আপনাদের সবাইকে ভগবান বাসবেশ্বরের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে অনেক অনেক শুভেচ্ছা।বাসব সমিতিও তার ৫০ বছর পূর্তি উদযাপনের মাধ্যমে ভগবান বাসবেশ্বরের বাণীগুলিপ্রচারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আমি তাঁদের হৃদয় থেকে অভিনন্দনজানাই।
আমি আমাদের ভূতপূর্ব উপ-রাষ্ট্রপতি স্বর্গীয় জাত্তি সাহেবকেও এই সময় সাদরেস্মরণ করতে চাই। তিনি এই পবিত্র কাজের সূত্রপাত করেছিলেন, এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তিনিইএর প্রধান সম্পাদক ছিলেন। আমি স্বর্গীয় কুলবার্গী মহোদয়কেও প্রণাম জানাই। তিনি এইকাজে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। আজ তিনি যেখানেই থাকুন না কেন নিজের প্রাণাধিকপ্রিয় সংস্থাকে পূর্ণতা পেতে দেখে নিশ্চয়ই খুশি হচ্ছেন। আমরা সবাই রাজনীতির পাঁকেনিমজ্জমান, গদীর লোভে গদীর আশপাশেই আমাদের পৃথিবী চলে। আর আমি দেখেছি, যখনই কোনওরাজনৈতিক নেতার মৃত্যু হয় তখন তাঁর কোনও উত্তরসূরী গম্ভীর চেহারায় বলেন, আমি বাবারঅসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করব! এখন আপনারাও জানেন, আমিও জানি, রাজনৈতিক নেতার ছেলেকোন্ অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করবেন! সেই নেতার দলের লোকেরাও জানেন, এইপ্রতিশ্রুতির মানে কী! কিন্তু আমি অরবিন্দজি-কে শুভেচ্ছা জানাই, সত্যি সত্যিই তিনিপিতার অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করে দেখিয়েছেন। দেশের উপরাষ্ট্রপতির পদ অলঙ্কৃত করেযিনি দেশের গৌরববৃদ্ধি করেছেন, দেশে তাঁকে মনে রেখেছে। তাঁর ছেলে পিতার অসম্পূর্ণকাজ শেষ করেছেন ভগবান বাসবরাজের বাণী দেশের কোনায় কোনায় পাঠিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরকাছে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে। জাত্তি সাহেব নিজেও আমাদের সামনে অনেক মূল্যবোধের আদর্শরেখে গেছেন। কিন্তু ভাই অরবিন্দ কোনও আদর্শ রাজনৈতিক পরিবারের উত্তরসূরী হিসেবেউচ্চ আদর্শের প্রচারে জীবন উৎসর্গ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সেজন্য আমি তাঁকেঅভিনন্দন জানাই।
সমিতির ৫০ বছর পূর্তির পেছনে হয়তো দুই বা ততোধিক প্রজন্মের অনেক মানুষেরপরিশ্রম রয়েছে। এই ৫০ বছরে যাঁরাই এই কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁদের কৃতজ্ঞতাজানাতে চাই।
আমার প্রিয় ভাই ও বোনেরা, ভারতের ইতিহাস কেবল পরাজয়ের ইতিহাস নয়, দাসত্বেরইতিহাস নয়, কেবলই জুলুম আর অত্যাচার সহ্য করার ইতিহাস নয়। কেবলই দারিদ্র্য,ক্ষুধা, অশিক্ষা আর সাপ ও বেজির লড়াইয়ের ইতিহাসও নয়। সময়ের সঙ্গে নানা কালখন্ডেদেশ কিছু সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। কিছু সমস্যা এখানেই শেকড় গেড়ে বসেছে। কিন্তু এসবসমস্যা, এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি, এই কুসংস্কারগুলি আমাদের পরিচিত নয়। আমাদের পরিচয়হ’ল এই সমস্যাগুলির সম্মুখীন হওয়ার পদ্ধতিসমূহ, আমাদের কৌশল, যা গোটা বিশ্বকে,মানবতাকে গণতন্ত্র, সুশাসন, অহিংসা ও সত্যাগ্রহের বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। যুগে যুগেআমাদের দেশে এমন মহাপুরুষেরা আবির্ভূত হয়েছেন, যাঁরা গোটা মানবজাতিকে, নিজেদেরজীবন দর্শনের মাধ্যমে পথ দেখিয়েছেন। যখন বিশ্বের বড় বড় দেশ, পাশ্চাত্যের বিদ্বানরাসকলের সমানাধিকারকে এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে শুরু করেন, তার থেকেও কয়েক শতাব্দীআগে; সমস্ত ভারতবাসী গর্বের সঙ্গে বলতে পারেন, তার থেকে কয়েক শতাব্দী আগে ভারত এইবিচারধারাকে শুধু আবিষ্কারই করেনি, নিজেদের শাসন ব্যবস্থায় প্রয়োগও করেছে।খ্রীস্টীয় একাদশ শতাব্দীতে ভগবান বাসবেশ্বরও তেমনই একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপত্তন করেছিলেন। তিনি ‘অনুভব মণ্ডপ’ নামক এহেন ব্যবস্থায় গরিব, দলিত, পীড়িত,শোষিত, বঞ্চিত – প্রত্যেক নাগরিক এসে নিজের মনের কথা সর্বসমক্ষে বলার নিয়মিত সুযোগপেতেন। সেদিক থেকে দেখতে গেলে, সেটি ছিল দেশের প্রথম সংসদ – যেখানে সকলেরসমানাধিকার ছিল। উঁচু-নীচু বৈষম্য ছিল না। ভগবান বাসবেশ্বরের বাণী; তিনি বলতেন,ভাবনার আদান-প্রদান না হলে, যুক্তি সহকারে তর্ক না হলে, এই অনুভব গোষ্ঠীওপ্রাসঙ্গিক থাকবে না, আর যেখানে প্রাসঙ্গিকতা থাকে না সেখানে ঈশ্বরও থাকেন না।অর্থাৎ তিনি ভাবনার আদান-প্রদানকে ঈশ্বরের মতো শক্তিশালী এবং প্রয়োজনীয় বলেছিলেন।এর থেকে বড় জ্ঞানের কল্পনা আর কী হতে পারে? অর্থাৎ ভারতে প্রায় এত শতাব্দী আগেওভাবপ্রকাশের সামর্থ্যকে ঈশ্বরের সমতুল আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এই কল্পনা আজও হয়তোবিশ্ববাসীকে অবাক করবে। তখন অনুভব মণ্ডপে মহিলারাও নিজেদের বক্তব্য রাখতে পারতেন।আজ পাশ্চাত্য আমাদের মহিলা ক্ষমতায়নের পাঠ পড়াতে চায়, আমাদের পিছিয়ে পড়া বলতে চায়!কিন্তু আমাদের রয়েছে এই অনেক শতাব্দী পুরনো নারী ক্ষমতায়নের ইতিহাস। ভগবানবাসবেশ্বর নারীর সমানাধিকারকে কেমন করে ব্যবস্থায় সামিল করেছিলেন, নিছকই মুখে বলাহয়, কিভাবে তা বাস্তবায়িত করেছিলেন! ঐ ‘অনুভব মণ্ডপ’-এই সমাজের প্রত্যেক শ্রেণীরমহিলারাও নিজেদের বক্তব্য রাখতে পারতেন। কোনও মহিলা যদি কোনও কুসংস্কারের বশবর্তীহয়ে তিরস্কৃত হতেন, তিনিও ঐ মণ্ডপে এসে নিজের পক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য রাখতেপারতেন। এক শতাব্দী আগে আমাদের দেশে এমন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত রয়েছে।তারপর আবার সমাজ কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়েছে। হওয়া উচিৎ ছিল না। হয়েছে, কিন্তু সেসবকুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিতে কেউ একজন আবার আমাদের সমাজ থেকেইআবির্ভূত হয়েছেন। সে সময় রাজা রামমোহন রায় বিধবা বিবাহের প্রস্তাব রেখেছিলেন, তখনকত না বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি অটল থাকেন। সমাজের নারী জাতিরপ্রতি এই ঘোর অন্যায়কে তিনি প্রতিহত করে ছাড়েন।
সেজন্য কখনও ভাবি, ‘তিন তালাক’ নিয়ে আজ এত বড় বিতর্ক চলছে। ভারতের মহানপরম্পরাকে অনুভব করে আমার মনে আশার সঞ্চার হচ্ছে। এদেশের সমাজের মধ্য থেকেই সমস্তকুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার মতো শক্তিশালী মানুষেরা উঠে আসেন। তাঁরাইকুসংস্কার হটিয়ে আধুনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। আমার আশা, মুসলমান সমাজ থেকেও এমনইপ্রজ্ঞাবান মানুষেরা উঠে আসবেন। আর মুসলিম কন্যাদের উপর যে অত্যাচার হচ্ছে তাঁরাএর বিরোধিতা করবেন, সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য নতুন পথ বের করবেন। ভারতের মুসলমানসমাজে অনেক প্রজ্ঞাবান মানুষ আছেন। তাঁদের ক্ষমতা সম্পর্কে আমি আস্থাবান। ভারতেরমাটির সেই শক্তি আছে, হাজার বছর আগে সমাজে অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদের বিরুদ্ধে যেমনভগবান বাসবেশ্বর ‘অনুভব মণ্ডপ’ চালু করে জাতি, বর্ণ ও লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলকেসেখানে সর্বসমক্ষে নিজের নিজের সমস্যা ও প্রতিবাদ জানানোর অধিকার দিয়েছিলেন। একহাজার বছর আগে ভগবান বাসবেশ্বর যদি এই সাহস দেখাতে পারেন, আমার বিশ্বাস, আজকেরমুসলমান সমাজের প্রজ্ঞাবান মানুষেরাও রাজনীটির উর্দ্ধে উঠে তা পারবেন। আপনাদেরসাফল্য নিজেদের আনন্দদানের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মকেও আলোর পথ দেখাবে।
বন্ধুগণ, ভগবান বাসবেশ্বরের বাণী থেকে তাঁর শিক্ষা সঞ্জাত সাতটি সিদ্ধান্তরামধনুর সাতটি রঙের মতো আজও দেশের এক প্রান্তের সঙ্গে অন্য প্রান্তকে জুড়ে রেখেছে।সকলের প্রতি আস্থা থাকুক, সকলের প্রতি সম্মান থাকুক। জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতার মতোসামাজিক রোগ না থাকুক, সকলে সমান অধিকার পাক – এটাই তিনি চেয়েছেন। তিনি প্রত্যেকমানুষের ঈশ্বর দেখেছেন। তিনি বলেছেন, ‘দেহ ওয়ে একল’, অর্থাৎ এই শরীর একটি মন্দির,যেখানে আত্মা নামক ঈশ্বরের বাস। তিনি যুক্তি ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর ভাবনাকেবিকশিত করতে চেয়েছেন। এর মাধ্যমেই প্রতিটি মানুষের ক্ষমতায়ন সম্ভব। এই সিদ্ধান্তযে কোনও গণতন্ত্র, যে কোনও গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য একটি মজবুত ভিত্তির মতো। তিনিবলতেন, মানুষ কোন্ জাতের, কোন্ মতের তা জিজ্ঞেস করবে না, ‘ইব ইয়া রব ইয়ে কহো কিইয়ু নমব’। এই মানুষ আমাদের। আমাদের সকলের একজন। এই ভিত্তির উপরই একটি মজবুতরাষ্ট্র গড়ে ওঠে। এই সিদ্ধান্ত একটি দেশের নীতি-নির্দেশের কাজ করে। আমাদের পক্ষেএটা অত্যন্ত গর্বের বিষয় যে ভারতের মাটিতে ৮০০ বছরেরও আগেই ভগবান বাসবেশ্বর এইচিন্তাভাবনাগুলিকে গণভাবনা এবং গণতন্ত্রের ভিত্তি করে তুলেছেন। তাঁর বাণীতে সবাইকেসঙ্গে নিয়ে চলার আহ্বানই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের ‘সবার সঙ্গেসবার উন্নয়ন’ মন্ত্রে। বৈষম্যহীন উন্নয়নের এই মন্ত্র দেশের প্রত্যেক মানুষের মনেবাসা বাধুক। বৈষম্যহীন ২৪ ঘন্টা বিদ্যুৎ বৈষম্য ছাড়াই, গ্রামে গ্রামে সড়ক যোগাযোগ,প্রত্যেক কৃষকের জন্য সেচের জল, সার, ফসলের বিমা – একেই তো বলে ‘সবার সঙ্গে সবারউন্নয়ন’। এদেশে এখন সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলার অনেক প্রয়োজন। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সকলেরচেষ্টা ও যত্নে সকলের উন্নয়ন করা সম্ভব।
আপনারা সবাই হয়তো ভারত সরকারের ‘মুদ্রা যোজনা’ সম্পর্কে শুনেছেন। এইপ্রকল্পে দেশের নবীন প্রজন্মের যুবক-যুবতীদের কোনও বৈষম্য ছাড়া, কোনও গ্যারান্টিছাড়া ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ দেওয়া হয়েছে, যাতে তাঁরা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে রোজগার করতেপারেন। ইতিমধ্যেই দেশের সমস্ত অঞ্চল থেকে সাড়ে তিন কোটিরও বেশি যুবক-যুবতী এই ঋণপেয়েছেন। আপনারা শুনলে খুশি হবেন, ৮০০ বছর পর ভগবান বাসবেশ্বরও হয়তো খুশি হবেন যে,ঐ ঋণ প্রাপকদের ৭৬ শতাংশই হলেন মহিলা। সত্যি বলতে কি, এই প্রকল্প যখন শুরু হয়েছিলআমরাও কল্পনা করিনি যে এত বেশি মাত্রায় মহিলারা এগিয়ে আসবেন আর ‘স্বউদ্যোগী’ হয়েওঠার সংকল্প নিয়ে কাজ করবেন! আজ এই প্রকল্প নারী ক্ষমতায়নে একটি গুরুত্বপূর্ণভূমিকা পালন করছে। গ্রামে গ্রামে, অলিগলিতে এই মুদ্রা যোজনা মহিলা স্বউদ্যোগীদেরমাধ্যমে নতুন আর্থিক প্রাণ সঞ্চার করেছে। ভাই ও বোনেরা, ভগবান বাসবেশ্বরের বাণীশুধু জীবনের সত্যি নয়, এগুলি সুশাসনের ক্ষেত্রেও এতটাই উপযোগী। তিনি বলতেন যে,জ্ঞানের শক্তিতে অজ্ঞানের বিনাশ, আলোর শক্তিতে অন্ধকার বিনাশ, সত্যের শক্তিতেঅসত্যের বিনাশ, স্পর্শের শক্তিতে লৌহসম কাঠিন্যের বিনাশ ব্যবস্থা থেকে দূর করতেপারবে সুশাসন। যখন গরিবের জন্য নির্ধারিত ভর্তুকি, রেশন তাঁদের হাতেই পৌঁছয়, যেদিনকর্মনিযুক্তির জন্য সুপারিশ বন্ধ হবে, দুর্নীতি ও কালো টাকার হাত থেকে মুক্তিপাওয়া যায়, তখন ব্যবস্থায় সততার পথ প্রশস্ত হয়। ভগবান বাসবেশ্বর তাঁর বাণীরমাধ্যমে এসব কথাই বলে গেছেন। যা মিথ্যে ও ভুল, তাকে হটিয়ে স্বচ্ছতা আনাই তোসুশাসন।
ভগবান বাসবেশ্বর বলতেন, নিঃস্বার্থ কর্মযোগের মাধ্যমেই মানুষের জীবন বিকশিতহয়। শিক্ষা মন্ত্রী মহোদয়, তিনি মানতেন যে, সমাজে নিঃস্বার্থ কর্মযোগ যত বৃদ্ধিপাবে, সমাজে দুর্নীতিগ্রস্ত আচরণ তত কমবে। দুর্নীতিই ঘুণের মতো আমাদের গণতন্ত্র ওসামাজিক ব্যবস্থাকে ভেতর থেকে কুরে কুরে ফাঁপা করে দিচ্ছে। দুর্নীতিই মানুষেরসমানাধিকার ছিনিয়ে নিচ্ছে। একজন মানুষ পরিশ্রম ও সততার মাধ্যমে উপার্জন করেন, তিনিযখন দেখেন, আরেকজন দুর্নীতির সাহায্য নিয়ে অনেক কম পরিশ্রমের বিনিময়ে আরাম ও আয়েসকরছেন, তখন এক মুহূর্তের জন্য হলেও তিনি ভেবে বসতে পারেন হয়তো তাঁর পথ ভুল, এমনইপ্রলোভনের বশবর্তী হয়ে তিনিও সততার পথ ছেড়ে দিতে বাধ্য হতে পারেন। সেজন্য সমাজথেকে অসাম্যের ইঙ্গিত দূর করা আমাদের সবার কর্তব্য। আপনারা বর্তমান কেন্দ্রীয়সরকারের নীতিসমূহ এবং সিদ্ধান্তগুলিকে ভালভাবে দেখলে অনুভব করবেন, আমরাওনিঃস্বার্থ সেবার ভাবনাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছি। আজ বাসবাচার্যজির বাণী, তাঁর দর্শন,তাঁর চিন্তাপ্রবাহ কর্ণাটকের সীমা ছাড়িয়ে, দেশের সীমা ছাড়িয়ে টেমস্ তীরবর্তীলন্ডন পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
লন্ডনে বাসবাচার্যের মর্মর মূর্তির আবরণ উন্মোচনের সৌভাগ্য আমার হয়েছে। যেদেশ সম্পর্কে এক সময় বলা হতো, দেশে কখনও সূর্য অস্ত যায় না। সেই দেশের সংসদ ভবনেরসামনে গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে বাসবাচার্যের মূর্তির আবরণ উন্মোচনের সময় মেঘরাজওঅমৃতবর্ষণ করছিলেন। কনকনে শীত ছিল। তবুও অসংখ্য মানুষ সেখানে দাঁড়িয়ে ভগবানবাসবেশ্বর সম্পর্কে শুনে অবাক হচ্ছিলেন যে এত শতাব্দী আগে ভারতে নারী ক্ষমতায়ন ওসাম্যকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল!
বন্ধুগণ, এখন এটাকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি ভাবুন অথবা নিজেদেরঅতীতকেই বিস্মৃত হওয়ার দুর্বলতা; আজও আমাদের দেশে লক্ষ কোটি যুবক-যুবতি জানেন নাযে ৮০০-৯০০ বছর আগে, হাজার বছর আগে আমাদের দেশে সামাজিক মূল্যের পুনর্স্থাপনারজন্যে কেমন গণজাগৃতির আন্দোলন চলছিল! সমাজে ব্যপ্ত কুসংস্কারগুলিকে নিকেশ করতে সেইকালখন্ডে ৮০০-১০০০ বছর আগে, দাসত্বের দিনগুলিতেও আমাদের ঋষিরা, সাধু সন্ন্যাসীরাগণআন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করেন। তাঁরা গণআন্দোলনকে ভক্তির সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন।ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিআর সমাজের প্রতি ভক্তি -দাক্ষিণাত্য থেকে শুরু হয়ে এই ভক্তিআন্দোলনের ঢেউ মহারাষ্ট্র ও গুজরাট হয়ে উত্তর ভারতে পৌঁছয়। সেই সময় নানা ভাষার,নানা বর্গের মানুষ সমাজকে সচেতন করার কাজে ব্রতী হন। তাঁরা সমাজের জন্য আয়নার মতোকাজ করেন। যা কিছু ভাল, যা কিছু খারাপ, তাঁরা সেগুলিকে আয়নার মতো মানুষের সামনেরেখেই ক্ষান্ত হননি। তাঁরা কুসংস্কার থেকে সমাজকে মুক্ত করতেও ভক্তির পথ অবলম্বনকরেন। ভক্তির পথকেই তাঁরা মুক্তির পথে পর্যবসিত করেন। রামানুজাচার্য, মাধবাচার্য,নিম্বকাচার্য, সন্ত তুকারাম, মীরাবাঈ, নিরসিংহ মেহতা, কবীরা, কবীর দাস, সন্তরবিদাস, গুরু নানকদেব, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু – অনেক অনেক মহান ব্যক্তির আবির্ভাবেভক্তি আন্দোলন মজবুত হয়েছে। তাঁদের প্রভাবেই দেশ দাসত্ব সত্ত্বেও একটি দীর্ঘকালখন্ড নিজের চেতনা সঞ্জীবিত রাখতে পেরেছে, নিজের আত্মাকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে।আরেকটা জিনিস আপনারা লক্ষ্য করবেন, তাঁরা অনেক সহজ সরল ভাষায় নিজেদের কথা সাধারণমানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। ভক্তি আন্দোলনের সময় ধর্ম, দর্শন ও সাহিত্যেরএমনই ত্রিবেণীসঙ্গম হয়েছিল যে আজও সেই ভক্তি আন্দোলন আমাদের প্রেরণা যোগায়। তাঁদেররচিত দোহাগুলি, তাঁদের বচন, চৌপাই, কবিতা, গীত আজও আমাদের সমাজে প্রাসঙ্গিকতাহারায়নি। তাঁদের মূল্যবান দর্শন যে কোনও সময়ের নিরিখে সমাজে প্রযোজ্য বলে বিবেচিতহচ্ছে। ৮০০ বছরেরও আগে বাসবেশ্বরজি যা যা বলে গেছেন, তা আজকের প্রেক্ষিতেও সত্যবলে মনে হয়।
বন্ধুগণ, আজ ভক্তি আন্দোলনের সেই ভাব, সেই দর্শনকে গোটা বিশ্বে ছড়িয়েদেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। আমি আনন্দিত যে, আজ বাসবেশ্বরজির তাঁর বাণীর অনুবাদ ২৩টিভাষায় প্রকাশিত হচ্ছে। অনুবাদে নিয়োজিত প্রত্যেককে আমি অভিনন্দন জানাই। আপনাদেরচেষ্টায় ভগবান বাসবেশ্বরের বাণী এখন বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছবে। আজ এই সুযোগে আমি বাসবসমিতির কাছেও কিছু আবেদন রাখব। রাখব তো? গনতন্ত্রে সবকিছুই সাধারণ মানুষকে জিজ্ঞেসকরতে হয়। একটা কাজ আমরা করতে পারি, এই বাণীগুলি থেকে প্রশ্নমালা তৈরি করে ক্যুইজব্যাঙ্ক করে ডিজিটাল অনলাইনে আপলোড করে আলাদা-আলাদা বয়সের ছাত্রছাত্রীদের জন্যপ্রতিযোগিতা আয়োজন করতে পারি। তহশিল পর্যায়ে প্রতিযোগিতা, জেলা পর্যায়ে প্রতিযোগিতা,তারপর রাজ্য পর্যায়, জাতীয় পর্যায় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতার আয়োজন সারাবছর ধরে চলতে পারে। ৫০ লক্ষ থেকে ১ কোটি ছাত্রছাত্রী যেন অংশগ্রহণ করতে পারে!সেজন্য তাঁর ‘বচনামৃত’-এর নিবিড় অধ্যয়ণ জরুরি হয়ে পড়বে। আমার মনে হয় – অরবিন্দজি,আপনারা এই প্রতিযোগিতা অবশ্যই শুরু করতে পারেন। না হলে, আমরা অন্য আরওগুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যের মতো একেও বিস্মৃত হ’ব। যেদিন আপনার সঙ্গে সংসদে দেখাহয়েছিল, তখন বিমুদ্রাকরণ নিয়ে তুমুল হট্টগোল চলছে। সবাই পকেটে হাত রেখে ঘুরছেন।আগে যাঁরা নিয়মিত অন্যের পকেট কাটতেন, তাঁরাও তখন নিজেদের পকেটে হাত রেখেঘুরছিলেন। সেই সময় অরবিন্দজি আমাকে বাসবাচার্যজির একটি উক্তি শুনিয়েছিলেন, এত যথযথউক্তি যে ৭ তারিখে জানলে আমি সেই উক্তিটি ৮ তারিখের বিমুদ্রাকরণ ভাষণে অবশ্যইউল্লেখ করতাম। আর তারপর কর্ণাটকে কী কী প্রকাশিত হ’ত – তা আপনারা কল্পনা করতেপারেন! সেজন্য আমি চাই যে, এই কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক। এখানেই যেন থেমে নাযায়! আজকের প্রজন্ম তো গুগল গুরু নির্ভর জীবনযাপন করেন। তাঁদের জন্য এই ডিজিটালআপলোড আর ক্যুইজ প্রতিযোগিতাই উপযুক্ত উপায়। তবেই তাঁরা জানতে পারবেন যে ৮০০-৯০০বছর আগে আধুনিক বিশ্বের চিন্তাধারার পাশাপাশি এই ‘বচন অমৃত’-এর তুলনামূলক পাঠথেকেই তাঁরা বুঝতে পারবেন নিজেদের ঐতিহ্যের গুরুত্ব। আজকের অনেক দার্শনিকের তুলনায়অনেক ক্ষুরধার ছিল ৮০০-৯০০ বছর আগে আমাদের দেশের দার্শনিকদের ভাবনা! আরেকটি অনুরোধআমি করব, এই ভবনে বসে যাঁরা আমার বক্তব্য শুনছেন, দেশের নানা প্রান্ত ও বিশ্বেরবিভিন্ন স্থানে যাঁরা আমার কথা শুনছেন তাঁদের প্রতিও এই অনুরোধ।
আগামী ২০২২ সালে দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি হবে। সেই ৭৫ বছর পূর্তিউদযাপনের আগে আমরা দেশকে কোথায় পৌঁছে দিতে চাই, সেটা ঠিক করতে হবে! প্রত্যেকব্যক্তি, সংস্থা, পরিবার, গ্রাম, নগর, শহরের জন্য সংকল্প করতে হবে। যাঁরা দেশস্বাধীন করার জন্য জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছেন, জীবনের মূল্যবান বছরগুলিকারান্তরালে কাটিয়েছেন, তাঁরা যেমন স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, স্বাধীনতার পর৭০ বছর পেরিয়ে গেলেও দেশে আজও তাঁদের সকল স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। আমরা কি পারব,আগামী পাঁচ বছরে তাঁদের স্বপ্নগুলির বাস্তব রূপ দিতে। পরামর্শ দেওয়ার লোকের অভাবনেই; সরকারের এই কাজ করা উচিৎ, সরকারের ঐ কাজ করা উচিৎ! আজ্ঞে না, ১২৫ কোটিভারতবাসীকেই কাজ করতে হবে। আর ঠিক করতে হবে কে কী করব! তা না হলে বাসবাচার্যেরস্বপ্ন যে দেশের মানুষের মনে সঞ্জীবিত বিশ্বের বুকে সেসব স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতেআমরা পিছিয়ে থাকব না, এই সংকল্প নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সেজন্য আমার অনুরোধ,আপনাদের সমিতির মাধ্যমে যাঁরা এই বিচারধারার প্রচার ও প্রসারে ভাল কাজ করেছেন, যেসরস্বতীর বরপুত্রদের সঙ্গে আজও সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয়েছে, যাঁরা রাতদিন কাজ করে এইপ্রকল্পের বাস্তব রূপ দিয়েছেন, কন্নড় ভাষা শিখে তবেই তাঁরা নিজের নিজের ভাষায়অনুবাদ করতে পেরেছেন, কন্নড় ভাষা ৮০০ বছর আগে যেমন ছিল, সেটা তাঁদের শিখতে হয়েছে,তাঁদের সকলকে আমি হৃদয় থেকে অনেক অনেক অভিনন্দন জানাই। এই কাজকে সম্পূর্ণ করতেআপনারা সময় দিয়েছেন, শক্তি জুগিয়েছেন, নিজের জ্ঞানকে এই কাজে উৎসর্গ করেছেন। এইপবিত্র অনুষ্ঠানে আপনাদের মাঝে আসার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাই। এখানেএসে সেই মহান বাণীগুলি শোনার সৌভাগ্য হয়েছে, আজ আমার নিজেরআগ্রহও বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি ধন্য হয়েছি। সেজন্য আপনাদের সবাইকে আবার ধন্যবাদজানাচ্ছি।
অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানাই।