আমার প্রিয় বন্ধু, প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিশন,
বন্ধুগণ,
নমস্কার !
সিডনি সংলাপের উদ্বোধনী পর্বে মূল ভাষণ দেওয়ার জন্য আপনারা আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, ভারতের জনসাধারণের জন্য এটি একটি বিরাট সম্মান, যা ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং ডিজিটাল জগতে উদীয়মান শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি বলে আমি মনে করি। আমাদের দুটি দেশের মধ্যে সর্বাঙ্গীন কৌশলগত অংশীদারিত্ব, এই অঞ্চলের শুভ শক্তি হিসেবে আপনাদের আমন্ত্রণকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ সাইবার প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় আমি সিডনি সংলাপকে অভিনন্দন জানাই।
বন্ধুগণ,
আমরা এমন একটি সময়ের মধ্যে রয়েছি যখন নানাধরণের পরিবর্তন হচ্ছে। ডিজিটাল যুগ আমাদের চারপাশের সবকিছুর পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজের নতুন সংজ্ঞা নির্ধারিত হচ্ছে। সার্বভৌমত্ব, প্রশাসন, নৈতিকতা, আইন, অধিকার এবং সুরক্ষার মতো বিষয়গুলিতে নতুন নতুন প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিযোগিতা, ক্ষমতা ও নেতৃত্বকে নতুনভাবে বিন্যস্ত করা হচ্ছে। প্রগতি এবং সমৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করার নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। কিন্তু একইসঙ্গে আমরা সমুদ্রতল থেকে সাইবার জগৎ এবং মহাকাশে নতুন নতুন ঝুঁকিরও সম্মুখীন হচ্ছি, নতুন নতুন সংঘাতের মুখোমুখি হচ্ছি। আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে প্রযুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এর সাহায্যে আগামীদিনে আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে। প্রযুক্তি এবং তথ্য নতুন হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। গণতন্ত্রের সবথেকে বড় শক্তি হল মুক্ত চিন্তা। একইসঙ্গে এই মুক্ত চিন্তার অপব্যবহার করে স্বার্থান্বেষীরা যাতে সফল হতে না পারে সেডিকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
বন্ধুগণ,
গণতন্ত্র এবং ডিজিটাল ক্ষেত্রে ভারত নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমাদের সমৃদ্ধি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে অংশীদারদের মধ্যে ভাগ করে নিতে ভারত প্রস্তুত। ভারতের ডিজিটাল বিপ্লবের মূলে রয়েছে আমাদের গণতন্ত্র, আমাদের জনবিন্যাস ও আমাদের অর্থনীতি। শিল্পোদ্যোগীদের শক্তি এবং আমাদের যুব সম্প্রদায়ের উদ্ভাবন ক্ষমতার সাহায্যে আমরা অতীতের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেছি, এর সাহায্যে আগামী দিনের পরিকল্পনা তৈরি করেছি। ভারতে ৫ রকমের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে। প্রথমত, আমরা বিশ্বে সবথেকে বড় জনসাধারণের জন্য তথ্য সংক্রান্ত পরিকাঠামো গড়ে তুলছি। ১৩০ কোটি ভারতবাসীর একটি অনন্য ডিজিটাল পরিচিতি রয়েছে। ব্রডব্যান্ডের সাহায্যে ৬০ লক্ষ গ্রামকে আমরা যুক্ত করছি। বিশ্বের সবথেকে দক্ষ লেনদেনের পরিকাঠামো- ইউপিআই ব্যবস্থাপনা আমরা তৈরি করেছি। ৮০ কোটির বেশি ভারতবাসী ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। ৭৫ কোটি মানুষের স্মার্ট ফোন আছে। মাথাপিছু তথ্য ব্যবহারকারী হিসেবে আমরা সবথেকে বেশি তথ্যকে কাজে লাগাই। বিশ্বে সবথেকে সস্তায় তথ্য পাই আমরাই। দ্বিতীয়ত প্রশাসন, সমন্বয়, ক্ষমতায়ণ, যোগাযোগ, বিভিন্ন সুবিধা লাভের জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা মানুষের জীবনে পরিবর্তন নিয়ে এসেছি। ভারতের আর্থিক সমন্বয়, ব্যাঙ্কিং ও ডিজিটাল লেনদেনে বিপ্লবের কথা সকলেই জানেন। সম্প্রতি আমরা প্রযুক্তির সাহায্যে ১১০ কোটি টিকার ডোজ দিয়েছি। আরোগ্যসেতু এবং কোউইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে বিশাল ভারতবর্ষে এই টিকাকরণের কাজটি হচ্ছে। আমরা জাতীয় ডিজিটাল স্বাস্থ্য মিশন নিয়ে কাজ করছি। আমাদের ১০০ কোটির বেশি মানুষকে কম পয়সায় সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যুক্ত করেছি। আমাদের এক দেশ, এক রেশন কার্ড লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে দেশের যেকোন জায়গায় তাদের বকেয়া খাদ্যশস্য সংগ্রহ করতে সাহায্য করছে। তৃতীয়ত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ও দ্রুত উন্নয়নশীল স্টার্টআপ ব্যবস্থাপনা ভারতে রয়েছে। কয়েক সপ্তাহ অন্তর নতুন ইউনিকর্ন তৈরি হচ্ছে। এরা স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জাতীয় নিরাপত্তা- সব ক্ষেত্রের নানা সমস্যার সমাধান করছে।
চতুর্থত ভারতের শিল্প ও পরিষেবা এবং কৃষিক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতিতে বিপুল পরিবর্তন হচ্ছে। স্বচ্ছ জ্বালানীর ব্যবহার বাড়ানো, সম্পদের উৎসের পরিবর্তন এবং জীব বৈচিত্র্য রক্ষার জন্য আমরা ডিজিটাল প্রযুক্তিকে ব্যবহার করছি। পঞ্চমত ভারতকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করার বিষয়ে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফাইভ-জি এবং সিক্স-জি’র মতো টেলিকম প্রযুক্তিতে দেশীয় ব্যবস্থাপনা প্রয়োগ করতে আমরা বিনিয়োগ করছি। কৃত্রিম মেধা এবং মেশিন লার্নিং-এ ভারত বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। কৃত্রিম মেধার মানব কেন্দ্রিক নৈতিক ব্যবহারের জন্য আমরা উদ্যোগী হয়েছি। ক্লাউড প্ল্যাটফর্ম এবং ক্লাউড কম্পিউটিং-এ আমরা দক্ষতা বাড়াচ্ছি।
প্রাণশক্তি এবং ডিজিটাল সার্বভৌমত্বের এগুলি চাবিকাঠি। কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এ আমরা আন্তর্জাতিক মানের দক্ষতা গড়ে তুলছি। আমাদের অর্থনীতি এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভারতের মহাকাশ কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভারতকে সাইবার নিরাপত্তার আন্তর্জাতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে আমরা একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছি। আন্তর্জাতিক স্তরে আমাদের দক্ষতা আস্থা অর্জন করার সুফল আমরা পাচ্ছি। এখন আমরা হার্ডওয়্যারের দিকে মনোনিবেশ করেছি। সেমিকন্ডাকটর উৎপাদনে প্রথম সারির দেশ হয়ে ওঠার জন্য আমরা উৎসাহ ভিত্তিক প্যাকেজ তৈরি করছি। ইতিমধ্যেই বৈদ্যুতিন এবং টেলিকম ক্ষেত্রে উৎসাহ ভিত্তিক উৎপাদন প্রকল্প শুরু হওয়ায় দেশী-বিদেশী সংস্থারা ভারতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হচ্ছে।
বন্ধুগণ,
আজ তথ্য হল প্রযুক্তির সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ফসল। তথ্য সংরক্ষণ, গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তার জন্য আমরা একটি বিরাট পরিকাঠামো গড়ে তুলেছি। একইসঙ্গে জনসাধারণের ক্ষমতায়ণের উৎস হিসেবে আমরা তথ্যকে ব্যবহার করছি। একটি গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় ব্যক্তি বিশেষের অধিকারকে সুনিশ্চিত করে তথ্য নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা ভারত ছাড়া আর কোনো দেশের নেই।
বন্ধুগণ,
একটি দেশ তার মূল্যবোধ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকে যুক্ত করার জন্য কিভাবে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে? ভারতের গণতান্ত্রিক রীতিনীতি প্রাচীন। আমাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠানগুলি শক্তিশালী। আর আমরা সবসময়ই বিশ্বাস করি সারা বিশ্ব আসলে একটিমাত্র পরিবার। ভারতের তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত মেধাশক্তি আন্তর্জাতিক স্তরে ডিজিটাল অর্থনীতি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। ওয়াইটুকে সমস্যার সমাধান করতে আমরা সাহায্য করেছি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পরিষেবা প্রদানে প্রযুক্তির প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করা হয়েছে। আজ আমরা আমাদের কোউইন প্ল্যাটফর্মকে সারা বিশ্বের কাছে বিনামূল্যে সরবরাহ করছি, এটি একটি ওপেন সোর্স সফ্টওয়্যার। প্রযুক্তি ব্যবহার করার বিপুল অভিজ্ঞতা ভারতের রয়েছে। জনসাধারণের মঙ্গলের জন্য নীতি গ্রহণ, সর্বাঙ্গীন উন্নয়ন এবং সামাজিক ক্ষমতায়ণ উন্নয়নশীল দেশগুলির পক্ষে সহায়ক। বিভিন্ন দেশের এবং জনসাধারণের ক্ষমতায়ণের জন্য আমরা একযোগে কাজ করতে পারি। এই শতাব্দীর সুযোগগুলি যাতে সকলে কাজে লাগাতে পারেন তার জন্য প্রস্তুত করতে পারি। এই বিশ্বের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। এর মধ্য দিয়ে আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিফলিত হয়। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা এবং সমৃদ্ধির জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বন্ধুগণ,
একসঙ্গে কাজ করা, গবেষণা ও ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির উদ্ভাবনে একসঙ্গে বিনিয়োগ করা, পারস্পরিক আস্থা যুক্ত উৎপাদন ব্যবস্থা ও সরবরাহ শৃঙ্খল গড়ে তোলা গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাইবার নিরাপত্তায় পরিচালনগত সহযোগিতা বাড়ানো, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রক্ষার পরিকাঠামো গড়ে তোলা, জনমতকে যারা বিভ্রান্ত করতে চায় তাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করা, প্রশাসনিক কাজে প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটানো, প্রশাসনিক কাজে তথ্য ব্যবহারের মানদন্ড তৈরি করা, সীমান্তের অন্য প্রান্ত থেকে সুরক্ষিত তথ্য পাওয়া নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একযোগে কাজ করতে হবে। জাতীয় অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং জনসাধারণের কল্যাণের দিকটি নিশ্চিত করতে হবে। যেমন ধরুন ক্রিপ্টো কারেন্সি বা বিট কয়েন। এই বিষয়ে সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একযোগে কাজ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খেয়াল রাখতে হবে এই ব্যবস্থা যাতে ভুল লোকের কাছে না গিয়ে পরে, যারা আমাদের যুব সম্প্রদায়ের ক্ষতি করবে।
বন্ধুগণ,
আমরা বাছাই করার এক ঐতিহাসিক মুহুর্তে দাঁড়িয়ে রয়েছি। আমাদের সময়কার প্রযুক্তির সুন্দর ক্ষমতাগুলি কিভাবে ব্যবহার করা হবে- সহযোগিতা না সংঘাত, বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ করা না নিজের ইচ্ছায় গ্রহণ করা, প্রতিপত্তি না উন্নয়ন, নির্যাতন না সুযোগ, এই বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এবং এই অঞ্চলের বাইরে আমাদের যেসব অংশীদাররা রয়েছেন তাদের সকলকে আমরা এই বিষয়ে আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা আমাদের দায়বদ্ধতা পালনে প্রস্তুত। বর্তমান সময়ের নিরিখে আমাদের অংশীদারিত্বকে একটি নির্দিষ্ট রূপ দিতে হবে, যার মধ্য দিয়ে আমাদের দেশ এবং বিশ্বের ভবিষ্যৎ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় এর জন্য সিডনি সংলাপ একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ হয়ে উঠবে বলে আমি আশাবাদী।
ধন্যবাদ।