১৮৭৫ সালথেকে একটি সুদৃঢ় যাত্রা এবং দক্ষতার সঙ্গে এগিয়ে চলেছে অনেক পরত, অনেক সাফল্য,অনেক সংকটও এসেছে কিন্তু স্টেটস্ম্যান টিম প্রাণপনে নিজের দায়িত্ব পালন করারচেষ্টা চালিয়ে গেছে। গতকাল অনেকক্ষণ মিঃ আর এন আর-এর সঙ্গে গল্প করার সুযোগপেয়েছিলাম। একবার শ্রদ্ধেয় ইরানি সাহেবের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলার সুযোগপেয়েছিলাম। তিনি আমাদের প্রখর সমালোচক ছিলেন, কিন্তু তাঁর সঙ্গে কথা বলে খুব আনন্দপাওয়া যেত, তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু জানা ও শেখা যেত। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ তাঁর সহজাতস্বভাব ছিল, আমি কখনও কখনও সেসব কাছে থেকে শোনার সুযোগ পেয়েছি।
আমাদের দেশেএকটি জিনিসের অভাব রয়েছে, তার কারণ কী, আমার সঙ্গে সকলে একমত নাও হতে পারেন। আমরাকখনও ইতিহাস সচেতন সমাজ রূপে পরিচিত ছিলাম না, আর সেজন্য ...... যেমন ইংরেজদের দেখুন,প্রতিটি ছোট ছোট জিনিস কিভাবে সামলে রাখেন। সম্প্রতি আমি পর্তুগাল গিয়েছিলাম। গোয়াযখন পর্তুগীজ উপনিবেশ ছিল, তখনকার শাসন সংক্রান্ত পত্রালাপের নকল পাওয়ার চেষ্টাজারি ছিল। ঐ চিঠিগুলির মাধ্যমে সেই দীর্ঘ ঔপনিবেশিক সময়ের ইতিহাস জানা যাবে। এবারআমি গেলে সেদেশের সরকার আমাদের প্রস্তাব মেনে সকল চিঠিপত্রের এককপি গোয়া রাজ্যসরকারের জন্য দিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ সেই পত্রসম্ভারের নকল। ঐগুলি গোয়ারউন্নয়নযাত্রার ঘটনাক্রমেরও সাক্ষী। অথচ আমাদের দেশের এগুলিকে কেউ সামলে রাখেননি।আজও আমরা যদি দেখি ভারতের অনেক কিছু নিয়ে জানতে হলে আমাদের গবেষকদের ব্রিটেনে গিয়েসেখানকার কোনও গ্রন্থাগারে বসে পড়তে হয়। কারণ, আমাদের সংরক্ষণের স্বভাব নেই। আমিবুঝি এটি কোনও ব্যক্তি ভক্তির বিষয় নয়, রাষ্ট্রের জীবনে এই সকল ব্যবস্থার অত্যন্তগুরুত্ব থাকে আর সেগুলিকে ইতিহাসের ঘটনা রূপে গ্রহণ করলে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরজন্য অনেক বড় সেবা করি।
এখন এটি তোএকটি চিত্র সফর, আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের রাষ্ট্রপতি, তাঁর আশেপাশে সবলম্বা-চওড়া মানুষদের তটস্থতা, অনেক প্রোটোকল, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হচ্ছে, অত্যন্তগরিমা নিয়ে দাঁড়িয়ে, বিশ্ব এটাই দেখে। কিন্তু এইসব ব্যবস্থার মাঝে একজন সহৃদয়মানুষ থাকেন, সেটা তখনই বোঝা যায় যখন কোনও চিত্র সাংবাদিকের ক্লিকে ক্যাকমেরাবন্দী হন। আর পরদিন যখন সবাই আমরা সেগুলি বইয়ে ছাপা অবস্থায় দেখি, আচ্ছা, আমাদেররাষ্ট্রপতিজি কেমন বালকের মতো হাসেন! সেই হাসি আমাদের মন ছুঁয়ে যায়। বিদেশ থেকে যতবড় অতিথিই আসুন না কেন, তাঁর আকার যত দীর্ঘদেহীই হোক না কেন, ওই ছবিগুলি দেখে বোঝাযায় আমাদের রাষ্ট্রপতির আত্মবিশ্বাস কত দৃঢ়; তা দেখে গর্ব হয়। এরকম সমস্ত মুহূর্তেরছবি এই গ্রন্থে সংকলিত। অর্থাৎ পদ ও ব্যবস্থার বাইরেও তিনি আমাদের রাষ্ট্রপতি,তাঁর মধ্যেও একজন মানুষের সফরকে আমরা ক্যামেরাবন্দী রূপে দেখি, যা ছবি রূপে প্রকটহয়ে থাকে।
মহাত্মাগান্ধী যখন জীবিত ছিলেন, সেই সময় তো এত ক্যামেরা ছিল না, ব্যবস্থা ছিল না, কিন্তুতাঁর ছবিগুলির মধ্যে গান্ধীজির দুটি ছবি – একটিতে তিনি ঝাড়ু হাতে সাফাই করছেন, আরঅন্য ছবিতে অনুবীক্ষণ যন্ত্রে দৃষ্টি নিবদ্ধ; এগুলি থেকে বোঝা যায়, তাঁরব্যক্তিত্বের বিস্তার কোথা থেকে কোথায়! দুটো ছবির মাধ্যমে গান্ধীজির দুটো রূপদেখানো সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ ফটোগ্রাফার যখন ছবি তোলেন, তখন সেই মুহূর্তকে সেই রূপেধরেন, যে মুহূর্ত ইতিহাসকে অমরত্ব প্রদানের সামর্থ্য রাখে।
ইতিহাসকেঅমরত্ব দেওয়ার কারণে এই ছবি নথি বা দলিলে পরিণত হয়ে ওঠে। এখানে ফটোগ্রাফার বরুণযোশীও তাঁর তোলা ছবিগুলিতে তেমনি ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলিকে ধরার চেষ্টা করেছেন,স্টেটস্ম্যান টিম এগুলিকে সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছে। অন্যথা যখন প্রযুক্তিরমাধ্যমে এসএমএস-এর দুনিয়া শুরু হয়েছিল, তখন হয়তো আপনারা দেখেছেন যে, খবরেরকাগজগুলিতে অনেক নিবন্ধ ছাপা হ’ত যে এসএমএস এমন এক উপায়, যা মানুষের চিঠি লেখারঅভ্যাসকেই শেষ করে দিতে পারে! পত্র-সাহিত্য মানব সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণঐতিহ্য। সেটা যদি লোপ পায়, তা হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কিছু জানতেই পারবে না। ২৫ বছরআগে এ ধরনের আশঙ্কাপূর্ণ নিবন্ধ ছাপা হ’ত। তখন সেই পণ্ডিত নিবন্ধকাররাও বুঝতেপারেননি যে প্রযুক্তি এত বদলে যাবে, সম্ভবতঃ প্রত্যেক মানুষের মধ্যে সৃষ্টিশীলতাজেগে উঠবে, সকলের মধ্যে একজন লেখক তৈরি হবে আর নতুন নতুন প্রযুক্তি আমাদের অন্তরেরসৃষ্টিশীলতার অঙ্কুরোদগম ঘটাবে, আর সম্ভবতঃ তা সুরক্ষিতও থাকবে।
একটা সময়ছিল, যখন ‘অটোগ্রাফ’-এর অত্যন্ত গুরুত্ব ছিল, ধীরে ধীরে ফটোগ্রাফির গুরুত্ব বাড়ে,আর এখন ‘অটোগ্রাফ’ আর ‘ফটোগ্রাফ’-এর মিলিত স্থান গ্রহণ করেছে ‘সেলফি’। দেখুন,কিভাবে পরিবর্তন আসে। সেলফি অটোগ্রাফ আর ফটোগ্রাফ উভয়ের উন্নত সংস্করণ। অর্থাৎ মূলভাবনা থেকে পরিবর্তন হতে হতে কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে যেতে পারে – তা আমরা অনুভব করছি।এই বইটিকে দেখে আমার মনে হয়েছে যে, খবরের কাগজের মাধ্যমে বিশ্ব যে রাষ্ট্রনায়ককেচিনেছে, আমাকে ক্ষমা করবেন! এখানে অনেক খবরের কাগজের সাংবাদিক ছিলেন। ঐ খবরেরকাগজের চৌহদ্দির বাইরেও, রাজনৈতিক জীবনে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা মানুষেরারয়েছেন। নৈমিত্তিক দৌড়ঝাঁপে খবরের কাগজ তাঁদের পরিমাপ করতে পারে না, কিন্তুপরবর্তী সময়ে গবেষণার মাধ্যমে যখন অনেক কিছু জানা যায়, তখন বোঝা যায় যে, নৈমিত্তিকজীবনে দেখা মানুষটির ভেতরে আরেকজন মানুষ বসে আছেন। আর সেজন্য ভেতরের সত্যিকে জানতে,প্রণবদাকে জানতে, তাঁর কাছে যেতে এমনকি কখনও তাঁর অন্তরে প্রবেশ করতে এই বই সুযোগকরে দেবে। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য আমি গুপ্তাজি এবং তাঁর সম্পূর্ণ টিমকে,বিশেষ করে ভাই বরুণ যোশীকে হৃদয় থেকে অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা জানাই।
আমিসৌভাগ্যবান, মাননীয় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আমি কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। আমার জীবনে এরকমকিছু মহান ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছে। জরুরি অবস্থার সময় অনেক ভিন্নভিন্ন মতাদর্শের ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এসেছি। তখন আমি রাজনীতিতে ছিলাম না, নানাসামাজিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, বয়স অনেক কম ছিল। তাই ঐ বিপরীত মতাবলম্বীমানুষদের সংস্পর্শে এসে অনেক কিছু শিখেছি, বুঝেছি। তেমনই একজন ছিলেন, গুজরাটবিদ্যাপীঠের উপাচার্য ধীরুভাই দেশাই, জরুরি অবস্থার সময় আমাকে নানা কাজে তাঁরবাড়িতে যেতে হ’ত। তাঁর বাড়িতে প্রখর গান্ধীবাদী নেতা রবীন্দ্র বর্মার সঙ্গে পরিচয়।সমাজবাদী নেতা জর্জ ফার্নান্ডেজের সান্নিধ্যে এসে তাঁর মাধ্যমে কংগ্রেস দলেরসমাজবাদী চিন্তাধারার কয়েকজনের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছে। তাঁদের জীবন ওজীবনদর্শন আমাকে কম-বেশি প্রভাবিত করেছে। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরও এমনঅনেকের সান্নিধ্য পেয়েছি, যাঁরা আমাকে প্রভাবিত করেছেন। যেমন কংগ্রেসের বিশিষ্টনেতা নওয়ল কিশোর শর্মা মহোদয়ের সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে। তাঁর কাছ থেকে অনেকশিখেছি। তেমনই আমার জীবনের বড় সৌভাগ্য যে প্রণবদার মতো মহান ব্যক্তিত্বের হাত ধরেদিল্লির কর্মজীবনে নিজেকে মানিয়ে নিতে পেরেছি। অনেক সাহায্য, অনেক পরামর্শ;দিল্লিতে তাঁর সান্নিধ্যে আমার অনেক বড় সহায় বলে প্রতিপন্ন হয়েছে।
আমি এমন একমানুষ যার মনে সবসময় দুশ্চিন্তা থাকে যে, কোনও কাজ দ্রুত না শেশ হয়ে যায়! কাজ নাথাকলে সন্ধ্যার পর কী করব? আপনারা সংবাদমাধ্যমের মানুষ, যে কোনও খবর ‘লিক’ করানোয়আপনারা সিদ্ধহস্ত। আমি একদিন আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলাম, তখন ৮টা-৯টার মাঝামাঝিহবে। তারপর ৯টা নাগাদ মিটিং শেশ হলে আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছিল যে, আরে এততাড়াতাড়ি বৈঠক শেষ? ঠিক আছে, যাই, দেখি, কিভাবে সময় কাটানো যায়! পরদিন অবাক হয়েদেখি, এই মুখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়া কথাও খবরের কাগজে ছাপা হয়ে গেছে! লেখা হয়েছে, ‘রাত৯টার পরও তিনি ভাবেন, সময় কিভাবে কাটাবেন’!
কিন্তু গততিন বছরে মাননীয় রাষ্ট্রপতি মহোদয়ের সঙ্গে আমার কোনও সাক্ষাৎ এরকম ছিল না, যেদিনতিনি পিতার মতো, আমি অন্তর থেকে বলছি, কোনও পিতা তাঁর সন্তানকে যেমন সস্নেহে লালনকরেন, দেখো মোদীজি! কমপক্ষে আধা দিন বিশ্রাম নিতেই হবে! কোনওদিন প্রণবদা বলেন,দেখো ভাই, এত কেন দৌড়ঝাঁপ করো? নৈমিত্তিক অনুষ্ঠান কিছু কম করো? নিজের শরীরের দিকেলক্ষ্য রাখতে হবে।
উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনের আগে আমি যখন নির্বাচনী প্রচারের জন্য ছুটে বেড়াচ্ছি,তখন একদিন তিনি বলেন, ভাই নির্বাচনে হার-জিত চলতে থাকবে কিন্তু নিজের শরীরটাও তোদেখতে হবে, কি ঠিক তো?
এই সতর্কবাণীও ব্যক্তিগত স্নেহের পরশ রাষ্ট্রপতির কর্তব্যের অংশ ছিল না। কিন্তু তাঁর ভেতরেরমানুষটি এক অনুজ সঙ্গীর জন্য ভাবেন। আমার মতে, এই ব্যক্তিত্ব, এই সম্মান, মর্যাদারএই রূপ আমাদের রাষ্ট্রজীবনকে গৌরবান্বিত করেছে। এভাবেই প্রণবদা আমাদের সকলকেপ্রেরণা যুগিয়ে গেছেন। মাননীয় রাষ্ট্রপতির এই ব্যক্তিত্বকে আমি সাদর প্রণাম জানাই।আর আজ ভাই বরুণ যোশীকে শুভেচ্ছা জানাই। এই অমূল্য সম্পদ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ঐতিহ্যহয়ে উঠবে। স্টেটস্ম্যান গ্রুপ’কে শুভেচ্ছা জানাই।
অনেক অনেকধন্যবাদ।