পৃথিবীর নানাপ্রান্ত থেকে বিপুল সংখ্যায় আগত আমার প্রিয় ভাই ও বোনেরা,
ইতিহাসবিস্মৃত হলে তার চরম মূল্য দিতে হয়, অনেক কিছু হারাতে হয়। একথার মর্ম বুঝতে হলেআমাদের শ্রদ্ধেয় শ্রীমদ্ রাজচন্দ্র মহোদয়ের জীবন ও ব্যক্তিত্ব থেকে শিক্ষা নিতেহবে। তাঁকে বিস্মৃত হয়ে আমরা কতকিছু হারিয়েছি। আজ এক অদ্ভুত মুহূর্তে আমরা এখানেমিলিত হয়েছি, যখন স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী যাঁকে ‘কবিশ্রী’ আখ্যায় ভূষিত করেছেন, সেইশ্রীমদ্ রাজচন্দ্র মহোদয়ের সার্ধশত জন্ম বার্ষিকী আর তাঁর কর্মক্ষেত্র সবরমতীআশ্রম, যে প্রতিষ্ঠান কয়েক শতাব্দীর দাসত্ব থেকে মুক্তির জন্য মানুষের মনে চেতনাজাগিয়ে তোলার পবিত্র কর্তব্য পালন করেছে, তার শতবর্ষ উদযাপন হচ্ছে।
২০১৭ সালঅনেক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শতবর্ষ পূর্বে এমন দিনেই চম্পারণের মাটি থেকে দেশেপ্রথম সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ১৯১৫ সালে পূজনীয় বাপুজী দক্ষিণ আফ্রিকাথেকে ভারতে ফিরেছিলেন। ২০১৫ সাল ছিল তাঁর প্রত্যাবর্তনের শতবর্ষ। ভারত সরকার এইগুজরাটের গান্ধীনগরে মহাত্মা মন্দির স্থাপন করে সেখানে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকেপ্রবাসী ভারতীয়দের আমন্ত্রণ জানিয়ে ঐ শতবর্ষ উদযাপনকে মাত্রান্বিত করেছিল।
আজকের এইঅনুষ্ঠানের সঙ্গে দেশের নানা প্রান্তের গান্ধীবাদী মানুষেরা যুক্ত রয়েছেন। তাঁদেরকাছে শ্রীমদ্ রাজচন্দ্রজী পরিচিত। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাঁর পরিচয়বিস্মৃত। এটা আমাদের দোষ যে আমরা আমাদের মনীষীদের সম্পর্কে পরবর্তী প্রজন্মকেঅবহিত করি না। নিজেরা ভুল পথে পরিচালিত হয়ে তাঁদেরকেও বিস্মৃত হই। বর্তমান সরকারচায় – দলমত, ধর্ম ও পন্থা নির্বিশেষে এদেশের সকল মহান পুরুষ, মহান পরম্পরা ও মহানইতিহাস নিয়ে নিয়মিত চর্চা হোক। আমরা যেন সবসময় শেকড়ের সঙ্গে জুড়ে থাকি। আর তা থেকেপ্রেরণা ও শক্তি সংগ্রহ করে নতুন ইতিহাস রচনার পরাক্রম অর্জন করি। এই উদ্দেশ্যনিয়েই আমরা এগিয়ে যেতে চাই।
সবরমতীআশ্রমে শতাব্দী সমারোহ নিয়ে ভাবলে আমার মনে হয় যে, মহাত্মা গান্ধীকে বিশ্ববাসীরসঙ্গে যেভাবে পরিচিত করার প্রয়োজন ছিল, তা আমরা যথাসময়ে করে উঠতে পারিনি। তা হলে,আগুনের সমুদ্র লঙ্ঘন করে এগিয়ে যাওয়া মানবসভ্যতা গান্ধীজির কাছ থেকে প্রাণশক্তি ওত্রাণ পেতে পারত। এখনও সময় আছে, আমার ইচ্ছে আছে, জানি না সকল ইচ্ছা পূরণ হবে কিনা! তবু ইচ্ছে থাকা তো আর মন্দ ব্যাপার নয়। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর বিশ্বশান্তির কথা মাথায় রেখে যেমন রাষ্ট্রসঙ্ঘের গঠন হয়েছিল, তেমনই আমার ইচ্ছে, আমরাযদি সারা পৃথিবীতে শান্তি ও মৈত্রীর প্রতীক হিসাবে মহাত্মা গান্ধীর জীবন ওব্যক্তিত্বকে তুলে ধরতে পারি! রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব যিনিই নির্বাচিত হন না কেন,শপথ গ্রহণের পরই তিনি যেন সবরমতী আশ্রমে এসে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে মহাত্মা গান্ধীরজীবন থেকে প্রেরণা নিয়ে যেতে পারেন – সেই ব্যবস্থা চালু করা। আমার মন বলে, আজ নয়তোকাল, একদিন আমার এই ইচ্ছা বাস্তবায়িত হবেই। বিশ্বকে এই বিশালতার সঙ্গে যুক্ত করারপ্রচেষ্টা আমাদের প্রতিনিয়ত করে যেতে হবে।
শ্রীমদ্রাজচন্দ্রজি কেমন মানুষ ছিলেন? গুরুদেব রাকেশজি যেমন বলছিলেন, যে মহাত্মা গান্ধীরসঙ্গে দেখা করতে বিশ্বের বড় বড় মানুষেরা আসতেন, দেশ-বিদেশের অনেক ডাকসাইটেব্যক্তিত্বের সঙ্গে এই আশ্রমে মহাত্মা গান্ধী ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে আলাপ-আলোচনাকরতেন। লম্বা-চওড়া, ছয়-সাড়ে ছয় ফুটের সুন্দর, সুদর্শন শ্বেতাঙ্গরা আসতেন, কিন্তুতারা কেউই মহাত্মা গান্ধীকে প্রভাবিত করতে পারেননি। কিন্তু শ্রীমদ্ রাজচন্দ্রজিরমতো রোগা-পাতলা এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর ব্যক্তিত্বে এমন কি ছিল, কেমন বিশালতা,গভীরতা ও শক্তি ছিল যে গান্ধীজি তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন?
শ্রীমদ্রাজচন্দ্রজির জন্মস্থান বোয়ানিয়া যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তাঁর পরিবারের মানুষরাজচন্দ্রজির পৈত্রিক বাড়িটি সুন্দরভাবে গুছিয়ে রেখেছেন বলে আমি তাঁদের কাছেকৃতজ্ঞ। সেখান থেকে ফিরে আমি শিক্ষকদের বলেছিলাম যে, আপনারা যখনই সৌরাষ্ট্র বেড়াতেযাবেন, কিছুটা সময় বের করে অবশ্যই বোয়ানিয়া ঘুরে আসবেন। আমরা যখন মন্দিরে যাই, তখনএকটি অন্য ধরণের কম্পন টের পাই, একটি ভিন্ন ধরণের অনুভূতি হয়। আমি যা অনুভব করেছি,আমি নিশ্চিত যে আপনারাও তা অনুভব করবেন। শ্রীমদ্ রাজচন্দ্রজির স্মৃতিতে বোয়ানিয়াতেযা তৈরি হয়েছে, তা মন্দির নয়। কিন্তু সেখানে গিয়ে একটি জায়গায় দাড়ালেই আপনারঅধ্যাত্মিক চেতনার কম্পন অনুভূত হবে।
আমাদের দেশেঅনেক বিষয় নিয়েই পিএইচডি হয়। অনেক মহাপুরুষের কবিতা, গদ্য ও পদ্য নিয়ে গবেষণা হয়।আমি চাইব শ্রীমদ্ রাজচন্দ্রজির সার্ধ শত জন্মবর্ষে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেবিশেষ করে গুজরাটের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কেউ কেউ শ্রীমদ্ রাজচন্দ্রজির রচনা ওবক্তৃতামালা নিয়ে গবেষণা করুন। তাহলেই বোঝা যাবে গান্ধীজির জীবন ও তাঁর কাজেশ্রীমদ্ রাজচন্দ্রজির অসংখ্য চিঠিপত্রের প্রভাব কতটা ছিল। লক্ষ্য করবেন,গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর বয়সের খুব একটা পার্থক্য ছিল না। শ্রীমদ্ রাজচন্দ্রজি জৈনপরম্পরায় লালিত-পালিত। আর মহাত্মা গান্ধী ছিলেন একজন নামী ব্যারিস্টার। দক্ষিণআফ্রিকায় সফল আন্দোলন করে ফিরেছেন। ভারতের বড় বড় নেতারা তাঁর সঙ্গে দেখা করতেআসতেন। এতদ্ সত্ত্বেও নিজের প্রায় সমবয়সী একজন সাধারণ জীবনধারণ করা মানুষের কাছেচিঠি লিখে অন্তরের সকল জিজ্ঞাসার সমাধান চাইতেন। আর শ্রীমদ্ রাজচন্দ্রজিনিঃসঙ্কোচে তাঁর অধ্যাত্মিক জীবন চেতনা ও প্রজ্ঞার সম্পুট ঋদ্ধ উত্তর লিখতেন । পূজ্য বাপু আর শ্রীমদ্ রাজচন্দ্রজির পত্রালাপ নিয়ে গবেষণা করলে সেইকালখন্ড সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানতে পারব। এত বড় দেশেস্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানকারী মহাত্মা গান্ধীর নানা মানসিক টানাপোড়েন,আনন্দ ও দুঃখ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানা যাবে। কখনও হতাশ হলে তিনি কিভাবে নিজেকেসামলাবেন, তা নিয়ে শ্রীমদ্ রাজচন্দ্রজির কাছে পরামর্শ চাইতেন।
আমাদের নতুনপ্রজন্ম কিছুই জানে না। আর সেজন্য এবছর যখন আমরা সবরমতী আশ্রমের শতাব্দী পালনকরছি, সারা দেশ থেকে যে ছাত্রছাত্রীরা স্টুডেন্ট গ্রান্ট নিয়ে গুজরাট ঘুরতে আসে,তাদের শিক্ষকদের বলব, সব জায়গায় ঘোরাতে নিয়ে যান কিন্তু আপনারা অবশ্যই লক্ষ্যরাখবেন যাতে ঐ ছেলেমেয়েরা কিছুক্ষণ সময় সবরমতী আশ্রমে কাটাতে পারে। তাদেরবোয়ানিয়ায় নিয়ে গিয়ে দেখান, আমাদের দেশের মহাপুরুষরা কত অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন।এটা কোনও মুনি-ঋষিদের যুগের কথা বলছি না। আমি গুরুদেব রাকেশজিকে যত অভিনন্দনইজানাই না কেন, তা যতেষ্ট নয়। তিনি জ্ঞানমার্গী ও কর্মমার্গী। শ্রদ্ধেয়লালচন্দ্রজির প্রেরণায় ঋদ্ধ রাকেশজির জীবন দর্শন। এই দর্শনকে বাস্তব রূপ দিতে তিনিনানা পাহাড়ে-অরণ্যে বসবাসকারী মানুষদের সেবায় নিয়োজিত। আর আমি দেখেছি, তিনি যখনটিভির অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন তখন বিশ্বের নানাপ্রান্তের মানুষ তাঁর বক্তব্যশোনেন। গত পরশু আমি নেদারল্যান্ড থেকে ফিরেছি। সেখানে আমি দুটো নতুন জিনিস জানতেপেরেছি। ভারতে যত রাস্তার নাম মহাত্মা গান্ধীর নামে দেওয়ার হয়েছে, তারপর বিশ্বেরকোনও দেশে সর্বাধিক রাস্তার নাম গান্ধীজির নামে দেওয়া হয়েছে নেদারল্যান্ডে।দ্বিতীয় তথ্য হ’ল – সুরিনামের মানুষেরা বৃহৎ সংখ্যায় সেখানে বসবাস করছেন, তাঁরাসবাই ডাচ নাগরিক। আর রয়েছে, ভারতে নতুন প্রজন্মের এক বৃহৎ সংখ্যক আইটি পেশার সঙ্গেযুক্ত মানুষেরা। কিন্তু নিদেনপক্ষে এক ডজন মানুষ আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন যে, পরশুআপনার সঙ্গে রাকেশজির দেখা হবে। আমাদের দয়া করে রাকেশজির সঙ্গে তোলা আপনার ছবিপাঠাবেন। এটা সহজ কথা নয়। এই জিজ্ঞাসার মধ্যে অনেক বড় সামর্থ্য রয়েছে। আমরা যখনপূজ্য বাপুর কথা স্মরণ করি, সরবমতী আশ্রমেরও স্মরণ করি। কারণ, বাপু এখানে ১২ বছরসাধনা করেছেন। তাঁর সংকল্প শক্তি দেখুন। তিনি বলেছিলেন, আমার অপমৃত্যু হলেওস্বাধীনতা লাভ না করে ফিরব না। ১২ বছর ধরে তিনি যে আশ্রমে তপস্যা করেছেন, সেইতপস্যার এত সামর্থ্য যে তিনি সাফল্য না পেলে সেই আশ্রমে না ফেরার সংকল্প নিয়েবেড়িয়ে পড়তে পারেন। ভাবা যায়, তাঁর আত্মবিশ্বাস কত পোক্ত ছিল যে, তিনি সশরীরেব্রিটিশের কাছ থেকে ভারতের স্বাধীনতা অর্জন করেই ফেরার কথা ভেবেছিলেন।
আগামী ২০১৯সালে আমরা পূজ্য বাপুর সার্ধশত জন্মবর্ষ পালন করব। এটা কোনও সাধারণ ব্যাপার নয়।মহাত্মা গান্ধীর সার্ধশত জন্মবার্ষিকী পালনের অর্থ হ’ল, তাঁর মতো কোনও সংকল্প নিয়েপ্রত্যেক ভারতবাসীকে তা ২০১৯ সালের মধ্যে বাস্তবায়িত করতে হবে। স্বাধীনতাআন্দোলনের আত্মা ও শরীর যেখানে গড়ে উঠেছে, সেই সবরমতী আশ্রমের শতবর্ষ উদযাপনেরপূর্ণ লগ্নে পূজ্য বাপুর স্বপ্নের ভারত গড়ে তোলার জন্য আমাদেরকেও কিছু দায়িত্বপালন করতে হবে।
সবরমতী আশ্রমযেসব ইতিহাসের সাক্ষী তার সঙ্গে নৈমিত্তিক পরিচ্ছন্নতার একটা নিবিড় সম্পর্ক ছিল।এখানে পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে কোনও রকম সমঝোতা করা হ’ত না। সবরমতী আশ্রম থেকে প্রেরণানিয়ে ২০১৯ সালের মধ ্যে এই পরিচ্ছন্নতাই সকল ভারতীয়দের স্বভাব হয়ে ওঠা উচিৎ। আমাদের শিরা ও ধমনীতে, অস্তিত্ব ও ভাবনায়,আচার-আচরণে পরিচ্ছন্তা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেলে তবেই আমরা পূজ্য বাপুজিকেসর্বশ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে পারব। বাপুজি বলতেন, স্বাধীনতা ও পরিচ্ছন্নতারমধ্যে আমার প্রথম পছন্দ পরিচ্ছন্নতা। তার মানে তিনি স্বাধীনতা থেকেও অপরিচ্ছন্নতাথেকে মুক্তিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন।
পূজ্য বাপুর প্রিয় গান ছিল ‘বৈষ্ণব জনকো তেনেরে কহিয়ে ……’ একটু আগেই আমরা গানটি শুনছিলাম। এদেশের সকল প্রান্তেসমস্ত বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা এই গানটি জানে। দেশের প্রত্যেক নাগরিক জানে যে,গানটি গান্ধীজির অত্যন্ত প্রিয় ছিল। এই গানের এতটাই শক্তি যে, ১০০ জনের মধ্যে ৯০জন বলবেন, ‘বৈষ্ণব জন কো তেনেরে কহিয়ে ……’। আর তাঁদেরকে যদি জিজ্ঞেস করেন, এটিকোন্ ভাষায় লেখা, আমি বাজি ধরে বলতে পারি ১০ শতাংশ মানুষও সঠিক জবাব দিতে পারবেননা। কারণ, এই গানের উষ্ণতা আমাদের অন্তরে সঞ্চারিত হয়েছে। ভাষার বিভেদ ভুলেপ্রত্যেকেই গানটিকে ভালোবাসেন।
আমি অনেক দেরীতে রাজনীতিতে এসেছি। এখনরাকেশ ভাই যে অঞ্চলে কাজ করছেন, সেই ধরমপুর অঞ্চলে একটা সময় কাজ করার সৌভাগ্য আমারহয়েছে। যৌবনের দীর্ঘ সময় আদিবাসী জনজাতির মাঝে গিয়ে সামাজিক সেবা করার সৌভাগ্যআমার হয়েছে। যখন রাজনীতিতে এসেছি, তখনও বিশ্বাস হয়নি যে আমি রাজনীতিজ্ঞ হয়ে পড়ব।আজীবন সংগঠনে সমর্পিত ছিলাম। তখন ভারতীয় জনতা পার্টির কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণেরসময় আমি তাঁদের বলতাম যে, আজ থেকে ৪০০ বছর আগে কবি নরসিংহ মেহতা ‘বৈষ্ণব জন কোতেনেরে কহিয়ে ……’ গানটি লিখেছিলেন। আজ যতজন রাজনৈতিক নেতা রয়েছেন, সকলেই গেয়েওঠেন ‘বৈষ্ণব জন কো তেনেরে কহিয়ে, জে পীড় পরায়ি জাণে রে ……’। আপনারা দেখুন, ভারতেরজনপ্রতিনিধিদের কেমন হওয়া উচিত, জনসেবক ও জননায়কদের কেমন হওয়া উচিত, ‘বৈষ্ণব জন কোতেনেরে কহিয়ে ……’ পঙক্তিটির মধ্যে একবার নিজেকে বসিয়ে দেখুন, দেখবেন আপনাদেরআর কারও পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না। কোথায় যেতে হবে সেই পথ নিজেই খুঁজেপাবেন, কোনও সমস্যা থাকবে না। প্রত্যেকটি শব্দকে জুড়ে দেখবেন, সময়ের অভাবে আমিবিস্তারিত ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না, কিন্তু ওই পঙক্তিতে সামর্থ্য রয়েছে।
ভাই ও বোনেরা, প্রয়োজন পড়লে পূজনীয়বাপুজির নাম উচ্চারণ করার কৌশল আমরা দীর্ঘকাল ধরেই দেখে আসছি। আর কখন বাপুকেবিস্মৃত হতে হবে, সেই চাতুর্যও আমরা ভালভাবে দেখেছি। আজ সবরমতী আশ্রমে এসে শ্রীমদ্রাজচন্দ্রজির তপস্যা, তাঁর ধ্যান, তাঁর দর্শনঋদ্ধ একেকটি বাক্য যখন আমরা স্মরণকরছি, সবরমতী আশ্রমে শতাব্দী সমারোহের পুণ্য লগ্নে আজ আমি দেশবাসীকে একটি কথাগুরুত্ব দিয়ে বলতে চাইছি যে, দেশের বর্তমান পরিবেশ ও কিছু ঘটনা আমার জন্য অত্যন্তপীড়াদায়ক ও সেগুলির প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করতে চাই। যেদেশ একটি পিঁপড়েকেও আহারদিয়ে বাঁচিয়ে রাখার দর্শনে বিশ্বাস করে, যে দেশ অলিগলিতে ঘুরে বেড়ানো কুকুরদেরকেওকিছু না কিছু খাবার দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে, সকালে উঠে যে দেশের মানুষ পুকুর ও নদীতেগিয়ে মাছকে খাবার খাওয়ায়, যে দেশের সংস্কার এরকম, যে দেশে জন্ম নিয়ে মহাত্মাগান্ধীর মতো মহাপুরুষ অহিংসার বাণী সারা বিশ্বকে দিয়ে যান, সেদেশের হাসপাতালেরোগীদের আমরা কেন বাঁচাতে পারছি না? অপারেশন কেন বিফল হচ্ছে? জাল ওষুধে রোগীরমৃত্যু কেন হবে? আর ফলস্বরূপ রোগীর পরিবারের মানুষ হাসপাতালে আগুন লাগিয়ে দেবেন,ডাক্তারদের মারবেন – এটা কি আমার দেশ! এটা কি পূজ্য বাপুর দেশ! হঠাৎ হঠাৎ এরকমকান্ড ঘটে। দুটো গাড়িতে ধাক্কা লাগল, দুর্ভাগ্যবশত কারও মৃত্যু হ’ল, কেউ আহত হলেনআর অজানা-অচেনা লোকেরা একত্রিত হয়ে গাড়িটিকেই জ্বালিয়ে দিল – এটা কি আমার দেশ?
গোরক্ষা, গরুর প্রতি ভক্তি; মহাত্মাগান্ধী আর বিনোবা ভাবের থেকে বড় ভক্ত কেউ হতে পারেন না। গোরক্ষার ক্ষেত্রে এই দুইমনীষী আমাদের সর্বোত্তম উপায় দেখিয়ে গেছেন। তাঁদের প্রদর্শিত পথে চললেই এদেশেরমঙ্গল হবে। একবার বিনোবাজির সঙ্গে দেখা করতে ওয়ার্ধা গিয়েছিলাম। তাঁকে প্রণামকরতেই তিনি আমাকে বসতে বললেন। তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের পর আমি সামনের দিকে তাকিয়েছিলাম। হঠাৎ বিনোবাজি বলে ওঠেন ‘মরে যা, মরে যা’। আমি অবাক হলাম। তবু চুপ করেব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলাম। তিনি আবার বললেন, ‘মরে যা, মরে যা’, গরুর জন্য,গোমাতার জন্য। ভিনোবাজি তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত লড়াই করেগেছেন। তার অটল গোভক্তি সম্বল করে তিনি গোরক্ষার জন্য অনেকবার অনশন করেছেন। ভারতেরসংবিধানও আমাদের গোরক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত করে, কিন্তু কোনও মানুষকে মেরেকি আমরা গোরক্ষা করতে পারব? এ কেমন গোভক্তি, এ কেমন গোরক্ষা। পূজ্য বাপু তো এরকমপথ দেখিয়ে যাননি। বিনোবা ভাবে তো এমন বার্তা দিয়ে যাননি। তাঁরা আমাদের অহিংসারবাণী শিখিয়ে গেছেন। অহিংসাই ভারতের জীবনধর্ম। আমরা কিভাবে বুদ্ধিভ্রষ্ট হচ্ছি।ডাক্তারদের মেরে ফেলছি, দুর্ঘটনাগ্রস্ত গাড়ির চালকদের মেরে দিচ্ছি, গোরক্ষার নামকরে মানুষকে মেরে ফেলছি।
আমার ছোটবেলার একটা কথা মনে পড়ে। এটাআমার জীবনের একটা সত্য ঘটনা। সম্ভবত আজ প্রথমবার সেই ঘটনার কথা বলছি। একটা সময়আমার লেখার অভ্যাস ছিল। তখন ভাবতাম কোনও দিন সেই বিষয়ে লিখব। কিন্তু লিখে উঠতেপারিনি। আজ এই পবিত্র আশ্রমে দাঁড়িয়ে আমার মনের অন্তরতম প্রদেশ থেকে একটি সত্যকেআপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই।
আমি তখন বালক ছিলাম। আমার গ্রামে একটিসরু গলিতে আমার বাড়ি ছিল। তখনকার দিনে গ্রামের বাড়িগুলি পরস্পরের লাগোয়া হ’ত।আমাদের বাড়ির সামনেই একটি রাজমিস্ত্রী পরিবার ছিল। সে পরিবারে কোনও সন্তানাদি ছিলনা। ঐ প্রৌঢ় দম্পতির বিয়ের অনেক বছর পরও সন্তান না থাকায় বাড়িতে অশান্তির পরিবেশছিল। কিন্তু তাঁরা দু’জনেই ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক প্রবৃত্তির মানুষ। বেশি বয়সেতাঁদের একটি ছেলে হয়। আমাদের সেই সরু গলিতে সকালবেলা গরুদেরকেও একটিনিয়মানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে চলতে হ’ত। গরুর দল যে বাড়ির সামনে দিয়ে যেত, সে বাড়িরমানুষ গরুগুলিকে রুটি খাওয়াতেন। যাঁদের বাড়িতে কোনও সন্তান নেই, তাঁরা রুটিখাওয়াতে পারতো না। একবার কোনও উৎসবে কোনও ছেলেমেয়েরা বাজি ফাটালে একটি গরু ভয় পেয়েলেজ তুলে ছুটতে থাকে, যে রাখাল ঐ গরুটিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁর বয়স তিন-পাঁচ বছরহবে। সে বুঝতে পারছিল না, গরুটিকে সামলাতে কোন্ দিকে যাবে আর অজান্তেই সে গরুটিরপায়ের তলায় চলে এল। সেই রাখাল বাচ্চাটি ছিল ঐ প্রৌঢ় রাজমিস্ত্রী দম্পতির সেইছেলেটি। দুর্ভাগ্যবশত গরুর খুড়ে চাপা পড়ে বাচ্চাটি মারা যায়। আপনারা কল্পনা করতেপারেন, সেই পরিবারের কি দশা হয়েছিল! গলির সকল পরিবারের মানুষ হাহাকারে উদ্বেল হয়েউঠেছিল। সেই দৃশ্য আমি ভুলতে পারি না। পরদিনই সকালবেলা ঐ গরুটি তাঁদের ঘরের সামনেএসে দাঁড়িয়ে পড়ে। সে আর কারও বাড়িতে গিয়ে রুটি খেতে চায় না। প্রত্যেক বাড়ির মানুষইচেষ্টা করে দেখেছেন, কিন্তু গরুটি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নীরবে কাঁদতে থাকে। এক-দুদিনকরে পাঁচ দিন পেরিয়ে গেল, ঐ গরুটি খাবার তো দূরের কথা জলও খাচ্ছিল না। ঐ পরিবারেরএকদিকে একমাত্র সন্তানের মৃত্যু শোক, অন্যদিকে গরুটির ওই অবস্থা, তাঁরাও গরুটাকেখাওয়ানোর অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন, ফলে গরুটা শরীর ছেড়ে দিল এবং মারা গেল।একটি শিশুর মৃত্যুশোকে একটি গরুর প্রায়শ্চিত্য এবং আত্মবলিদানের এই ঘটনা আমি ছোটবেলায়দেখেছি। এই দৃশ্য আমার সামনে এখনও জীবন্ত। আজ যখন শুনি, গোরক্ষার অছিলায় কাউকেহত্যা করা হয়, কেউ দোষী কি নির্দোষ, তা বিচার করার জন্য দেশে আইন ও বিচার ব্যবস্থারয়েছে। আইনকে আইনের পথে চলতে দিন। সাধারণ মানুষের কোনও অধিকার নেই, আইন নিজের হাতেনেওয়ার।
সবরমতী আশ্রমের শতাব্দী সমারোহেগান্ধীজি এবং বিনোবা ভাবের মতো গোরক্ষায় সমর্পিত মহাপুরুষের দৃষ্টান্ত আমাদেরসামনে রেখে আমি দেশবাসীকে বলতে চাইব যে, হিংসা কোনও সমস্যার সমাধান নয়। যে চিকিৎসকমানুষের সেবায় অক্লান্ত পরিশ্রম করেন, কোনও কারণে তিনি আপনার পরিবারের মানুষটিকেবাঁচাতে পারেননি বলে, তাঁকে গণপিটুনি দেওয়ার কোনও অধিকার আপনার নেই। কোনও অবাঞ্ছিতদুর্ঘটনায় কারও মৃত্যু হলে গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া কিংবা চালককে গণপিটুনি দেওয়ারঅধিকারও কারও নেই। আপনারা অভিযোগ জানান, দেশের আইন অপরাধীর বিচার করবে। জাতিরপিতার অহিংসার বাণী আমাদের জীবনে ভারসাম্য রাখতে সাহায্য করে। অন্যের দায়িত্বেরসঙ্গে নিজের দায়িত্বকে যুক্ত করুন। তবেই আমরা জাতির জনকের স্বপ্নের দেশ নির্মাণকরতে পারব। ২০২২ সালে ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি হচ্ছে। যে স্বাধীনতাসংগ্রামীদের আত্মবলিদান, নির্বাসন, সম্পূর্ণ যৌবন কারন্তরালে কাটান এবং ফাঁসিকাঠেঝোলানোর ফলস্বরূপ এদেশ স্বাধীন হয়েছে, তাঁরা যে সমৃদ্ধ ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশেরস্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্নকে কি আমরা ২০২২ সালের মধ্যে বাস্তবরূপ দিতে পারব?২০২২ সাল আসতে এখনও পাঁচ বছর বাকি। ১২৫ কোটি দেশবাসী যদি সংকল্প গ্রহণ করেন যে, স্বাধীনতাসংগ্রামীরা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা আমরা ২০২২ সালের মধ্যেই বাস্তবায়িত করব, তাহলে সেটা সম্ভব। যে সবরমতী আশ্রম থেকে ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্নকে আসমুদ্র হিমাচলআপামর ভারতবাসীর মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই সবরমতী আশ্রমের শতবর্ষে আসুন আমরামিলিতভাবে সংকল্প গ্রহণ করি। ১২৫ কোটি ভারতবাসী যদি এক পা এগিয়ে যায়, তা হলে ভারত১২৫ কোটি পা এগিয়ে যাবে। এই স্বপ্ন নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
শ্রীমদ্ রাজচন্দ্রজি আমাদের অপ্রতিমআধ্যাত্মিক চেতনা, কর্মমার্গ, জ্ঞানমার্গ ও অন্তর্চেতনাকে জাগ্রত করার পথদেখিয়েছেন। পূজ্য বাপুও তাঁর দর্শনকে সফল প্রয়োগের মাধ্যমে তাঁর প্রদর্শিত পথেসাফল্য পেয়েছেন। এই দুই মহাপুরুষ একসঙ্গে স্মরণ করে আমি আরেকবার এখানে জমায়েতবিপুল সংখ্যক মানুষকে অভিনন্দন জানাই। আজ আপনাদের মাঝে আসার সুযোগ হয়েছে। রাকেশজিরসঙ্গে সাক্ষাৎ-এর সুযোগ হয়েছে, এটা আমার পরম সৌভাগ্য।
অনেক অনেক ধন্যবাদ।