পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল শ্রী জগদীপ ধনকড়জি, কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি এবং পর্যটন মন্ত্রী শ্রী জি কিষাণ রেড্ডিজি, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল-এর সঙ্গে যুক্ত সমস্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্যগণ, কলা ও সংস্কৃতি জগতের মহারথীগণ, ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ!
সবার আগে আমি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে হওয়া হিংস্র ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। পীড়িত পরিবারগুলির প্রতি আমার সমবেদনা ব্যক্ত করছি। আমি আশা করি যে, রাজ্য সরকার পশ্চিমবঙ্গের মহান মাটিতে এরকম জঘন্য পাপ যারা করেছে, তাদেরকে অবশ্যই চরম শাস্তি দেবে। আমি পশ্চিমবঙ্গের জনগণকে অনুরোধ করব যে, এরকম নৃশংস ঘটনা যারা ঘটিয়েছে, সেই অপরাধীদের যারা সাহস যোগাচ্ছে, তাদেরকে কখনও ক্ষমা করবেন না। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে আমি রাজ্যকে এক্ষেত্রে আশ্বস্ত করছি যে, অপরাধীদের যত দ্রুত সম্ভব শাস্তি দেওয়ার জন্য যত ধরনের সাহায্য আপনারা চাইবেন, কেন্দ্রীয় সরকার সেই সাহায্য আপনাদের দেবে।
বন্ধুগণ,
স্বাধীনতার “অমৃত মহোৎসবের পূণ্য পালন লগ্নে মহান বিপ্লবীদের ঐতিহাসিক আত্মবলিদানের প্রতি সমগ্র ভারতবাসীর পক্ষ থেকে আ-ভূমি প্রণাম জানাচ্ছি।” শহীদ দিবস উপলক্ষে আমি দেশের জন্য তাঁদের মতো সর্বস্ব উৎসর্গকারী সমস্ত বীর-বীরাঙ্গনাদের, কৃতজ্ঞ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করছি। শ্রীমদ্ভাগবত গীতাতেও বলা হয়েছে – “নৈনং ছিন্দন্তী শস্ত্রাণী, নৈনং দহতি পাবকঃ” অর্থাৎ, যাঁকে অস্ত্র কাটতে পারে না আর যাঁকে অগ্নিও দগ্ধ করতে পারে না। দেশের জন্য আত্মবলিদানকারীদের জীবন এমনই হয়। তাঁরা অমরত্ব লাভ করেছেন। সেই প্রেরণার পুষ্প হয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তাঁরা নিজেদের সুরভিতে সকলকে সুরভিত করে যাচ্ছেন। সেজন্য আজ এত বছর পরও অমর শহীদ ভগৎ সিং, রাজগুরু এবং সুখদেবের আত্মবলিদানের গাথা দেশের প্রায় প্রতিটি শিশুর জিহ্বাবেও উচ্চারিত হয়। আমাদের সবাইকে এই বীরেদের অমর গাথা দেশের স্বার্থে দিন-রাত পরিশ্রম করার জন্য প্রেরণা যোগায়। স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের সময় এবার শহীদ দিবসের গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে। দেশ আজ স্বাধীনতার জন্য অবদান রাখা নায়ক-নায়িকাদের প্রণাম জানাচ্ছে, তাঁদের অবদানের স্মৃতিকে স্মরণে তাজা করে তুলছে। বাঘাযতীনের সেই হুঙ্কারের কথা ভাবুন – “আমরা মরব, জাতি জাগবে” অথবা ক্ষুদিরাম বসুর সেই আহ্বান – “একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি”। গোটা দেশ আজ এই কথাগুলি আরও একবার স্মরণ করছে। বঙ্কিমবাবুর ‘বন্দে মাতরম’ তো আজ আমাদের মতো প্রত্যেক ভারতবাসীর প্রাণশক্তি হয়ে উঠেছে। তাঁর ‘বন্দে মাতরম’ দেশের জন্য মন্ত্র হয়ে উঠেছে। ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ, ঝলকারিবাঈ, চিত্তোরের রানি চেনাম্মা, মাতঙ্গিনী হাজরা, বীনা দাস, কমলা দাশগুপ্ত, কনকলতা বড়ুয়া – এরকম কতো না বীরাঙ্গনা এই স্বাধীনতা সংগ্রামের অমর প্রদীপকে নারীশক্তি দিয়ে প্রজ্জ্বলিত রেখেছেন। এমন সব বীর-বীরাঙ্গনার পুণ্য স্মৃতিতে আজ ভোরবেলা থেকে দেশের অনেক জায়গায় প্রভাত ফেরির শোভাযাত্রা বের হয়েছিল। আমাদের স্কুল-কলেজের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে। স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের এই ঐতিহাসিক কালখণ্ডে শহীদ দিবস উপলক্ষে কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে আজ এই’ বিপ্লবী ভারত গ্যালারি’র উদ্বোধনও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা”। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, অরবিন্দ ঘোষ, রাসবিহারী বসু, ক্ষুদিরাম বসু, বাঘাযতীন, বিনয়, বাদল, দীনেশ – এরকম অনেক মহান স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্মৃতিতে আজ এই স্থান, এই পরিবেশ পবিত্র হয়েছে। ‘নির্ভীক সুভাষ গ্যালারি’র পর আজ ‘বিপ্লবী ভারত গ্যালারি’ রূপে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার, হেরিটেজ বা ঐতিহ্যে আরও একটি অনিন্দ্যসুন্দর মুক্তো আজ যুক্ত হয়েছে।
বন্ধুগণ,
এই ‘বিপ্লবী ভারত গ্যালারি’ বিগত বছরগুলিতে পশ্চিমবঙ্গের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক ঐতিহ্যগুলিকে সংরক্ষণ করা এবং সাজানো র প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতারও প্রমাণ। এখানকার ‘আইকনিক গ্যালারিজ’ থেকে শুরু করে ‘ওল্ড কারেন্সি বিল্ডিং’, ‘বেলভেডিয়ার হাউজ’, ‘ভিক্টোরিলা মেমোরিয়াল’ কিংবা ‘ম্যাটকাফ হাউজ’ – এগুলিকে আরও অনিন্দ্যসুন্দর, আরও সুসজ্জিত করে তোলার কাজ প্রায় সম্পূর্ণ হয়েছে। বিশ্বের সর্বাধিক প্রাচীন মিউজিয়াম বা যাদুঘরগুলির মধ্যে অন্যতম কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামকেও নতুন রং-রূপে বিশ্বের সামনে তুলে ধরার জন্য আমাদের সরকার নিরন্তর কাজ করে চলেছে।
বন্ধুগণ,
আমাদের অতীতের ঐতিহ্যগুলি আমাদের বর্তমানকে পথ দেখায়। আমাদের উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য প্রেরণা যোগায়। সেজন্য আজ দেশ তার ইতিহাসকে, তার অতীতকে তার প্রাণশক্তির জাগ্রত স্রোত রূপে অনুভব করছে। আপনাদের হয়তো সেই সময়ের কথা মনে আছে যখন আমাদের দেশে প্রায়ই প্রাচীন মন্দিরগুলি থেকে মূর্তি চুরি হওয়ার খবর আসত। আমাদের কলা-শিল্পকৃতিগুলি প্রায়ই স্মাগলার বা চোরাকারবারীদের হাত ধরে বিদেশে পাচার হত। ভারতবাসীর কাছে যেন এগুলির কোনও গুরুত্বই ছিল না। কিন্তু এখন ভারত সেই ঐতিহ্যগুলিকে, সেই শিল্পকৃতিগুলিকে নানা দেশ থেকে ফিরিয়ে আনছে। একটু আগেই আমাদের সংস্কৃতি মন্ত্রী জি কিষাণ রেড্ডিজি বিস্তারিতভাবে এই প্রক্রিয়ার বর্ণনা করেছেন। এইতো দু’দিন আগেই অস্ট্রেলিয়া সরকার এরকম কয়েক ডজন মূর্তি, পেন্টিংস এবং অন্যান্য শিল্পকৃতি ভারতকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এগুলির মধ্যে অনেকক’টির ইতিহাস পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক ও আধ্মাত্মিক ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। গত বছর আমেরিকা ভারতকে প্রায় ১৫০টি শিল্পকৃতি ফিরিয়ে দিয়েছিল। যখন দেশের সামর্থ্য বৃদ্ধি পায়,আর যখন দুটি দেশের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কে নিবিড়তা বাড়ে, তখনই এই ধরনের অনেক উদাহরণ সামনে উঠে আসে। আপনারা একটি তথ্যের মাধ্যমেই এই বিষয়টা ভালভাবে অনুমান করতে পারবেন যে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ২০১৪-র আগে পর্যন্ত অনেক দশকে মাত্র ডজনখানেক মূর্তিই ভারতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বিগত সাত বছরে এই ফিরিয়ে আনা শিল্পকৃতির সংখ্যা ২২৫টিরও বেশি। ভারত তার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিরন্তর প্রেরণা যোগানোর লক্ষ্যে এ ধরনের নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব সভ্যতার এই নির্দশনগুলি বিশ্বের নানা দেশ থেকে ভারতে ফিরিয়ে আনার জন্যএকের পর এক চেষ্টা চালাচ্ছে।
ভাই ও বোনেরা,
আজ দেশ যেভাবে তার জাতীয় এবং আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যগুলিকে একটি নতুন আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিকশিত করছে, এই প্রক্রিয়ার আরও একটি বিশেষ দিক রয়েছে। সেই দিকটি হল – ‘হেরিটেজ ট্যুরিজম’ বা ঐতিহ্যশালী স্থানগুলির পর্যটন। এই ঐতিহ্যশালী স্থানগুলির পর্যটনের আর্থিক দৃষ্টিতে অপার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি, এর মাধ্যমে উন্নয়নের নতুন নতুন পথও খোলে। সেজন্যে ডান্ডিতে লবণ সত্যাগ্রহের স্মৃতিতে স্মারক নির্মাণ থেকে শুরু করে জালিয়ানওয়ালা বাগ স্মারকের পুনর্নির্মাণ কিংবা কেওড়িয়ার একতা নগরে ‘স্ট্যাচু অফ ইউনিটি’ নির্মাণ বা পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায়জির স্মারক নির্মাণ, দিল্লিতে বাবাসাহেব মেমোরিয়াল থেকে শুরু করে রাঁচিতে ভগবান বিরসা মুন্ডা মেমোরিয়াল পার্ক এবং সংগ্রহালয়, অযোধ্যা ও বেনারসের গঙ্গার ঘাটগুলির সৌন্দর্যায়ন থেকে শুরু করে সারা দেশে ঐতিহাসিক মন্দির এবং আস্থা কেন্দ্রগুলির পুনরুদ্ধার – এই সবকিছুই তো হেরিটেজ ট্যুরিজমকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভারতে একটি দেশব্যাপী অভিযানের অঙ্গ। ‘স্বদেশ দর্শন’-এর মতো বেশ কিছু প্রকল্পের মাধ্যমে এই হেরিটেজ ট্যুরিজমকে আরও গতি প্রদান করা হচ্ছে। গোটা বিশ্বের অভিজ্ঞতা এরকমই; কিভাবে হেরিটেজ ট্যুরিজম সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণের আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে, কর্মসংস্থানের নতুন নতুন সুযোগ তৈরি ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে! একবিংশ শতাব্দীর ভারত তার এই ‘পোটেনশিয়াল’ বা সম্ভাবনাকে বুঝেই এগিয়ে চলেছে।
বন্ধুগণ,
ভারতকে দাসত্বের কয়েক শতাব্দীর কালখণ্ড থেকে মুক্তি দান যে তিনটি ধারার সংযুক্ত প্রচেষ্টাতেই সম্ভব হয়েছে, সেই তিনটি ধারা হল – স্বাধীনতা, সত্যাগ্রহ এবং জনজাগৃতি ও নানা সৃষ্টিশীল কাজ। আমার মনে এই তিনটি ধারাই দেশের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকার তিনটি রঙের মধ্যে উঠে আসে। আমার মন ও মস্তিষ্কে বারবার এই ভাব প্রকট হয়ে ওঠে। আমাদের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকার ওপর গেরুয়া রং আমাদের বিপ্লবী ধারার প্রতীক। মাঝের সাদা রং সত্যাগ্রহ এবং অহিংসার ধারার প্রতীক, আর নিচের সবুজ রং সৃষ্টিশীল প্রবৃত্তির ধারার, মানবিক মূল্যবোধ-ভিত্তিক শিক্ষার প্রচার-প্রসারের, দেশভক্তিমূলক সাহিত্যিক রচনাগুলি, ভক্তি আন্দোলন – এই সমস্ত কিছু এর মধ্যে নিহিত। ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকার মাঝে যে নীল চক্র রয়েছে, তাকে আমি ভারতের সাংস্কৃতিক চেতনার প্রতীক রূপে দেখি। বেদ থেকে বিবেকানন্দ পর্যন্ত, আর বুদ্ধ থেকে গান্ধী পর্যন্ত - এই চক্র নিরন্তর ঘুরতে ঘুরতে আমাদের কাছে এসেছে। মথুরার কৃষ্ণ, বৃন্দাবনের কানহাইয়া, কুরুক্ষেত্রের মোহন, তাঁর সুদর্শন চক্র আর পোরবন্দরের মোহনের চরখাধারী চক্র – এই চক্র কখনও থামেনি।
আর বন্ধুগণ,
আজ যখন আমি ‘বিপ্লবী ভারত গ্যালারি’র উদ্বোধন করছি, তখন আমাদের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকার তিনটি রঙে নতুন ভারতের ভবিষ্যতও দেখতে পাচ্ছি। গেরুয়া রং আমার মনে এখন আমাদের কর্মঠতা, কর্তব্য এবং জাতীয় সুরক্ষাকে প্রেরণা যোগায়। সাদা রং এখন ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস অউর সবকা প্রয়াস’-এরই একটা পর্যায়। সবুজ রং এখন পরিবেশের সুরক্ষার জন্য ‘রিনিউয়েবল এনার্জি’ বা পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির জন্য ভারতের বড় লক্ষ্যের প্রতীক। ‘গ্রিন এনার্জি’ বা পরিবেশ-বান্ধব শক্তি উৎপাদন থেকে শুরু করে গ্রিন হাইড্রোজেন পর্যন্ত ‘বায়ো-ফুয়েল’ বা জৈব-জ্বালানি থেকে শুরু করে ইথানল ব্লেন্ডিং পর্যন্ত ‘ন্যাচারাল ফার্মিং’ বা প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে কৃষিকাজ থেকে শুরু করে ‘গোবর্ধন’ যোজনা পর্যন্ত – এই সবকিছু এর প্রতিবিম্ব হয়ে উঠছে। তেমনই ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকার মধ্যমণি হয়ে থাকা নীল চক্র আজ আমাদের ‘ব্লু ইকনমি’ বা নীল অর্থনীতির একটি প্রতীক। ভারতের কাছে যে অথৈ সামুদ্রিক সম্পদ রয়েছে, বিশাল সমুদ্রতট রয়েছে, আমাদের জলশক্তি ভারতের উন্নয়নকে নিরন্তর গতি প্রদান করছে।
আর বন্ধুগণ,
আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকার এই মর্যাদা ও মাহাত্মকে আরও বৃদ্ধির জন্য দেশের নবীন প্রজন্ম প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে কাজ করে চলেছে। এ দেশের নবীন প্রজন্মই প্রতিটি প্রতিযোগিতায় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের মশালকে তাদের হাতে ধরে রেখেছিল। আপনারা মনে করুন, আজকের দিনে যখন ভগৎ সিং, সুখদেব ও রাজগুরুর ফাঁসি হয়েছিল, তখন তাঁরা মাত্র ২৩-২৪ বছর বয়সী যুবক। ক্ষুদিরাম বসুর বয়স তো ফাঁসির সময় তাঁদের থেকেও অনেক কম মাত্র ১৬ বছর ছিল। ভগবান বিরসা মুন্ডা আত্মবলিদানের সময় ২৫-২৬ বছর বয়সী ছিলেন। চন্দ্রশেখর আজাদের বয়সও ২৪-২৫ বছর ছিল, আর তাঁরা ইংরেজ সরকারের সিংহাসনকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। ভারতের যুবক-যুবতীদের সামর্থ্য তখনও কম ছিল না, আজও কম নেই। আমি দেশের যুব সম্প্রদায়কে বলতে চাই, কখনও নিজেদের শক্তি এবং নিজেদের স্বপ্নকে ছোট করে দেখবেন না। এরকম কোনও কাজ নেই যা ভারতের যুব সম্প্রদায় করতে পারে না। এরকম কোনও লক্ষ্য নেই যা ভারতের যুব সম্প্রদায় অর্জন করতে পারে না। স্বাধীনতার ১০০ বছর যখন হবে, তখন ভারত যে উচ্চতায় পৌঁছবে, ২০৪৭-এ ভারত যেখানে পৌঁছবে, যে উচ্চতায় পৌঁছবে, তা আজকের যুব সম্প্রদায়ের ক্ষমতা ও উদ্যোগের ওপরই নির্ভরশীল। সেজন্য আজকের যে যুব সম্প্রদায়, তাঁদের জীবনে সবচাইতে বড় লক্ষ্য হওয়া উচিৎ নতুন ভারত নির্মাণে তাঁদের নিজস্ব অবদান রাখা। আগামী ২৫ বছরে ভারতের যুব সম্প্রদায়ের পরিশ্রমই ভারতের ভাগ্যকে নির্মাণ করবে, ভারতের ভবিষ্যতকে উজ্জ্বল করে তুলবে।
বন্ধুগণ,
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে আমরা সর্বদাই ‘এক ভারত শ্রেষ্ঠ ভারত’-এর জন্য কাজ করার প্রেরণা পেয়েছি। স্বাধীনতার সংগ্রামীরা ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উঠে এসেছিলেন। তাঁদের আচার, আচরণ, পোষাক-আশাক, ভাষা, কথ্যভাষা সব ভিন্ন ছিল। এমনকি, তাঁদের পারিবারিক প্রেক্ষাপট, ব্যক্তিগত জীবনে সম্পদের যোগানেও বৈচিত্র্য ছিল। কিন্তু দেশ সেবার ভাবনা এবং দেশভক্তি একনিষ্ঠ ছিল। সেই ভারতভক্তির সূত্রে তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন, একটি সঙ্কল্প নিয়ে লড়েছেন, একসঙ্গে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন। ভারতভক্তির এই শ্বাশত ভাব, ভাবের একতা, অখণ্ডতা আজও যেন আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হয়। আপনাদের রাজনৈতিক ভাবনা যাই হোক না কেন, আপনারা যে কোনও রাজনৈতিক দলের নেতা, কর্মী কিংবা সমর্থক হোন না কেন, ভারতের একতা ও অখণ্ডতার সঙ্গে কোনও ধরনের ছেলেখেলা ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রামীদের প্রতি সবচাইতে বড় বিশ্বাসঘাতকতা হবে। একতা না থাকলে আমরা ‘এক ভারত শ্রেষ্ঠ ভারত’-এর ভাবনাকেও শক্তিশালী করে তুলতে পারব না। দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি সম্মান, সাংবিধানিক পদগুলির প্রতি সম্মান, সমস্ত নাগরিকের প্রতি সম্মানভাব, তাঁদের প্রতি সমবেদনা দেশের একতাকে শক্তিশালী করে। আজকের এই সময়ে আমাদের দেশের একতার বিরুদ্ধে যারা কাজ করছে, সেরকম প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর নজর রাখতে হবে, অত্যন্ত কড়াভাবে তাদের মোকাবিলা করতে হবে। আজ যখন আমরা স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব পালন করছি, তখন একতার এই অমৃতকে রক্ষা করাও আমাদের অনেক বড় দায়িত্ব।
ভাই ও বোনেরা,
আমাদের নতুন ভারতে নতুন দৃষ্টি নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। এই নতুন দৃষ্টি ভারতের আত্মবিশ্বাসের, ভারতের আত্মনির্ভরতার, ভারতের আত্ম- পরিচিতির, ভবিষ্যতের উত্থানের। এতে সবচাইতে বড় গুরুত্ব রয়েছে কর্তব্য ভাবনারই আমরা আজ নিজেদের কর্তব্যগুলিকে যতটা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করব, আমাদের প্রচেষ্টায় যতটা পরাকাষ্ঠা থাকবে, দেশের ভবিষ্যৎ ততটাই সুন্দর হবে। সেজন্য আজ কর্তব্যনিষ্ঠাই আমাদের জাতীয় ভাবনা হওয়া উচিৎ। কর্তব্য পালনই আমাদের জাতীয় প্রেরণা হওয়া উচিৎ। কর্তব্যই ভারতের জাতীয় চরিত্র হওয়া উচিৎ। এটা কি কর্তব্য? দেখবেন,আমরা অনেক সহজেই নিজেদের চারপাশে নিজেদের কর্তব্য-সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্তও নিতে পারি, চেষ্টাও করতে পারি, পরিণামও আনতে পারি। যখন আমরা পথে চলতে চলতে, ট্রেনে, বাসস্ট্যান্ডে, গলিতে, বাজারে যত্রতত্র নোংরা ফেলব না, পরিচ্ছন্নতার কথা মাথায় রাখব, তখনই আমরা নিজেদের কর্তব্য পালন করব। যথাসময়ে ‘ভ্যাক্সিনেশন’ বা সমস্ত ধরনের প্রয়োজনীয় টিকাকরণ করানো, জল সংরক্ষণে অবদান রাখা, আর পরিবেশ রক্ষায় সাহায্য করাও এক ধরনের কর্তব্য পালন। এগুলিকে কর্তব্যের উদাহরণ হিসেবেও পেশ করা যায়। যখন আমরা ডিজিটাল পেমেন্ট করি, তখন অন্যদেরকে এর প্রতি জাগ্রত করে তুলি, তাঁদের প্রশিক্ষিত করি। এভাবেই আমরা নিজেদের কর্তব্য পালন করি। যখন আমরা কোনও স্থানীয় পণ্য কিনি, যেমন ‘ভোকাল ফর লোকাল’অভিযান, তখনই আমরা আমাদের কর্তব্য পালন করি। যখন আমরা ‘আত্মনির্ভর ভারত অভিযান’কে গতি প্রদান করি, তখন নিজেদের কর্তব্য পালন করি। আমি এজন্যও অত্যন্ত আনন্দিত যে আজই ভারত ৪০০ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ, ৪০ লক্ষ কোটি টাকা মূল্যের পণ্য রপ্তানির নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছে। আজ ভারতের ক্রমবর্ধমান রপ্তানি আমাদের শিল্পের শক্তি, আমাদের ‘এমএসএমই’ বা অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোগ, আমাদের ‘ম্যানুফ্যাকচারিং’ বা উৎপাদন ক্ষমতা, আমাদের এগ্রিকালচার বা কৃষিক্ষেত্রের সামর্থ্যের প্রতীক।
যখন প্রত্যেক ভারতবাসী তাঁদের কর্তব্যগুলিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবেন, সম্পূর্ণ নিষ্ঠার সঙ্গে সেগুলিকে পালন করবেন, তখন ভারতকে এগিয়ে যেতে তেমন সমস্যায় পড়তে হবে না। তখন ভারতের অগ্রগতিকে আর কেউ আটকাতে পারবে না। আমরা আমাদের চারপাশে তাকিয়ে দেখলে বুঝবো যে এখন ভারতে লক্ষ লক্ষ যুবক-যুবতী, লক্ষ লক্ষ মহিলা, আমাদের ছেলে-মেয়ে, আমাদের পরিবার এই কর্তব্যের ভাবনা নিয়েই জীবনধারণ করছে। এই ভাবনা যত প্রত্যেক ভারতবাসীর মধ্যে সঞ্চারিত হবে, তাঁদের চরিত্রকে রূপান্তরিত করবে, ভারতের ভবিষ্যৎ ক্রমে ততটাই উজ্জ্বল হতে থাকবে। আমি কবি মুকুন্দ দাসজির শব্দ উচ্চারণ করে বলব – “কী আনন্দধ্বনি উঠল বঙ্গভূমে, বঙ্গভূমে, বঙ্গভূমে বঙ্গভূমে, তারপর ভারতভূমে জেগেছে আজ ভারতবাসী, আর কী মানা শোনে, লেগেছে আপন কাজে, আর জানিছে মনে মনে।” কবি মুকুন্দ দাসজির শব্দে কোটি কোটি ভারতবাসীর এই ভাবনা যেন নিরন্তর শক্তিশালী হতে থাকে। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ভাবনা থেকে আমরা যেন সর্বদাই প্রেরণা পাই। এই সব কামনা নিয়ে ‘বিপ্লবী ভারত গ্যালারি’র জন্য আমি আরও একবার আপনাদের সবাইকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানাই। বন্দে মাতরম!
ধন্যবাদ!