প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী আজ ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উত্তর প্রদেশের বাহারাইচে মহারাজা সুহেলদেবের স্মৃতিসৌধ এবং চিত্তৌর হ্রদের উন্নয়নমূলক কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী এদিন মহারাজা সুহেলদেব নামাঙ্কিত মেডিকেল কলেজ ভবনেরও উদ্বোধন করেছেন। অনুষ্ঠানে উত্তর প্রদেশের রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারতের ইতিহাস কেবল ঔপনিবেশিকতা বা সেই মানসিকতার অধিকারীদের দ্বারা রচিত ইতিহাস নয়। ভারতীয় ইতিহাস হচ্ছে এমন, যা সাধারণ মানুষ তাঁদের লোকসংস্কৃতির মাধ্যমে বিকশিত করে এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এগিয়ে নিয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে, যারা ভারত ও ভারতীয়ত্বের জন্য সমস্ত ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাঁদের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব ও মর্যাদা দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, দেশের স্বাধীনতার ৭৫- তম বর্ষের সূচনায় সেই সমস্ত ব্যক্তির অবদানকে স্মরণ করাই এখন মহত্বপূর্ণ কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতীয় ইতিহাসের লেখকদের দ্বারা ইতিহাস প্রণেতাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও অবিচার এখন সংশোধন করা হচ্ছে বলে প্রধানমন্ত্রী জানান।
প্রধানমন্ত্রী উদাহরণস্বরূপ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর লালকেল্লা থেকে আন্দামান নিকোবর, স্ট্যাচু অফ ইউনিটি হিসেবে সরদার বল্লভভাই প্যাটেল, এবং পঞ্চতীর্থের মাধ্যমে বাবাসাহেব আম্বেদকরকে স্মরণের কথা উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এমন অসংখ্য ব্যক্তি রয়েছেন যারা বিভিন্ন কারণে স্বীকৃতি পাননি। চৌরিচৌরার সাহসী বাহিনীর সাথে কি ঘটেছিল তা কী ভুলতে পারা যায় এমন প্রশ্নও প্রধানমন্ত্রী তোলেন।
তেমনি ভারতীয়ত্ব রক্ষায় মহারাজা সুহেলদেবের অবদানও উপেক্ষিত হয়ে রয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন। অবধ, তরাই এবং পূর্বাঞ্চলের লোককথার মাধ্যমে মহারাজা সুহেলদেব মানুষের অন্তরে জায়গা করে নিয়েছেন। যদিও ইতিহাসের পাঠ্য বইয়ে এসব উপেক্ষিত হয়ে রয়েছে। মহারাজা সুহেলদেবকে একজন সংবেদনশীল ও উন্নয়নমূলক শাসক হিসাবে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, তাঁর এই স্মৃতিসৌধ নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করবে। এর পাশাপাশি তাঁর নামাঙ্কিত মেডিকেল কলেজ ও চিকিৎসা পরিষেবার বিস্তার সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে। প্রধানমন্ত্রী মহারাজা সুহেলদেবের স্মরণে দু'বছর আগে একটি স্ট্যাম্প প্রকাশ করেছিলেন।
বসন্ত পঞ্চমী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী দেশের জনগণকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, এই বসন্ত ভারতের ক্ষেত্রে নতুন আশার সঞ্চার করবে। করোনা অতিমারি জনিত নিরাশা থেকে মুক্তি দেবে। তিনি কামনা করেন যে, মা সরস্বতী জ্ঞান এবং বিজ্ঞান ও গবেষনা এবং উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশ গঠনের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি দেশবাসীকে আশীর্বাদ করবেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পর্যটন বিকাশের জন্য সরকার বিগত কয়েক বছরে ইতিহাস, মানুষের বিশ্বাস এবং আধ্যাত্বিকতার সঙ্গে সম্পর্কিত স্মৃতিসৌধ গড়ে তুলেছেন। উত্তর প্রদেশও তার থেকে বাদ নেই। পর্যটন বিকাশের জন্য সেখানে ভগবান রামের জীবনী সম্পর্কিত রামায়ণ সার্কিটস, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবন সম্পর্কিত স্পিরিচুয়াল সার্কিটস, ভগবান বুদ্ধর জীবনী সম্পর্কিত বুদ্ধিস্ট সার্কিটস গড়ে তোলা হয়েছে। যেমন রয়েছে অযোধ্যা, চিত্রকূট, মথুরা, বৃন্দাবন, গোবর্ধন, কুশিনগর, শ্রাভাস্তি প্রভৃতি স্থানে। তিনি বলেন, দেশের অন্যান্য রাজ্যগুলির চেয়ে উত্তর প্রদেশ পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। বিদেশি পর্যটকদের কাছেও ভারতের তিনটি আকর্ষণীয় রাজ্যের মধ্যে উত্তর প্রদেশ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, পর্যটকদের যাতায়াতের সুবিধার্থে উত্তরপ্রদেশে অযোধ্যা বিমানবন্দর এবং কুশিনগর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর খুবই কাজে লাগবে। এর পাশাপাশি ওই রাজ্যে আরও বেশ কয়েকটি ছোট ও বড় মাপের বিমান বন্দর গড়ে তোলা হচ্ছে।
সড়ক যোগাযোগ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেন, পূর্বাঞ্চল এক্সপ্রেসওয়ে, বুন্দেলখান্ড এক্সপ্রেসওয়ে, গঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে, গোরখপুর লিংক এক্সপ্রেসওয়ে, বালিয়া লিংক এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের মাধ্যমে উত্তর প্রদেশে পরিকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটানো হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন উত্তর প্রদেশে পণ্য পরিবাহী করিডোরের দুটি বড় জংশন রয়েছে। শিল্পোদ্যোগীরাও বিনিয়োগ করতে এগিয়ে এসেছেন। শিল্প এবং কর্মসংস্থানের প্রভূত সম্ভাবনা রয়েছে।
করোনা মোকাবিলায় উত্তরপ্রদেশ সরকারের ভূমিকার প্রধানমন্ত্রী ভুয়সি প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, অতিমারি জনিত কারণে ভিন্ রাজ্য থেকে ফিরে আসা শ্রমিকদের জন্য উত্তরপ্রদেশ সরকার কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে পেরেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাজ্য সরকারের প্রচেষ্টার ফলে ম্যানেনজাইটিসে আক্রান্তের সংখ্যাও রাজ্যে কমেছে। তিনি উল্লেখ করেন যে, উত্তরপ্রদেশে মেডিকেল কলেজের সংখ্যা গত ৬ বছরে ১৪ থেকে বেড়ে ২৪ হয়েছে। গোরখপুর এবং বেরিলিতে এইমস তৈরির কাজও এগিয়ে চলেছে। এর বাইরে, ২২টি নতুন মেডিকেল কলেজ তৈরির কাজ চলছে। বারাণসীর মতো আধুনিক মানের ক্যান্সার হাসপাতালের পরিষেবা পূর্বাঞ্চলেও মিলবে।
উত্তরপ্রদেশে জল জীবন মিশন প্রকল্পে বাড়ি বাড়ি পানীয় জল সরবরাহের কাজ উল্লেখযোগ্যভাবে হয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেন।
উত্তরপ্রদেশের গ্রামের দরিদ্র এবং কৃষকরা এখন বিদ্যুৎ, পানীয় জল, রাস্তা এবং স্বাস্থ্য সুবিধার মাধ্যমে পরিষেবা পাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী কৃষক সম্মান নিধি প্রকল্পে উত্তরপ্রদেশে প্রায় আড়াই কোটি কৃষক পরিবারের ব্যাংক একাউন্টে সরাসরি অর্থ দেওয়া হচ্ছে। যারা এক সময় অন্যদের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছিল, বিশেষত সার ক্রয়ের জন্য। আগে সেখানে কৃষকরা জমিতে জল সেচের জন্য বিদ্যুতের প্রয়োজনে সারারাত জেগে থাকতেন। রাজ্য সরকার বিদ্যুৎ পরিষেবার উন্নয়নের ফলে সেই পরিস্থিতি এখন আর নেই।
কৃষক উৎপাদক সংস্থা তৈরির ওপর গুরুত্ব আরোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জমি একীকরণের জন্য করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে কৃষক তাঁর চাষের ক্ষেত্র সংকুচিত করার বিষয়টি সমাধান করতে পারে। যখন ১-২ দুই বিঘা জমিতে ৫০০ কৃষক পরিবার সংঘটিত হয়, তখন তাঁরা ৫০০-১০০০ বিঘা জমির মালিক কৃষকের চেয়ে আরও শক্তিশালী হয়। এর পাশাপাশি, শাকসবজি, ফলমূল, দুধ, মাছ এবং এই জাতীয় ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত ছোট কৃষকরা বিপণনের জন্য এখন কিষান রেলের মাধ্যমে বড়বাজার গুলির সাথে যুক্ত হতে পারছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাম্প্রতিককালের চালু হওয়া কৃষি সংস্কার গুলি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের উপকৃত করবে। কৃষি আইনের ইতিবাচক প্রভাব সারাদেশ জুড়ে মিলবে। তিনি বলেন, কৃষি আইন নিয়ে নানা রকমের ভুলভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। যারা এই আইন প্রণয়ন করেছেন তাঁরা বিদেশি কোম্পানিগুলিকে সুবিধা পাইয়ে দিতে নতুন কৃষি আইন করেছেন বলে রটানো হচ্ছে। এ ব্যাপারে কৃষকদের ভয় দেখানো হচ্ছে। এই মিথ্যা এবং অপপ্রচারের বিষয়টি এখন উন্মোচিত হয়েছে। নতুন আইন কার্যকর হওয়ার পর গত বছরের তুলনায় উত্তরপ্রদেশে এবার ধান সংগ্রহ দ্বিগুণ হয়েছে। যোগী সরকার ইতিমধ্যে আখ চাষীদের ১ লক্ষ কোটি টাকা প্রদান করেছে। এছাড়াও কেন্দ্র সরকার চিনিকল গুলিকে কৃষকদের অর্থ প্রদানের জন্য বিভিন্ন রাজ্য সরকার মারফত কয়েক হাজার কোটি টাকা দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী জানান, আখ চাষীদের যাতে সময় মত অর্থ দেওয়া হয় তা নিশ্চিত করতে উত্তরপ্রদেশ সরকার সর্বতোভাবে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস দেন যে, গ্রামবাসী এবং কৃষকদের মান উন্নয়নের জন্য সরকার বদ্ধপরিকর। স্বামীত্ব প্রকল্পটি কোন গ্রামের বাড়ির অবৈধ দখলের সম্ভাবনা থেকে মুক্তি দেবে। এই প্রকল্পের আওতায় বর্তমানে উত্তরপ্রদেশের প্রায় ৫০ টি জেলায় ড্রোন দিয়ে জরিপের কাজ চালানো হচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার গ্রামে ড্রোন মারফত জরিপের কাজ শেষ হয়েছে। যার ফলে এখনো পর্যন্ত ২ লক্ষেরও বেশি পরিবার সম্পত্তির কার্ড পেয়েছেন। যে কারণে ওই পরিবারগুলি এখন সব ধরনের ভয় ভীতি থেকে মুক্ত হয়েছেন বলে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কেউ কেউ গুজব ছড়াচ্ছেন যে, কৃষক সংস্কার আইনের ফলে কৃষকের জমি দখল হয়ে যাবে। কিন্তু, সরকারের লক্ষ্য দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য সশক্তিকরণ। সরকারের প্রতিশ্রুতি হচ্ছে, দেশকে আত্মনির্ভর করা এবং এই কাজে আমরা নিবেদিত।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, গোস্বামী তুলসী দাস রচয়িত রামচরিত মানস মহাকাব্য থেকে একটি শ্লোক উদ্ধৃত করেন, যার অর্থ হলো, সঠিক উদ্দেশ্যে কোন কাজ করা হলে এবং ভগবান রামকে হৃদয়ের মধ্যে রেখে স্মরণ করলে সেই কাজ সফল হতে বাধ্য।