কয়েক দিন আগেই আমরা হারিয়েছি প্রফেসর এম এস স্বামীনাথনকে। চলে গেলেন এমন একজন, যিনি কৃষি বিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটিয়েছেন, দেশের বিকাশে যাঁর অবদান সব সময়ে লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। দেশপ্রেমিক প্রফেসর এম এস স্বামীনাথন চাইতেন ভারতের মানুষ, বিশেষত কৃষকরা সমৃদ্ধ জীবনযাপন করুন। লেখাপড়ায় কৃতি এই বিজ্ঞানী অন্য পেশাকেও বেছে নিতেই পারতেন। কিন্তু বাংলায় ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ তাঁকে এতটাই প্রভাবিত করে যে তিনি ঠিক করে ফেলেন কাজ করবেন কৃষিক্ষেত্র নিয়েই।
বেশ অল্প বয়সে তিনি ডঃ নরম্যান বোরলগের সংস্পর্শে আসেন। বিশদে ডঃ বোরলগের কাজকর্ম প্রত্যক্ষ করেন তিনি। ১৯৫০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষকতার কাজ পেয়েও ছেড়ে দেন ডঃ স্বামীনাথন। কারণ তিনি ভারতেই থেকে ভারতের জন্য কাজ করতে চাইছিলেন।
চরম সংকটের মধ্যে থাকা দেশকে তিনি যেভাবে স্বনির্ভরতা এবং প্রত্যয়ের দিশায় এগিয়ে নিয়ে গেছেন তা একবার ভেবে দেখুন। স্বাধীনতার পর প্রথম দুই দশক দেশের সামনে থাকা বড় সমস্যাগুলির মধ্যে ছিল খাদ্য ঘাটতি। ১৯৬০-এর দশকের প্রথম দিকে দুর্ভিক্ষের করাল ভ্রুকুটির মুখোমুখি হয় দেশ। ঠিক তখনই প্রফেসর স্বামীনাথনের দৃঢ় প্রত্যয়, দায়বদ্ধতা এবং দূরদর্শিতা দেশকে কৃষিক্ষেত্রে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার অনন্য অধ্যায়ের সূচনা করে। তাঁর নেতৃস্থানীয় ভূমিকা সামগ্রিকভাবে কৃষিক্ষেত্র, বিশেষত গম উৎপাদনের প্রশ্নে দেশকে দারুনভাবে সফল করে তোলে। খাদ্য ঘাটতির দেশ থেকে এক্ষেত্রে স্বনির্ভর দেশ হয়ে ওঠে ভারত। স্বাভাবিকভাবেই “ভারতীয় সবুজ বিপ্লবের জনক” বলে চিহ্নিত হন ডঃ স্বামীনাথন।
সবুজ বিপ্লব ভারতের “সফল হবই” মনোভাবকে তুলে ধরে- অর্থাৎ সামনে যদি কোটি কোটি সমস্যা এসে উপস্থিত হয়, তবে তার মোকাবিলার জন্য আমাদের কাছেও রয়েছে উদ্ভাবনী শক্তিতে প্রজ্বলিত মনন। সবুজ বিপ্লব শুরু হওয়ার ৫ দশক পর ভারতীয় কৃষি আরও আধুনিক ও প্রগতিশীল হয়ে উঠেছে। তবে এর মূল ভিত্তি গড়ে দিয়ে গেছেন প্রফেসর স্বামীনাথন- একথা কখনই ভোলার নয়।
বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি আলু চাষে পরজীবী প্রজাতির নেতিবাচক প্রভাবজনিত সমস্যা নিয়ে গবেষণা করেন। তার ফলে ঠাণ্ডা আবহাওয়াতেও আলু চাষের পথ খুলে যায়। আজ সারা বিশ্ব মিলেট বা শ্রী অন্নকে সুপার ফুড হিসেবে দেখছে। কিন্তু এনিয়ে গবেষণা ও আলোচনার প্রসারে প্রফেসর স্বামীনাথন উৎসাহ দিয়ে গেছেন সেই ১৯৯০ –এর দশক থেকেই।
প্রফেসর স্বামীনাথনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগযোগ বহুদিনের। ২০০১–এ আমি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সময় থেকেই তার সূচনা। ওই সময়ে কৃষিক্ষেত্রে গুজরাট অগ্রবর্তী রাজ্য হিসেবে তেমন পরিচিত ছিল না। একের পর এক খরা, সুপার সাইক্লোন এবং একটি বিধ্বংসী ভূমিকম্প রাজ্যটির বিকাশের পথে প্রশ্ন চিহ্ন এঁকে দিয়েছিল। পরিস্থিতির মোকাবিলায় আমরা যেসব উদ্যোগ নিই তার মধ্যে একটি ছিল সয়েল হেল্থ কার্ড- যা মাটির চরিত্র আরও ভালোভাবে বোঝা এবং কোনো সমস্যা এলে আরও ভালোভাবে তার মোকাবিলা করার পক্ষে সহায়ক। ওই সময়ে প্রফেসর স্বামীনাথনের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি উল্লিখিত প্রকল্পটির প্রশংসা করেন এবং মূল্যবান মতামত দেন। ডঃ স্বামীনাথনের এই প্রশংসা প্রকল্পটি সম্পর্কে সন্দিহানদের মুখ বন্ধ করে। কৃষিক্ষেত্রে গুজরাটের সাফল্যের ভিত তৈরি হয়।
আমি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন এবং প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেও প্রফেসর স্বামীনাথনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। ২০১৬-য় আন্তর্জাতিক কৃষি-জীববৈচিত্র্য কংগ্রেসে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়। ২০১৭-য় দুটি খণ্ডে তাঁর লেখা নিয়ে একটি বই প্রকাশ করি আমি।
তামিল ধ্রুপদী সাহিত্য ‘কুরাল’ বলে কৃষকরা বিশ্বের ধারক, কারণ তাঁরা রয়েছেন সর্বত্র। প্রফেসর স্বামীনাথন এই নীতিতে বিশ্বাস করতেন। অনেকে তাঁকে “কৃষি বৈজ্ঞানিক” বলে থাকেন। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি তিনি ছিলেন আরও বেশি কিছু- “কিষাণ বৈজ্ঞানিক”। তাঁর মনন এবং চিন্তনে ছিল কৃষিজীবির অস্তিত্ব। ডঃ স্বামীনাথনের সাফল্য অবশ্যই লেখাপড়ার জগতে সীমাবদ্ধ নয়। তার প্রভাব পরিব্যাপ্ত পরীক্ষাগার পেরিয়ে- খেতে খামারে। তিনি বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং তার বাস্তব প্রয়োগের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে এনেছিলেন। ক্রমাগত তিনি ধারাবাহিক কৃষির ওপর জোর দিয়ে গেছেন- যা তুলে ধরে মানুষের অগ্রগতি এবং বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে ভারসাম্যকে। ক্ষুদ্র কৃষকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং উদ্ভাবনার সুফল তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজে প্রফেসর স্বামীনাথন যে অগ্রাধিকার দিয়েছেন তার কথা উল্লেখ করতেই হয়। মহিলা কৃষিজীবীদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের প্রশ্নে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে গেছেন তিনি।
প্রফেসর স্বামীনাথনের ব্যক্তিত্বের আরেকটি দিক বিশেষভাবে উল্লেখ্য। তিনি উদ্ভাবনা এবং পরামর্শ ও উৎসাহদানের প্রশ্নে ছিলেন ক্লান্তিহীন। ১৯৮৭ সালে বিশ্ব খাদ্য পুরস্কারের প্রথম প্রাপক হিসেবে পাওয়া অর্থ তিনি একটি অলাভজনক গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরির কাজে লাগান। আজও ওই প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করে চলেছে। একের পর এক প্রতিভাবানকে তিনি আরও শেখা এবং নতুন কিছু করে দেখানোয় উৎসাহিত করে গেছেন অক্লান্তভাবে। প্রতিষ্ঠান নির্মাতা হিসেবেও তাঁর অবদান ভোলার নয়। বহু উল্লেখযোগ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পেছনে তাঁর অবদান রয়েছে। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। ২০১৮-য় বারাণসীতে তৈরি হয় ওই প্রতিষ্ঠানের দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক কেন্দ্র।
ডঃ স্বামীনাথনের প্রতি শ্রদ্ধার অর্ঘ নিবেদনে আমি আবার “কুরাল”-এর শরণাপন্ন হতে চাই। সেখানে লেখা আছে “যাঁরা পরিকল্পনা করেন, তাঁরা যদি স্থিত প্রজ্ঞ হন তবে তাঁরা কাঙ্খিত উপায়ে কাঙ্খিত ফল লাভ করবেন।” ডঃ স্বামীনাথন প্রথম জীবনেই কৃষি এবং কৃষকদের জন্য কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেকাজ তিনি করেছেন অনন্য উদ্ভাবনী শক্তি এবং ভালোবাসার সঙ্গে। কৃষিক্ষেত্রে উদ্ভাবনা ও ধারাবাহিকতার দিশায় এগোতে তিনি আমাদের সামনে আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবেন। যে নীতিতে তিনি বিশ্বাস করতেন তার প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হবে আমাদের। কৃষকদের কল্যাণে ব্রতী হওয়া, বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনার সুফল কৃষি জগতের তৃণমূল স্তরে পৌঁছে দেওয়া, ধারাবাহিক বিকাশের প্রশ্নে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া এবং আগামী প্রজন্মের সমৃদ্ধি নিশ্চিত করায় সচেষ্ট থাকলে তবেই তা সম্ভব।