আজ আপনাদের সামনে আসার সুযোগ হয়েছে, আর যেভাবে পর্তুগালের প্রধানমন্ত্রী, পর্তুগালসরকার এবং এখানকার সাধারণ মানুষ আমাদের স্বাগত ও সম্মান জানিয়েছেন, তার জন্য আমি১২৫ কোটি ভারতবাসীর পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই। কারণ, আপনারা আমাকে সম্মান জানানোর মাধ্যমে ১২৫ কোটিভারতবাসীকে সম্মানিত করেছেন।
এই রাধাকৃষ্ণ মন্দির এক প্রকার এখানকার সামাজিক চেতনার মন্দির। সকলসম্প্রদায়ের মানুষ এবং তাঁদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আজ সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয়েছে। এইভেদাভেদহীন মিলনই ভারতের বৈশিষ্ট্য। এই বৈচিত্র্যই ভারতের পরিচয়, এটাই ভারতেরশক্তি।
কয়েক দিন আগে পর্তুগাল একটি বড় দাবানলে বিধ্বস্ত হয়েছে। অসংখ্য মানুষ পুড়ে ছাই হয়ে গেছেন। যাঁদের মৃত্যুহয়েছে, তাঁদের সকলের প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাই আর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, তিনিযেন তাঁদের পরিবারের সদস্যদের শক্তি দেন।
পর্তুগালের সঙ্গে ভারতের একটি পরম্পরাগত সম্পর্ক রয়েছে, ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।গুজরাটের সঙ্গে পর্তুগালের সম্পর্ক আরও নিবিড়। আমরা ছোটবেলায় শুনেছি যে, ভাস্কো দাগামা যখন ভারতে এসেছিলেন, তখন নাকি কাঞ্জিমালম নামক এক গুজরাটি তাঁকে পথ দেখিয়ে ভারতে নিয়ে এসেছিলেন।কাঞ্জিমালম গুজরাট থেকে সমুদ্রপথে গিয়ে আফ্রিকায় বসবাস শুরু করেছেন, সেখানকার একটিবন্দরে ভাস্কো দা গামার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, তারপর সব ইতিহাস। কাঞ্জিমালমেরমাধ্যমেই গোটা ইউরোপের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্কের সূত্রপাত হয়েছিল। আর তাসম্ভব হয়েছিল পর্তুগাল নাবিকদের মাধ্যমে। কাজেই আমাদের সম্পর্ক অনেক পুরনোসম্পর্ক।
একথা সত্য যে, ভারত স্বাধীন হওয়ার পর বিগত ৭০ বছরে এই প্রথম কোনও ভারতীয়প্রধানমন্ত্রী দ্বিপাক্ষিক সফরে এখানে এসেছে। সেই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করারসৌভাগ্য আমার হয়েছে। শ্রদ্ধেয় অটল বিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তিনিপর্তুগালে এসেছিলেন, কিন্তু দ্বিপাক্ষিক সফরে নয়। ইউরোপীয়ন ইউনিয়নের একটিআলোচনাসভায় তিনি অংশগ্রহণের জন্য এসেছিলেন।
আমি সেই সৌভাগ্যবান ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। আজ পর্তুগালের প্রধানমন্ত্রীরসঙ্গে অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে, বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নেওয়াহয়েছে, যাতে ভারত ও পর্তুগাল সহজেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে পারে। আমাদের অভিজ্ঞতাও শক্তি রয়েছে, পরস্পরের যে প্রয়োজনীয়তা সেগুলি সিদ্ধির উদ্দেশ্যে সম্মিলিতভাবেএগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
পর্তুগালের মহান নেতা শ্রী মারিও সোরেস ১৯৯২ সালে ভারতের স্বাধীনতা দিবসেপ্রধান অতিথি রূপে গিয়েছিলেন। তাঁর শাসনকালে ভারত ও পর্তুগালের পারস্পরিক সম্পর্কেনিবিড়তা বৃদ্ধি পেয়েছিল। সে বছরই তিনি পরলোকগত হলে প্রবাসী ভারতীয়রা তাঁকে শ্রদ্ধাজানিয়েছিলেন। পর্তুগালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক তখন এতটাই উষ্ণ ছিল।
বিগত দিনে পর্তুগালের ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী এবং বর্তমানে রাষ্ট্রসঙ্ঘেরমহাসচিব শ্রী অ্যান্টনিও গুটেরেস-এর সঙ্গে সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয়েছিল রাশিয়ায়। সেদিনতিনি যোগাসন নিয়ে আমার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, তাঁরপরিবারের সকল সদস্যই যোগাসন করেন। যোগের প্রতি তাঁর এই অগ্রাধিকার আজও আমি দেখেছি,এখানকার মানুষ উন্নতমানের যোগ প্রদর্শন করেছেন। ‘ওঙ্কার’ মন্ত্র জপ করেছেন, ‘ওমনমঃ শিবায়’ জপ করেছেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও আমার আজকের আলোচনায় সার্বিকস্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকে শুরু করে প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং সুলভস্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। তিনি অত্যন্ত আত্মবিশ্বাস নিয়েবলছিলেন যে, পর্তুগালবাসীরা সুস্থ থাকার চেয়ে ভালো থাকাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে প্রায়প্রতিটি বিদ্যালয়ে এখন যোগের মাধ্যমে শিশুদের প্রশিক্ষিত করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়েচলেছেন। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে হৃদয় থেকে অভিনন্দন জানাই যে, যোগ আন্দোলনকেগোটা ইউরোপে ছড়িয়ে দিতে পর্তুগাল যেভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছে, বিগত ২১ জুন আন্তর্জাতিকযোগ দিবসে পর্তুগালবাসী যে উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছেন, সেজন্য সকল যোগপ্রেমীভাই ও বোনেদের আমি অন্তর থেকে অভিনন্দন জানাই। মানব কল্যাণের জন্য বিনা খরচেস্বাস্থ্য রক্ষার খাতিরে যে যোগ আন্দোলন শুরু হয়েছে, তাকে এদেশের প্রধানমন্ত্রীযেভাবে উৎসাহ দিচ্ছেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, পর্তুগালের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এর দ্বারাঅত্যন্ত উপকৃত হবে। আর সেজন্য শতাব্দীর পর শতাব্দী কাল ধরে পর্তুগালবাসী তাঁকে মনেরাখবেন।
স্টার্ট আপ ব্যবসার ক্ষেত্রে পর্তুগাল স্বনামধন্য। এখানকার যুবসম্প্রদায়েরপ্রতিভা এবং সরকারের সক্রিয় নীতির মিলিত ফল এই স্টার্ট আপ আন্দোলনে পর্তুগালকেএকটি বড় সৃষ্টিশীল বাণিজ্যপুঞ্জ করে গড়ে তুলছে। আজ ভারত ও পর্তুগাল একটি যৌথপোর্টাল চালু করেছে। এই পোর্টালের মাধ্যমে স্টার্ট আপ-এর ক্ষেত্রে নবীন প্রজন্মেরমানুষেরা তাঁদের উদ্ভাবন সম্পর্কে দু’দেশের মধ্যে অভিজ্ঞতা ও সাফল্যের আদান-প্রদানকরবে এবং এভাবে বিশ্ব মঞ্চে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে উভয় দেশের যুবসম্প্রদায়লাভবান হবেন। কিছুদিন আগে ভারত থেকে ৭০০-রও বেশি যুবক-যুবতী স্টার্ট আপ বিষয়েপর্তুগালের নবীন প্রজন্মের মানুষদের সঙ্গে আলোচনার জন্য এসেছিলেন এবং পরস্পরেরউদ্ভাবন ও অভিজ্ঞতা নিয়ে যে আলাপ-আলোচনা হয়েছে, সেই প্রেরণাদায়ী আলোচনারই ফল আজকেরএই সম্মিলিত পোর্টাল।
ক্রীড়া ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে পর্তুগালের চুক্তি হয়েছে। ফুটবলেক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো সারা পৃথিবীর ফুটবল প্রেমীদের প্রেরণা-স্বরূপ। ভারতেও তিনিযথেষ্ট জনপ্রিয়। এরকম আরও নানা ক্ষেত্রে আমরা মিলেমিশে কাজ করতে পারি। আমাদেরদু’দেশেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রয়েছে। আমরা উভয়েই বিশ্বের সকল সম্প্রদায়কে সঙ্গেনিয়ে এগিয়ে চলার স্বভাবে ধনী। আমরা সম্মিলিতভাবে কাজ করলে শুধু ভারত আর পর্তুগালেরলাভ হবে না, বিশ্ব মানবতার ক্ষেত্রেও আমাদের যৌথ প্রয়াস ফলদায়ী হবে।
ভাই ও বোনেরা, ভারত দ্রুতগতিতে উন্নয়নের নতুন নতুন শিখর অতিক্রম করছে। ভারতসৌভাগ্যবান যে, দেশের ৬৫ শতাংশ জনসংখ্যারবয়স ৩৫ বছরের কম। এহেন যুবক দেশের স্বপ্ন ও যৌবনময়। আর নবীন স্বপ্নের সামর্থ্যঅনেক বেশি থাকে। সেই সামর্থ্য নিয়েই ভারত আজ উন্নয়নের নানা শিখর স্পর্শ করছে। বিগততিন বছর ধরে দেশের প্রধান সেবক রূপে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে। আপনাদের কাছে তো সবখবরই পৌঁছে যায়। আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যে কোনও খবরই সকলে পেয়ে যান। আমিজানি, আপনাদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন, যাঁদের মোবাইলে নরেন্দ্র মোদী অ্যাপ ডাউনলোডকরেছেন। যাঁরা করেননি তাঁরা অবশ্যই করে নেবেন। আমি প্রত্যেক মুহূর্তে আপনাদেরপকেটে থাকি। সেজন্য ভারতের উন্নয়নে সমস্ত খবর আপনারা পেয়ে যান।
মহাকাশ অভিযানে ভারতের বৈজ্ঞানিকরা অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছেন। গতকালইতাঁরা ৩০টি ন্যানো-স্যাটেলাইট উত্থাপন করেছেন। কিছুদিন আগে আমাদের মহাকাশবিজ্ঞানীরা একসঙ্গে ১০৪টি কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে উৎক্ষেপণ করে বিশ্ব রেকর্ডকরেছেন।
অর্থনীতির ক্ষেত্রেও ভারতে বহুবিধ পরিবর্তন আসছে। নতুন নতুন উপযোগী নীতিগ্রহণ করা হচ্ছে। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা অনেক দরজা খুলেদিয়েছি। ভারতে একবিংশ শতাব্দীর অনুকূল পরিকাঠামো নির্মাণে এই প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগকার্যকর ভূমিকা পালন করছে। আমাদের রেল ও সড়ক পথ এখন দ্রুতগতিতে একবিংশ শতাব্দীরঅনুকূল আন্তর্জাতিক মানের হয়ে উঠছে।
পর্যটনের ক্ষেত্রে আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করতে সক্ষমহচ্ছে ভারত। গত এক বছরে দেশে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
আমার বিশ্বাস যে, সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা আমাদের প্রবাসী ভারতীয় ভাই ওবোনেরা এতদিন যেভাবে যেখানেই গেছেন, নিজেদের ঐতিহ্য ও পরম্পরাকে বজায় রেখেছেন,নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছেন – এর ফলেই গোটা বিশ্বেভারতের প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে। ভারতীয়রা এদেশে কেউ নতুন এসেছেন আবার অনেকেই দুই কিংবাতিন প্রজন্ম ধরে রয়েছেন। কিন্তু তাঁরা নিজেদের ঐতিহ্যকে ভুলে যাননি। পাশাপাশি, যেদেশের জল ও খাবার খান, যেদেশের নুন খান – সেদেশের জন্যও প্রাণপন পরিশ্রম করেন।বিশ্বের যেখানেই ভারতীয়রা গেছেন, সেখানকার সমাজের সঙ্গে মিশে গেছেন। তাঁদের উন্নয়নযজ্ঞে ইতিবাচক অংশগ্রহণ ভারতের সম্মান বৃদ্ধি করেছে। সকলের সঙ্গে মিলেমিশে চলার এইভারতীয় স্বভাব গড়ে উঠেছে আমাদের দেশেই। এদেশে আমরা ১০০টিরও বেশি ভাষায় কথা বলি,তার মধ্যে ১,৭০০-রও বেশি কথ্য ভাষা রয়েছে। প্রত্যেক ২০ মাইল দূরত্বেই এদেশেরখাওয়া-দাওয়ার স্বাদ বদলে যায়। এই বিবিধতার মিলনেই আমাদের অপরকে আপন করে নেওয়ারসামর্থ্য গড়ে ওঠে। এভাবেই ভারতীয়রা সারা পৃথিবীতে নিজেদেরকে একটি গ্রহণযোগ্য সমাজহিসাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। একাজ আপনারা করেছেন, আপনাদের পূর্বসূরীরা করেছেন।আপনারাই বিশ্বের সর্বত্র ভারতের সত্যিকরের রাজদূত। আমি আপনাদের সকলকে হৃদয় থেকেঅনেক অনেক কৃতজ্ঞতা জানাই।
আজ আপনাদের মাঝে আসার সুযোগ পেয়েছি। অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমার পক্ষ থেকেআপনাদের সকলকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা। ভিভা পর্তুগাল।