ফিজির প্রধানমন্ত্রী,
ইতালির প্রধানমন্ত্রী,
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী,
ভদ্র মহোদয়/মহোদয়াগণ,
সরকার পক্ষের অংশগ্রহণকারী,
আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান,
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞগণ।
বিপর্যয় প্রতিরোধী পরিকাঠামো সংক্রান্ত জোটের (সিডিআরআই) বার্ষিক সম্মেলনের তৃতীয় সংস্করণ এক অভূতপূর্ব সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমরা এমন এক সময়ের মধ্য দিয়ে চলেছি, যা শতাব্দীতে একবারই ঘটে এবং তা হ’ল কোভিড-১৯ মহামারী। এই মহামারী আমাদের শিখিয়েছে যে, পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল এবং সম্পর্কযুক্ত এই বিশ্বে কোনও দেশ – ধনী বা দরিদ্র, পূর্ব বা পশ্চিম অথবা উত্তর ও দক্ষিণ বিশ্বব্যাপী বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। খ্রীস্টের জন্মের ২০০ বছর আগে প্রখ্যাত ভারতীয় পন্ডিত নাগার্জুন লিখেছিলেন, পরস্পরের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। তিনি দেখিয়েছিলেন, মানবজাতি সহ সমস্ত কিছুর মধ্যেই পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। তাই, আমরা যদি প্রাচীণ জ্ঞান গভীরভাবে অনুভব করি, তা হলে আমরা আমাদের বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থার অবক্ষয় হ্রাস করতে পারবো। একদিকে মহামারী আমাদের দেখিয়েছে, সমগ্র বিশ্বে তার প্রভাব কত দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। অন্যদিকে, এই মহামারী এটাও দেখিয়ে দিয়েছে যে, সমগ্র বিশ্ব এক অভিন্ন সঙ্কট মোকাবিলায় সক্ষম। আমরা দেখেছি, কিভাবে মানুষের বিচক্ষণতা ও সৃজনশীলতা সবচেয়ে জটিল সমস্যাগুলির সমাধান খুঁজে পেয়েছে। আমরা রেকর্ড সময়ের মধ্যে টিকা উদ্ভাবন করেছি। এই মহামারী আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে যে, বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলায় উদ্ভাবন বিশ্বের যে কোনও জায়গা থেকেই হতে পারে। আমাদের এমন এক অনুকূল বিশ্ব পরিবেশ গড়ে তোলা প্রয়োজন, যা এই গ্রহের সর্বত্রই উদ্ভাবনের সহায়ক হবে এবং উদ্ভাবনের পরিণাম সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এমন জায়গাগুলিতে সহজেই স্থানান্তরিত করা যাবে।
চলতি ২০২১ সালটিকে মহামারী থেকে মুক্তির বছর হিসাবে দেখা হচ্ছে। এই মহামারী থেকে আমরা যে শিক্ষা পেয়েছি, তা কখনই ভোলার নয়। আমাদের অর্জিত এই শিক্ষা কেবল জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে নয়, বরং অন্যান্য যে কোনও ধরনের বিপর্যয়ের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। আমাদের সামনে এক অস্পষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্কট। রাষ্ট্রসংঘের পরিবেশ সংক্রান্ত বিভাগের প্রধান সম্প্রতি বলেছেন, জলবায়ু সঙ্কট মোকাবিলায় টিকার মতো কোনও উপশম নেই। এই সঙ্কট মোকাবিলায় প্রয়োজন, ধারাবাহিকভাবে আন্তরিক প্রয়াস গ্রহণের। আমাদের সেই সমস্ত পরিবর্তনগুলিকে গ্রহণ করতে হবে, যেগুলি পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং সেগুলির প্রভাব বিশ্ববাসীর ওপর পড়ছে। এই প্রেক্ষিতে বিপর্যয় প্রতিরোধী জোটের গুরুত্ব আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই, আমরা যদি বিপর্যয় প্রতিরোধী পরিকাঠামো গড়ে তুলতে বিনিয়োগ করি, তা হলে তা হয়ে উঠবে আমাদের সামগ্রিক প্রয়াসের মূল কেন্দ্র। ভারতের মতো যে সমস্ত দেশ পরিকাঠামো খাতে বিপুল বিনিয়োগ করে থাকে, তাদের এটা সুনিশ্চিত করতে হবে যে, বিপর্যয় প্রতিরোধী পরিকাঠামোর ক্ষেত্রেও সমান বিনিয়োগের প্রয়োজন, যাতে ঝুঁকি এড়ানো যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে যে সমস্ত ঘটনা ঘটেছে, তা কেবল উন্নয়নশীল দেশের সমস্যা নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে গত মাসে তীব্র শৈত্য প্রবাহ ‘উরি’র ফলে এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্পূর্ণ ব্যহত হয়ে পড়ে। এমনকি, ৩০ লক্ষেরও বেশি মানুষের বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন হয়। এ ধরনের ঘটনা বিশ্বের অন্যত্রও ঘটতে পারে। যদিও টেক্সাসের বিশাল এলাকা জুড়ে বিদ্যুৎহীন বা ব্ল্যাকআউট হয়ে যাওয়ার ঘটনা এখনও অজানা। তাই, আমাদের এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।
ডিজিটাল পরিকাঠামো, জাহাজ পরিবহণ এবং বিমান চলাচলের নেটওয়ার্কের মতো বিভিন্ন পরিকাঠামো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছে। তাই, বিশ্বের কোনও একটি অংশে বিপর্যয়ের প্রভাব অপর প্রান্তেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রেক্ষিতে, বিশ্ব ব্যবস্থার বিপর্যয় প্রতিরোধী ক্ষমতা সুনিশ্চিত করতে সহযোগিতার প্রয়োজন। দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে পরিকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে। এই পরিকাঠামোকে আমরা যদি বিপর্যয় প্রতিরোধী হিসাবে গড়ে তুলতে পারি, তা হলে আমরা কেবল আমাদের জন্যই নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও অনেক্ বিপর্যয় প্রতিরোধ করতে পারবো। যখন একটি সেতু ভেঙ্গে পড়ে, টেলিযোগাযোগের টাওয়ার ভেঙ্গে পড়ে, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়, অথবা একটি বিদ্যালয় যখন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন তার প্রভাব সমগ্র ব্যবস্থার ওপর পড়ে। ঠিক একইভাবে, পরোক্ষ লোকসানের কারণে ছোট ব্যবসা বন্ধ হওয়া এবং শিশুদের বিদ্যালয়ে পঠন-পাঠন বিঘ্নিত হওয়ার মতো ঘটনার সামগ্রিক প্রভাব অনেক বেশি ও নিবিড়। এই কারণেই আমাদের পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন ও আত্মবিশ্লেষণ প্রয়োজন। আমরা যদি আমাদের পরিকাঠামোকে আরও বেশি বিপর্যয় সংবেদনশীল করে তুলতে পারি, তা হলে আমরা নিঃসন্দেহে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অপচয় হ্রাস করে আরও বেশি মানুষের জীবন সুরক্ষিত করতে পারবো।
সিডিআরআই – এর প্রতিষ্ঠার বছরগুলিতে ব্রিটেন এই জোটের দায়িত্ব পালন করায় আমরা কৃতজ্ঞ। ২০২১ সাল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। আমরা সুস্থায়ী উন্নয়নের উদ্দেশ্য পূরণ, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি এবং সেন্ডাই ফ্রেমওয়ার্ক সংক্রান্ত দায়বদ্ধতাগুলি পূরণের মধ্যবর্তী পর্যায়ে পৌঁছতে চলেছি। চলতি বছরের শেষদিকে ব্রিটেন ও ইতালিতে আয়োজিত হতে চলা কপ-২৬ থেকে আমাদের অনেক প্রত্যাশা রয়েছে।
সুস্থায়ী উন্নয়নের উদ্দেশ্য পূরণ, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি এবং সেন্ডাই ফ্রেমওয়ার্ক সংক্রান্ত দায়বদ্ধতাগুলি পূরণে সিডিআরআই অংশীদারিত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, বিশেষ করে, বিপর্যয় প্রতিরোধী পরিকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে। এই প্রেক্ষিতে আমি কয়েকটি বিষয়ে আমার চিন্তাভাবনা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। প্রথমত, সিডিআরআই জোটভুক্ত দেশগুলি অতি অবশ্যই সুস্থায়ী উন্নয়নমূলক উদ্দেশ্যগুলি পূরণের বিষয়টিকে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখবে। সহজ কথায় এর অর্থ হ’ল – কোনও দেশই যেন এই উদ্দেশ্যগুলি পূরণের ক্ষেত্রে বাদ না পড়ে। অন্যভাবে ব্যাখ্যা করতে গেলে বলতে হয়, আমাদের সবচেয়ে অসুরক্ষিত দেশ ও মানুষের উদ্বেগগুলিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এই প্রেক্ষিতে যে সমস্ত ক্ষুদ্র উন্নয়নশীল দ্বীপরাষ্ট্র চরম প্রতিকূল বিপর্যয়ের মুখোমুখী হচ্ছে, তাদের প্রযুক্তি ও জ্ঞান আদান-প্রদান করা। আমাদেরকে স্থানীয় পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক স্তরের সেরা সমাধানসূত্রগুলির সদ্ব্যবহার ও প্রয়োগের সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। একইসঙ্গে, আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ক্ষেত্রে অগ্রগতিও পর্যালোচনা করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে – স্বাস্থ্য ও ডিজিটাল পরিকাঠামো। উল্লেখ করা প্রয়োজন, স্বাস্থ্য ও ডিজিটাল পরিকাঠামো মহামারীর সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আমরা এই দুটি ক্ষেত্র থেকে কি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তাও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। এমনকি, এই দুটি ক্ষেত্রকে কিভাবে আমরা ভবিষ্যতে বিপর্যয় প্রতিরোধের কাজে ব্যবহার করতে পারি, তাও খুঁজে বের করতে হবে। জাতীয় ও আঞ্চলিক স্তরে আমাদের সুসংবদ্ধ পরিকল্পনা, কাঠামোগত নক্শা প্রণয়ন, আধুনিক সরঞ্জামের যোগান সহ পরিকাঠামো ক্ষেত্রে সুদক্ষ মানবসম্পদের সংস্থান করতে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। এই ক্ষেত্রগুলিতে গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগের সমান প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তৃতীয়ত, বিপর্যয় প্রতিরোধী পরিকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কোনও প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাকেই মৌলিক বা আধুনিক পদ্ধতি হিসাবে গণ্য করা চলবে না। সিডিআরআই জোটভুক্ত দেশগুলিকে প্রযুক্তির প্রয়োগ আরও বাড়াতে হবে। আমরা গুজরাটে ভারতের প্রথম আইসোলেশন টেকনিক-ভিত্তিক হাসপাতাল গড়ে তুলেছি। এখন ভূমিকম্প থেকে সুরক্ষার জন্য আমরা ভারতেই বেস আইসোলেটর তৈরি করছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের সামনে অনেক সুযোগ রয়েছে। আমাদেরকে ভূ-আঞ্চলিক প্রযুক্তি, মহাকাশ-ভিত্তিক সক্ষমতা, ডেটা সায়েন্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রভৃতির পূর্ণ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। সেই সঙ্গে, এগুলিকে স্থানীয় পরিস্থিতি অনুযায়ী উপযোগী করে তূলে বিপর্যয় প্রতিরোধে কাজে লাগাতে হবে। চতুর্থত, বিপর্যয় প্রতিরোধী পরিকাঠামোর ধারণাকে গণআন্দোলনে পরিণত করতে হবে, যাতে কেবল বিশেষজ্ঞরাই নন, সাধারণ মানুষ এমনকি যুবসম্প্রদায়কেও এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে তোলা যায়। বিপর্যয় প্রতিরোধী পরিকাঠামো গড়ে তোলার সামাজিক চাহিদা বিপর্যয়ের ঝুঁকি হ্রাস করার ক্ষেত্রেও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা নেবে। অবশ্য, এ বিষয়ে জনসাধারণের সচেতনতা ও শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয়ভাবে উদ্ভূত বিভিন্ন ঝুঁকি ও পরিকাঠামোর ওপর তার প্রভাব সম্পর্কে আমাদের উপযুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
পরিশেষে আমি বলতে চাই, সিডিআরআই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি বিষয় নিয়ে কাজ করার লক্ষ্য স্থির করেছে। খুব শীঘ্রই এর ফল পাওয়া যাবে। পরবর্তী ঘূর্ণিঝড়, পরবর্তী বন্যা, পরবর্তী ভূকম্পের সময় আমরা একথা অবশ্যই বলতে পারবো যে, এখন আমাদের পরিকাঠামো ব্যবস্থা অনেক বেশি মজবুত ও ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করতেও সক্ষম। অবশ্য, নিতান্তই ক্ষয়ক্ষতি হলে আমরা দ্রুততার সঙ্গে বিভিন্ন পরিষেবা পুনর্বহাল করতে পারবো এবং তার প্রভাব মোকাবিলায় সক্ষম হয়ে উঠবো। বিপর্যয় প্রতিরোধী পরিকাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমাদের সমস্ত প্রয়াসে আমরা সকলেই একসঙ্গে অগ্রসর হবো। বর্তমান মহামারী আমাদের এই শিক্ষা দিয়েছে যে, সকলে নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত কেউই সুরক্ষিত নন। তাই আমাদের সুনিশ্চিত করতে হবে যে, কোনও শ্রেণীর মানুষ, কোনও জায়গা এবং কোনও অর্থ ব্যবস্থাই যেন সুরক্ষা কবচের আওতার বাইরে না থাকে। ঠিক যেভাবে আমরা মহামারীর সময় বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষের সুরক্ষার জন্য লড়াই চালিয়ে এসেছি। বিপর্যয় প্রতিরোধী পরিকাঠামো গড়ে তোলার সময় আমাদের বিশ্বের প্রতিটি মানুষের কথা বিবেচনায় রাখতে হবে।
আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।