এক উন্নত ভারত গড়ে তোলার লক্ষ্যে পরিকাঠামো, বিনিয়োগ, উদ্ভাবন এবং অন্তর্ভুক্তি প্রচেষ্টার ওপর ভারত বিশেষ জোর দিয়েছে। ভারতের ওপর আবার নতুন করে আস্থা স্থাপন করতে শুরু করেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। তাদের সকলের কাছেই ভারত হয়ে উঠেছে এমন একটি দেশ যা বিশ্বের যোগান শৃঙ্খলকে স্থিতিশীল করে তোলার মতো ক্ষমতার অধিকারী। দেশের রাজ্যগুলি যদি এই উন্নয়ন প্রচেষ্টায় আরও বেশি করে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে, তাহলে বিশ্ববাসীর এই আস্থাকে আমরা পূর্ণ মর্যাদা দিতে পারব কারণ, এ হল আমাদের সামনে এক বিশেষ সুযোগ। এজন্য নির্দিষ্ট গুণমান বজায় রাখার পাশাপাশি ‘ভারতই প্রথম’ – এই চিন্তাভাবনাকে অনুসরণ করে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন।
আজ রাজধানীতে বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যসচিবদের দ্বিতীয় জাতীয় সম্মেলনে ভাষণদানকালে এই মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি আরও বলেন, রাজ্যগুলির উচিৎ উন্নয়নমুখী প্রশাসন, বাণিজ্যিক কাজকর্মকে সহজতর করে তোলা, জীবনযাত্রার মানকে আরও সহজ অথচ উন্নত করে তোলা এবং শক্তিশালী পরিকাঠামো গড়ে তোলার মতো উদ্যোগ গ্রহণ করা।
ব্লক পর্যায়ে আকাঙ্ক্ষামূলক কর্মসূচির সূচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের লক্ষ্য হল জেলা পর্যায়ে আকাঙ্ক্ষামূলক উন্নয়ন কর্মসূচির একটি মডেল গড়ে তোলা। ব্লক কর্মসূচির মধ্য দিয়েই তার শুভ সূচনা হতে পারে। এই লক্ষ্যে ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক ও কর্মীদের নিজ নিজ রাজ্যে কর্মসূচি রূপায়ণে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। কয়েকটি রাজ্যে জেলা পর্যায়ের আকাঙ্ক্ষামূলক কর্মসূচির সাফল্যের প্রসঙ্গটিও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
ক্ষুদ্র, মাঝারি ও অণু শিল্প উদ্যোগগুলির কথা উল্লেখ করে শ্রী মোদী বলেন, এই ধরনের শিল্প সংস্থাগুলিকে একটি ব্যবহারিক রূপ দেওয়ার জন্য রাজ্যগুলিকে ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে কাজ করে যেতে হবে। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও অণু শিল্প উদ্যোগগুলিকে বিশ্বের বাজারে আরও প্রতিযোগিতামুখী করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। এজন্য অর্থ, প্রযুক্তি, বিপণন উদ্যোগ ও দক্ষতা অর্জন সহ যা কিছু প্রয়োজন তা সম্ভব ও নিশ্চিত করে তুলতে হবে। ‘জিইএম’ পোর্টালটিতে আরও বেশি সংখ্যক এই ধরনের শিল্প সংস্থাকে যুক্ত করার বিষয়টিও আলোচনা করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের মূল্য শৃঙ্খলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশের এই ধরনের শিল্প সংস্থাগুলিকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল ও উন্নত হয়ে উঠতে হবে। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও অণু শিল্পগুলির উন্নয়ন প্রচেষ্টায় গুচ্ছ বা ক্লাস্টার গড়ে তোলার সাফল্যের বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্থানীয় তথা আঞ্চলিক পর্যায়ে উৎপাদিত পণ্যকে বিশ্বের বাজারে তুলে ধরার জন্য স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে এই শিল্প সংস্থাগুলির জোটবন্ধন গড়ে তোলা দরকার। শুধু তাই নয়, অভিনব উৎপাদনগুলিকে যাতে জিআই ট্যাগের জন্য নথিভুক্তির ব্যবস্থা করা যায় সেই লক্ষ্যেও আমাদের সচেষ্ট হতে হবে। এই বিষয়টিতে আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ, ‘একটি জেলা, একটি উৎপাদিত পণ্য’ – এই ধারণাটির আশ্রয় গ্রহণ করা। আর এইভাবেই স্থানীয় তথা আঞ্চলিক পর্যায়ে উৎপাদিত পণ্যের গুণমান সম্পর্কে আমরা নির্দ্বিধায় সকলের কাছে উচ্চকন্ঠে ঘোষণা করতে পারব। রাজ্যগুলির উচিৎ তাদের শ্রেষ্ঠ উৎপাদিত সামগ্রীগুলিকে চিহ্নিত করে জাতীয় তথা আন্তর্জাতিক নির্দিষ্ট গুণমানে উন্নীত করা। এই প্রসঙ্গে ‘স্ট্যাচু অফ ইউনিটি’তে একতা মল-এর দৃষ্টান্তটি তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
দেশ এক সময় মাত্রাতিরিক্ত নিয়মনীতি ও নিয়ন্ত্রণের বেড়ায় দিশাহারা হয়ে পড়ত। সেই সময়কালের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করে শ্রী মোদী বলেন, এক বিশেষ সংস্কার কর্মসূচির মাধ্যমে রাজ্য তথা জাতীয় পর্যায়ের হাজার হাজার জটিলতাকে আমরা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। বহু প্রাচীন এবং অপ্রচলিত আইনের অবলুপ্তির প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এর অনেকগুলিরই অস্তিত্ব ছিল স্বাধীনতার সময়কাল থেকে।
এক সময় দেশের বিভিন্ন সরকারি দপ্তর থেকে একই নথি বারবার চাওয়া হত। এই জটিলতাকে দূর করার জন্য স্বপ্রত্যায়িত নথি দাখিল করা আজকের দিনে একান্ত জরুরি। এই প্রসঙ্গের অবতারণা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশ বর্তমানে ব্যবহারিক তথা সামাজিক পরিকাঠামোকে উন্নততর করে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী গতি শক্তি জাতীয় মাস্টার প্ল্যানটির প্রসঙ্গও এদিন ছুঁয়ে যায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে। অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবার সুষ্ঠু যোগান ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ডেটা সুরক্ষা এবং এক নিরাপদ ও সুরক্ষিত প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্য বিষয়ের মধ্যে। তিনি বলেন, রাজ্যগুলির উচিৎ এক শক্তিশালী সাইবার নিরাপত্তা কৌশল গড়ে তোলা। কারণ মনে রাখতে হবে, বিনিয়োগ হল উন্নত ভবিষ্যতের লক্ষ্যে এক বিমাবিশেষ। সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কিত অডিট ব্যবস্থাপনা এবং সঙ্কট তথা বিপর্যয়ের মুহূর্তে উপযুক্ত পরিকল্পনা রচনার ওপরও বিশেষ জোর দেন শ্রী নরেন্দ্র মোদী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, উপকূল বরাবর ভারতের যে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে সেখানে সহায়সম্পদের কোনও অভাব নেই। এর ফলে বিশেষ বিশেষ কিছু সুযোগও আমাদের রয়েছে। চক্রাকার অর্থনীতি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মিশন এলআইএফই’ হল এমন এক বিশেষ কর্মসূচি যা পরিবেশগত জীবনশৈলীকে উন্নত করে তোলার ক্ষেত্রে যথেষ্ট উপযোগী। এই প্রচেষ্টাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে রাজ্যগুলির।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের বিশেষ বিশেষ উদ্যোগগুলির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারতের প্রস্তাবক্রমে রাষ্ট্রসঙ্ঘ ২০২৩ সালকে ‘আন্তর্জাতিক বাজরা বর্ষ’ রূপে উদযাপনের কথা ঘোষণা করেছে। এই খাদ্যশস্যটি একদিকে যেমন পরিবেশ-বান্ধব, অন্যদিকে তেমনই যোগানের ক্ষেত্রেও তা ভবিষ্যতে এক নিশ্চিত খাদ্যসম্ভার আমাদের সামনে এনে দিতে পারে। বাজরা উৎপাদনের জন্য সমীক্ষা ও গবেষণার কাজকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ারও দায়িত্ব রয়েছে রাজ্যগুলির। বাজরার প্রক্রিয়াকরণ, তা প্যাকেটজাত করা, বিপণন, ব্র্যান্ডিং, মূল্য সংযোজন – সবকিছুকেই সম্ভব ও নিশ্চিত করে তুলতে হবে। শুধু তাই নয়, দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলিতে গড়ে তুলতে হবে ‘মিলেট কাফে’। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে জি-২০-র যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে তার প্রদর্শনীতে মিলেট তথা বাজরাকেও তুলে ধরার চিন্তাভাবনা করা হয়েছে।
বিভিন্ন রাজ্যে জি-২০ বৈঠকের উদ্যোগ আয়োজনের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাধারণ নাগরিকদের এই প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কারণ, সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। এজন্য ‘নাগরিক সংযোগ’ নামে এক বিশেষ প্রচেষ্টা বাস্তায়িত হওয়া দরকার। এ প্রসঙ্গে মাদক ও নেশাদ্রব্য, আন্তর্জাতিক অপরাধ, সন্ত্রাস এবং বিদেশের মাটি থেকে ভুল তথ্য পরিবেশনের মতো চ্যালেঞ্জগুলির সঠিক মোকাবিলার জন্য রাজ্যগুলিকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
মুখ্যসচিবদের সম্মেলনে আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা ও দক্ষতাকে আরও উন্নত করে তোলার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। সেইসঙ্গে, ‘মিশন কর্মযোগী’র সূচনার প্রসঙ্গটিও উত্থাপন করেন তিনি। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পরিকাঠামো এবং দক্ষতা বৃদ্ধি কর্মসূচির পর্যালোচনার বিষয়টি ভেবে দেখতে তিনি আর্জি জানান রাজ্যগুলির কাছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুখ্যসচিবদের এই সম্মেলন আয়োজন করার লক্ষ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ৪ হাজার আধিকারিক নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। এর মাধ্যমে কাজে লাগানো হয়েছে ১ লক্ষ ১৫ হাজার শ্রম দিবসকে। এই প্রচেষ্টার প্রতিফলনকে সফল ও নিশ্চিত করে তুলতে সঠিকভাবে রাজ্যগুলিকে কাজ করে যেতে হবে। মুখ্যসচিবদের এই সম্মেলন থেকে যে প্রস্তাব ও সুপারিশগুলি পেশ করা হবে তার ভিত্তিতে কর্মসূচি রূপায়ণে উদ্যোগী হতেও রাজ্যগুলিকে আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে রাজ্যগুলির মধ্যে এক সুস্থ প্রতিযোগিতার মানসিকতা গড়ে তুলতে এগিয়ে আসা উচিৎ নীতি আয়োগেরও।
প্রসঙ্গত, গত বছর জুনের পর থেকে এ পর্যন্ত দেশের উন্নয়ন প্রচেষ্টার একটি চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী জানান যে ভারতকে জি-২০-র সভাপতিত্ব পদে বরণ, বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে ওঠার মতো সাফল্য অর্জন, নতুন নতুন স্টার্ট-আপগুলির দ্রুত নথিভুক্তি, মহাকাশ কর্মসূচিতে বেসরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানানো, জাতীয় লজিস্টিক্স নীতির সূচনা এবং জাতীয় গ্রিন হাইড্রোজেন মিশনের অনুমোদনের মতো ঘটনা নিঃসন্দেহে আমাদের সাফল্যের পথে এক একটি মাইলফলক হয়ে উঠেছে।