জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে আয়োজিত নবম নিউজ ৯ আন্তর্জাতিক বৈঠকে আজ ভিডিও কনফারেন্সের মঞ্চে বক্তব্য রাখেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী। এই বৈঠককে ভারত-জার্মানি অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সংযোজন বলে মন্তব্য করেন তিনি। শ্রী মোদী বলেন, ভারতের এক সংবাদমাধ্যম গোষ্ঠী জার্মানির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার চেষ্টা করছে জেনে তিনি বিশেষভাবে আনন্দিত। বর্তমানের তথ্যযুগে জার্মানির নাগরিকদের সঙ্গেও ওই সংবাদমাধ্যমটি যোগাযোগ স্থাপন করছে। এর ফলে, জার্মানি এবং সেখানকার জনসাধারণ সম্পর্কে জানা ও বোঝার বিশেষ সুবিধা হবে ভারতীয় নাগরিকদের।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জার্মানির এফএইউ স্টুটগার্ট এবং বাডেন-রুটেমবার্গের সঙ্গে সহযোগিতায় এই বৈঠকের আয়োজক ভারতের টিভি ৯ চ্যানেলগোষ্ঠী। বৈঠকের বিষয় হল – ‘ভারত-জার্মানি : নিরন্তর উন্নয়নের লক্ষ্যে এক পথ নির্দেশিকা’। এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে ভারত ও জার্মানির মধ্যে এক দায়িত্বশীল সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি আরও বলেন যে গত দু’বছর ধরে বিভিন্ন বৈঠক ও সম্মেলনে যাঁরা অংশগ্রহণ করছেন, তাঁরা অর্থনৈতিক বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে ফলপ্রসূর আলোচনার কাজ সেরে ফেলার সাথে সাথে ক্রীড়া ও বিনোদন সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়কেও আলোচ্যসূচির মধ্যে স্থান দিয়েছেন। এর ফলশ্রুতিতে ভারত ও জার্মানির মধ্যে সহযোগিতার পরিধি আরও প্রসারিত হতে চলেছে। শ্রী মোদী তাঁর এদিনের ভাষণে বিশেষ জোর দিয়ে বলেন যে কৌশলগত দিক থেকে ইউরোপ এখন ভারতকে যথেষ্ট গুরুত্বের চোখে দেখছে। বিশেষত, ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেহেতু অন্যতম প্রধান অংশীদার হল ভারত, সেই কারণে এ সম্পর্কে চিন্তাভাবনার পরিসরও ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও, ২০২৪ বছরটি হল ভারত-জার্মানি কৌশলগত অংশীদারিত্বের ২৫তম বার্ষিকী যাকে নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক ঘটনা বলা চলে। জার্মানির চ্যান্সেলরের তৃতীয়বারের জন্য ভারত সফর এবং ১২ বছরের ব্যবধানে দিল্লিতে আয়োজিত জার্মানির বাণিজ্য প্রচেষ্টা সম্পর্কে এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় সম্মেলন নিঃসন্দেহে একটি তাৎপর্যময় ঘটনা। জার্মানি ইতিমধ্যেই ‘ফোকাস অন ইন্ডিয়া’ নামে একটি প্রামাণ্য নথিও প্রকাশ করেছে। সেখানে ভারতের জন্য দক্ষ শ্রম প্রকৌশল সম্পর্কিত একটি বিষয়ও স্থান পেয়েছে। এ সমস্ত কিছুই দুটি দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও জোরদার করে তোলার লক্ষ্যে এক বিশেষ পদক্ষেপ বলে বর্ণনা করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
শ্রী মোদী বলেন, ভারত ও জার্মানির মধ্যে কৌশলগত অংশীদারিত্বের সম্পর্ক দীর্ঘ ২৫ বছরের। কিন্তু, দুটি দেশের মধ্যেই যোগাযোগ ও সম্পর্ক হল শতাব্দী প্রাচীন। মনে রাখা দরকার যে ইউরোপের প্রথম সংস্কৃত ব্যাকরণের বই তৈরি করা হয়েছিল জার্মানিতে। শুধু তাই নয়, ওই দেশের ব্যবসায়ীরা ইউরোপে প্রথম তামিল ও তেলেগু ভাষায় ছাপার কাজও শুরু করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে জার্মানিতে প্রায় ৩ লক্ষ ভারতীয়ের বসবাস এবং ৫০ হাজারের মতো ভারতীয় ছাত্রছাত্রী সেখানে পড়াশোনা করছেন। অন্যদিকে ভারতে ১,৮০০টিরও বেশি জার্মান সংস্থা গত ৩-৪ বছরে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সম-পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে। দুটি দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য অঙ্কের দিক থেকে দাঁড়িয়েছে ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আগামী বছরগুলিতেও বাণিজ্যের এই গতি অপ্রতিহত থাকবে। কারণ, দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক এখন যথেষ্ট গভীর ও নিবিড়।
ভারত বর্তমানে বিশ্বের দ্রুততম গতিতে এগিয়ে চলা এক বৃহৎ অর্থনীতির দেশ বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী তাঁর এদিনের ভাষণে। তিনি বলেন যে এর ফলে ভারতের সঙ্গে উন্নয়নের লক্ষ্যে জোটবদ্ধ হতে আগ্রহ দেখিয়েছে বিশ্বের অনেকগুলি দেশই। জার্মানির ‘ফোকাস অন ইন্ডিয়া’ নামে যে নথিটি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে একথা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে বিশ্ববাসীর কাছে ভারতের কৌশলগত বিষয়গুলির গুরুত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। গত এক দশক ধরে ভারতের সংস্কার প্রচেষ্টা তা সম্ভব করে তুলেছে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, এই প্রচেষ্টার হাত ধরে একদিকে যেমন বাণিজ্যিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি আরও উন্নত হয়েছে, অন্যদিকে তেমনই আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপও অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। উপরন্তু, বিভিন্ন ক্ষেত্রের উন্নয়নের লক্ষ্যে গৃহীত নীতিগুলিকে আধুনিক করে তোলার প্রচেষ্টাও এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। জিএসটি চালু করার মাধ্যমে কর ব্যবস্থার সরলীকরণ, ৩০ হাজারেরও বেশি বাধ্যবাধকতাকে তুলে দেওয়া এবং ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা আরও স্থিতিশীল করে তোলা আমাদের সংস্কার প্রচেষ্টারই বিশেষ ফসল। শ্রী মোদী বলেন যে আমাদের যাবতীয় প্রচেষ্টা ভারতের ভবিষ্যৎকে আরও উন্নত করে তোলার ক্ষেত্রে এক বলিষ্ঠ ভিত গঠন করে দিয়েছে যার ফলে জার্মানির সঙ্গে আমাদের অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্ক ক্রমপ্রসারিত হয়েছে।
বড় ধরনের একটি আন্তর্জাতিক উৎপাদন কেন্দ্র হিসাবে বিশ্ব মানচিত্রে এক বিশেষ স্থান অধিকার করেছে ভারত। একথার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমান্তরালভাবে গড়ে উঠেছে জার্মানির উৎপাদন সম্পর্কিত নিজস্ব উন্নয়ন প্রচেষ্টাও। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচির মাধ্যমে উৎপাদকদের উৎপাদন সম্পর্কিত নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধাও দেওয়া হচ্ছে। মোবাইল ও বৈদ্যুতিন সাজসরঞ্জাম উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভারত হল বর্তমানে বিশ্বের অগ্রণী একটি দেশ। এমনকি, দু’চাকার যানের উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভারতের বর্তমান অবস্থান এখন একেবারে প্রথম সারিতে। এক্ষেত্রে ভারতকে বৃহত্তম উৎপাদক একটি দেশ বলে বর্ণনা করলেও অত্যুক্তি হবে না। আবার, সিমেন্ট ও ইস্পাত উৎপাদনের দিক থেকে ভারত হল বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম একটি দেশ। এ সমস্ত কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের উৎপাদন ক্ষেত্রে ভারত বর্তমানে একটি সুপরিচিতি নাম হয়ে উঠেছে। আবার, চার চাকার যান উৎপাদনের দিক থেকে চতুর্থ বৃহত্তম দেশ হল ভারত। সেমি-কন্ডান্টর শিল্পেও আন্তর্জাতিক দিক থেকে ভারত উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। পরিকাঠামোর প্রসার, পরিবহণ ব্যয় হ্রাস, বাণিজ্যিক কাজকর্মের পরিবেশ সহজ করে তোলা এবং স্থায়ী সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে আমাদের এই সার্বিক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। ব্যবহারিক, সামাজিক এবং ডিজিটাল পরিকাঠামোর দিক থেকেও ভারতের এই উন্নয়ন প্রচেষ্টায় এখন গতি সঞ্চারিত হয়েছে। যার ফলে, উদ্ভাবনমূলক ডিজিটাল প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ভারত হয়ে উঠেছে বিশ্ববাসীর কাছে অত্যন্ত সুপরিচিত একটি নাম। শুধু তাই নয়, ভারতে ডিজিটাল সরকারি পরিকাঠামো একদিক থেকে আবার অতুলনীয় যা ভারতকে এক বিশেষ গর্বের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।
যে সমস্ত জার্মান সংস্থা ইতিমধ্যেই ভারতে উৎপাদন শুরু করেছে, তাদের বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রচেষ্টাকেও এদিন স্বাগত জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, যে সমস্ত সংস্থা এখনও ভারতে বাণিজ্যিক কাজকর্ম শুরু করেনি, তাদেরও আমরা আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাচ্ছি। কারণ, এটিই হল সঠিক সময় যখন ভারতের নিরন্তর প্রচেষ্টা হয়ে উঠেছে দ্রুত থেকে দ্রুততর। নতুন নতুন ক্ষেত্রে ভারত ও জার্মানির সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন তিনি। ভারতের মতো একটি সুপ্রাচীন সভ্যতার দেশ যেভাবে বিশ্ব অংশীদারিত্বকে স্বাগত জানিয়েছে তা একটি উল্লেখ করার মতো ঘটনা। ভারতের সাথে সাথে সমগ্র বিশ্বের জন্য এক উন্নত ও সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার আহ্বান জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী।