দেশের সামাজিক এবং বাণিজ্যিক নেতৃত্বকে সর্বদা প্রেরণা ও প্রাণশক্তি যোগানকারী শ্রদ্ধেয় রতন টাটা এবং তাঁর এই ঐতিহ্যকে যাঁরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, এন চন্দ্রশেখরণজী, রূপাজী এবং উপস্থিত ভদ্র মহিলা ও ভদ্র মহোদয়গণ,
শ্রদ্ধেয় রতন টাটা, চন্দ্রশেখরণজীর সঙ্গে মিলিত হওয়া কিংবা তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করা সর্বদাই নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়। দেশের সর্ববৃহৎ সংস্থাগুলির অন্যতম প্রতিষ্ঠানকে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব এরা পালন করছেন।
এত বড় দায়িত্ব সত্ত্বেও সর্বদা হাসি মুখে ও উদ্বেগমুক্ত কিভাবে থাকেন, আমার মনে হয়, এই বিষয়েও চন্দ্রশেখরণজীর একটি বই লেখা উচিৎ। আর হ্যাঁ, এই ভাবনা আমার পেটেন্ট নয়। আপনারা তো সত্যি সত্যিই উদ্বেগমুক্ত হয়ে অনেক কাজ করতে পারেন।
বন্ধুগণ,
তিনি বই লিখবেন কি লিখবেন না, তা আমি বলতে পারি না। কিন্তু সর্বদা হাসি মুখে ও উদ্বেগমুক্ত থাকলে কি হয়, তার পরিণাম ‘ব্রিজিটাল নেশন’ রূপে আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে।
ইতিবাচকতা, সৃষ্টিশীলতা এবং গঠনমূলক মনোভাব নিয়ে দেশের সমস্যাগুলির সমাধানে যেসব ভাবনার উদ্ভব হয় – এই বই তারই পরিণাম।
এই ইতিবাচকতা, এই আশাবাদ আমাদের মেধা এবং মানবসম্পদের ওপর এই বিশ্বাসই নতুন ভারতের মূল ভাবনা।
আমার বিশ্বাস যে, এই গ্রন্থ উচ্চাকাঙ্খী ভারতকে তো প্রেরণা যোগাবেই, সমাজের কিছু পেশাগত নিরাশাবাদীকে নতুন ভাবনা ও নতুন দৃষ্টিকোণ অবলম্বন করতে উৎসাহ যোগাবে। আমি চন্দ্রশেখরণজী এবং রূপাজীকে এই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নথি রচনার জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানাই।
বন্ধুগণ,
এই গ্রন্থ এমন সময় এসেছে, যখন প্রযুক্তিকে দৈত্যরূপে প্রতিস্থাপিত করা ও ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা চলছে।
বিশেষ করে, ভারতের প্রেক্ষিতে প্রযুক্তিকে আমাদের জনসংখ্যাগত লভ্যাংশের প্রতিস্পর্ধা রূপে তুলে ধরার চেষ্টা চলছে।
এই বই সরকারের সেই দৃষ্টিকোণকে আরও শক্তিশালী করেছে, যার ভিত্তি হ’ল – প্রযুক্তি যুক্তির কাজ করে, বিযুক্তির নয়।
প্রযুক্তি একটি সেতু, প্রতিবন্ধক নয়।
প্রযুক্তি এবং মেধা শক্তিকে গুণীতক করে, প্রতিস্পর্ধা তৈরি করে না।
প্রযুক্তি উচ্চাকাঙ্খা এবং সাফল্যের মাঝে সেতু-স্বরূপ।
প্রযুক্তি চাহিদা এবং সরবরাহের মাঝে সেতু-স্বরূপ।
প্রযুক্তি সরকার এবং প্রশাসনের মাঝে সেতু-স্বরূপ।
প্রযুক্তি ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ – এর সঙ্গে যুক্ত করার সেতু-স্বরূপ।
বন্ধুগণ,
এই ভাবনা থেকে বিগত পাঁচ বছর ধরে আমরা কাজ করছি আর এটাই আমাদের ভবিষ্যতের দৃষ্টিকোণ।
এই বই এতো সুন্দরভাবে লেখা হয়েছে যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং এবং রোবটিক্সের মতো আধুনিক প্রযুক্তিকে কিভাবে উন্নয়নের হাতিয়ার করে তোলা যায়, তার স্বরূপ নির্ণয়ে সাহায্য করবে।
এই কথাগুলি আমি নিজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেও বলতে পারি। বিগত পাঁচ বছরে প্রযুক্তিগত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ভারতে প্রশাসনকে কিভাবে সংস্কার ও রূপান্তরণের পথে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তা আপনারা অনুভব করতে পারছেন। এইসব কিছু কিভাবে হচ্ছে তার একটা উদাহরণ আমি আপনাদের দিচ্ছি।
বন্ধুগণ,
আমাদের দেশে অনেক দশক ধরেই ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে এলপিজি গ্যাস সংযোগের প্রকল্প চালু ছিল। আমরা যখন উজ্জ্বলা যোজনা চালু করি, অনেকে ভেবেছিলেন যে, আমরা তেমনই কোনও প্রকল্প চালু করতে যাচ্ছি। কিন্তু আমরা ভিন্ন ভাবনা, দৃষ্টিকোণ এবং প্রযুক্তিগত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে অনেক গুণ সফল হই।
বন্ধুগণ,
আমরা আগের মতো চললে কমিটি তৈরি করতাম, অসফল হলে সেই কমিটি বাতিল করে অন্য কমিটি তৈরি করতাম, সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে কথা বলতাম। কিন্তু আগের মতোই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারতাম না। সেজন্য আমরা কমিটির জায়গায় প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করেছি।
তথ্য বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় আমরা শুরুতে ১৭ হাজার চালু এলপিজি সরবরাহ কেন্দ্রগুলিকে চিহ্নিত করি, আর তারপর অত্যন্ত কম সময়ে ১০ হাজার নতুন সরবরাহ কেন্দ্র চালু করি। সেজন্য আমাদের দেশের প্রতিটি গ্রামকে ডিজিটাল মানচিত্রকরণে সামিল করতে হয়েছে।
এই তথ্যকে অন্যান্য তথ্যসূত্র, যেমন – সেল রিপোর্ট, এলপিজি ব্যবহারকারী জনসংখ্যা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা – এই সবকিছুই বিশ্লেষণে ব্যবহার করা হয়েছে।
লক্ষ লক্ষ গ্রামের প্রায় ৬৪ লক্ষ বিচিত্র তথ্যসূত্র বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ঠিক করা হয়েছে যে, এই সরবরাহ কেন্দ্রগুলি কোথায় কোথায় গড়ে ওঠা উচিৎ। কিন্তু সেখানেই আমাদের কাজ শেষ হয়নি, আরেকটি বড় সমস্যা ছিল, যার সমাধানে প্রযুক্তির সাহায্য নিতে হয়েছে।
ড্যাশবোর্ডে আবেদনপত্র এবং সরবরাহের সময়ানুগ তদারকির মাধ্যমে জানা যায় যে, অনেক মহিলাদের দরখাস্ত বাতিল করা হয়েছে। কারণ, তাঁদের কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ছিল না।
এই সমস্যা সমাধানের জন্য জন ধন শিবির চালু করে এদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। ফলস্বরূপ, আমরা তিন বছরে ৮ কোটি রান্নার গ্যাসের সংযোগ দেওয়ার যে লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছিলাম, তা নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই বাস্তবায়িত হয়েছে।
বন্ধুগণ,
এতো গেল প্রযুক্তির ব্যবহারের কথা। এখন আমি ব্যবহারের চরিত্রগত পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির কেমন ভূমিকা থাকে, তার উদাহরণ দিতে চাই – আপনাদের এই বইয়ে দেশে স্বাস্থ্য পরিষেবার পরিস্থিতি নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। বিশেষ করে, অর্থের অভাবে গরিবদের মনে চিকিৎসা না করানোর মানসিক প্রতিবন্ধকতার কথাও বলা হয়েছে।
আয়ুষ্মান ভারত যোজনা এই পরিস্থিতি পরিবর্তনের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আগে যে দরিদ্র মানুষ অর্থের অভাবে কিংবা বিষয় – সম্পত্তি বিক্রি হয়ে যাবে এই ভয়ে কঠিন রোগের ক্ষেত্রে হাসপাতালে যেতে চাইতেন না, তাঁরা এখন হাসপাতালে যাওয়া শুরু করেছেন।
আজ এভাবেই গরিব মানুষের ব্যবহারে চরিত্রগত পরিবর্তন আনা সম্ভব হচ্ছে। স্বাস্থ্য পরিষেবার চাহিদা বেড়েছে, গরিব মানুষদের চিকিৎসাও হচ্ছে, হাসপাতালগুলি সরকার থেকে পয়সা পাচ্ছে। প্রযুক্তির মাধ্যমেই এত দ্রুত সবকিছু করা সম্ভব হয়েছে।
বন্ধুগণ, এই প্রযুক্তির মাধ্যমেই আয়ুষ্মান ভারত স্বাস্থ্য পরিষেবাকে সম্পূর্ণ প্যাকেজ রূপে গড়ে তোলার কাজ চলছে।
আগে প্রতিষেধক স্বাস্থ্য পরিষেবাকে গুরুত্ব দেওয়া হ’ত না। প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা শুধুই মাথা ব্যথা আর পেট ব্যথায় সীমাবদ্ধ ছিল। আর উন্নত চিকিৎসা পরিষেবা সম্পূর্ণ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হ’ত।
এখন সকলের জন্য চিকিৎসা পরিষেবা সুনিশ্চিত করতে দেশে দেড় লক্ষ হেলথ অ্যান্ড ওয়েলনেস সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে এবং এগুলিকেই উন্নত চিকিৎসা পরিষেবার ভিত্তি হিসাবে বিকশিত করা হচ্ছে।
আপনারা শুনলে অবাক হবেন যে, এত কম সময়ে এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলি দেড় কোটিরও বেশি রোগীকে উচ্চ রক্তচাপজনিত রোগের চিকিৎসা করেছে, ১ কোটি ২৫ লক্ষেরও বেশি মধুমেহ রোগের চিকিৎসা এবং দেড় কোটিরও বেশি ক্যান্সার চিহ্নিতকরণ সম্ভব হয়েছে।
আগে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে এইসব পরিষেবা ছিল না। এখন এই হেলথ অ্যান্ড ওয়েলনেস সেন্টারগুলি প্রয়োজনে উন্নত চিকিৎসা পরিষেবার জন্য ‘রেফার’ করতে পারে আর সেক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সরাসরি ও দ্রুত নিরাময় প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।
বন্ধুগণ,
প্রযুক্তি যখন সেতু হয়ে ওঠে, তখন আমাদের স্বচ্ছতা এবং নির্ধারিত সময়ে সরবরাহের সমাধান প্রদান করে। ভারতে দালালদের কী ভূমিকা ছিল, সে সম্পর্কে আপনারা ভালোভাবেই জানেন!
একটা যেন নিয়ম হয়ে গিয়েছিল যে, সরকার দেশ চালাবে আর দালালরা প্রশাসন চালাবে। জনগণ এবং প্রক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য ছিল বলেই এটা সম্ভব হ’ত। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শংসাপত্রকরণে একটি দীর্ঘ ব্যবস্থা ছিল, যা সাধারণ মানুষকে নিষ্পেষিত করতো।
আজ জন্ম থেকে জীবন প্রমাণপত্র পর্যন্ত সহস্রাধিক সরকারি পরিষেবা অনলাইন হয়েছে। এখন দেশে আত্ম-প্রত্যয়ীকরণই যথেষ্ট। এখন আমরা আত্ম-মূল্যায়ন, স্ব-ঘোষণা এবং ফেসলেস কর মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার দিকে এগিয়ে চলেছি।
বন্ধুগণ,
প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার কিভাবে সমস্যাগুলিকে সু্যোগে পরিণত করতে পারে, তার একটি বড় উদাহরণ হ’ল – ইন্ডিয়া পোস্ট পেমেন্ট ব্যাঙ্কের সর্ববৃহৎ নেটওয়ার্ক। মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের ক্রমবর্ধমান প্রসারের ফলে আমাদের ডাক পরিষেবা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, যাতে লক্ষ লক্ষ মানুষের চাকরি চলে যেত। কিন্তু আজ প্রযুক্তির প্রয়োগে সেই ডাকঘরগুলি ব্যাঙ্কিং পরিষেবা ডিজিটাল লেনদেন এবং হোম ডেলিভারির কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
এভাবে গ্রামে গ্রামে অনলাইন পরিষেবা প্রদানকারী কমন সার্ভিস সেন্টারের নেটওয়ার্ক ১২ লক্ষেরও বেশি যুবক-যুবতীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে।
বন্ধুগণ,
নবীন প্রজন্মের নতুন উদ্যোগ গড়ে তোলার ইচ্ছাশক্তিকে ব্যবহার করে ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে শক্তিশালী ও কর্মসংস্থানমুখী করে তুলতে এই বইয়ে যে পরামর্শগুলি দেওয়া হয়েছে, সেগুলির সঙ্গে আমি একরকম সহমত। এক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা দূর করতে আমরা ইতিমধ্যেই প্রযুক্তির বহুল ব্যবহার চালু করেছি।
সরকারি অফিস-আদালতের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় ক্ষেত্রের সরকার ই-মার্কেট প্লেস বা জিইএম চালু করেছে। এই প্রক্রিয়া সরকারের চাহিদা পূরণে ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পদ্যোগগুলির সরবরাহ ব্যবস্থার মধ্যে সেতু হয়ে উঠেছে।
একটি তথ্যের মাধ্যমে এই পদ্ধতির সাফল্য সম্পর্কে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবেন। এ বছর সরকারি অফিস-আদালতের জন্য প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়ের লক্ষ্য রাখা হয়েছে।
ভারতের সমস্যাগুলিকে সামনে রেখে নতুন নতুন ভাবনা রূপায়ণের মাধ্যমে শিল্পোদ্যোগে প্রয়োগে প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। ফলস্বরূপ, আজ অধিকাংশ স্টার্ট আপ টিয়ার-২ এবং টিয়ার-৩ শহরগুলিতে গড়ে উঠছে।
বন্ধুগণ,
এতসব কিছু সত্ত্বেও প্রযুক্তিই একমাত্র সমাধান নয়। মানুষের ইচ্ছাশক্তি – সদিচ্ছার প্রয়োজন রয়েছে। একথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে কী বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে, তা নিয়ে তর্ক করা উচিৎ নয়! রোবট কবে মানুষের চেয়ে বেশি স্মার্ট হবে? তর্ক হওয়া উচিৎ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মানুষের সদিচ্ছার মধ্যে আমরা কিভাবে সেতু-বন্ধন করবো, আমাদের দক্ষতাকে কিভাবে নতুন চাহিদা অনুসারে উন্নত করবো?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেন আমাদের আরও উন্নত ও সংবেদনশীল হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
আরও অনেক কিছু বলা যায়। কিন্তু আমার উচিৎ যে, অন্যরা যাতে এই বইটি পড়েন তার সুযোগ করে দেওয়া। এই উৎকৃষ্ট গ্রন্থ, এই অসাধারণ প্রচেষ্টার জন্যে অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানাই।
ধন্যবাদ।