আমার প্রিয় দেশবাসী, নমস্কার!
আজ দেশ আবারও করোনার বিরুদ্ধে বিরাট লড়াই করছে। কয়েক সপ্তাহ আগে পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল, কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ঝড়ের গতিতে আঘাত করেছে। যে যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে আপনারা গিয়েছেন এবং এখনও যাচ্ছেন তা আমি জানি। যাঁরা গত কয়েকদিনে নিজের প্রিয়জনদের হারিয়েছেন, আমি দেশবাসীর তরফে তাঁদের আন্তরিক সমবেদনা জানাই। পরিবারের সদস্য হিসেবে আমি এই দুঃখের সময়ে আপনাদের সঙ্গে আছি। সমস্যা অনেক বড়, কিন্তু আমাদের দৃঢ় সংকল্প, সাহস এবং প্রস্তুতি নিয়ে সম্মিলিতভাবে একে পরাস্ত করতে হবে।
বন্ধুরা,
আমি নিজের বক্তব্য রাখার আগে দেশের সমস্ত চিকিৎসক, চিকিৎসা কর্মী, প্যারা মেডিকেল কর্মী, আমাদের সমস্ত সাফাই কর্মী ভাইবোনেরা, অ্যাম্বুলেন্সের চালক, সুরক্ষা বাহিনী- পুলিশকর্মী, সবার প্রশংসা করব। আপনারা করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময়েও নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জনসাধারণের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। এখন আবার এই সঙ্কটের সময়ে, আপনারা নিজেদের পরিবার, নিজেদের সুখ, নিজেদের চিন্তা ভুলে অন্যের প্রাণ বাঁচাতে দিনরাত কাজ করে চলেছেন।
বন্ধুরা,
আমাদের শাস্ত্রে বলা হয়েছে- ‘ত্যাজ্যম ন ধৈর্য্যম, বিধুরেপি কালে’। অর্থাৎ, কঠিন থেকে কঠিন সময়েও আমাদের ধৈর্য্য হারানো উচিত নয়। যে কোনও পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে আমাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সঠিক দিকে প্রচেষ্টা করতে হবে, তখনই আমরা এর বিরুদ্ধে জয় হাসিল করতে পারব। এই মন্ত্র সামনে রেখেই ভারত দিনরাত কাজ করে চলেছে। গত কয়েকদিনে যে সিদ্ধান্তগুলি নেওয়া হয়েছে, যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা দ্রুতগতিতে পরিস্থিতির উন্নতি করতে সাহায্য করবে। এবার করোনা সঙ্কটে দেশের অনেক অঞ্চলে অক্সিজেনের চাহিদা অনেক বেড়েছে। এই চাহিদা মেটাতে তৎপরতা এবং সংবেদনশীলতার সঙ্গে কাজ করা হচ্ছে। কেন্দ্র সরকার, রাজ্য সরকার, বেসরকারী ক্ষেত্র অক্সিজেনের প্রয়োজন রয়েছে এমন প্রতিটি ব্যক্তির কাছে অক্সিজেন পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছে। বিভিন্ন পর্যায়ে অক্সিজেনের উৎপাদন এবং সরবরাহ বৃদ্ধি করতে প্রয়াস করা হচ্ছে। রাজ্যগুলিতে নতুন অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরি হোক, ১ লক্ষ নতুন অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দেওয়া হোক, শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহৃত অক্সিজেনকে চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবহার করাই হোক, অক্সিজেন রেল হোক, সমস্তরকম প্রয়াস করা হচ্ছে।
বন্ধুরা,
এবার করোনার কেস বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেশের ফার্মা সেক্টরগুলি ওষুধের উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়েছে। জানুয়ারী- ফেব্রুয়ারী তুলনায় দেশে এখন কয়েকগুন বেশি ওষুধের উৎপাদন হচ্ছে। এখন তা আরও বাড়ানো হচ্ছে। গতকালই আমার দেশের ফার্মা সেক্টরের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ ধরে আলোচনা হয়েছে। উৎপাদন বৃদ্ধি করতে বিভিন্ন পর্যায়ে ওষুধ কোম্পানীগুলির সাহায্য নেওয়া হচ্ছে। আমরা সৌভাগ্যবান যে আমাদের দেশের ফার্মা সেক্টর এতোটাই শক্তিশালী যা উন্নত এবং দ্রুত ওষুধ তৈরি করতে পারে। পাশাপাশি, হাসপাতালে শয্যার সংখ্যাও বাড়ানো হচ্ছে। চাহিদার কথা মাথায় রেখে বেশ কয়েকটি শহরে বিশেষ এবং বড় কোভিড হাসপাতাল তৈরি করা হচ্ছে।
বন্ধুরা,
গতবছর, যখন দেশে মাত্র কয়েকজন করোনা রোগী পাওয়া গেছিল, তখন থেকেই ভারতে করোনা ভাইরাসের প্রভাবী টিকা বানানোর কাজ শুরু হয়ে গেছিল। আমাদের বিজ্ঞানীরা দিনরাত পরীশ্রম করে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই টিকা নিয়ে এসেছেন। আজ ভারতের কাছে পৃথিবীর সবথেকে সস্তা টিকা রয়েছে। ভারতের কোল্ড চেন ব্যবস্থার অনুযায়ী টিকা আমাদের কাছে রয়েছে। এই প্রচেষ্টায় আমাদের বেসরকারী ক্ষেত্র উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং ব্যবসার ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করেছে। টিকাগুলি অনুমোদনের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণমূলক প্রক্রিয়ার ফাস্ট ট্র্যাকিং এবং সমস্ত বৈজ্ঞানিক এবং নিয়ন্ত্রক সাহায্যও দেওয়া হয়েছে। এই দলীয় প্রচেষ্টার ফলেই ভারত দুটি ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ টিকার মাধ্যমে বিশ্বের বৃহত্তম টিকাকরণ অভিযান শুরু করেছে। টিকাকরণ অভিযানের প্রথম পর্ব থেকেই এই টিকা যাতে সর্বাধিক অঞ্চলে এবং যাঁদের সবথেকে প্রয়োজন তাঁদের কাছে পৌঁছে যায় তাঁর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ভারত বিশ্বের প্রথম দেশ যেখানে সবচেয়ে কম সময়ে প্রথমে ১০ কোটি , তারপর ১১ কোটি এবং এখন ১২ কোটি টিকার ডোজ দেওয়া হয়েছে। অত্যন্ত আশার কথা যে আমাদের স্বাস্থ্যকর্মী, ফ্রন্টলাইন করোনা যোদ্ধা এবং প্রবীণ নাগরিকদের মধ্যে একটি বিরাট অংশের টিকাকরণ হয়ে গেছে।
বন্ধুরা,
গতকালই টিকাকরণ নিয়ে আমরা আরও একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ১লা মে থেকে, ১৮ বছরের থেকে বেশি বয়সের যে কোনও ব্যক্তি টিকা নিতে পারবেন। এবার থেকে, ভারতে যে টিকা তৈরি হবে, তাঁর অর্ধেক ভাগ সোজা রাজ্যগুলি এবং হাসপাতালগুলিও পাবে। এছাড়াও, দরিদ্র, প্রবীণ, নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত এবং ৪৫ বছরের বেশি বয়স্কদের জন্য কেন্দ্র সরকারের যে টিকাকরণ অভিযান চলছে, তাও সমানগতিতে জারি থাকবে। আগেরমতোই সরকারী হাসপাতালগুলিতে বিনামূল্যে টিকা পাওয়া যাবে যার লাভ যেমন আমি বললাম, দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারেরা পাবে।
বন্ধুরা,
একদিকে আমরা যেমন জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করছি, একইসঙ্গে অর্থনৈতিক কাজকর্ম এবং জীবিকা নির্বাহের ওপর যাতে এর কম থেকে কম প্রভাব পড়ে সেই চেষ্টাও করা হচ্ছে। এটাই আমাদের প্রচেষ্টা হওয়া উচিত। ১৮ বছরের ওপরের ব্যক্তিদের জন্যে টিকাকরণ খুলে দেওয়ার ফলে শহরগুলিতে আমাদের যে রোজগেরে জনসাধারণ রয়েছে, তাঁদের দ্রুতগতিতে টিকাকরণ সম্ভব হবে। রাজ্য এবং কেন্দ্র সরকারের চেষ্টায় শ্রমিকদেরও দ্রুত টিকাকরণ সম্ভব হবে। আমি রাজ্য সরকারগুলিকে অনুরোধ করব শ্রমিকদের আস্থা বাড়ানোর জন্যে, তাঁদের অনুরোধ করতে যেখানে রয়েছেন সেখানেই যেন থাকেন। রাজ্য সরকারদের এই ভরসা শ্রমিক এবং কর্মচারীদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করবে যে তাঁরা যেখানেই আছেন সেখানে থাকলেই কিছুদিনের মধ্যেই টিকাও পাবেন এবং তাঁদের কাজও বন্ধ হবেনা।
বন্ধুরা,
গতবারের পরিস্থিতি এবারের থেকে অনেকটাই আলাদা ছিল। তখন আমাদের কাছে এই বৈশ্বিক অতিমারির বিরুদ্ধে লড়াই করার বিশেষ চিকিৎসা পরিকাঠামো ছিলনা। আপনারা মনে করুন, দেশের কী অবস্থা ছিল! করোনা পরীক্ষা করার যথেষ্ট ল্যাবও ছিলনা, পিপিই কিটের উৎপাদন ছিলনা। আমাদের কাছে এই অসুখের চিকিৎসার কোনও বিশেষ জ্ঞানও ছিলনা। কিন্তু অনেক কম সময়ের মধ্যেই আমরা এই জিনিসগুলিতে উন্নতি করেছি। আজ আমাদের চিকিৎসকেরা করোনার চিকিৎসায় যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করেছেন। আজ আমাদের কাছে প্রচুর পিপিই কিট রয়েছে, ল্যাবের নেটওয়ার্ক হয়েছে এবং করোনা পরীক্ষার সুবিধাও বেড়েছে।
বন্ধুরা,
দেশ এতোদিন পর্যন্ত করোনার বিরুদ্ধে ধৈর্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে গিয়েছে। এর কৃতিত্ব সমস্ত দেশবাসীর। করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আপনার অনুশাসন ও ধৈর্য্যের জন্যেই দেশ আজ এখানে পৌঁছেছে। আমি নিশ্চিত যে আমরা জনগণের অংশগ্রহণের শক্তি দিয়ে করোনার এই ঝড়কেও পরাস্ত করতে সক্ষম হব। আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি যে প্রচুর মানুষ এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠান দরিদ্রদের সাহায্য করার জন্য দিনরাত কাজ করছে। ওষুধ সরবরাহ করা, বা খাবার বা থাকার ব্যবস্থা করা হোক না কেন, এই সমাজসেবীরা পুরো মনোযোগ সহকারে কাজ করে চলেছে। আমি তাঁদের সকলের সেবার ভাবনাকে প্রণাম জানাই এবং দেশবাসীদের কাছে আবেদন করছি, এই সঙ্কটের এই সময়ে যতটা সম্ভব এগিয়ে আসুন এবং দরিদ্রদের সাহায্য করুন। সমাজের এই প্রতিশ্রুতি দিয়েই আমরা এই যুদ্ধকে জয় করতে সক্ষম হব। আমি তরুণ বন্ধুদের কাছে অনুরোধ করছি এলাকা,পাড়া এবং অ্যাপার্টমেন্টগুলিতে ছোট ছোট কমিটি তৈরি করুন এবং অন্যদের কোভিড অনুশাসনের পালন করতে সহায়তা করুন। যদি আমরা এটি করতে পারি, তবে সরকারদের কন্টেন্টমেন্ট জোন তৈরি করার বা কার্ফু জারি করার প্রয়োজন পড়বে না, লকডাউনের তো প্রশ্নই ওঠে না। লকডাউনের কোনও প্রশ্নই আসে না। স্বচ্ছতা অভিযানের সময়, আমার শিশু বন্ধুরা দেশে সচেতনতা গড়ে তুলতে অনেক সাহায্য করেছিল। ছোটো- ছোটো শিশুরা পঞ্চম, সপ্তম এবং দশম শ্রেণি্র ছাত্ররা। তারা বাড়ির সদস্যদের বুঝিয়ে তাদের রাজি করিয়েছিল। তারা বড়দেরও স্বচ্ছতার বার্তা দিয়েছিল। আজ, আমি আমার শিশু বন্ধুদের আবার বিশেষ করে একটি কথা বলতে চাই। আমার ছোটো বন্ধুরা, ঘরে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করো যাতে পরিবারের সদস্যরা কাজ, বা কোনও কারণ ছাড়াই অযথা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে না যায়। আপনাদের প্রয়াস ভাল ফল আনতে পারে। আমি প্রচার মাধ্যমের কাছে অনুরোধ করব,এই সঙ্কটের সময়ে জনগণকে সজাগ ও সচেতন করতে যে প্রয়াস তাঁরা করছেন, তা আরও বিস্তারিত করতে হবে। একইসঙ্গে, তাদের এও নিশ্চিত করা উচিত যাতে আতঙ্কের কোনও পরিবেশ তৈরি না হয় এবং গুজব না ছড়ায়।
বন্ধুরা,
আজকের পরিস্থিতিতে আমাদের দেশকে লকডাউনের থেকে বাঁচাতে হবে। আমি রাজ্যদের কাছেও অনুরোধ করব তাঁরা যেনো লকডাউনকে সর্বশেষ বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করেন। লকডাউন থেকে বাঁচার সবরকম প্রচেষ্টা করতে হবে। এবং মাইক্রো কন্টেনমেন্ট জোনের ওপরেই বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। আমরা আমাদের অর্থব্যবস্থার উন্নতি করব এবং পাশাপাশি দেশবাসীর স্বাস্থ্যেরও খেয়াল রাখব।
বন্ধুরা,
আজ নবরাত্রীর শেষ দিন। কাল রামনবমী এবং মর্যাদা পুরুষোত্তম রামের আমাদের প্রতি বার্তা হলো, আমরা যেনো অনুশাসন পালন করি। করোনা থেকে বাঁচতে সমস্ত প্রোটোকল মেনে চলা উচিত। ওষুধও এবং অনুশাসনও, এই মন্ত্র ভুলে গেলে চলবে না। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র, টিকা নেওয়ার পরেও এটি গুরুত্বপূর্ণ। পবিত্র রমজান মাসের আজ সপ্তম দিন। রমজান আমাদের ধৈর্য্য, আত্মসংযম এবং অনুশাসনের শিক্ষা দেয়। করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে অনুশাসনেরও প্রয়োজন রয়েছে। প্রয়োজন হলে তবেই বাইরে বেরোবেন, কোভিড অনুশাসনের পালন করুন, আপনাদের কাছে আমার এটাই অনুরোধ। আমি আপনিদের আবারও একবার ভরসা দিতে চাই, আপনাদের এই সাহস, ধৈর্য্য এবং অনুশাসনের মাধ্যমে দেশ আজকের পরিস্থিতি পরিবর্তনের যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। আপনারা সকলে সুস্থ থাকুন, আপনাদের পরিবারের সকলে সুস্থ থাকুক, এই কামনার সঙ্গে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি। অনেক অনেক ধন্যবাদ!