অটলজি আমাদের মধ্যে নেই, আমাদের মন একথা মানতে চায় না! অসুস্থতার কারণে বিগত আট-নয় বছর ধরে তাঁকে কোনও মঞ্চে দেখা যায়নি! রাজনৈতিক জীবন সমাপ্ত হয়ে যাওয়ার পর একটি প্রজন্ম বদলে গেছে, কিন্তু তার মহা প্রয়াণের পর দেশবাসী যেভাবে তাদের আবেগ প্রকাশ করেছেন, সম্মান প্রদর্শন করেছেন, তা তাঁর জীবনের তপস্যার আলোকপুঞ্জ রূপে আমরা অনুভব করতে পারি। বিশ্বমানের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা কোনদিন নিশ্চয়ই বিস্তারিত ভাববেন যে বেশ কিছু সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা একটি রাজনৈতিক দল, কর্মকর্তাদের সাধারণ সংগঠনের সাধারণ মানুষের ভরসায়, একদিকে লড়াই চালিয়ে যাওয়া আর অন্যদিকে সংগঠন মজবুত করা, জনগণকে নিজেদের ভাবনাচিন্তার প্রতি আকর্ষণ করা, প্রভাবিত করা, প্রতিটি মানুষের মনে ঢেউ তুলে আন্দোলনের মাধ্যমে একের পর এক ইঁট সাজিয়ে এতবড় সংগঠন তৈরি করা সহজ কাজ নয়।
বিশ্বের এত বড় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ১০০ থেকে ১২৫ বছরেরও অধিক পুরনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক মঞ্চের বিপরীতে একটি নতুন রাজনৈতিক দলকে এত কম সময়ের মধ্যে সম্ভবত বিশ্বের বৃহত্তম দলে পরিণত করা, তার এত বিস্তার ঘটানো, জনসঙ্ঘের সময়ে আর তারপর ভারতীয় জনতা পার্টির গড়ে ওঠার দিনগুলিতে সম্পূর্ণ টিম তাঁর নেতৃত্বে সমৃদ্ধ হয়েছে। সারা দেশে তিনি দলের ছোট ছোট কর্মীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন, জনগণের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন। এর মাধ্যমে ক্রমে অটলজির বক্তব্য শুধু ভারতীয় জনতা পার্টির বক্তব্য নয়, প্রায় তিন-চার দশক ধরে তা আপামর জনগণের আশা ও আকাঙ্ক্ষার অভিব্যক্তি হয়ে উঠেছিল। অটলজি বলার মানে দেশবাসীর বলা, তিনি বললে গোটা দেশ শুনতো। তিনি শুধু মানুষকে আকর্ষণ বা প্রভাবিতই করতেন না, মানুষের মনে আস্থা গড়ে তুলতেন। আর এই আস্থা শুধু কথা দিয়ে নয়, পাঁচ-ছয় দশকের দীর্ঘ সাধনার মাধ্যমে তিনি তা অর্জন করেছিলেন। এখন যারা রাজনীতি করেন, দুই-পাঁচ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকলেই তাঁরা এত অস্থির হয়ে ওঠেন, ছটফট করতে থাকেন – তহশীল এলাকার নেতা থেকে শুরু করে জেলাস্তর, রাজ্যস্তর, এমনকি জাতীয় স্তরে। কেউ কল্পনা করতে পারেন, এত বছর ধরে একজন তপস্বীর মতো, সাধকের মতো বিরোধী আসনে বসে, প্রতি মুহূর্তে দেশের সাধারণ মানুষের কন্ঠস্বর হয়ে ওঠা, সেরকমই জীবনধারণ করা। তাঁর জীবনেও কি এমন মুহূর্ত আসেনি, যখন কোনও রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় কেউ না কেউ তাদের দলে যোগদানের আহ্বান জানিয়েছেন, তাঁদের নেতা বানিয়ে উঁচু পদের প্রলোভন দেখিয়েছেন! অনেকবারই হয়তো হয়েছে, আমার কাছে কোন তথ্য নেই, কিন্তু এদেশের রাজনৈতিক উত্থানপতনের ইতিহাস দেখে অনুমান করছি! কিন্তু তিনি ছিলেন ভিন্ন ধাতুতে গড়া! তিনি আদর্শের সঙ্গে নিজের জীবনের সম্পর্ক জুড়েছেন, আর সেজন্যই এরকম কোনও লোভের শিকার হননি।
আর দেশের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়, দলের স্বার্থ, নিজের হাতে গড়ে তোলা সংগঠনের স্বার্থ থেকেও গণতন্ত্রের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। দূরদৃষ্টির মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্রকে দীর্ঘজীবী করে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। নিজের ঘাম-রক্ত সিঞ্চন করে যে জনসঙ্ঘ দল গড়ে তুলেছিলেন, গণতন্ত্রের স্বার্থে কোনরকম প্রাপ্তির প্রত্যাশা না করেই সেই দলকে জনতা দলে বিলীন করে দিয়েছেন। আর তারপর জনতা পার্টির মধ্যে আদর্শের সংঘাত তৈরি হলে, গণতন্ত্রের কষ্ঠিপাথরে দলের স্বার্থ বড় হয়ে ওঠায় তিনি হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে বলেন, আপনাদের পথে আপনাদের জয়জয়কার হোক, আমরা আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতে পারবো না, আমরা দেশের জন্য মরতে পারি কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থে আদর্শকে জলাঞ্জলি দিতে পারি না। দল ছেড়ে দিয়ে আবার পদ্মের বীজ পুঁতলেন। আজ আমরা ভারতের প্রত্যেক প্রান্তে পদ্মের অস্তিত্ব অনুভব করছি। কেমন দূরদৃষ্টি ছিল ভাবুন, তিনি জানতেন যে, একদিন অন্ধকার দূর হবে, সূর্য উঠবে, পদ্ম ফুটবে! এখন তো পদ্ম ফুটেছে, জন্মের পর বেশি সময় কাটেনি। কিন্তু তাঁর মনে নিজের তৈরি দল জনসঙ্ঘ নিয়ে কতটা আত্মবিশ্বাস ছিল, নিজের আদর্শে কত অটল ছিলেন, নিজের সাধনা ও তপস্যায় কত আস্থা ছিল, নিজের দলের কর্মীদের নিষ্ঠার প্রতি কতটা প্রত্যয় ও শ্রদ্ধা থাকলে তিনি সেই সময় ঘোষণা করতে পেরেছিলেন যে – অন্ধকার দূর হবে, সূর্য উঠবে, পদ্ম ফুটবে! রাষ্ট্রজীবনে বৈচিত্র্যই আমাদের গৌরব গরিমাকে বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সবচাইতে বড় সম্বল, আর তাকে বজায় রাখা আমাদের বড় দায়িত্ব। রাজনৈতিক আদর্শ এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের নানা ভাষা, নানা মত, নানা আচার ব্যবহারও ভারতের শক্তি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোন না কোন মূল্য সংযোজন করে।
এক ধরণের নেতা, এক ধরণের ভাবনা, এক ধরণের কথাবার্তা ভারতের বৈচিত্র্যের অনুকূল নয়। সেজন্যই আমরা সবাই মিলে, সকল বিচার ধারায় লালিত-পালিত হয়ে যাঁরাই দেশের স্বার্থে ভেবেছি, যে কোন কট্টরবাদের বিরুদ্ধে লড়েছি, অটলজি তাঁদের সকলকে একসঙ্গে এনে মূল্য সংযোজন করে গেছেন। তিনি ছিলেন সকল প্রকার বৈচিত্র্যকে সংরক্ষণের মাধ্যমে, উৎসাহপ্রদানের মাধ্যমে বিবিধের সমন্বয়ে মহান মিলনের মাধ্যমে ভারতের রাষ্ট্রীয় জীবন, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনকে সমৃদ্ধ করার পক্ষে। তাঁর এই আদর্শ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রেরণা যোগায়, আলোকবর্তিকা হয়ে পথপ্রদর্শন করে। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, অটলজির জীবন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক জীবন, ব্যক্তিগত জীবন এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে সমর্পণভাব, ‘এক জীবন এক লক্ষ্য’ নিয়ে কেমন ভাবে কাজ করা যায় – তা বুঝতে সাহায্য করবে। আগামীকাল অটলজির মহাপ্রয়াণের পর প্রথম জন্মজয়ন্তী। তার একদিন আগে আজ ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তাঁর স্মৃতিতে একটি ১০০ টাকা মূল্যের মুদ্রা প্রকাশ করা হচ্ছে। আমাদের মনে অটলজির জীবনের মতোই এই মুদ্রা আমাদের জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, প্রেরণা যোগাবে, ধাতুর মুদ্রায় তাঁকে চিরঞ্জীবী করে রাখার এটি একটি ছোট্ট প্রচেষ্টা। এটিও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের একটি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা, যা আমাদের সকলকে একটি সুখের অনুভূতি এনে দিচ্ছে।
আগামীকাল অটলজির জন্মজয়ন্তী, ২৫ ডিসেম্বর। সর্বদা অটল, একটি স্মৃতিস্থল, রাজঘাটের পাশেই সেই স্মৃতিস্থলে গিয়ে আগামীকাল আমাদের অটলজির অভাব আরও বেশি করে অনুভব করবো। সেই সময় এই স্মৃতিস্থল আমাদেরও সর্বদা অটল থাকতে, ব্যক্তি জীবন, সমাজ জীবনে এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে আদর্শে অটল থেকে কাজ করে যাওয়ার সঙ্কল্প সুদৃঢ় করতে প্রেরণা যোগাবে। এই ভাবনা নিয়ে আজ সবাইকে হৃদয় থেকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, আপনারা সবাই সময় বের করে এসেছেন। আমরা সবাই অটলজিকে হৃদয়ে স্থাপন করেছি, তিনি যা চেয়েছেন, যে স্বপ্ন দেখে গেছেন, আমরা যেন তা বাস্তবায়িত করতে কখনই পিছপা না হই! এই সঙ্কল্প নিয়েই আমি অটলজিকে সাদর প্রণাম জানাই। অনেক অনেক ধন্যবাদ।