এই ধরণের পরিচয়ের জন্য ধন্যবাদ চিকিৎসক ড্যান ইয়ারগিনকে। এখানে উপস্থিত সকল অতিথি, আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
নমস্কার!
আমি বিনয়ের সঙ্গে সেরাউইক (CERAWeek) গ্লোবাল এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করছি। আমি আমার এই মহান মাতৃভূমি, ভারতীয়দের উদ্দেশে এই পুরষ্কার উৎসর্গ করছি। আমি এই পুরস্কারটি আমাদের পৃথিবীর গৌরবময় ঐতিহ্যের উদ্দেশে উৎসর্গ করছি, যা আমাদের পরিবেশের প্রতি যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে পথ দেখিয়েছে।
বন্ধুগণ,
এই পুরস্কার পরিবেশগত নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে স্বীকৃতি দেয়। নেতৃত্ব সম্পর্কে সাধারণত বলা হয় যে, কর্মের মাধ্যমে পথ দেখানোর সর্বোত্তম উপায়। কোনো সন্দেহ নেই যে, যখন পরিবেশের প্রতি যত্ন নেওয়ার প্রসঙ্গ আসে তখন ভারতীয়রাই নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। বহু শতাব্দী ধরে এটাই চলে আসছে। আমাদের সংস্কৃতি, প্রকৃতি এবং বৈভব একে অপরের সঙ্গে জড়িত। আমাদের দেব, দেবীদের কথার সঙ্গে কোনো না কোনো গাছ এবং প্রাণী যুক্ত রয়েছে। এই গাছ এবং প্রাণীরা পবিত্র। আপনি যে কোনো দেশ থেকে যে কোনো ভাষার সাহিত্য বেছে নিতে পারেন। মানুষ এবং প্রকৃতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের অনেক উদাহরণ পাবেন।
বন্ধুগণ,
পরিবেশগত দিক থেকে মহাত্মা গান্ধী আমাদের মধ্যে আজীবন সর্বাগ্রে রয়েছেন। তাঁর দেখানো মানবতার পথ যদি আমরা অনুসরণ করি তাহলে আজ আমরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে, তা আর হবো না। আমি আপনাদের সকলকে গুজরাটের উপকূলীয় শহর পোর বন্দরে অবস্থিত মহাত্মা গান্ধীর বাড়িতে আসার জন্য অনুরোধ করছি। তাঁর বাড়ির চারপাশে আপনি জল সংরক্ষণ সম্পর্কে খুব ভালো হাতে কলমে শিক্ষা নিতে পারবেন। এখানে প্রায় ২০০ বছর পূর্বে ভূগর্ভস্থ জলাধারগুলি নির্মিত হয়েছে। এগুলি বৃষ্টির জল সংরক্ষণের জন্য তৈরি করা হয়েছিল।
বন্ধুগণ,
জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় আজ বড় সমস্যা। এই দুটি একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। এর বিরুদ্ধে লড়াই করার দুটি উপায় আছে। এগুলি হলো নীতি, আইন, বিধি এবং নির্দেশ। এগুলির নিজস্ব গুরুত্ব রয়েছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমি আপনাদের সঙ্গে কয়েকটি উদাহরণ ভাগ করে নিতে পারি : ভারতে জীবাশ্ম নয় এমন উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা এখন ৩৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ‘ভারত - ৬’ কার্বন নির্গমন সংক্রান্ত নিয়ম বিধি চালু করেছি। এই বিধি ইউরো – ৬ জ্বালানি নীতির সমান। ভারত ২০৩০ সালের মধ্যে প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনের ক্ষমতা ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। এলএনজি-কে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে উৎসাহ যোগানো হচ্ছে। আমরা সম্প্রতি একটি জাতীয় হাইড্রোজেন মিশনের সূচনা করেছি। হাইড্রোজেনকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য এই মিশন চালু করা হয়েছে। সম্প্রতি ‘পিএম কুসুম’ নামে একটি প্রকল্পের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এটি সৌর শক্তি উৎপাদন ক্ষেত্রে একটি ন্যায় সংগত এবং বিকেন্দ্রীভূত মডেল বিষয়ে প্রচার চালাবে। তবে, নীতি, আইন, বিধি এবং নির্দেশের বাইরেও কিছু বিষয় রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সবচেয়ে শক্তিশালী উপায় হলো আচরণগত পরিবর্তন। আপনারা অনেকেই শুনে থাকবেন একটি বিখ্যাত গল্পের কথা। একটি ছোট শিশুকে ছেঁড়া বিশ্বের মানচিত্র দেওয়া হয়।। কখনই এটি জোড়া যাবে না ভেবে শিশুটিকে যুক্ত করতে বলা হয়। কিন্তু শিশুটি সফল হয়। শিশুটি কিভাবে এটি করেছিল তা জানতে চাইলে উত্তরে শিশুটি জানায় ওই বিশ্ব মানচিত্রের পেছনেই একটি ব্যক্তির চিত্র ছিল। সে ওই লোকটির চিত্র একত্রিত করেছে, সে কারণে বিশ্বের মানচিত্র একত্রিত হয়ে গেছে। এই গল্পটি থেকে একটি বার্তাই পরিস্কার হয় – আসুন আমরা নিজেদেরকে ঠিক করি। তবেই বিশ্ব আরও উন্নতি লাভ করবে।
বন্ধুগণ,
আচরণ পরিবর্তনের এই চেতনা আমাদের ঐতিহ্যগত অভ্যাসের একটি অঙ্গ। যা আমাদের সহানুভূতির সঙ্গে ব্যবহার বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করে। নির্বোধের সংস্কৃতি আমাদের নীতির অংশ নয়। আমাদের কৃষি কাজের পদ্ধতি বা আমাদের খাদ্যাভ্যাসগুলি লক্ষ্য করুন। আমাদের গতিশীলতার ধরণগুলি বা শক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রগুলি দেখুন। আমি আমাদের কৃষকদের জন্য গর্বিত। তারা নিয়মিত সেচের আধুনিক কৌশল ব্যবহার করে চলেছেন। মাটির স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং কীটনাশকের ব্যবহার হ্রাস করার বিষয়ে ক্রমাগত সচেতনতার বার্তা ছড়িয়েছেন। আজ বিশ্ব সুস্থতা এবং সু-স্বাস্থ্যের দিকে মনোনিবেশ করেছে। স্বাস্থ্যকর এবং জৈব খাদ্যের জন্য ক্রমশই চাহিদা বাড়ছে। ভারত মশলা, আয়ুর্বেদ পণ্য এবং আরও অনেক কিছুর মাধ্যমে এই বিশ্বব্যাপী পরিবর্তনে চালনা শক্তি হতে পারে। একই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব ক্ষেত্রে গতি প্রদান করতে পারে। আপনি জেনে আনন্দিত হবেন যে ভারতে আমরা ২৭টি শহরে মেট্রো সংযোগ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কাজ করেছি।
বন্ধুগণ,
বৃহত্তর প্রেক্ষিতে আচরণ পরিবর্তনের জন্য আমাদের এমন সমাধানের পথ প্রস্তাব করতে হবে যা উদ্ভাবনী, সাশ্রয়ী এবং জনসাধারণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। আমি একটা উদাহরণ দিচ্ছি, ভারতীয়রা এমন এক মাত্রায় এলইডি বাল্ব জ্বালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যা আগে কখনো দেখা যায়নি। ২০২১ সালের পয়লা মার্চ পর্যন্ত দেশে ৩৭ মিলিয়ন এলইডি বাল্ব ব্যবহার করা হচ্ছে। এর ফলে অর্থ এবং শক্তি দুটোই সাশ্রয় হচ্ছে। এমনকি প্রতি বছর ৩৮ মিলিয়ন টনেরও বেশি কার্বনডাই অক্সাইড নিঃসরণ কম হচ্ছে। ভারতে ‘গিভ ইট আপ মুভমেন্ট’-এর আরও একটি উদাহরণ রয়েছে। দরিদ্র মানুষের সুবিধার্থে সাধারণ মানুষদের এলপিজি গ্যাসের ভর্তুকি ত্যাগ করার জন্য একটি সাধারণ অনুরোধ রয়েছে। ভারতে একাধিক ব্যক্তি স্বেচ্ছায় তাদের ভর্তুকি ত্যাগ করেছেন। এটি লক্ষ লক্ষ পরিবারকে ধোঁয়াহীন রান্নাঘর দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ২০১৪ সালে সারা দেশে যেখানে ৫০ শতাংশ মানুষ এলপিজি-র আওতাভুক্ত ছিলেন আজ তা বেড়ে ৯৯.৬ শতাংশ হয়েছে। মহিলারা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছেন। আজকাল আরও একটি ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। সম্পদের অপচয় হলে ভারতে গুঞ্জন তৈরি হচ্ছে। আমাদের নাগরিকরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুনর্ব্যবহার যোগ্য অনন্য মডেল নিয়ে আসছেন। এটি বৃত্তাকার অর্থনীতিতে উৎসাহ যোগাবে। সাশ্রয়ী পরিবহণ উদ্যোগ ক্ষেত্রে সুস্থায়ী বিকল্পের আওতায় আমাদের দেশে বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। ২০২৪ সালের মধ্যে ১৫ মিলিয়ন মেট্রিকটন জৈব গ্যাস উৎপাদনের লক্ষ্যে ৫,০০০টি কম্প্রেসড জৈব গ্যাসের কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এটি পরিবেশ এবং মানুষের ক্ষমতায়ণে সাহায্য করবে।
বন্ধুগণ,
ভারতে ইথানলের ক্রমশ গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ২০২৫ সালের মধ্যে পেট্রোলে ২০ শতাংশ ইথানল মিশ্রন করা হবে। আগে এই লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ সাল পর্যন্ত নেওয়া হয়েছিল।
বন্ধুগণ,
আপনাদের সকলকে জানাতে পেরে খুব অনন্দিত হব যে গত ৭ বছরে ভারতে বনভূমি অঞ্চল উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সিংহ, বাঘ, চিতাবাঘ এবং জলে পাখির সংখ্যা বেড়েছে। এগুলি ইতিবাচক আচরণগত পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ সূচক। এই পরিবর্তনগুলি আমাদের আশ্বস্ত করে যে ভারত ২০৩০ সালের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার আগে প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যগুলি সফলভাবে অর্জন করবে।
বন্ধুগণ,
পরিবেশগত রূপান্তরের জন্য সমমনোভাবাপন্ন দেশগুলির সঙ্গে ভারত একযোগে কাজ করতে চায়। আন্তর্জাতিক সৌর জোটের প্রাথমিক সাফল্য প্রমাণ করেছে যে আরও উন্নত পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য প্রচেষ্টা চালানোর ক্ষেত্রে ভারতের কতটা গুরুত্ব রয়েছে। ভবিষ্যতে আমরা এধরণের প্রয়াস চালিয়ে যাবো। এটি মহাত্মা গান্ধীর বিশ্বস্ততা নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশ্বস্ততার মূল বিষয় হলো সমষ্টি, দায়িত্ব এবং সমবেদনা। বিশ্বস্ততার অর্থ হলো সম্পদকে দায়িত্বের সঙ্গে ব্যবহার করা। মহাত্মা গান্ধী ঠিক বলেছিলেন : আমি উদ্ধৃতি তুলে ধরে বলছি “আমরা প্রকৃতির উপহারগুলি আমাদের ইচ্ছে মতো ব্যবহার করতে পারি, তেমনই প্রকৃতির বইয়ে নাম ও অ্যাকাউন্টগুলিও সর্বদা সম্পদের মতো হয়”। প্রকৃতির একটি সাধারণ ব্যালান্সশিট রয়েছে, অ্যাকাউন্টে যা পাওয়া যায় তা ব্যবহার বা খরচ করা যায়। তবে এটির অবশ্য যথাযথভাবে বিতরণ করা উচিত। কারণ যদি আমরা অতিরিক্ত সম্পদ ব্যবহার করি তবে তা অন্য কারোর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। একইভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারত এই কথাই বলে আসছে।
বন্ধুগণ,
যৌক্তিক উপায়ে এখন পরিবেশ নিয়ে চিন্তা করার সময় এসেছে। এটি আমার বা আপনার বিষয় নয়। এটি আমাদের পৃথিবীর ভবিষ্যতের বিষয়। আমরা আমাদের আগামী প্রজন্মের কাছে ঋণী। আমি এই পুরষ্কারের জন্য ফের আরও একবার আপনাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
নমস্কার।