসেছি, দু’বছর পর যখন আমূলের ৭৫ বছর পূর্ণ হবে, আর তারপরই ২০২২ সালে যখন ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ হবে – এই দুই বিশেষ উপলক্ষ্যকে মাথায় রেখে আমূল কী নতুন কোনও লক্ষ্য স্থির করতে পারে? আমাদের হাতে মাত্র কয়েকটি বছর সময় রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে আমরা লক্ষ্য স্থির করে দেশ ও বিশ্বের সামনে নতুন কোনও দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারি কি না?
আজ গোটা বিশ্বে আমরা দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণে ১০ নম্বর স্থানে রয়েছি। আমূল যদি চায়, সংকল্প করে যে, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির আগেই আমরা দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণে এগিয়ে দেশকে ১০ থেকে ৩ নম্বর স্থানে পৌঁছে দেব, আর সেই লক্ষ্যে কাজ করতে থাকি, তা হলে আমার মনে হয় এটা অসম্ভব নয়।
একটা সময় ছিল, যখন আমাদের দেশবাসী নানারকম অভাব নিয়ে বাঁচতেন। নানা অভাব থেকে মানুষের জীবনে যেসব সমস্যা সৃষ্টি হ’ত, সেগুলির বিরুদ্ধে লড়তে হ’ত। তখন সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া, ভাবনাচিন্তা এবং কর্মসংস্কৃতি ভিন্ন ছিল। আমরা দায়িত্ব গ্রহণের পর দ্রুতগতিতে দেশকে সেসব সমস্যা থেকে বের করে আনতে সক্ষম হই। আজ আমাদের সামনে অভাব কোনও সঙ্কট নয়। আজ দেশের সামনে প্রধান সমস্যা হ’ল বিপুলতা। দেশের কৃষকরা এত এত শস্য ফলান যে কখনও কখনও বাজার পড়ে যায়। আর বাজার পড়ে গেলে কৃষকের যে লোকসান হয়, তার মূলে কোনও অভাব নয়, ফলনের বিপুলতাই দায়ী।
আগে উৎপাদন কম হ’ত, বিদেশ থেকে গম আমদানি করতে হ’ত। কৃষি বিপ্লবের ফলে দেশের অন্ন ভাণ্ডার স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। তেমনই, শ্বেত বিপ্লবের ফলে দেশে দুধের সমস্যাও মেটে। এখন আমাদের প্রয়োজন থেকেও বেশি কিছু উৎপাদনকে নিয়ন্ত্রণের সমস্যায় আমরা ভুগছি। এই পরিস্থিতি থেকে বেরোনোর একমাত্র উপায় হ’ল মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে নানা রকমভাবে প্রক্রিয়াকরণ। আমাদের ডেয়ারি উদ্যোগ, প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে দুধের নানা রকম সামগ্রী, পশুপালকদের উপার্জন বৃদ্ধি না করলে পশু পালন ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না।
তেমনই, কৃষিজাত পণ্যের ক্ষেত্রেও মূল্য সংযোজন অনেক প্রয়োজন। আমি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলাম, এখানেই একদিন কৃষি মহোৎসব উপলক্ষে এসেছিলাম। এখানে আমার এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। তাঁকে কোট-প্যান্ট-টাই পরিহিত অবস্থায় দেখে আমি অবাক হয়ে বলি, তুমি তো অনেক বদলে গেছো। কি করছো আজকাল?
তিনি জবাব দেন, আমি দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে পাউডার বানিয়ে বিক্রি করা শুরু করে লাভবান হয়েছি।
এর মানে মূল্য সংযোজন। পাউডার দুধের পুষ্টিমূল্য দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায় – এই ধারণাই অনেকের ভাগ্য বদলে দিয়েছে। আমাদের প্রত্যেকটি কৃষিজাত পণ্যের সেই শক্তি রয়েছে। টমেটোর ফলন বেশি হলে এর বাজার পড়ে যায়। কারণ, টমেটো ২-৩ দিনের মধ্যেই পচে যায়। কিন্তু মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে টমেটোর প্রক্রিয়াকরণ করে সস্ উৎপাদন করলে ভালো বোতলে প্যাকিং হলে মাসের পর মাস খারাপ হয় না। আর দেশ তথা বিশ্বের বাজারে ভালো দামে বিক্রি হয়। আমাদের কৃষকদের লোকসান হয় না। সেজন্য আমাদের দুধের মতো প্রতিটি কৃষিজাত পণ্যের মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে প্রক্রিয়াকরণ করে নানারকম রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদনের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। সেজন্য কেন্দ্রীয় সরকার প্রধানমন্ত্রী কৃষি সম্পদা যোজনার মাধ্যমে নানাভাবে সাহায্য করছে।
আমি একদিন ডেয়ারি ব্যবস্থাপকদের কাছে এরকম কিছু আবেদন রেখেছিলাম, আমরেলি এবং বনাস ডেয়ারি আমার আবেদনে সারা দিয়ে এগিয়ে এসেছিল, আমার অজান্তে আরও কোনও কোনও ডেয়ারিও এগিয়ে এসে থাকতে পারে। আমি বলেছিলাম যে, শ্বেত বিপ্লবের মতোই এখন আমাদের মিষ্টি বিপ্লব গড়ে তোলা উচিৎ। আমাদের পশুপালক বন্ধুদের আপনারা মউ পালনের প্রশিক্ষণ দিন। তাঁদের উৎপাদিত মধু আপনাদের দুধের কাউন্টার থেকে বিক্রি করুন। আপনাদের প্ল্যান্টে বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ্যের যেমন প্যাকেজিং করেন, মধুরও সেরকমই প্যাকেজিং করুন। আমরেলি এবং বনাস এই দুটি বড় ডেয়ারি সংগঠন আমার কথায় সারা দিয়ে মধু উৎপাদনে এতটাই সাফল্য পেয়েছে যে, এখন ভারত আগের তুলনায় অনেক গুণ মধু উৎপাদন শুরু করেছে। আগে যে মধু বিদেশ থেকে আমদানি করতে হ’ত, এখন আমাদের দেশ থেকে মধু রপ্তানি হচ্ছে। মধু এমন একটি জিনিস, তা যদি ঠিক সময়ে বিক্রি না হয়, নষ্ট হয়ে যাবে না। বাড়ির ছেলেমেয়েরা মধু খেলে তাঁদের পুষ্টি বৃদ্ধি হবে। মধু উৎপাদনের জন্য কোনও পরিশ্রম করতে হয় না। যত ছোট চাষের ক্ষেতই হোক না কেন, মউ পালন সম্ভব। তেমনই সোলার প্যানেলও যে কোনও মাপের চাষের ক্ষেতে লাগানো যায়। এভাবেই আমরা ২০২২ সালে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির আগেই ভারতের কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার জন্য তাঁদেরকে অনেক অনেক প্রকল্পে যুক্ত করছি।
আমি আশা করি যে, আপনারা সবাই এর সঙ্গে যুক্ত হবেন। আরেকটি অনুরোধ আমি করেছিলাম, যা আমি মুখ্যমন্ত্রী থাকা অবস্থায় বাস্তবায়িত হয়নি। এখনও হয়নি, কিন্তু আমরা করতে পারি। যেমন, এখানে ‘টেক হোম রেশন’ এ বিষয়ে অনেক কাজ হয়েছে। আপনাদের ‘বাল আমূল’ প্রকল্প দেশে শিশুদের পুষ্টিবর্ধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দেশে মিড-ডে-মিল প্রকল্পে আপনাদের উৎপাদিত পণ্য আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যে গ্রামগুলিতে আমরা দুধ সংগ্রহ করতে যাই, কেন্দ্রীয়ভাবে যদি রান্নার ব্যবস্থা করা যায়, তা হলে দুধের গাড়িতে করেই স্কুলে-স্কুলে শিশুদের জন্য পুষ্টিকর ও উপাদেয় মিড-ডে-মিল পৌঁছে দিতে পারি। পরের দিন দুধের গাড়িতে তাদের খালি টিফিন বক্স ফেরৎ আসতে পারে। এভাবে কোনও রকম অতিরিক্ত পরিবহণ খরচ ছাড়াই খুব সহজে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পুষ্টিবর্ধনে আমরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারি। আমাদের দুগ্ধ মণ্ডলী যেখানে যেখানে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে, সেখানকার স্কুলগুলি মিড-ডে-মিল বাবদ সরকার প্রদত্ত অর্থ দিয়ে এই টাটকাতাজা খাদ্য কিনতে পারে। শুধু সঠিক সমন্বয় ও ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন।
আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে পারি যে, ইস্কন যেভাবে সাফল্যের সঙ্গে অত্যাধুনিক মিড-ডে-মিল প্রকল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আমাদের ডেয়ারি প্রকল্পগুলির মিলিত প্রয়াসের আমাদের এলাকাগুলিতে এরকম শক্তিশালী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি। একই ব্যবস্থায় বহুমুখী উপযোগ – একথা মাথায় রেখে পরিকল্পনা করলে শুধু কিছু সীমিত ক্ষেত্র নয়, জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে আমরা প্রভাব ফেলার মতো কাজ করতে পারি। এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
আমাদের দেশে গোচারণ ভূমি নিয়ে পশুপালকদের মধ্যে প্রায়শই ঝগড়া হয়। কিন্তু আমার মনে আছে যে, ধর্মচ এলাকার পশুপালক ভাইয়েরা অনেকে বছর আগেই সমবায় সমিতি গড়ে তুলে গোচারণের ক্ষেত্রে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। নিজেদের পশুদের প্রয়োজন মিটিয়ে তাঁরা আশেপাশের গ্রামেও বাড়িতে বাড়িতে নিয়মিত সবুজ ঘাস পৌঁছে দিতেন। পরবর্তী সময়ে অনেকেই তাঁদের দেখাদেখি গোচারণ সমবায় সমিতি গড়ে তুলেছিল। এখন সেই সমিতিগুলি কী অবস্থায় আছে আমি জানি না।
কিন্তু তাঁদের উদাহরণ দেওয়ার উদ্দেশ্য হ’ল সমবায়ের অভ্যাস যখন সংস্কারে পরিণত হয়, তখন সমবায় কিরকম ব্যাপক রূপ ধারণ করতে পারে, আর আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরস্পরের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে আমরা কিভাবে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে কাজ করতে পারি!
আমি আরেকবার আমূল পরিবারের চতুর্মুখী উন্নতির জন্য আমার প্রগতিশীল কৃষক ও পশুপালক বন্ধুদের অভিনন্দন জানাই। সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল ও অন্যান্য মণীষীদের প্রদর্শিত পথে চলতে চলতে আপনারা প্রজন্মান্তরে যে উন্নত পরম্পরা গড়ে তুলেছেন, তা সমবায় ক্ষেত্রকে আজ বহুবিধ প্রকল্পের মাধ্যমে গুজরাটের মাটিকে, দেশের মাটিকে অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে সমর্পণের অনুভূতি নিয়ে আপনাদের সবাইকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানাই। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই যে, এই সমস্ত প্রকল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কেন্দ্রীয় সরকার কখনও পিছিয়ে থাকবে না। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আপনাদের উন্নয়ন যাত্রায় সহযোগীর ভূমিকা পালন করবে। আপনাদের সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমার সঙ্গে সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে বলুন –
ভারতমাতা কি – জয়।
আরে ভাই কী হ’ল – এটা তো আমার চরোতর। এত দুর্বল প্রতিধ্বনি কেন?
ভারতমাতা কি – জয়।
এই না হলে চরোতর – সাবাশ।
ধন্যবাদ।