মাননীয় সভাপতি মহোদয়,
আমি সবার আগে আমার নিজের এবং সভার সকলের পক্ষ থেকে নবনির্বাচিত উপ–সভাপতি শ্রী হরিবংশ নারায়ণ সিং মহোদয়কে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই। আমাদের জন্য আরও আনন্দের বিষয় হল আরোগ্যলাভের পর মাননীয় অরুণ জেটলিও আজ আমাদের মধ্যে উপস্থিত হয়েছেন। আজ ৯ই আগস্ট। আগস্ট বিপ্লব ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, আর সেই অধ্যায়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মবলিদানের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। উত্তরপ্রদেশের বালিয়া স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি দুর্গ ছিল। ১৮৫৭-র স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে স্বাধীনতা অর্জনের লগ্ন পর্যন্ত বালিয়া বিপ্লবের বিউগল বাজিয়ে, অসংখ্য মানুষের আত্মোৎসর্গ করার ক্ষেত্রে সামনের সারিতে ছিল। মঙ্গল পাণ্ডে থেকে শুরু করে চিত্তু পাণ্ডে হয়ে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রদ্ধেয় চন্দ্রশেখর পর্যন্ত যে পরম্পরা, তারই সুযোগ্য উত্তরাধিকারী এই শ্রদ্ধেয় হরিবংশ নারায়ণ সিং মহোদয়। তাঁর জন্ম হয়েছে অবিসংবাদী জননেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের গ্রামে। আজ তিনি সেই গ্রামের সঙ্গেই জুড়ে রয়েছেন। জয়প্রকাশ নারায়ণের স্বপ্নগুলি বাস্তবায়ণের লক্ষ্যে গঠিত একটি ট্রাস্ট-এর ম্যানেজিং ট্রাস্টিরূপে তিনি সেটি পরিচালনা করেন। একজন লেখক হিসেবেও তিনি স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী ও যথেষ্ট জনপ্রিয়। তাঁর শিক্ষাজীবন কেটেছে বেনারসে। সেখান থেকেই তিনি অর্থশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর হওয়ার পর প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সসম্মানেউত্তীর্ণ হয়ে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কে নির্বাচিত হন। কিন্তু তিনি সেখানে যোগদান করেননি। আরও উচ্চশিক্ষার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বাড়ির পরিস্থিতির কারণে তিনি আবার প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে একটি রাস্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে কর্মজীবন শুরু করেন। সভাপতি মহোদয়, আপনি শুনে খুশি হবেন যে তিনি জীবনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বছর কর্মসূত্রে হায়দ্রাবাদে অতিবাহিত করেন। কখনও মুম্বাই, কখনও হায়দ্রাবাদ, কখনও দিল্লিতে কাটিয়ে একসময় তিনি ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে কলকাতায় গিয়ে ‘রবিবার’ নামক খবরের কাগজে যোগ দেন। সাংবাদিক হিসেবে তাঁর খুব নাম হয়। এস পি সিং নামে লিখতেন। টি ভি সাংবাদিক হিসেবেও তিনি বেশ নাম করেন। বিশিষ্ট সাংবাদিক ধর্মবীর ভারতীর সুযোগ্য শিষ্য হিসেবে কাজ শুরু করে হাত পাকিয়ে তিনি পরবর্তীকালে ‘ধর্মযুদ্ধ’ পত্রিকায় কাজ করেন।
পরবর্তীকালে দিল্লিতে শ্রদ্ধেয় চন্দ্রশেখরজীর সঙ্গে কাজ করেন। চন্দ্রশেখরজী তাঁকে খুব ভালবাসতেন। পদের গরিমা এবং মূল্যবোধেবলিয়ান এই মানুষটি আগে থেকেই জানতেন যে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে চন্দ্রশেখরজী পদত্যাগ করতে চলেছেন। শ্রী হরিবংশ নারায়ণ সিং মহোদয় তখনও সাংবাদিক এবং একটি খবরের কাগজের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু নিজের কাগজকেও ঘুণাক্ষরে জানতে দেন নি যে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করতে চলেছেন। নিজের পদের গরিমা অনুসারে তিনি এই গোপনীয়তা রক্ষা করেন। এমন খবর জানা থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজের খবরের কাগজকেও স্কুপ করে বাহবা কুড়োতে দেননি।
হরিবংশ নারায়ণ সিং আবার ‘রবিবার’ কাগজের বিহার সংস্করণের দায়িত্ব নেন। তখন ছিল অবিভক্ত বিহার। তারপর ঝাড়খণ্ড হল। তিনি রাঁচি চলে গেলেন। সেখানে ‘প্রভাত খবর’ কাগজে যোগ দেন। তখন ‘প্রভাত খবর’ এর সার্কুলেশন ছিল মাত্র চারশো। তাঁর জীবন এত বর্ণময়, এতবছর ব্যাঙ্কে চাকরি করেছেন, প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব; তিনি মাত্র চারশো সার্কুলেশনসম্পন্ন কাগজে যোগদান করে নিজের সামর্থ্যে কাগজটিকে বাণিজ্যিক সফল করে তোলেন, জনগণের মুখপত্র করে তোলেন। রাজনীতি থেকে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেন। এটাই তাঁর সাফল্যের মূল কারণ যে তিনি নিজেকে রাজনীতি থেকে দূরে রেখে নিরন্তর সামাজিক সংস্কারের পক্ষে লড়াই চালিয়ে যান। একটি গণআন্দোলন গড়ে তোলার মিশন নিয়ে তিনি কাগজ চালাতেন।সাধারণমানুষশুধুঐ সংবাদপত্রের পাঠক ছিলেন না, অংশীদার হয়ে উঠেছিলেন, ‘প্রভাত খবর’ তাদের মুখপত্র হয়ে উঠেছিল। আজ থেকে বছর বিশেক আগে একদিন হরিবংশ নারায়ণ সিং-এর কাছেখবর আসে যে একাত্তরের যুদ্ধে শহিদ হওয়া মরণোত্তর পরমবীরচক্র বিজয়ী অ্যালবার্ট এক্কার স্ত্রী খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। হরিবংশজি দায়িত্ব নিয়ে পাঠকদের কাছে আবেদন জানিয়ে অর্থসংগ্রহ করে নিজে গিয়ে চার লক্ষ টাকা মরণোত্তর পরমবীরচক্র বিজয়ী অ্যালবার্ট এক্কার স্ত্রীর হাতে পৌঁছে দিয়েছিলেন। একবার একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিকে নকশালরা উঠিয়ে নিয়ে গেলে হরিবংশজি তাঁর কাগজের সোর্স-এর সাহায্য নিয়ে নকশাল অধ্যুষিত অঞ্চলে চলে যান। আর বিভ্রান্ত যুবকদের সঙ্গে কথা বলে, বুঝিয়ে সেই ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে আনেন। নিজের জীবনের পরোয়া করেন নি! অর্থাৎ, এমন একজন মানুষ আমাদের এই হরিবংশ নারায়ণ সিং মহোদয়, যিনি অনেক বই লেখার আগে অনেক অনেক বই পড়েছেন, আর খবরের কাগজ পরিচালনা করা, সাংবাদিকদের যথাযথ সংবাদ পরিবেশনে উদ্বুদ্ধ করা কখনোই সহজ কাজ নয়। সমাজের জন্য কাজ করা, সমাজ সংস্কারকের ভূমিকা পালন করা – রাজনীতি থেকে অনেক কঠিন কাজ। রাজনীতিজ্ঞ হিসেবেও সাংসদরূপে তাঁর সফল কার্যকালের অভিজ্ঞতা সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু সংসদে অধিকাংশ সময় খেলোয়াড়দের থেকেআম্পায়ারকে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। সবাই যাতে নিয়ম মেনে খেলে তা সুনিশ্চিত করা, অত্যন্ত কঠিন কাজ। আমার বিশ্বাস, হরিবংশজি অবশ্যই এক্ষেত্রেও সফল হবেন।
হরিবংশজীর স্ত্রী আশাজী চম্পারণের মেয়ে। অর্থাৎ, একটি এমন পরিবার যাদের সম্পর্ক মহাত্মা গান্ধী থেকে জয়প্রকাশ নারায়ণ, আর পড়াশুনা রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে, এই প্রেক্ষিত এখন আপনাদের জীবনে খুবই কাজে লাগবে। আমার বিশ্বাস, এখন এই সভার মন্ত্র হয়ে উঠবে, আমাদের সকল সাংসদদের হরিকৃপার জন্য হরি -ভরসায় অপেক্ষা করতে হবে! আর আমি নিশ্চিত যে, আমরা সভাকক্ষের ডানদিকে কিম্বা বাঁদিকে; সেখানেই বসি না কেন, হরিকৃপা থেকে কেউই বঞ্চিত হবো না! এই নির্বাচন এমন ছিল যে দুদিকেই হরি ছিলেন। আজ শ্রী হরিবংশ নারায়ণ সিং মহোদয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন হরিপ্রসাদজী। তাঁর নামের আগে ‘বি কে’ রয়েছে। আমি হরিপ্রসাদজিকে ধন্যবাদ জানাই গণতন্ত্রের গরিমা উচ্চে তুলে ধরে নিজের দ্বায়িত্ব পালনের জন্যে… অনেকেই বলছিলেন যে পরিণাম তো জানি, কিন্তু সাংবিধানিক প্রক্রিয়া যথাযথভাবে পালন করতে হবে। অনেক নতুন সাংসদ এই প্রক্রিয়ার প্রশিক্ষিতও হলেন…… ভোট দিলেন।
আমি এই সভায় উপস্থিত সকল মাননীয় সদস্য, সম্মানিত ব্যক্তিকে এই সাংবিধানিক প্রক্রিয়া খুব সুন্দরভাবে পালনের জন্যে ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানাই। নবনির্বাচিত উপসভাপতিশ্রী হরিবংশ নারায়ণ সিং মহোদয়ের একটি বৈশিষ্ট, তিনি নিজের খবরের কাগজে একটি নিয়মিত কলাম লিখতেন, সেই জনপ্রিয় কলামটির শীর্ষক ছিল, ‘হমারা সাংসদ কেয়সা হোনা চাহিয়ে’(আমাদের সাংসদ কেমন হওয়া উচিত)। তখন তো তিনি এও জানতেন না যে নিজে কোনোদিন সাংসদ নির্বাচিত হবেন। কিন্তু তিনি সাংসদ কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে দীর্ঘদিন লিখেছেন। আর পরে নিজে সাংসদ হয়ে সেসব স্বপ্ন নিজের সাংসদীয় এলাকায় সফল বাস্তবায়ণের সুযোগ পেয়ে তার সদ্ব্যবহারও তিনি করেছেন। এখন তাঁর কাছ থেকে আমাদের সাংসদরা মাঝেমধ্যেই প্রশিক্ষণের সুযোগ পাবেন। এই সংসদে এবং দেশে বিদেশে প্রায়ই যে দশরথ মাঝির প্রসঙ্গ ওঠে, আলোচনা হয়; অনেকেই জানেন না যে সেই দশরথ মাঝির অবিশ্বাস্য কীর্তিকলাপের সঙ্গে সবাইকে প্রথম পরিচয় করিয়েছিলেন এই হরিবংশজিই। তিনিই অনেক অনুসন্ধানের পর এই অত্যন্ত সাধারণ অসাধারণ জেদী মানুষটির কথা পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসেন। অর্থাৎ, সমাজের নিম্নবর্গের সঙ্গে নিয়মিত যুক্ত থাকা একজন মহান মানুষ, শ্রী হরিবংশ নারায়ণ সিং মহোদয় আজ থেকে এই সভাকে নেতৃত্ব দিতে চলেছেন।
আমার তরফ থেকে তাঁকে অনেক অনেক শ্রদ্ধা, অনেক অনেক শুভেচ্ছা।