সেরা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। ধীর গতিতে চলা এই দৈত্য এবার ধীরে চলো নীতি থেকে সরে আসতে শুরু করেছে। শুধু দেশকে রক্ষাকরাই নয়, প্রতিরক্ষার সঙ্গে নানা ভাবে জড়িয়ে থাকা ১৫ লক্ষ মানুষের প্রশাসনিক কাজও করতে হয় এই মন্ত্রককে । ভারত সরকারের বাজেটের সিংহভাগ জুড়ে থাকে প্রতিরক্ষা। উদাহরণ হিসেবে ২০১৭-২০১৮ সালের কথাই বলা যায়। এই বছরের বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে ৩,৫৯,৮৫৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। মার্কিন অর্থমূল্য অনুযায়ী ৫৩.৫ বিলিয়ন ডলার। যদিও প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির হার কম বলে সমালোচনা করেছেন সমালোচকদের একাংশ।
যদিও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পরিকর এবং তাঁর দপ্তরের কাছে অর্থ সংকট সব থেকে বড় প্রতিবন্ধকতা নয়। আর জায়গায় অধিগ্রহন করার ক্ষেত্রে সময় কমিয়ে আনা এবং উপস্থিত সম্পদের পূরণ ব্যবহার করা অনেক বেশি প্রয়োজনীয়। পাশাপাশি এই ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা রাখাও খুব জরুরি। এই বিষয়গুলিকে খামতি থেকে গেলে প্রতিরক্ষা খাতে ভারতীয় সেনার প্রস্তুতিতেও ফাঁক থেকে যেতে পারে। এই সমস্ত বিষয় নিয়েই ভাবছেন দিল্লির সাউথব্লকের কর্তারা। উল্লেখ্য এখন থেকেই পরিচালিত হয় ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক।
অস্ত্র বেচা কেনা থেকে শুরু করে এই সংক্রান্ত সমস্ত নীতিতে বড় পরিবর্তন আসে ডিফেন্স অফ প্রকিউরমেন্ট পলিসি ( ডিপিপি)-২০১৬ ঘোষণা হওয়ার পর। প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত ক্রয়ের নির্দেশিকা দস্তাবেজ হলো ডিপিপি।
ডিপিপি-২০১৬-তে কেনা আইডিডিএম (ইন্ডিজিনিয়াসলি ডিসাইন্ড ডেভেলাপেড অ্যান্ড ম্যানুফাকচার্ড ) এখন নতুন ডিপিপি গঠন করে ছয়টি বিভাগের মধ্যে সর্বাধিক অগ্রাধিকার পায়। এর অর্থ এই যে প্রতিরক্ষার কাজে যুক্ত যেসমস্ত ভারতীয় সংস্থা দেশীয় পদ্ধতি অবলম্বন করে তাদের বিভিন্ন সামগ্র্রী তৈরি করে তারা আরও বেশি করে তিনটি সশস্ত্র বাহিনীর কাজ করতে পারবে।
নতুন এই আইডিডিএম (ইন্ডিজিনিয়াসলি ডিসাইন্ড ডেভেলাপেড অ্যান্ড ম্যানুফাকচার্ড) বিভাগের মধ্যে বলা রয়েছে ৪০ শতাংশ সামগ্রীই স্থানীয় ভাবে কেনা হবে।
প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে অধিগ্রহণ সমস্যার সমাধানে বেশ কিছু অভিনব পরিকল্পনা করা হয় ডিপিপির মাধ্যমে। পাশাপাশি মেক ইন ইন্ডিয়া প্রকল্পের মধ্যে দেশীয় ভাবে কাজ করে চলা সংস্থাগুলিকেও উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।
বিলম্ব এড়াতে ডিপিপি ঠিক করেছে এখন থেকে কোনও একটি নির্দিষ্ট প্লাটফর্মের অন্তর্গত সমস্ত এওএন (আকসেপ্টেন্স অফ নেসেসিটি) গুলি ১২ মাসের জায়গায় ৬ মাস করে বৈধ থাকবে। চূড়ান্ত আরএফপি (রিকয়েস্ট ফর প্রপোসাল ওর ডিটেলেড টেন্ডার) না থাকলে কোনও এওএন-ই অনুমোদিত হবে না। আগে এওএন-এর পর আরএফপির অনুমোদন করা হত বলে বিলম্ব সংক্রান্ত সমস্যা হত।
প্রতিরক্ষায় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রথম ধাপ ছিল গুরুত্ব আরোপ করা। গত পাঁচ বছরে অধিগ্ৰহণ সংক্রান্ত খরচ বেড়েছে। শুধু তাই নয় সেভাবে করাও যায়নি।
জমে থাকা প্রকল্পের তথ্য তালাশ করতে গিয়ে দেখা গিয়েছে গত পাঁচ বছর ধরে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সামরিক ও অসামরিক দু-ধরণের আমলারাই তিন বাহিনী মিলিয়ে ছোট বড় প্রায় ৪০০ টি প্রকল্প নিয়ে কাজ করে চলেছেন। এর মধ্যে এক তৃতীয়াংশ এখন আর অপ্রাসঙ্গিক। তা সেগুলিকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় ৫০টি প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিয়ে চলেছে।
এর পর তিন বাহিনীতে কার্যকর এমন কয়েকটি গুরুতর পরিকল্পনাকে বেছে নেওয়া হয় যেগুলিতে টাকা দেওয়া প্রয়োজন। সন্ত্রাসবাদীদের মোকাবিলা করার কাছে নিযুক্ত সেনা আধিকারিক থেকে শুরু করে যারা বিভিন্ন সময়ে বিদ্রোহ রুখতে কাজ করেন তাঁদের প্রয়োজনের তুলনায় কম পরিমানে বুলেট প্রতিরোধক জ্যাকেট ছিল। সেই বিষয়টি জানতে পেরেই ৫০ হাজার নতুন জ্যাকেট কেনার অনুমোদন দিয়ে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয় সেনা জওয়ানদের মাথা বাঁচাতে প্রয়োজনীয় হেলমেটের বরাত দেওয়া হলো দু-দশক বাদে। কানপুরের সংস্থা এমকেইউ ইন্ডাস্ট্রিসকে ১৭০ এবং ১৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১.৫৮ লক্ষ হেলমেট তৈরির বরাত দেওয়া হয়েছে।
নিজের ব্যাপারে নিজেই তথ্য দেয় পারিসংখ্যান। মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২,০৯৭৫১ কোটি টাকা মূল্যের ১২৪টি নতুন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
এর মধ্যে আছে আর্টিলারি বন্দুক, সেনার জন্য আক্রমণ করতে পারে এমন মাঝারি ওজনের মার্কিন চিনুক ও আপাচে হেলিকপ্টার, নৌ-বাহিনীর জন্য ফ্রীগেটস এবং মাইন কাউন্টার-মেসার ভেসেলস এবং বায়ু সেনার জন্য আকাশ মিসাইল। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারত সার্জিকাল স্ট্রাইক করে। এর পর পাকিস্তান প্রত্যাঘ্যাত করতে পারে এই আশঙ্কায় নিরাপত্তা বিষয়ক ক্যাবিনেট কমিটি তিন বাহিনী মিলিয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা অধিগ্রহনের বিষয়ে ছাড়পত্র দেয়। এই বিরাট কর্মকান্ডের প্রভাবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের কাছ এই বছরটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
পূর্ববর্তী সরকার মৌলিক প্রয়োজনীয়তাকেও উপেক্ষা করেছে বলে এই ধরণের পদক্ষেপ জরুরি ছিল। আগের ক্যাপ্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল ২০১৩ সালের মার্চ মাসে গোলাবারুদের প্রাপ্যতা ছিল ১৭০ টির মধ্যে ১২৫টি। এই রিপোর্ট সংসদে পেশ করা হয়। তারপরও 'ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য ঝুঁকির পর্যায়েও গোলাবারুদ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। এছাড়াও, গোটা গোলাবারুদের শতকরা ৫০ ভাগ হ'ল "গুরুতর"- এমনকি ১০ দিনের যুদ্ধের জন্য অপর্যাপ্ত বলে রিপোর্টে বলা হয়েছিল। এখন সে পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। এখন ১০ দিন লড়াইয়ের রসদ মজুদ করে রাখার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। একবার এই লক্ষ্য অর্জন করা হলে, মন্ত্রক ক্ষমতা আরও বাড়ানোর চেষ্টা হবে। তিনটি বাহিনী ও সেনাবাহিনী কমান্ডারদের ভাইস-প্রেসিডেন্টদের জন্য আর্থিক ক্ষমতা প্রদান করায় ক্রয় প্রক্রিয়া আরও সুগম হয়েছে। এমওডিকে ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা ধীর পদক্ষেপকে বদলে দিতে এটা একটা ঐতিহ্যসিক পদক্ষেপ।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো প্রতিরক্ষা খাতে প্রতক্ষ্য বিদেশী বিনিয়োগের পথ প্রসস্থ করা। বিষয় ভিত্তিক ভাবে ৪৯ শতাংশ থেকে শুরু করে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত এফডিআইয়ের পথ প্রসস্থ হয়েছে।
স্টেট অফ দ্য আর্ট টেকনোলজিকে আরও আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে বদলানো হয়েছে। এর ফলে প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগকারী সংস্থার সংখ্যা দেশে বাড়বে। রসদ বৃদ্ধি থেকে শুরু করে আধুনিকীকরণের পাশাপাশি সেনাদের জন্য এক পদ এক পেনশন চালুর যে দাবি ৪০ বছর ধরে ছিল তারও সমাধা হয়েছে এই মোদী সরকারের আমলেই। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মী ও আধিকারিকের প্রাপ্য সম্মান দিতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখিয়েছে এই সরকার।
অনিচ্ছা ও আগ্রহহীনতার ইতিহাসকে পিছনে ফেলে এগোতে চাইছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। চাইছে ভারতের সারভৌমত্ব ও অখন্ডতাকে সুরক্ষিত রাখতে সর্বদা তৈরি থাকতে।
(নীতিন আনন্ত গোখলে একজন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ, লেখক ও সংবাদ মাধ্যমেরে প্রশিক্ষক। খবরের কাগজ, টিভি ও ওয়েবসাইটে ৩২ বছর সাংবাদিকতার পর তিনি নিজে এখন BharatShakti.in নামক একটি প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত ওয়েবসাইট চালান। তাছাড়া জাতীয় সুরক্ষা নিয়ে নানা জায়গায় বক্তব্য রাখেন।)
এটি লেখকের নিজস্ব মত। এর সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী ওয়েবসাইটের বা নরেন্দ্র মোদী অ্যাপের মত নাও মিলতে পারে।