সারা ভারত সিভিল সার্ভিস দিবস হিসেবে আজকের দিনটি এক প্রকার পুনঃউৎসর্গীকরণ দিবস। সারা দেশে এখনও পর্যন্ত যতজন শ্রদ্ধেয় মানুষের এই কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে,আজ যাঁরা দেশের নানাপ্রান্তে কর্তব্যরত তাঁদের সবাইকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
আপনারা এত অভিজ্ঞ। আমি নিশ্চিতভাবেই জানি যে, আপনারা নিজেদের ক্ষমতাসম্পর্কে ভালভাবে জানেন, আপনাদের প্রতিনিয়ত যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, যেসবদায়িত্ব রয়েছে, সেগুলি সম্পর্কে ভালভাবে জানেন। আর আমরা দেখেছি যে, এই বর্তমান ব্যবস্থারমধ্যেই দেশকে আপনারা ভাল পরিণাম এনে দিয়েছেন! কিন্তু আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগের সময়েরসঙ্গে বর্তমান সময়ের অনেক পার্থক্য আর আগামী পাঁচ বছরে পরিস্থিতি আরও অনেক বদলেযাবে। কারণ, ১৫-২০ বছর আগে আমরাই আমরা ছিলাম, যতটা ছিলাম আমরাই ছিলাম। সাধারণমানুষের জীবনের সকল প্রয়োজন সাধনের পথ আমাদের পথেই এসে মিলত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য,সিমেন্ট, লোহা যা চাই সবকিছুর জন্যই সাধারণ মানুষ সরকারের মুখাপেক্ষী হতে হ’ত। আরযখন সরকারই সকল সমস্যার সমাধান করতে পারতো, আমরাই সকল দন্ডমুন্ডের কর্তা, তখনআমাদের মধ্যে কিছুন কুপ্রবৃত্তি গড়ে ওঠা স্বাভাবিক। কিন্তু গত ১৫-২০ বছর ধরে ক্রমেআমরা একটি প্রতিযোগিতার কালখন্ডে এসে পড়েছি। সাধারণ মানুষও তুলনা করার সুযোগপেয়েছেন যে, সরকারি বিমান এভাবে যায় আর বেসরকারি বিমান পরিষেবা এরকম! তখনই তাঁদেরমনে হয় – সরকারি ব্যবস্থা ফালতু, সরকার ফালতু, সরকারে ক্ষমতাসীন মানুষগুলি সবঅকর্মন্য, অপদার্থ। কারণ তাঁরা আজ নানা পরিবর্ত পরিষেবার সঙ্গে তুলনা করতে পারছেন।
আগে সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারবাবু হেসে দুটো কথা বললে, আর কিছু না করে শুধুরক্তচাপ মেপে নিলেও মানুষের মনে হ’ত যে, তাঁর রোগ সেরে যাবে, চিকিৎসা পরিষেবা ভালইপাচ্ছেন। আজ ডাক্তারবাবু দশবার এলেও মনে হয় বেসরকারি হাসপাতালে আনুষঙ্গিক অমুকঅমুক পরিষেবা পাওয়া যাবে, সেখানে গেলেই ভাল হ’ত। এই পরিবর্ত পরিষেবার হাতছানিসরকারি পরিষেবা এবং আধিকারিকদের বিশেষ প্রতিস্পর্ধার মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে।বিশেষ করে, যাঁরা সিভিল সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের দায়িত্ব ২০ বছর আগের তুলনায়অনেক বেড়ে গেছে। বোঝা বাড়েনি। প্রতিস্পর্ধা বেড়েছে। তুলনামূলক পরিষেবারপ্রতিস্পর্ধা। যে কোনও ব্যবস্থা প্রতিযোগিতার মধ্যেই উৎকৃষ্ট পরিবর্তন সাধনে অনেকবড় ভূমিকা পালন করে। স্থবিরতা থাকলে, উচ্চাকাঙ্খা না থাকলে, প্রতিযোগিতা না থাকলে,যা আছে সেটাকেই সর্বোত্তম বলে মনে হতে পারে। প্রতিযোগিতা আমাদের অপরের থেকে এগিয়েযাওয়ার উদ্যম যোগায়। সেজন্য যেন-তেন প্রকারণে প্রতিযোগীকে টেনে নামানো কিংবা তারউন্নতির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার মানসিকতা থাকলে চলবে না, আমাদের দূরদৃষ্টিরসাহায্য নিয়ে নিজেদের কার্যশৈলীতে পরিবর্তন এনে প্রতিযোগীদের এগিয়ে যেতে দিয়েতাঁদের থেকে উন্নত পরিষেবা প্রদান করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি আমরা নিয়ন্ত্রকের মেজাজথেকে বেরিয়ে সহযোগী শক্তিতে পরিণত হতে পারব, ওই সমস্যাগুলি তত তাড়াতাড়ি সুযোগেপরিণত হবে। সেক্ষেত্রে পরিবর্তিত সময়ে কোনও প্রকল্পে সরকারের অনুপস্থিতি অনুভূতহবে, আর সরকারের উপস্থিতিকে বোঝা বলে মনে হবে না। আমরা আমরা এমন ব্যবস্থা কিভাবেগড়ে তুলব? আমরা এই দৃষ্টিকোণ পরিবর্তনের মাধ্যমেই সবকিছু নতুনভাবে গড়ে তুলতে পারব।
এখন এখানে কিছু প্রচেষ্টা জারি রয়েছে। আপনারা কেবল এই সিভিল সার্ভিসেস্দিবস উদযাপনের কথাই ভাবুন না। আগে কেমন ছিল, এখন এমনভাবে কেন উদযাপিত হচ্ছে? এইপ্রশ্নের জবাব এটা হওয়া উচিৎ নয় যে, প্রধানমন্ত্রী চেয়েছেন বলে আমরা এরকম করছি!আসলে আগে এই সুন্দর অবসরটিকে আমরা প্রাতিষ্ঠানিকতায় পরিবর্তিত করেছিলাম। যে কোনওঅবসরকে আমরা যদি প্রাণবন্ত করে তুলতে পারি, নিজেকে যুক্ত করতে পারি, ভবিষ্যতের কথাভাবি, তা হলে সেই অবসর আমাদের মধ্যে একটি নতুন শক্তি সঞ্চার করে। আপনাদের প্রতিটিকাজে এই সম্ভাবনাগুলি অন্তর্নিহিত রয়েছে। কেবল একবার সেগুলিকে ছুঁয়ে দেখতে হবে,স্পর্শেই স্পন্দন অনুভব করতে শুরু করবেন। নিজেদের জীবনের কথা ভাবুন, একদিন কোনওগ্রামে গিয়ে কাজ করা শুরু করেছিলেন, ধীরে ধীরে জেলাস্তরে এসেছেন, এভাবে আপনারাএতদূর উঠে এসেছেন। আপনাদের সমসাময়িক অনেকে আজও জেলায় কাজ করছেন। কিন্তু গতবার অনেকেএতটা কল্পনাও করেননি, তাই এন্ট্রি ১০০টিরও কম হয়েছিল। কিন্তু এবার একলাফে এতসংখ্যাবৃদ্ধি হয়েছে। একেবারে ৫০০রও বেশি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। এই‘কোয়ান্টাম জাম্প’কে আমি স্বাগত জানাই। হতে পারে কেউ জিজ্ঞেস করেছেন, তুমিপাঠিয়েছ? আর তিনি ভেবেছেন, আরে ভাই, না পাঠালেও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারি, তাঁরচাইতে পাঠিয়েই দিই! কিন্তু আমার সামনে যখন রিপোর্ট এল তখন আমার মাথায় অন্যরকমচিন্তা এল। এতজন প্রতিযোগিতায় সামিল হওয়ায় ‘উৎকর্ষ বিশ্লেষণ’ এর নতুন ভাবনা এল।যাতে আমরা প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় পুরস্কার না দিতে পারলেও আমরা আরও বেশি খতিয়েদেখলাম। আমি এখানে সেসব পরিসংখ্যান উল্লেখ করতে চাই না। লাইভ টিভি চলছে। কিন্তুআমি অত্যন্ত খুশি, এক বছরে এই ‘কোয়ান্টাম জাম্প’ হয়েছে। এখন আমি চাই, আগামী একবছরে আরও গুণগত পরিবর্তন হোক। উৎকৃষ্টের নীচেও তো কোনও ‘এন্ট্রি’ হওয়া উচিৎ! কারণ,বর্তমান ব্যবস্থায় যাদের কাজে ‘উৎকর্ষের’ ছাপ লেগেছে, শুধু তাঁরাই এখানে এসেছেন।
এটা হতে পারে যে, তাঁরা কোনও কোচিং ক্লাসে যোগদান করে এই সাফল্য পেয়েছেন।কিন্তু তবুও উৎকর্ষের ছাপ লেগেছে বলেই এখানে এসেছেন। কিন্তু এই ছাপ লাগলেই হবে না।পরিষেবার ক্ষেত্রেও ধীরে ধীরে গুণগত পার্থক্য আসতে হবে। আপনারা হয়তো লক্ষ্যকরেছেন, অনেক পরিবারে গৃহিনীর কর্মকুশলতা থাকা সত্ত্বেও তেমন দাপট থাকে না। সবাইতাঁকে ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ মনে করে নেয়। কিন্তু ঈশ্বর হঠাৎ সেই পরিবারের কর্তাকেছিনিয়ে নিয়ে গেলে সেই রান্নাঘরে ব্যস্ত মহিলা হঠাৎ ব্যবসা পরিচালনা শুরু করেন। এতভাল পরিচালনা করেন যে, এর মাধ্যমে ছেলেমেয়েদের ভালভাবে বড় করে তোলেন। প্রতিবেশীপুরুষরাও তখন তাঁর বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টির সামনে ম্রিয়মান হয়ে পড়েন। গতকাল পর্যন্তযিনি অখ্যাত ছিলেন, অর্থাৎ অন্তর্নিহিত শক্তি ছিল, সুযোগ পেতেই সেটা এমন প্রস্ফুটিতহল যে তাঁর সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তেমনই এখানে যাঁরা রয়েছেন, ওই পরীক্ষায়বসতে কত না সমস্যার পাহাড় ঠেলে আসতে হয়েছে, কত না চাপ সহ্য করতে হয়েছে, কিন্তু এখনআপনাদের হাতে প্রভূত ক্ষমতা, এত বড় ব্যবস্থা! এতবড় সুযোগ পেয়েছেন, সবকিছুকে নতুনদৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন। ‘হায়ারার্কি’র বোঝা তো রয়েছেই। সম্ভবত, এটিইংরেজ জমানার ঐতিহ্য, মুসৌরিতেও আমি থেকে আমরা হয়ে উঠতে পারিনি। তোরা নতুন এসেছিস,আমি সব পারি! আমাদের সময়ে এরকম হ’ত! আমি তো ২০ বছর আগে জেলার দায়িত্ব ছেড়ে এসেছি,এই অভিজ্ঞতার ঝুলি! সেই ঝুলিই আমরা পারস্পরিকভাবে নবীনদের হাতে তুলে দিয়ে এসেছি।সিনিয়ররা ভাবুন, নবীন প্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়া আপনাদের সেই অভিজ্ঞতার ঝুলি কখনওবোঝায় পরিণত হচ্ছে না তো? কখনও আমাদের অভিজ্ঞতা নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রেপ্রতিবন্ধকতা হয়ে উঠছে না তো? কখনও এমন মনে হচ্ছে না তো, আজ আমি বিভাগীয় সচিব, ২০বছর আগে ঐ জেলায় অমুক সমস্যার সমাধান করার অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি! আমারপরও কেউ পারেনি, এখন ঐ নতুন ছেলেটি এসে সমাধান করে ফেললে, আমার অসম্মান হবে! কেউবলবে, তুই যা পারিসনি, দেখ ঐ বাচ্চা ছেলেটি তা করে দেখিয়েছে! এভাবে আমার অভিজ্ঞটারঝুলি বোঝায় পরিণত হয়ে একদিন আমিও মূর্তিমান বাধা হয়ে উঠি! অথচ আমাদের ঐ নতুনছেলেটিকে নিয়ে গর্ব হওয়া উচিৎ! যা আমি পারিনি, কিন্তু আমি যে স্বপ্ন দেখেছিলাম,বাস্তবে পরিণত হয়নি, এই ছেলেটি নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত করায়আমার স্বপ্নের বাস্তবায়ন হ’ল, আমি তাঁর জন্য গর্ব করব না? যে মাঠে আমি হালচালিয়েছি, পরের জন সেচের জলের ব্যবস্থা করেছেন, তার পরের জন গাছের চারা লাগিয়েছেন,চতুর্থজন লালন-পালন করে তাকে মহীরূহে পরিণত করেছে, আর পঞ্চমজন সেই গাছের ফল পেড়েআমাকে খাওয়াতে এসেছে। পাঁচজনেরই এতে সমান কৃতিত্ব। তবেই তো এই পরিণাম সাধিত হয়েছে।এই মনোভাব নিয়ে আমরা যদি এই পরম্পরাকে এগিয়ে নিয়ে যাই, তা হলে আমাদের সম্মিলিতশক্তি দেশকে সুফল দেবে।
আমি গতবার বলেছিলাম, সিভিল সার্ভিস-এর সবচাইতে বড় শক্তি কী? গুজরাটিতে একটিপ্রবচন আছে, হিন্দিতে কি হবে জানি না। ‘ঠোঠ নিশার নি কদর’ অর্থাৎ ‘সচেতন ব্যক্তিরসমাদর’। যে পড়াশুনায় দুর্বল সে অনুভব করে যে, পড়াশুনার ভাল সে আমার থেকে এগিয়ে!টাকার মূল্য আপনারা ও আমাদের মতো রাজনীতিজ্ঞরা ভালই বুঝি! কিন্তু এসব কিছু থেকেএগিয়ে যে শক্তিকে আমাদের অবহেলা করা উচিৎ নয়, তা হল – অনামিকতা!
আপনাদের কর্মজীবনে এখন কয়েকজন আধিকারিককে আপনারা দেখেছেন, যাঁদেরদূরদৃষ্টির ফলে এমন একটি ভাবনাকে বাস্তবায়িত করে গেছেন বাস্তবায়নের পরিকাঠামোনির্মাণ করে গেছেন যে তার সুফল গোটা দেশকে উপকৃত করছে। কিন্তু খুঁজতে গেলে বুঝতেপারবেন না, কোন্ অবসরে তাঁদের মাথায় এই ভাবনা এসেছিল । ঠিক কার মাথায়এই ভাবনা এসেছিল, কিভাবে এসেছিল? এই অনামিকাই দেশের সিভিল সার্ভিসের অন্যতমশ্রেষ্ঠ শক্তি বলে আমি মনে করি। কারণ, আমি এই শক্তি সম্পর্কে অভিজ্ঞ। কিন্তুদুর্ভাগ্যবশত ইদানিং সেই অনামিকা শক্তির হ্রাস অনুভব করছি। আমি সোশ্যাল মিডিয়ারশক্তিকে চিনি, এর মহত্ব বুঝি। কিন্তু ব্যবস্থার বিকাশে এই সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারসাধারণ মানুষকে ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করা অব্দিই সীমাবদ্ধ হওয়া উচিৎ। একজন জেলাআধিকারিক হিসেবে, ২০ তারিখ টিকাকরণ হবে – এই খবর জেলার নাগরিকদের কাছে পৌঁছতেআপনারা সোশ্যাল মিডিয়াকেও ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু আমি সেই টিকাকরণে ‘আমিবাচ্চাদের মুখে পোলিও প্রতিষেধক ফোঁটা খাওয়াচ্ছি’ সেই ফটো সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারকরলে তা সেই অনামিকা শক্তির বিরুদ্ধে প্রশ্নবোধক চিহ্ন জুড়ে দেয়। আমাদের ব্যস্তসময়ের অনেকটাই সোশ্যাল মিডিয়ায় আত্মপ্রচারে ব্যয় করলে ব্যস্ততার গুরুত্বটাইহাস্যকর হয়ে ওঠে। এমনকি, দেশের নানাস্থানে সরকারি কাজে গেলে আপনারা আমার সঙ্গেদাঁড়িয়ে ছবি তুলে সেগুলি সোশ্যাল মিডিয়ায় দিয়ে দেন। এতে সমস্ত কাজের গুরুত্ব যেহ্রাস পায় সেটা বুঝতে হবে। সেজন্য ফটো তুলতে দিই না। কোন্ মাধ্যমকে কিভাবেব্যবহার করব, কেন করব, সে সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। আমাদের কাজের সঙ্গে সাধারণমানুষকে যুক্ত করতে এই মাধ্যমগুলিকে ব্যবহার করতে হবে!
বিশ্ব এখন ই-গভর্ন্যান্স থেকে এম-গভর্ন্যান্স – এর দিকে যাত্রা শুরু করেছে।মোবাইল ফোন গভর্ন্যান্স এখন এই সময়ের সত্য। আমরা এই সত্য থেকে দূরে থাকতে পারি না।কিন্তু গণপ্রয়োজন মেটাতে, গণসুবিধা চালু করতে আমার মতে অনামিকাই সবচাইতে বড় শক্তি।তাজমহলের নক্শা কতজন মিলে এঁকেছিলেন, কতজন মিলে এর ভাবনা-পত্র প্রস্তুত করেছিলেন,কতজন নির্মাণ শ্রমিক ছিলেন, সে সম্পর্কে আপনি-আমি কেউ-ই জানি না। কিন্তু তাজমহলদেখে আমরা বুঝি, এই এলাকার মানুষের সমবেত প্রচেষ্টায় এই মহান কীর্তি গড়ে উঠেছে।অথচ, যাঁরা করেছেন, অবসর গ্রহণের পর তাঁদেরকে পাঁচটি আশ্চর্যের নাম জিজ্ঞেস করলে –সবাই তাজমহলের নাম নিতেন কি না কে জানে! আমি এই উৎসর্গীকৃত প্রাণ কর্মবীরদেরঅনামিকা শক্তিকে অনুভব করি। আজ আমাদের ফটো মানের মতো না উঠলে রাতে ঘুম আসতে চায়না! সেজন্য জানি, নিজেকে না চিনে দিনরাত দেশের জন্য দিনরাত কাজ করা কম কথা নয়! এইশক্তিকে আমি চিনি। আমাদের অগ্রজ প্রশাসকরা এই পরম্পরার ধারক ও বাহক ছিলেন। তাকেবজায় রাখা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মে সঞ্চারিত হওয়া বর্তমান প্রজন্মের কর্তব্য।
আমরা যখন সিভিল সার্ভিস দিবস পালন করছি, তখন প্রশাসনকে সংস্কারের মাধ্যমেসময়ানুগ করে তুলতে সারা দেশে কেন্দ্রীয় সরকার ও অনেক রাজ্য সরকারের বহু কমিটি গড়েউঠেছে, অনেক কমিশন বসানো হয়েছে। কিন্তু যারা এগুলি রচনা করেন, সবাই সম্পূর্ণরিপোর্ট পড়ে ওঠারও সময় পান না। কারণ, ৬ জন মিলে নানা অংশ লিখেছেন, সপ্তম ব্যক্তিসেগুলিকে একসঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন, এর মধ্যে কোনও পরস্পর বিরোধী প্রস্তাব থেকে গেল কিনা তা-ও খতিয়ে দেখলেন না! আমার কথা শুনতে কারও খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু এটাইবাস্তব। আর তারপর সেই রিপোর্ট কোথায় রাখা আছে, তা-ও অনেকে জানেন না। কেন্দ্র ওরাজ্যগুলিতে যখন যাঁরা ক্ষমতা এসেছেন, এমনই কিছু না কিছু সংস্কারের কথা ভেবেছেন।কমিশন বসালে এটা ঠিক যে কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত মানুষের কিছুদিন ভালই রোজগার হয়,অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাজের কাজ কিছু হয় না; কাঙ্খিত পরিবর্তন আসে না। আমার বর্তমানঅভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বিগত ১৬ বছর ধরে আপনাদের সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে।না হলে বুঝতে পারতাম না, কৈশোরে কোচিং ক্লাস করে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসারমতো পরিস্থিতি আমার ছিল না। কিন্তু ১৬ বছর ধরে প্রশাসনে কাজ করলে একজন কোন্ পদেউন্নীত হন? ডেপুটি সেক্রেটারি? নাকি ডাইরেক্টর! গত ১৬ বছরে অন্তত তো আমিও একজনডাইরেক্টরের সমান অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি বলতে পারি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলি, বাইরেথেকে কোনও কমিশনের পরামর্শ থেকে আপনাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার মূল্য,পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূল্য অনেক বেশি। সেজন্য আমি অধিকাংশ কমিশনের রিপোর্টকে তেমনগুরুত্ব দিই না, অনুসরণও করি না! বরঞ্চ যাঁরা মাঠেঘাটে কাজ করেছেন, প্রতিদিনবাস্তব সমস্যাগুলির মুখোমুখি হচ্ছেন, তাঁদের পদ যত ছোটই হোক না কেন, তাঁদেরপরামর্শ আমার কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য। আমি সর্বশেষ চারটি ব্যাচের নবীন প্রশাসকদেরবলেছি, তাঁদের প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতা নিয়ে রিপোর্ট লিখতে থাকুন, তাঁরা কিভাবেসমস্যাগুলিকে দেখছেন আর কিভাবে সমাধান করার কথা ভাবছেন, তাঁদের নতুনচিন্তাপ্রক্রিয়া সম্পর্কে আমরা জানতে চাই। তাঁরা লিখেছেন, হতে পারে কেউ কেউ ‘কাটপেস্ট’ করেছেন, আমি সবকটি পড়িনি, কিন্তু অনেকের স্বভাবে এসব থাকে। তবুও, এমন অনেকজিনিসই উঠে এসেছে, যা বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে চিন্তাপ্রক্রিয়ার মেলবন্ধনে গড়েউঠেছে, যা আমাদের অভিজ্ঞ প্রশাসকদের অধুনামতম বাস্তব সমস্যাগুলি এবং সেগুলিরনিরসনে নতুন প্রজন্মের চিন্তাভাবনা সম্পর্কে জানতে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহ্ণেরক্ষেত্রে সেগুলিকে সম্পৃক্ত করতে কাজে অলাগবে। কারণ, এই রিপোর্টগুলি তাঁরা কোনওডিগ্রি পাওয়ার জন্য কিংবা অ্যাকাডেমিক র্যাঙ্কিং পেতে লেখেননি। মাঠেঘাটে কাজ করারঅভিজ্ঞতা থেকে, দৈনন্দিন কৃষক, শ্রমিক, কেরানিকুল কিংবা কম্প্যুটার অপারেটরদেরসাথে মিশে যা দেখেছেন, বুঝেছেন, সেই অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন।
এই রিপোর্টগুলির নির্বাচিত সংকলনকে আমরা একটা ধর্মগ্রন্থের মতো গুরুত্বদিয়ে গ্রহণ করতে পারব কি? এগুলির গায়ে যত অনভিজ্ঞতাই লেগে থাকুক না কেন, এগুলিরমধ্যে তাঁদের মনের কথা লেখা আছে। মন থেকে উঠে আসা কথার অপার শক্তি রয়েছে। মনেরআকুতিসম্পন্ন সিদ্ধান্তে যে আপনত্ব থাকে তা সাফল্যকে সুনিশ্চিত করে। দলগতভাবেসিদ্ধান্তকে আপন করে নিলে দ্রুত সাফল্য আসে। দায়িত্ব কমে, বোঝা কমে, পরিণামের যশসবাই ভাগ করে নিতে পারেন। বর্তমান প্রয়াসও তেমনই আপনত্ব গড়ে তোলার আন্দোলন। এইদুর্দিনেও আমরা অনেক আপনত্ব অর্জন করি। সবাই অনুভব করেন যে, এই দেশ আমার, সরকারআমার, দায়িত্ব আমার, পরিণামও আমাদেরকেই আনতে হবে, সমস্যার সমাধান আমাদেরকেই করতেহবে।
একথা নিশ্চিত যে, ব্যক্তি হিসাবে মানুষের সঠিক পরীক্ষা কখন হয়; আপনারা এপ্রশ্নের জবাব ভালভাবেই জানেন। অভাবের সময় মানুষের সঠিক মূল্যাঙ্কণ করা সম্ভব নয়।ক্ষমতাবান অবস্থাতেই মানুষের সঠিক মূল্যাঙ্কণ সম্ভব। আপনার কাছে সবকিছু আছে, তবুওআপনি নির্লিপ্ত, তখন বোঝা যায় যে, হ্যাঁ এনার মধ্যে কোনও একটা ব্যাপার আছে। এখনআপনারাও তেমনই ক্ষমতাবান। গোটা শাসন ব্যবস্থা আপনাদের ইশারাতেই চলে। আপনাদের একএকটি শব্দের ক্ষমতা অসীম। আপনাদের একটি স্বাক্ষর কারও জীবন বদলে দিতে পারে। এইঅবস্থায় আপনারা কী কী করেন, সেটাই আপনাদের আসল পরীক্ষা।
তেমনই, দেশের উন্নয়নে আপনাদের অবদান, আমরা এমন একটি কালখন্ডের মধ্য দিয়েএগিয়ে চলেছি, আমাদের মধ্যে অনেকেরই এখনও অভাবের মধ্যে পথ খোঁজার চরিত্র রয়ে গেছে।বৈভবের মধ্যে কিভাবে কাজ করতে হবে, আমাদের মধ্যে অধিকাংশই সেই ভারসাম্য রাখতেপারেন না। খরার সময় কিভাবে বিপর্যয় মোকাবিলা করতে হবে, সেটা আপনারা ভালই জানেন।কিন্তু কোথাও পাক তৈরি হলে তখন আপনারা কী করবেন, তা জানা নেই! ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেআসন খালি থাকলে ছাত্র ভর্তি করতে জানেন, কিন্তু আসনের তুলনায় ছাত্রের সংখ্যা বেড়েগেলে তখন কি করতে হবে সেটা জানেন না!
যেভাবে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, যেভাবে দেশের সাধারণ মানুষের মতামতের সঙ্গে তারপরিশ্রম যুক্ত হচ্ছে, তাঁরা স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখতে পাচ্ছেন, কম জলে স্নান করারঅভ্যাস থাকলে ঝরণায় স্নান করতে কোনও অসুবিধা হয় না, কিন্তু যাঁরা বেশি জলে স্নানকরতে অভ্যস্ত তাঁদের পক্ষে কম জল দিয়ে দিন কাটানো খুব মুশকিল। সেজন্য যেখানেযেখানে বৈভবের সম্ভাবনা দেখা যায়, তার জন্য আমাদের রণকৌশল বদলাতে পারি কি? আমাদেরচিন্তা প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আসতে পারে কি? তা না হলে আমরা বড় হতে পারব না। আমাদেরচিন্তায় সীমাবদ্ধতা থেকে যাবে। একমাত্র ঐ প্রতিস্পর্ধাগুলিকে স্বীকার করেই এগিয়েযাওয়ার কথা ভাবা যায়।
আমি শুরুতেই যেমন বলেছিলাম, আমরা আগে আমরাই আমরা ছিলাম। পার্শ্ববর্তী কোনওজেলার সঙ্গেও প্রতিযোগিতা ছিল না। কিন্তু এখন সময় এত বদলে গেছে যে, শুধু জেলারসঙ্গে জেলা নয়, পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলির মধ্যে, পাশাপাশি দেশগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতাচলছে। গতকালের সঙ্গে আজকের প্রতিযোগিতা চলছে। আর এ ধরণের সমস্যাগুলির মোকাবিলারমাধ্যমেই আমাদের নিজেদেরকে বিশ্ববাসীর সামনে উপরে তুলে ধরতে হবে।
সিভিল সার্ভিস-এর আরেকটি শক্তি, ধর্মও বলা যেতে পারে। যিনি যেই পদেই থাকুন,তহশিল থেকে শুরু করে জেলা কিংবা রাজ্য পর্যায়ে তিনিই যদি শেষ কথা বলার অধিকারিহ’ন, তা হলে তাঁর ওপর দায়িত্ব বর্তায় প্রতিটি প্রস্তাবকে, প্রতিটি ঘটনাকে প্রত্যেকনির্ণয়কে রাষ্ট্রহিতের দাড়িপাল্লায় মেপে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া। একটি টুকরো হিসেবেদেখলে চলবে না। দেশের এক প্রান্তে বসে একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি হয়তো জনপ্রিয় হয়েউঠব, কিন্তু দেশের অন্যপ্রান্তে এই সিদ্ধান্তের প্রভাব হয়তো খুবই নেতিবাচক হবে।সেক্ষেত্রে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে নিরত থাকতে হয়। আপনাদের প্রশিক্ষণইএভাবে হয়েছে। সবসময়ে একথাগুলি মাথায় রাখবেন। সরকার আসবে-যাবে, নেতারাও আসবেন-যাবেনকিন্তু এই ব্যবস্থা অজর ও অমর। আর এই ব্যবস্থার ধর্ম হ’ল, রাষ্ট্রহিতেরদাড়িপাল্লায় মেপে নেওয়া। ভবিষ্যতেও যে কোনও সিদ্ধান্তের কী প্রভাব পড়বে, তা ভাবতেহবে। সেজন্য আপনারা যে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন, তা যুগ পরিবর্তনের প্রকৃতিকে বুঝেনিজেদেরকে কিভাবে প্রাসঙ্গিক করে তুলবেন, সেটা আপনাদের ভাবতে হবে। যুগেরপ্রেক্ষিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়লে পরিস্থিতি কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে যাবে, আমাদেরহাত থেকে বেরিয়ে যাবে, আমাদের বরবাদ করে ছাড়বে। আর সেজন্য আমাদের প্রাতিষ্ঠানিকপ্রবৃদ্ধি, প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়াকে নিয়মিত পুনর্নবীকৃতকরার প্রয়োজন রয়েছে।
একটু আগেই মানবসম্পদ নিয়ে কথা হচ্ছিল। আমি জানি না, মানবসম্পদ বিষয়কআলোচনায় ‘ল্যুব্রিকেটিং’ প্রসঙ্গটি উঠেছিল কি না! আমরা সিভিল সার্ভিসের মানুষেরা২৫ বছর পুরনো মামলা ঝুলিয়ে রাখব কেন? ৩০ বছরের পুরনো মামলাও ঝুলে রয়েছে। নেতৃত্বেসিদ্ধান্ত গ্রহণের অভাব নেই, কিন্তু দুই বিভাগের মাঝে ফাইল ঝুলে রয়েছে, লালফিতেরফাঁসে আটকে আছে; কেন? সেই প্রসঙ্গেই যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী ‘প্রগতি’ অনুষ্ঠানেরআহ্বান জানালে এতগুলি বিষয় সূচিবদ্ধ হয়, আর সবাই তাক্ লাগিয়ে দিয়ে ২৪ ঘন্টারমধ্যে ফটাফট নির্ণয় ঘোষিত হয়, ৮-৯ লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্প চালু হয়ে যায়, কিভাবে?‘প্রগতি’র সাফল্য নিয়ে আমি জয়জয়কার করতে পারি, কিন্তু দেশের উন্নয়নে প্রযুক্তিগতনানা ঝুলে থাকা সমস্যার সমাধান করতে হচ্ছে একজন প্রধানমন্ত্রীকে। এটা আমার জন্যখুশির বিষয় নয়। আমার জন্য এটি শিক্ষার বিষয়। আমি আমার সহকর্মীদের থেকে শিখতে চাই,জানতে চাই – যে সিদ্ধান্তগুলি নিতে আপনাদের মাত্র ২৪ ঘন্টা লাগল, সেগুলি আপনারা ১৫বছর ধরে কেন ঝুলিয়ে রেখেছিলেন? রাজপথ তৈরি হবে মানুষের প্রয়োজনে, কিন্তু বন দপ্তরসেটা ঝুলিয়ে রেখেছিল। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সেই কাজ হয়ে গেল। এটাকে আমি ভালবলব না। ‘প্রগতি’র সাফল্য নিয়ে মোদীর জয়জয়কার হলে দেশের কী ভাল হবে! এই সাময়িকজয়জয়কার আমি চাই না। ব্যবস্থা যদি সুন্দরভাবে ভারসাম্য রেখে কাজ করে, প্রত্যেকবিভাগের আধিকারিকদের মধ্যে একটি ‘ল্যুব্রিকেটিং’ ব্যবস্থা হওয়া উচিৎ।‘ল্যুব্রিকেটিং’ সহযোগিতা চাই। ঘর্ষণ শক্তির অপচয় ঘটায়। ল্যুব্রিকেশন শক্তিকে অক্ষতরাখে। আমরা কী সেভাবে ভাবতে পারি? আমি এখনও বুঝে উঠতে পারিনি, একই সরকারের দুটিবিভাগ পরস্পরের বিরুদ্ধে কেন লড়াই করে। এটা কী আমাদের অল ইন্ডিয়া সিভিল সার্ভিসেরদুর্বলতা নয়। সরকার এক অথচ দুটো বিভাগের মতামত আলাদা। এটা কি পলায়নপরায়তা নয়? নাকিঅহেতুক ব্যক্তিত্বের লড়াই। আমি চাইব, সিভিল সার্ভিস দিবসে আমাদের আত্মচিন্তনেরঅবসর থাকা উচিৎ। আর সেখানে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিৎ। দেশের আদালতগুলি কতটাসময় নষ্ট হয়, সাধারণ মানুষের সময়ের মূল্য দিতে জানতে হবে। একটি বিভাগের বিরুদ্ধেঅন্য বিভাগের মামলায় যে পক্ষই জিতুক, তাতে কার কী লাভ হবে! উভয়পক্ষ আলোচনা করলেইতো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। প্রয়োজন শুধু সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে সাধারণ মানুষের হিত’কেমাথায় রেখে আলোচনা করা, তা হলে পৃথিবীর কোনও শক্তি আমাদের আটকাতে পারবে না। সাধারণমানুষের ভালোর কথা ভেবে কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে যদি কোনও বিপত্তি আসে, তা হলেঘাবড়াবেন না, আমি আপনাদের পাশে আছি।
সত্যনিষ্ঠা নিয়ে কাজ করলে কেউ আটকাতে পারবে না। আজ হিম্মত নিয়ে সিদ্ধান্তনেওয়ার সময়। গতানুগতিক চিন্তাভাবনার বাইরে গিয়ে নতুন উদ্ভাবন শক্তির পরিচয় দিয়েকাজ করুন, সিদ্ধান্ত নিন। আমার সঙ্গে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদেরকে আহ্বান জানাচ্ছি,এরকম সুযোগ হয়তো খুব কম পেয়েছেন। আজ আপনার সৃজনশীলতার পরিচয় দিন।
এখানে ‘রিফর্ম’, ‘পারফর্ম’ এবং ‘ট্রান্সফর্ম’ প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল।‘রিফর্ম’-এর জন্য রাজনীতির ইচ্ছাশক্তি নির্ভর করে। কিন্তু ‘পারফর্ম’-এর জন্য আপনারকর্তব্য শক্তি নির্ভর করে। রাজনীতির ইচ্ছাশক্তি ‘রিফর্ম’ করতে পারে, কিন্তু এইটিমের কর্তব্যশক্তি হ্রাস পেলে ‘পারফর্ম’ হবে না। আর এতে জনঅংশীদারিত্ব না থাকলে‘ট্রান্সফর্ম’ও হবে না। সুতরাং, এই তিনটি জিনিস রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি ‘রিফর্ম’ করতেপারে, কিন্তু আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা, প্রশাসনকে ‘পারফর্ম’-ই করতে হবে। তবেইজনঅংশীদারিত্বের মাধ্যমে ট্রান্সফর্ম সম্ভব। আমাদের এই তিনটিকে একই তরঙ্গেপরিচালিত করতে হবে। যখন আমরা এই তিনটিকে একই তরঙ্গে পরিচালিত করতে পারব, তখনইঈপ্সিত পরিণাম দেখতে পাব।
আমি চাইব, সিভিল সার্ভিস দিবসে আমরা যেন আত্মচিন্তনের ক্ষেত্রে কোনওকার্পণ্য না করি। যেদিন আপনারা সিভিল সার্ভিস-এর জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেদিনআপনারা বাবা-মা, পরিবারের সদস্যবৃন্দ এবং বন্ধুবান্ধব কোন্ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন– সেই মুহূর্তের কথা মনে করুন। আমার মতে, আপনার জীবনে এর থেকে বড় আনন্দেরপথপ্রদর্শক মুহূর্ত আর কোনওটাই হতে পারে না। সেই মুহূর্তের স্মৃতি আপনার জীবনেরশক্তি। যদি অন্য কিছু হয়ে থাকে, তা হলে আমি বলব আপনি বিচ্যুত হয়েছেন। আর যদি সেটিআজও বজায় থাকে, তা হলে আপনি সঠিক পথে রয়েছেন। আমার পরামর্শ নেওয়ার কোনও প্রয়োজননেই। সারা দেশে আপনার অগ্রজদের কাছ থেকে প্রেরণা গ্রহণ করে আপনি যে সিদ্ধান্তই নিননা কেন, এতে দেশের কোনও ক্ষতি হবে না। যখনই দ্বিধাগ্রস্ত হবেন, সেই মুহূর্তটির কথাভাববেন, আর ভাববেন এই সিভিল সার্ভিস দিবসের কথা।
সরকারের একটা স্বভাব থাকে – পরিসংখ্যান নির্ভরতা। পরিসংখ্যানের মাধ্যমেলক্ষ্যে পৌঁছনো। আমি জানি, আপনাদের মধ্যে একটি কৌতুক প্রচলিত আছে, হয়তো কোনও অগ্রজপ্রশাসকের কাছে শুনেছেন, একটি বাগানে দু’জন মানুষ কাজ করছিলেন। একজন গর্ত খুড়ছিলেনআরেকজন মাটি ভরছিলেন। দু’জনেই অক্লান্ত কাজ করে যাচ্ছিলেন। একজন সচেতন নাগরিকতাঁদেরকে এরকম কাজ করতে দেখে কৌতুহলবশত গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ভাই আপনারা দু’জন কীকরছেন? এঁরা বলেন, আমরা দু’জন নয়, তিনজন।
– তৃতীয়জন কে?
– তৃতীয়জন আজকে আসেননি। তাঁর কাজ ছিল গাছ লাগানো। আমি মাটি খুড়ব, সে গাছলাগাবে আর ও মাটি ভরবে। কিন্তু সে আসেননি, আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
আমাদের প্রশাসনেও এমনই অনেকে ঘন্টার হিসাবে গর্ত খোড়েন এবং মাটি ভরেন।তাঁদের কর্তব্যনিষ্ঠায় কোনও ফাঁকি নেই। কিন্তু এতে দেশের কী লাভ হয়? যে গাছলাগাবে, সেই যদি অনুপস্থিত থাকেন!
কাজকে বিচার করতে হবে ফলের নিরিখে। এবার আমাদের অর্থমন্ত্রী অত্যন্তসাহসিকতার সঙ্গে ‘আউট কাম রিলেটেড’ বাজেট পেশ করেছেন। সেজন্য তাঁকে অনেক পরিশ্রমকরতে হয়েছে। এখানে আমি ফল বলতে ‘আউটপুট’ নয়, ‘আউটকাম’ বোঝাচ্ছি। ‘আউটপুট’ শব্দটিক্যাগ-এর জন্য ঠিক আছে। কিন্তু ‘আউটকাম’ শব্দটি ক্যাগ থেকে এক পা এগিয়ে। আর দেশেরগণতন্ত্র ক্যাগ থেকে দুই পা এগিয়ে। সেজন্য আমরা ক্যাগ-কেন্দ্রীক ‘আউটপুট’ দেখলেদেশের পরিবর্তন সহজে আসবে না। ক্যাগ+ চিন্তাভাবনা নিয়ে এগোলে ‘আউটকাম’-এর কথাভাবলে আমরা দেশকে কিছু দিয়ে যেতে পারব।
দেশ স্বাধীন হওয়ার ৭০ বছর পর প্রথমবার ৩১ মার্চে বাজেটের সকল প্রক্রিয়া ১০০শতাংশ পূর্ণ করে পয়লা এপ্রিল নতুন বাজেট অনুসারে খরচ শুরু করা গেছে। এই সাফল্যআপনাদের, আপনারাই করে দেখিয়েছেন। এর মানে হ’ল এই, আজ আমার সঙ্গীরা যাঁরা সিভিলসার্ভিস এবং সেনাবাহিনীতে রয়েছেন, তাঁরা যদি কোনও সিদ্ধান্ত নেন, সেটা করে দেখানোরসাহস তাঁদের রয়েছে। আর সেটা অনুভব করি বলেই আমার আস্থা অনেকগুণ বেশি। অন্যরা যখনহতাশার কথা বলেন, আমি আপনাদের কথা ভাবি, আপনাদের কর্তব্যের কথা ভাবলে হতাশা নামককোনও অনুভূতি আমাকে স্পর্শ করতে পারে না।
গত তিন বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমার গুজরাটের অভিজ্ঞতাকে বাদ দিয়েওগত তিন বছরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমি অনুভব করেছি যে, যখনই আপনাদের সামনে কোনওভাবনা রেখেছি, তা থেকে কোনও পরিণাম পাইনি, এমন দৃষ্টান্ত নেই। সেজন্য আমি বলি,সমাজ সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি চাই। আমার মধ্যে সেই সমস্যা নেই বরং একটুবেশিই আছে। কিন্তু বাস্তবায়িত করতে হলে কর্তব্যবোধ থাকতে হবে। আর সেকাজ কে করে,আমাকে বলুন? প্রধানমন্ত্রীর ভাবনাকে কাঁরা নীতিতে পরিবর্তিত করেন? নীতিগুলিকেকাঁরা প্রকল্পে পরিণত করেন? আপনারা করেন। দায়িত্ব বন্টন কারা করেন? কাঁচামাল কাঁরাযোগাড় করেন? সিদ্ধান্ত হওয়ার পর কাজ চালু হলে তদারকি কাঁরা করেন? ত্রুটি-বিচ্যুতিকাঁরা খুঁজে বের করেন? কোথাও ভুল হলে কাঁরা সংশোধন করান? – এই সবকিছু আপনারাইকরেন। বাইরে থেকে কেউ দেখলে অবাক হয়ে যাবেন যে, এই ব্যস্ত মানুষেরা এমনকি নিজেদেরত্রুটিও খুঁজে বের করেন, নিজেদের ভুল থেকে শিক্ষা নেন এবং সংশোধনের মাধ্যমেব্যবস্থাকে ত্রুটিমুক্ত করেন। এই স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবস্থার নামই ‘অল ইন্ডিয়া সিভিলসার্ভিস’। আর সেজন্য আজকের দিনটি দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যেব্যবস্থা এভাবে প্রত্যেকবার নানা সমস্যার পরাকাষ্ঠায় পরীক্ষিত হতে হতে নিজেকেসংশোধন করতে করতে প্রত্যাশার তুলনায় দু পা পিছিয়ে পড়লেও সর্বদাই দেশের সাধারণমানুষের প্রত্যাশা পূরণের স্বার্থে কাজ করে যায়। এই টিমই কাজ করে। এই টিমের প্রতিদেশবাসীর আরও সম্মান কিভাবে অর্জন করবেন। এ বিষয়েও আপনারা আত্মচিন্তন করুন। আপনারাখারাপ মানুষ নন, খারাপ কাজ করেননি, খারাপ করার ইচ্ছাও রাখেন না। তবুও সাধারণমানুষের মনে আপনাদের প্রতি যতটা শ্রদ্ধাভাব থাকা উচিৎ ছিল, তার অভাব কেন দেখা যায়!আত্মচিন্তন করলেই যে খুব একটা পরিবর্তন করতে হবে, তা আমি মনে করি না। হয়তো সামান্যকিছু ত্রুটি সামলাতে হবে।
কাশ্মীরে বন্যা হলে, সেনাবাহিনীর জওয়ানরা যখন যে কোনও মানুষের জীবন বাঁচাতেনিজেদের জীবনের কথা না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তখন তাঁরা সেই সৈনিকদের সম্মানে হাততালিদেন, আবার সেই মানুষরাই সৈনিকদের দিকে পাথর কেন ছোঁড়েন? পাথর ছোঁড়ার সময় কি তাঁদেরএকবারও মনে হয় না যে, এই মানুষগুলিই আমাদের জন্য নিজের জীবন তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়েপড়েছিল। তবুও আপনারা কাজ করে যান। এমনই উজ্জ্বল অতীতের স্মৃতি বহন করে কাজ করেযাওয়ার মাধ্যমেই আপনাদের শক্তির প্রকাশ ঘটে।
আপনাদের প্রতি আমার নিবেদন, আগামী ২০২২ সালে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তিহচ্ছে। একথা মাথায় রেখে আমাদের গোটা দেশে স্বপ্নকে একসঙ্গে জুড়ে দেশকে পরিচালিতকরতে হবে। প্রতিটি স্বপ্নকে সংকল্পে রূপান্তরিত করতে আমাদের অনুঘটকের ভূমিকা পালনকরতে হবে। ১২৫ কোটি ভারতবাসীর মনে এই সংকল্পকে সঞ্চারিত করতে হবে। স্বাধীনতাসংগ্রামীরা যে স্বপ্ন দেখে হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে উঠেছিলেন, তাঁদের আত্মবলিদানকেমাথায় রেখে, তাঁদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার সংকল্প নিতে হবে ১২৫ কোটি ভারতবাসীকেই।
আমরা গঙ্গা সাফাই অভিযানের কথা বলি। আপনাদের মধ্যে অনেকেই গঙ্গা তীরবর্তীগ্রামগুলির প্রশাসনিক দায়িত্বে রয়েছেন। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সময়থেকেই গঙ্গা সাফাই অভিযান চলছে, তখনও আপনাদের মধ্যে অনেকেই গঙ্গা তীরবর্তীগ্রামগুলির প্রশাসনিক দায়িত্বে রয়েছেন। তা হলে আপনাদের পরিচালনাধীন গ্রামগুলি থেকেনোংরা আবর্জনা যাতে গঙ্গায় না পড়ে, সেই সংকল্প নিয়ে এগিয়ে যেতে পারেননি কেন? আপনারাযদি যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিতেন, তা হলে আজওগঙ্গা লুষনাশিনী না হয়ে কলুষবাহিনী হয়ে থাকতো না। আমাদের স্বপ্ন এবং সংকল্পকেক্ষুদ্র পর্যায় ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তিত করতে দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। নিজেকে যুক্তকরতে হবে, তবেই পরিবর্তন আসা সম্ভব। মনে রাখবেন, সারা বিশ্ব ভারতের দিকে অত্যন্তআশা নিয়ে তাকিয়ে আছে। পরিবর্তিত বিশ্বে ভারতের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলি এইদেশটিকে স্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল করে তুলেছে। সেজন্য গতকাল পর্যন্ত আমরা কাজ চালানোরজন্য যা করে গেছি, তা করেছি। কিন্তু ২০২২ সালে দেশকে উন্নয়নের শিখরে পৌঁছে দেওয়ারস্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যেতে হলে, বিশ্বে ভারতকে একটি শক্তিশালী দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিতকরতে হলে আমার সামনে বসে থাকা এই নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ মানুষদেরই শুধু কর্তব্যপরায়ণহলে হবে না, শাসন ব্যবস্থায় কর্তব্যের পাশাপাশি লক্ষ্যও স্থির থাকতে হবে।প্রত্যেককে একই তরঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। তবেই আমরা নিশ্চিত পরিণাম পেতে পারি।
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের জীবন ও কর্ম আমাদের সকলের কাছে প্রেরণাস্বরূপ।এই ব্যবস্থাকে ভারতীয় প্রেক্ষিতে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের স্বপ্নের অনুকূল করেগড়ে তুলতে প্রত্যেকেই নিরলস কাজ করে গেছেন। এখন আমাদের কাঁধে দায়িত্ব বর্তেছেপরিবর্তিত যুগে, নানা সমস্যা ও প্রতিযোগিতার কালখণ্ডে আমরা নিজেদের কিভাবে প্রয়োগকরবো, সাধারণ মানুষের স্বপ্নকে বাস্তবায়নের চেষ্টা কিভাবে করবো।
আমি আরেকবার এই সিভিল সার্ভিস দিবসে দেশের প্রত্যেক প্রান্তে এবং বিশ্বেরনানা প্রান্তে কর্মরত আমার প্রশাসক সহকর্মীদের হৃদয় থেকে অনেক অনেক শুভেচ্ছাজানাই। দেশকে এতদূর পৌঁছে দিতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আপনাদের অবদানঅনস্বীকার্য। আমি আজ এই উপলক্ষে আপনাদের সকলের ঋণ স্বীকার করছি। পূর্বজ প্রশাসকদেরধন্যবাদ জানাই। আপনাদের সবাইকে শুভেচ্ছা জানাই।
অনেক অনেক ধন্যবাদ।