আপনাদের সবার সঙ্গে কথা বললে অনুভব করা যায় যে আমাদের দেশে পুতুল নির্মাণ শিল্পে কত বড় শক্তি লুকিয়ে আছে। এই শক্তিকে বাড়ানো, এর পরিচয় বাড়ানো, আত্মনির্ভর ভারত অভিযানের অনেক বড় অংশ। এটা আমাদের সকলের আনন্দের বিষয় যে আজ আমরা দেশের প্রথম পুতুল মেলা উদ্বোধন অনুষ্ঠানের অংশ হয়ে উঠেছি। পুতুল মেলার এই অনুষ্ঠানে আমার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় আমার সমস্ত সহকর্মীরা, পুতুল নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত সমস্ত প্রতিনিধিগণ, সমস্ত কারিগর ভাই-বোনেরা, অভিভাবক-অভিভাবিকারা, শিক্ষক-শিক্ষিকারা এবং আমার প্রিয় শিশুরা!
এই প্রথম পুতুল মেলা শুধুই একটি বাণিজ্যিক বা অর্থনৈতিক কর্মসূচি নয়। এই কর্মসূচি দেশের অনেক শতাব্দী পুরনো ক্রীড়া এবং উল্লাসের সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করার একটি পর্যায়। আমাকে বলা হয়েছে যে এই কর্মসূচির প্রদর্শনীতে কারিগরদের এবং বিদ্যালয়গুলি থেকে শুরু করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলি পর্যন্ত ৩০টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে আসা এক হাজারেরও বেশি প্রদর্শক অংশগ্রহণ করছেন। আপনাদের সকলের জন্য এটা এমন একটা মঞ্চ হয়ে উঠতে চলেছে যেখানে আপনারা খেলনার নকশা, উদ্ভাবন, প্রযুক্তি থেকে শুরু করে মার্কেটিং ও প্যাকেজিং পর্যন্ত সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন, আর নিজের নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানাবেন। পুতুল মেলা, ২০২১-এ আপনাদের ভারতে অনলাইন গেমিং শিল্পোদ্যোগ এবং ই-স্পোর্ট শিল্পোদ্যোগের ব্যবস্থা সম্পর্কে জানার সুযোগ হবে। এটা দেখে আমি খুব আনন্দিত যে এখানে শিশুদের জন্য অনেক অংশগ্রহণের সুযোগ রাখা হয়েছে। আমি পুতুল মেলার এই আয়োজনে নিজস্ব ভূমিকা পালনকারী সমস্ত বন্ধুদের হৃদয় থেকে শুভকামনা জানাই।
বন্ধুগণ,
খেলনার সঙ্গে ভারতের সৃষ্টিশীল সম্পর্ক ততটাই পুরনো যতটা এই ভূখণ্ডের ইতিহাস রচিত হয়েছে। সিন্ধু সভ্যতা, মহেঞ্জোদরো ও হরপ্পার আমলের খেলনা নিয়েও সারা পৃথিবী গবেষণা করেছে। প্রাচীনকালে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অভিযাত্রী বা পর্যটকরা যখন ভারতে আসতেন, তাঁরা ভারত থেকে বিভিন্ন খেলা শিখে যেতেন, আবার নিজেদের সঙ্গে অনেক খেলা নিয়েও আসতেন। আজ যে দাবা সারা পৃথিবীতে এত জনপ্রিয় একে আগে ‘চতুরঙ্গ’ বা ‘চাদুরঙ্গা’ রূপে ভারতে খেলা হত। আধুনিক লুডো তখন ‘পচ্চীসী’ রূপে খেলা হত। আমাদের ধর্মগ্রন্থেও আপনারা দেখবেন শিশু রামের জন্য কত ভিন্ন ভিন্ন ধরনের খেলনার বর্ণনা রয়েছে। গোকুলে গোপাল কৃষ্ণের ঘরের বাইরে বন্ধুদের সঙ্গে ‘কোন্দুক’ অর্থাৎ, বল খেলতে যেত। আমাদের প্রাচীন মন্দিরগুলিতেও বিভিন্ন খেলার ও খেলনার শিল্প খদিত রয়েছে, বিশেষ করে তামিলনাড়ুতে, চেন্নাইয়ে গিয়ে যদি আপনারা মন্দিরগুলি দেখেন তখন এরকম কত না উদাহরণ দেখতে পাবেন। ভিন্ন ভিন্ন মন্দিরে ভিন্ন খেলার ছবি, নানারকম খেলার ভাস্কর্য – এই সমস্ত কিছু আজও সেই মন্দিরগুলির দেওয়ালে দেখা যায়।
বন্ধুগণ,
যে কোনও সংস্কৃতিতে খেলা ও খেলনা যখন মানুষের আস্থার কেন্দ্রগুলির অংশ হয়ে ওঠে, তখন এর অর্থ হল যে সেই সমাজ ক্রীড়ার বিজ্ঞানকে গভীরভাবে অনুভব করত। আমাদের দেশে খেলনা এমনভাবে বানানো হত যা শিশুদের বহুমুখী বিকাশে অবদান রাখে। তাদের বিশ্লেষণমূলক মন বিকশিত করে। আজও ভারতীয় খেলনা আধুনিক ফ্যান্সি খেলনার তুলনায় অনেক সরল এবং সস্তা হয়, সামাজিক, ভৌগোলিক পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
বন্ধুগণ,
পুনর্ব্যবহার এবং পুনর্নবীকরণ যেভাবে ভারতীয় জীবনশৈলীর অংশ ছিল, সেটাই আমাদের খেলনাতেও পরিলক্ষিত হয়। অধিকাংশ ভারতীয় খেলনা প্রাকৃতিক এবং পরিবেশ-বান্ধব উপকরণ দিয়ে তৈরি হয়। সেগুলির মধ্যে ব্যবহার করা রঙও প্রাকৃতিক এবং নিরাপদ হয়। একটু আগেই আমি বারাণসীর কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছিলাম। বারাণসীর কাঠের খেলনা ও ‘গুড়িয়া’তে দেখুন, রাজস্থানের মাটির খেলনা দেখুন। তেমনই পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুরের ‘গলর মেয়ে পুতুল’, কচ্ছ-এর ‘কাপড়াডিংলা’ এবং ‘ডিংলি’, অন্ধ্রপ্রদেশের ‘ইটিকোপ্পোকা বোম্মলূ’ আর ‘বুধনী’ - এগুলি সব কাঠের খেলনা। কর্ণাটকে গেলে সেখানকার ‘চন্নপাটনা’ খেলনা একটু আগে দেখছিলাম। তেলেঙ্গানার ‘নির্মল’ খেলনা, চিত্রকূটের কাঠের খেলনা, আসামের ধুবরী থেকে আসা টেরাকোটার খেলনা - এই সমস্ত খেলনায় আপনারা দেখবেন কত বৈচিত্র্য, কত ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে ভরপুর। কিন্তু সবার মধ্যে একটি মিল আছে; প্রতিটি খেলনা পরিবেশ-বান্ধব এবং সৃষ্টিশীল। এই খেলনাগুলি আমাদের দেশের শিশুমনকে আমাদের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির সঙ্গেও যুক্ত করে, আর সামাজিক-মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত সহায়ক। সেজন্য আজ আমি দেশের পুতুল উৎপাদকদের কাছেও আবেদন রাখতে চাই, আপনারা এমন খেলনা তৈরি করুন যা প্রাকৃতিক ভারসাম্য এবং শিশুদের মানসিক ভারসাম্য - উভয়ের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। আমরা কি এই ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে পারি যে খেলনাগুলিতে ন্যূনতম প্লাস্টিকের ব্যবহার করব? এমন সব জিনিসই ব্যবহার করবো যেগুলিকে আমরা পুনর্নবীকরণ করতে পারি?
বন্ধুগণ,
আজ বিশ্বের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতীয় দৃষ্টিকোণ এবং ভারতীয় ভাবনা নিয়ে আলোচনা চলছে। ভারতের কাছে বিশ্বকে দেওয়ার জন্য একটি বিশেষ পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে। এটি হল আমাদের পরম্পরায়, পরিধানে, খাদ্যাভ্যাসে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য, এই বৈচিত্র আজ বিশ্বের অন্যত্রও একটি শক্তি রূপে পরিলক্ষিত হয়। এভাবে ভারতীয় পুতুল শিল্পও এই অদ্ভূত ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতকে, ভারতীয় বিচারধারা ও বোধকে উৎসাহিত করতে পারে। আমাদের দেশে খেলনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ঐতিহ্য রূপে সংরক্ষিত থাকে। দাদু-দিদাদের খেলনা নাতি-নাতনি ও তাদের নাতি-নাতনিদেরকেও উপহার দেওয়া হয়। উৎসবের সময় পরিবারের বড়রা তাঁদের খেলনা বের করে আনতেন এবং পারম্পরিক সংগ্রহকে অন্যদের সামনে তুলে ধরতেন। যখন আমাদের খেলনাগুলি এই ভারতীয় শিল্পবোধে অলঙ্কৃত হবে, তখন ভারতীয় ভাবনাগুলি, ভারতীয়ত্বের ভাবনাগুলি শিশুদের মনকে আরও সুন্দরভাবে বিকশিত করবে। তাতে এই মাটির গন্ধ থাকবে।
প্রিয় শিশু ও বন্ধুগণ,
গুরুদেব রবীন্দনাথ ঠাকুর তাঁর একটি কবিতায় বলেছিলেন, - “When I bring to you colored toys, my child, I understand why there is such a play of colors on clouds, on water, and why flowers are painted in tints when I give colored toys to you, my child.” , অর্থাৎ একটি খেলনা শিশুদের আনন্দকে অনন্ত বিশ্বে নিয়ে যায়। খেলনার এক একটি রং শিশুদের কতো না রং ছড়ায়। আজ এখানে এত খেলনা দেখে এখানে উপস্থিত শিশুরা যেমন অনুভব করছে, তেমনই অনুভব আমরা সবাইও নিজের নিজের শৈশবের স্মৃতিতে ডুবে উপভোগ করছি। কাগজের উড়োজাহাজ, লাট্টু, মার্বেলের গুলি, ঘুড়ি, পাতার বাঁশি, দোলনা, কাগজের চরকি, গুড্ডা এবং গুড়িয়া - এরকম কতো না খেলনা প্রত্যেকের শৈশবের সঙ্গী ছিল। বিজ্ঞানের কতো না সিদ্ধান্ত, কত না সূত্র যেমন ঘূর্ণন, অসসিলেশন, চাপ, ঘর্ষণ – এসব কিছু আমরা খেলনা নিয়ে খেলতে খেলতে, সেগুলি দিয়ে খেলনা বানানোর সময় অনেক কিছু শিখে যেতাম। ভারতীয় ক্রীড়া ও খেলনার এটাই বৈশিষ্ট্য যে সেগুলিতে জ্ঞান থাকে, বিজ্ঞান থাকে, মনোরঞ্জনও থাকে, আর মনোবিজ্ঞানও থাকে। উদাহরণস্বরূপ লাটিমকে নিতে পারেন। যখন শিশুরা লাটিম নিয়ে খেলা শেখে, তখন খেলতে খেলতেই অভিকর্ষ এবং ভারসাম্যের পাঠ পড়ে নেয়। তেমনই গুলতি নিয়ে খেলার সময় শিশুরা অজ্ঞাতেই ‘পোটেনশিয়াল’ থেকে ‘কাইনেটিক এনার্জি’ সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান শিখতে শুরু করে। পাজল টয়েজ থেকে রণনৈতিক ভাবনা এবং সমস্যা সমাধানের ভাবনা বিকশিত হয়। এভাবে নবজাতক শিশুকেও ঝুনঝুনি এবং বাজনা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ‘সার্কুলার মুভমেন্ট’ -এর অনুভব দেওয়া হয়। ভবিষ্যতে এই জিনিসগুলি যখন তারা শ্রেণীকক্ষে দেখে কিংবা বইয়ে পড়ানো হয়, তখন নিজের খেলার সঙ্গে সম্পর্ক যোগ করতে পারে, হাতে-কলমে প্রতিটি জিনিসকে বুঝতে পারে। শুধু বইয়ের জ্ঞান থেকেই তাদের সবকিছু বিকশিত হওয়া সম্ভব নয়।
বন্ধুগণ,
আপনারা সবাই হয়তো দেখেছেন, সৃষ্টিশীল খেলনাগুলি কিভাবে শিশুদের ইন্দ্রিয়গুলিকে আরও সতেজ করে তুলতে পারে। তাদের কল্পনাকে ডানা মেলতে দিতে পারে। নিজেদের খেলনার চারপাশে বাচ্চারা কিভাবে নিজেদের কল্পনার একটি সম্পূর্ণ সংসার গড়ে তোলে। যেমন আপনি যে কোনও শিশুকে খেলনার বাসন দিন, তারা এমনভাবে ব্যবহার করতে শুরু করবে যেন সম্পূর্ণ রান্নাঘরের ব্যবস্থা সামলাচ্ছে। আর পরিবারের সবার জন্য আজ সেখানেই রান্না হবে। তাদেরকে আপনারা বিভিন্ন পশু-পাখির খেলনা দিন, তখন তারা মনে মনে একটি সম্পূর্ণ অরণ্য তৈরি করে ফেলে, নিজেরাই তাদের মতো আওয়াজ করতে থাকে। তাদের যদি মনে হয় যে বাঘ আছে তাহলে বাঘের মতো আওয়াজ করে। শিশুকে একটি স্টেথোস্কোপ দিন, কিছুক্ষণের মধ্যেই চিকিৎসক হয়ে উঠবে - পারিবারিক চিকিৎসক, আর গোটা পরিবারের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে শুরু করে দেবে। তেমনই মাত্র একটি বল দিয়ে তারা ঘরের ভেতর সম্পূর্ণ ফুটবল মাঠ বানিয়ে নিতে পারে। খেলনা রকেট নিয়ে মকাহাশ অভিযানে বেড়িয়ে পড়তে পারে। তাদের স্বপ্নগুলির এই উড়ানের কোনও সীমা নেই, কোনও অন্ত নেই, ব্যস তাদের একটি ছোট্ট খেলনা চাই, যা তাদের ঔৎস্যুককে, তাদের সৃষ্টিশীলতাকে জাগিয়ে তুলবে। ভালো খেলনার গুণ হল সেগুলি বয়সহীন এবং সময়ের সীমা মানে না। আপনারাও যখন বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে শুরু করবেন, তখন এই খেলনাগুলির মাধ্যমে নিজেদের শৈশবে ফিরে যেতে পারবেন। সেজন্য আমি সমস্ত মা-বাবাকে অনুরোধ করব, আপনারা যেভাবে শিশুদের সঙ্গে লেখাপড়ায় যুক্ত হন, তেমনই তাদের খেলাতেও অংশ নিন। আমি একথা বলছি না যে আপনারা বাড়ির এবং অফিসের সব কাজ ছেড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বাচ্চাদের সঙ্গেই খেলতে থাকুন। কিন্তু আপনারা ওদের খেলায় অবশ্যই অংশ নিতে পারবেন। আজকাল পরিবারের খেলার সময়টাকে বিভিন্ন স্ক্রিন দখল করে নিয়েছে। সেজন্য আপনাদের খেলা এবং খেলনার ভূমিকাকে অবশ্যই বুঝতে হবে। খেলনার যে বৈজ্ঞানিক দিক রয়েছে, বাচ্ছাদের উন্নয়নে, তাদের শিক্ষায় খেলনার যে ভূমিকা রয়েছে তা অভিভাবকদেরও বুঝতে হবে আর শিক্ষকদের বিদ্যালয়ে তা প্রয়োগ করতে হবে। এই লক্ষ্যে এখন দেশও কার্যকর পদক্ষেপ ওঠাচ্ছে, ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনছে। এর একটি উদাহরণ আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতি। নতুন জাতীয় শিক্ষানীতিতে ক্রীড়া-ভিত্তিক এবং গতিবিধি-ভিত্তিক শিক্ষাকে বেশি করে সামিল করা হয়েছে। এটা একটি এমন শিক্ষা ব্যবস্থা যেখানে শিশুদের ধাঁধা এবং খেলার মাধ্যমে যুক্তি, তর্ক ও সৃষ্টিশীল ভাবনা যাতে বৃদ্ধি পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা হয়েছে।
বন্ধুগণ,
খেলনার ক্ষেত্রে ভারতের কাছে ঐতিহ্য যেমন আছে, প্রযুক্তিও আছে। নানারকম ধারনা যেমন আছে, তেমনই দক্ষতাও আছে। আমরা বিশ্বকে পরিবেশ-বান্ধব খেলনার দিকে ফিরিয়ে আনতে পারি। আমাদের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়াররা কম্পিউটার গেমগুলির মাধ্যমে ভারতের প্রাচীণ কথাগুলি, যেগুলি ভারতের মৌলিক সম্পদ, সেই কথাগুলিকে বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ১০০ বিলিয়ন ডলারের আন্তর্জাতিক খেলনা বাজারে আজ আমাদের অংশীদারিত্ব খুব কম। দেশের ৮৫ শতাংশ খেলনা বাইরে থেকে আসে, বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বিগত সাত দশকে ভারতীয় কারিগরদের, ভারতীয় ঐতিহ্যকে যেভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে তার পরিণাম হল ভারতের বাজার থেকে শুরু করে পরিবার পর্যন্ত বিদেশি খেলনায় ভরে গেছে, আর সেই খেলনাগুলি শুধুই আসেনি, একটি ভিন্ন ভাবনা প্রবাহ নিয়ে আমাদের বাড়িতে, শিশুদের মস্তিষ্কে ঢুকে পড়েছে। ভারতীয় শিশুরা নিজেদের দেশের বীর, নিজেদের নায়কদের থেকে বেশি করে বাইরের তারকাদের সম্পর্কে কথা বলে। এই সাংস্কৃতিক বন্যা, এই বহুদেশীয় সাংস্কৃতিক বন্যা আমাদের স্থানীয় বাণিজ্যের অত্যন্ত শক্তিশালী শৃঙ্খলকেও ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। কারিগররা নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মকে আর তাঁদের দক্ষতা শেখাচ্ছেন না। তাঁরা ভাবছেন যে আমাদের ছেলে-মেয়েরা এই ব্যবসায় যেন না আসে। আজ আমাদের এই পরিস্থিতি বদলানোর সময় এসেছে। সবাইকে মিলেমিশে কাজ করতে হবে। আমাদের খেলা ও খেলনার ক্ষেত্রেও দেশকে আত্মনির্ভর করে তুলতে হবে, ভোকাল ফর লোকাল হতে হবে। সেজন্য আমাদের আজকের প্রয়োজনগুলি বুঝতে হবে, আমাদের বিশ্ব বাজারের অগ্রাধিকারকে জানতে হবে। আমাদের খেলনাগুলির মধ্যে শিশুদের জন্য আমাদের মূল্যবোধ, শিষ্টাচার এবং শিক্ষার প্রভাব থাকতে হবে। তার উৎকর্ষ আন্তর্জাতিক মাপদণ্ডের হিসেবে হতে হবে। এই লক্ষ্যে দেশ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত বছর থেকে খেলনাগুলির কোয়ালিটি টেস্ট অনিবার্য করা হয়েছে। আমদানিকৃত খেলনাগুলির প্রত্যেক পর্যায়ে স্যাম্পেল টেস্টিং-এর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। পূর্ববর্তী সরকারগুলি খেলনা সম্পর্কে কথা বলারও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। এই বিষয়টিকে কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলেই মনে করা হয়নি। কিন্তু এখন দেশ খেলনা শিল্পকে ২৪টি প্রধান শিল্পের মধ্যে মর্যাদা দিয়েছে। ন্যাশনাল টয় অ্যাকশন প্ল্যানও রচনা করা হয়েছে। এতে ১৫টি মন্ত্রক এবং বিভাগকে সামিল করা হয়েছে যাতে এই শিল্পোদ্যোগ প্রতিযোগিতামূলক হয়ে ওঠে। দেশ খেলনার ক্ষেত্রে আত্মনির্ভর হয়ে ওঠে। আর ভারতের খেলনা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। এই গোটা অভিযানে রাজ্যগুলিকেও সমান অংশীদার করে তুলে টয় ক্লাস্টার উন্নয়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি, দেশে পুতুল পর্যটনের সম্ভাবনাকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ভারতীয় খেলাগুলির ভিত্তিতে গড়ে তোলা খেলনাকে প্রোমোট করার জন্য দেশে ‘টয়কাথন, ২০২১’ আয়োজন করা হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে যে এই ‘টয়কাথন’-এ ১২ লক্ষেরও বেশি যুবক-যুবতী, শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং বিশেষজ্ঞরা নিজেদের নথিবদ্ধ করিয়েছেন, আর ৭ হাজারেরও বেশি নতুন নতুন ভাবনা এসেছে। এ থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে অনেক দশকের উপেক্ষা ও সমস্যা থাকা সত্ত্বেও ভারতের প্রতিভা, ভারতের দক্ষতা আজও অসাধারণ সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ। যেভাবে ভারত অতীতে নিজের মনের আনন্দে, নিজের প্রাণশক্তি দিয়ে মানবসভ্যতাকে নানা রং-এ রাঙিয়ে দিয়েছিল, সেই প্রাণশক্তি আজও ততটাই জীবন্ত। আজ পুতুল মেলার এই অবসরে আমাদের সকলের দায়িত্ব হল আমাদের এই প্রাণশক্তিকে আধুনিক রূপ দিতে হবে। এই সম্ভাবনাগুলিকে বাস্তবায়িত করতে হবে। আর হ্যাঁ, মনে রাখবেন, আমরা যখন আজ ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ পণ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদা দেখতে পাচ্ছি, পাশাপাশি ‘হ্যান্ড-মেড ইন ইন্ডিয়া’র চাহিদাও সমানতালে বাড়ছে। আজ মানুষ খেলনাকে নিছকই একটি পণ্য রূপে নয়, সেই খেলনার সঙ্গে যুক্ত অভিজ্ঞতাও অর্জন করতে চান। সেজন্য আমাদের ‘হ্যান্ড-মেড ইন ইন্ডিয়া’কেও প্রোমোট করতে হবে। আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে আমরা যখন কোনও খেলনা তৈরি করি তখন একটি শিশুমনকে তৈরি করি। শৈশবের অসীম উল্লাসকে তৈরি করি। তাতে স্বপ্ন ভরে দিই। এই উল্লাস আমাদের আগামীকালের নির্মাণ করবে। আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে আজ আমাদের দেশ এই দায়িত্বকে বুঝতে পারছে। আমাদের এই প্রচেষ্টা আত্মনির্ভর ভারতকে এমন গতি ও আনন্দ দেবে যে গতি ও আনন্দ শৈশবে একটি নতুন দুনিয়া রচনা করে। এই বিশ্বাস নিয়ে আপনাদের সবাইকে আরেকবার অনেক অনেক শুভকামনা জানাই। এখন বিশ্বে ভারতের খেলনার ডঙ্কা বাজাতে হবে। এটা আমাদের সকলের দায়িত্ব। আমাদের মিলেমিশে চেষ্টা করতে হবে। নিরন্তর চেষ্টা করতে হবে। নতুন নতুন রং-রূপে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। নতুন নতুন ভাবনা, নতুন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আমাদের খেলনাগুলির সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে আমাদের এই পুতুল মেলা আমাদের সেই লক্ষ্যে নিয়ে যেতে একটি শক্তিশালী পদক্ষেপ রূপে সিদ্ধ হবে। আমি আরেকবার আপনাদের সবাইকে অনেক অনেক শুভকামনা জানাই।
অনেক অনেক ধন্যবাদ!