আপনি কি জানতেন যীশুর জন্মের ৮০০ বছর আগেই বৈদিক পুরোহিতরা আগুনের ব্যবহার প্রসঙ্গে পাইথোরিয়ান তত্বকে কাজে লাগাতেন? আমেরিকান ফিল্ডস মেডেল বিজয়ী গণিতবিদ ডেভিড মুমফোর্ড আরেক আমেরিকান গণিতজ্ঞ কিম প্লফকারের লেখা বই 'মাথ্যামেটিক্স ইন ইন্ডিয়া'-র পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হয়েছেন।

এই প্রশ্নের উত্তর বেশিরভাগ ভারতীয়ই জানেন না।

অনেকেই জানতেন না পাইথাগোরাস থিওরেমকে "বৌদ্ধ্যয়ানার তত্ত্ব" বলে মনে করা উচিত। এই সূত্রেই মুমফোর্ড লিখেছেন, তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি সুসংবদ্ধ ভাবে সংখ্যা তত্বের দিক নির্দেশ করেছেন।

প্রশ্ন উঠতেই পারে বৌদ্ধ্যয়ানা কে?

 

"ভারতের ধারণা সম্পর্কে ভারতে অনেক আলোচনা আছে কিন্তু প্রকৃত ভারতের ধারণার বিষয়ে কথন সামান্যই"

সমস্যাটা এখানেই। 'ভারতের ধারণা সম্পর্কে ভারতে অনেক আলোচনা আছে কিন্তু প্রকৃত ভারতের ধারণার বিষয়ে কথন সামান্যই'। এই প্রসঙ্গে বলতে হয় বৌধ্যায়না ছিলেন প্রাচীন ভারতের এক বিশিষ্ট পন্ডিত ও সন্ন্যাসী। শুধু দেশ সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা না থাকাই নয় আরও এক জায়গাতেই খামতি আছে। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভিমত ছিল ভারতের ধারণা অন্য সমস্ত দেশের থেকে আলাদা। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে মতের অমিল ও বিচ্ছিন্নতা থেকে যে সংঘাতের সৃষ্ট হতে পারে তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ভারতের ধারণা। এই বিষয়ে ভারতের মহাত্ম্য বোঝাতে রবি ঠাকুর খুব সহজেই বসুধৈব কুটুম্বাকমের কথা বলতে পারতেন, এর মানে গোটা পৃথিবী আমার পরিবার।

ভারতকে জানতে আমাদের শুরু করতে হবে শূন্য থেকে। দেশের আগামী প্রজন্মকে বোঝাতে হবে ভারতের ধারণা আসছে কথা থেকে? এটা করতে পারলেই সব দিক থেকে ভাল হবে।

প্রাচীন ভারতের গণিতজ্ঞদের কাছে মেরু প্রস্তারা নামে যে তত্ব প্রচলিত ছিল সেটাই পরবর্তী সময়ে প্যাস্কালের তত্ব বলে জনপ্রিয় হয়। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে গণিতজ্ঞ পিঙ্গলা তাঁর চন্দ্রস সূত্রে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে পিঙ্গলা ও পানিনি থেকে শুরু করে গাণিতিক আর্যভট্ট, ভাস্কর থেকে শুরু করে ব্রম্ভগুপ্তরা হলেন প্রাচীন ভারতের গণিত শাস্ত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র। ভাগ্যের পরিহাস এটাই যে পাণিনির পরিচিতি গণিতজ্ঞ যে নয় সংস্কৃত ব্যাকরণে অবয়ানের জন্য। অথচ পানিনিই প্রথম
কিছু নিয়ম এবং শব্দের বিভিন্ন উপসর্গ চিহ্নিত করতে কিছু বস্তূ চিহ্নগুলির প্রবর্তন করেন যা কিছু নিয়মনীতিতে কিছু সাধারণ পদ্ধতিতে ব্যবহার করা হবে।

খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৬ সনে জন্মানো ভারতীয় বৈজ্ঞানিক আর্যভট্টই প্রথম পাই চার দশমিকের প্রায় সঠিক ধারণা দিয়েছিলেন। (৬২৮৩২/২০০০; ৩.১৪১৬)। প্রাচীন ও ক্ল্যাসিকাল সময়ে জন্ম নেওয়া ভারতীয় গণিতজ্ঞরা গ্রীক ও রোমান গণিতজ্ঞদেরও ছাপিয়ে গিয়েছিলেন এটা বলাই যায়। বিজ্ঞান ও দর্শনের আন্তর্জাতিক ইউনিয়নের প্রথম অ-প্রাশ্চাত্য সভাপতি বি ভি সুব্বারাপ্পার মত এমনটাই। বর্গক্ষেত্র এবং ঘনক্ষেত্রের শিকড়, ত্রিভুজ এবং ট্র্যাভেজিয়ামের ক্ষেত্রসমূহ, বৃত্ত, গোলক এবং পয়মালের আয়তন, অনুক্রমিক অগ্রগতি এবং সিরিজের সমষ্টি, ভগ্নাংশ সম্পর্কেও ধারণা ছিল আর্যভট্টের।

 

"এটা বললে মটেই বেশি বলা হয় না যে পানিনিই প্রথম কম্পিউটার সায়েন্সের প্রাথমিক ধারণা দেন"

চিকিৎসা শাস্ত্রের ক্ষেত্রে সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতে সুশ্রুত সংহিতা লেখা হয়। এই গ্রন্থেই অস্ত্রপচার সম্পর্কে কিছু মৌলিক ধারণা দেওয়া হয়। অনেক চিকিৎসক এটিকে ভারতীয় চিকিৎসার জনক বলে মনে করেন। বইটিতে ১০১ টি ভোঁতা ও ২০টি ধারালো সামগ্রীর কথা বলা ছিল যা দিয়ে অস্ত্রপচার করা যায়। এর মধ্যে ছিল সাঁড়াশী, চিমটা, স্ক্যাল্পেল, ক্যাথার্স, বুগিজ, ট্রকারে, সিরিংজ, স্পিকুলাম, সূঁচ, স্লেট, কাঁচি, লেন্স, হুক এবং প্রোবের মতো জিনিস।

ল্যাপারোোটমি এবং লিথোটোমির মতো সূক্ষ্য অস্ত্রপচারও করতে পারতেন তৎকালীন ভারতের চিকিৎসকরা। চোখ থেকে ছানিও ব্যাড দিতে পারতেন তাঁরা। ক্রনিটোমি ও অশ্বের অস্ত্রপচারের কৌশলও তাঁদের জানা ছিল। সুবরাপ্পা লিখেছেন, আরেকটি কৃতিত্ব হলো পিঁপড়ের কামড়ালে, পিঁপড়ের দেহছেদ করে কাটা জায়গা জুড়ে দেওয়ার কৌশল জানা।

২০০৮ সালের এন্সাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বলছে সুশ্রুত সংহিতাই প্রথম বই যেখানে কুষ্ঠব্যাধিকে রোগ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

রসায়ন শাস্ত্রে ভারতের বুৎপত্যি জানতে গেলে ফায়ার যেতে হবে বিখ্যাত রসায়নবিদ প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এবং বিশিষ্ট ইংরেজ জোসেফ নিধামেরে লেখায়। সেখানে দেখা যাবে রসায়ন শাস্ত্রে মদ থেকে পারদ সবেরই ব্যবহার হত প্রাচীন ভারতে। ধারণা পেতে আমরা প্রফুল চন্দ্র রায়ের কোঠি বলতে পারি। জলের দ্রবিকরণ নিয়ে তিনি যে কাজ করেছিলেন তা গোটা বিশ্বে প্রশংসিত হয়, এমনকি ১৯১২ সালে নেচার পত্রিকায় এ নিয়ে প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়। এর বাইরেও ১০০টিরও বেশি বৈজ্ঞানিক দস্তাবেজ লিখেছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন বেঙ্গল কেমিক্যাল এবং ফার্মাসিটিক্যাল ওয়ার্কস। ফরাসি রসায়নবিদ মার্সেলিনা বার্থেলটসের ভলিউম লেস আদি ডি দে আল্কিমির অনুপ্রেণায় ১৯০২ এবং ১৯০৮ সালে হিন্দু রসায়ন ইতিহাসের দুইটি অনুচ্ছেদ প্রকাশ করেন। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই অভাবনীয় প্রশংসা লাভ করে বই দুটি। পরে নিজেই এই বি দুটি প্রকাশ করেন বার্থেলট।

 

"ভারতীয়রা যদি আরও বেশি করে বুঝতে পারেন যে এ দেশে পুরাকালে থেকে যুক্তি এ বিশ্বাস হাত ধরাধরি করে চলছে তা হলে খুবই ভাল হয়"

রয়াল সোসাইটির ফেলো, ব্রিটিশ আক্যাডেমির ফেলো এবং অর্ডার অফ দ্য কোম্প্যারিসন অফ ওনার - এই তিনটি বিড়াল সম্মানের সাধিকারী প্রথম জীবিত ব্যক্তি ছিলেন নিধাম। তাঁর গবেষণা থেকে জানা যায় প্রাচ্য বিশেষ করে চিন কিভাবে প্রাশ্চাত্যকে আবিষ্কার এবং প্রযুক্তিতে হারিয়ে দিয়েছিল। পাশাপাশি এখন তাদের পিছিয়ে পড়ার কারণও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ভারত নিয়ে তাঁর গবেষণাও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এদেশে আলকোহল ডিস্টিলিং পদ্ধতি নিয়ে তাঁর বিশেষ পড়াশুনা ছিল।

এগুলি বিশ্বকে দেওয়া ভারতের বৈজ্ঞানিক অবদানের মাত্র কয়েকটি উদাহরণ। ভারতীয়রা যদি আরও বেশি করে বুঝতে পারেন যে এ দেশে পুরাকালে থেকে যুক্তি এ বিশ্বাস হাত ধরাধরি করে চলছে তা হলে খুবই ভাল হয়। সেই সূত্র ধরেই কি স্বামী বিবেকানন্দ উল্লেখ করেছেন ধর্ম নিজেই যুক্তি আবিষ্কারের দ্বারা ন্যায্যতা বজায় রাখে, যার মাধ্যমে প্রতিটি অন্যান্য বিজ্ঞান নিজেই নিজের রাস্তা ঠিক করে? এই একই পদ্ধতিতে কি গবেষণা চালিয়ে আমরা বাইরে বিজ্ঞান এবং জ্ঞান প্রয়োগ করতে পারি যার থেকে ধর্মের বিজ্ঞান প্রয়োগ সম্ভব? আমার মনে হয় এটাই করা উচিৎ। যত তাড়াতাড়ি এটা করা যায় তত ভাল। কোনও ধর্ম যদি এ ধরনের কুসংস্কার দ্বারা ধ্বংস হয়ে যায় তবে তা সর্বদা নিরর্থক, অপ্রয়োজনীয় কুসংস্কার, এবং যত তাড়াতাড়ি এটি আরও ভালো হয়ে যায়।

___________________

 

[i] ডেভিড মুমফোর্ড, বুক রিভিউ: মাথিয়ামেটিক্স ইন ইন্ডিয়া, নোটিশেস অফ দ্য মার্কিন মাথ্যমেটিক্যাল সোসাইটি, মার্চ ২০১০, পাতা ৩৪৫

[ii] বি ভি সুবরাপ্পা, ইন্ডিয়াস কান্ট্রিবিউশন তো ওয়ার্ল্ড থ্রুঅটুট অ্যান্ড কালচার: ইন্ডিয়াস কান্ট্রিবিউশন টু হিস্টরি অফ সায়েন্স ( চেন্নাই: বিবেকানন্দ কেন্দ্র প্রকাশন ট্রাস্ট, ১৯৭০) পাতা ৪৯

[iii] সুব্বারাপ্পা, ইন্ডিয়াস কন্ট্রিবিউশন অফ ওয়ার্ল্ড থ্রুঅটুট অ্যান্ড কালচার, পাতা ৫৮

[iv] সুব্বারাপ্পা, ইন্ডিয়াস কন্ট্রিবিউশন অফ ওয়ার্ল্ড থ্রুঅটুট অ্যান্ড কালচার, পাতা ৫৮

[v] স্বামী বিবেকানন্দ, দ্য কমপ্লিট ওয়ার্কস অফ স্বামী বিবেকানন্দ, অনুচ্ছেদঃ ১ ( মায়াবতী: অদ্বৈত আশ্রম,২০০৭) পাতা ৩৬৭


                                                                                                      ___________________

(হিন্দোল গোস্বামী একজন পুরস্কারজয়ী সাংবাদিক, সাতটি লেখক এবং ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের নবীন গ্লোবাল লিডার।)

এই প্রবন্ধের সমস্ত মন্ত্যব লেখকের। নরেন্দ্র মোদী ওয়েবসাইট ও নরেন্দ্র মোদী অ্যাপের মত নয়।