আজ ২০১৭ সালের শেষ দিন। আমার সৌভাগ্য যে আজকের দিনে শ্রী নারায়ণগুরু এবংমঞ্চে আসীন সন্ন্যাসীদের আশীর্বাদ গ্রহণের সুযোগ পেয়েছি।
কামনা করি, শ্রী নারায়ণ গুরুর আশীর্বাদে ২০১৮’র প্রথম আলো যেন গোটা দেশসমগ্র বিশ্বের জন্য শান্তি, সদ্ভাবনা ও উন্নয়নে নতুন সকাল নিয়ে আসে।
শিবগিরি মঠে পৌঁছে আমি সর্বদাই অনেক আধ্যাত্মিক সুখ পাই। আজ শিবগিরিতীর্থযাত্রা উৎসবের উদ্বোধনের সুযোগ দিয়ে আপনারা সেই সুখকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন,সেজন্য আমি শ্রী নারায়ণ ধর্ম সংঘম ট্রাস্ট এবং আপনাদের সকলের কাছে অনেক কৃতজ্ঞ।
ভাই ও বোনেরা,
আমাদের দেশ, আমাদের সমাজের একটি বৈশিষ্ট্য হ’ল যে তার অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাও সময়ের সঙ্গে উদ্ভূত কুসংস্কার দূরীকরণের প্রক্রিয়াও ধর্মাচরণের পাশাপাশি চলতেথাকে। এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে নানা সময়ে সন্ন্যাসী, মুনি, ঋষি ও মহাত্মারাঅবতরিত হয়েছেন। এই পুণ্যাত্মারা সমাজকে এই কুসংস্কারসমূহ থেকে মুক্ত করানোর জন্যনিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
পরমপূজ্য স্বামী নারায়ণ গুরুজির মতো পুণ্যাত্মাও জাতিভেদ ও সাম্প্রদায়িকতারবিরুদ্ধে সমাজকে জাগ্রত ও ঐক্যবদ্ধ করেছেন। আজ শিক্ষা ক্ষেত্রে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সমান সাফল্যের নিরিখে সামাজিক কুসংস্কার এবং অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধেসমাজে যে ঘৃণাভাব সৃষ্টি হয়েছে; এসব এমনই সম্ভব হয়নি! আমরা কল্পনা করতে পারি যে,সেই সময় শ্রী নারায়ণ গুরুর মতো মহাত্মারা মানুষকে সচেতন করতে কত না পরিশ্রমকরেছেন, কত না সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন!
বন্ধুগণ,
শ্রী নারায়ণ গুরুর মন্ত্র ছিল “শিক্ষার মাধ্যমে স্বাধীনতা, সংঘের মাধ্যমেশক্তি, শিল্পের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা”।
সমাজ সংস্কারের জন্য দলিত-পীড়িত-শোষিত-বঞ্চিতদের ক্ষমতায়নের স্বার্থে তিনিএই পথ বেছে নিয়েছিলেন। তিনি মানতেন যে, গরিব, দলিত ও পিছিয়ে পড়া মানুষ তখনই এগিয়েযেতে পারবেন, যখন তাঁরা শিক্ষার শক্তিতে বলিয়ান হবেন। তিনি জানতেন যে, যখন সমাজশিক্ষত হবে, তখনই আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে আর আত্মনিরীক্ষণ করতে পারবে।সেজন্য তিনি শুধু কেরল নয়, আশেপাশের বেশ কয়েকটি রাজ্যে শিক্ষা ও সংস্কৃতিকেউজ্জীবিত করে তোলার উপযোগী বেশ কিছু সংস্থা গড়ে তোলেন। আজ দেশ-বিদেশে শ্রী নারায়ণগুরুর দর্শনকে প্রচারিত ও প্রসারিত করার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এমনই অসংখ্যসংস্থা।
শ্রী নারায়ণ গুরু সমাজের প্রতিটি মানুষকে জুড়ে নেওয়ার কাজ করেছেন। তিনিমন্দিরগুলিকে যাদু-টোনা-ভোজবাজি থেকে মুক্ত করার মাধ্যমে সততা ও পরিচ্ছন্নতাকেঅগ্রাধিকার দিয়েছেন। যেসব পূজা-পদ্ধতি অপরিচ্ছন্নতার কারণ হয়ে উঠেছিল, তিনিসেগুলির সংস্কার করেছেন। অপ্রয়োজনীয় আচার-বিচার বাতিল করে দিয়ে তিনি নতুন পথদেখিয়েছেন। তিনি প্রতিটি মন্দিরে জাতি-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষেরপূজা দেওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। শিবগিরি তীর্থযাত্রাও এক প্রকার সমাজসংস্কারের ব্যাপক দর্শনের বিস্তারস্বরূপ।
এই শ্রী নারায়ণ গুরুর দর্শনেরই প্রতীক হ’ল যে, তিনি শিবগিরি তীর্থযাত্রাকেশিক্ষা-পরিচ্ছন্নতা, সত্যশক্তি-সংগঠনশক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত করে একেউন্নয়ন যাত্রায় মাত্রান্বিত করেছেন।
তিনি বলেছিলেন, “বাস্তব জীবনের সমস্ত জ্ঞানকে ব ্যবহার করলে তবেই জনগণ এবং দেশেরউন্নতি ও সমৃদ্ধি সম্ভব। শিবগিরি তীর্থযাত্রার এটাই মূল উদ্দেশ্য”।
আমি অত্যন্তআনন্দিত বিগত ৮৫ বছর ধরে শিবগিরি তীর্থযাত্রার মাধ্যমে নিয়মিতভাবে সংশ্লিষ্টবিদ্যার বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা শোনা হচ্ছে। আজওএখানে এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রের দিগ্গজ পণ্ডিতরা যুক্ত রয়েছেন।আমি আপনাদের সকলকে স্বাগত ও সম্মান জানাই এবং আশা করি যে, আপনাদের কাছ থেকে সাধারণমানুষ অনেক নতুন কিছু শিখতে ও বুঝতে পারবেন।
ভাই ও বোনেরা,
শিবগিরিতীর্থযাত্রা এক ধরনের জ্ঞানকুম্ভ, যেখানে যাঁরা ডুব দেন, তাঁরাই সিদ্ধিলাভ করেন।
কুম্ভ মেলারসময়ও আমাদের বিশাল দেশকে সমস্ত বৈচিত্র্য সহকারে এক জায়গায় জড়ো করার প্রচেষ্টা হয়।সাধু-সন্ন্যাসী-ঋষি-মুনিরা একত্রিত হয়ে সমাজের ভালোমন্দ, সুখ-দুঃখ নিয়ে আলোচনাকরেন। সময়ের সঙ্গে কিছু পরিবর্তন অবশ্যই এসেছে, কিন্তু কুম্ভ মেলার স্বরূপে আরেকটিবিশেষ ব্যাপার রয়েছে। এখানে প্রত্যেক বারো বছরে সাধু-সন্যাসীরা একত্রিত হয়ে ঠিককরেন যে, আগামী ১২ বছর সমাজ কোন্ পথে চলবে, দেশ কোন্ পথে চলবে, সমাজেরকর্মদক্ষতায় কি ধরনের পরিবর্তন আনা প্রয়োজন?
একে একরকমসামাজিক সংকল্প বলা যায়। তারপর, প্রত্যেক তিন বছরে কখনও নাসিক, কখনও উজ্জয়িনী আবারকখনও হরিদ্বারে। কুম্ভমেলার সময় এটা বিশ্লেষণ করা হ’ত যে, আমরা মহাকুম্ভে যেসিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তা কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রতিটি বিষয়ের যথাযথ বিশ্লেষণ ওপুনর্বিচার করা হ’ত।
আমি আশা করিযে, আপনারা সকলে যখন প্রতি বছরের শেষ দিনে এই উপলক্ষে মিলিত হন, তখন নিশ্চয়ই এরকমইআলাপ-আলোচনা হয় যে, গত বছর যে সিদ্ধান্তগুলি নিয়েছিলাম, সেগুলির পরিণাম কি হয়েছে!শ্রী নারায়ণ গুরু যে লক্ষ্যপ্রাপ্তির পথ দেখিয়েছিলেন, আমরা কি সেদিকে কয়েক পাএগোতে পেরেছি?
বন্ধুগণ,
শিবগিরিতীর্থযাত্রা হোক, কুম্ভ, মহাকুম্ভ হোক, সমাজকে নতুন পথ দেখাক, দেশকে অভ্যন্তরীণকুসংস্কার থেকে মুক্ত করতে এ ধরনের পরম্পরা আজও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের ভিন্নভিন্ন রাজ্যে এ ধরনের তীর্থযাত্রা দেশকে ঐক্যবদ্ধ করে। ভিন্ন ভিন্ন রাজ্য থেকেমানুষ আসেন, ভিন্ন মতালম্বী মানুষেরা আসেন, তাঁরা পরস্পরের পরম্পরাকে দেখে-বুঝেএকাত্ম ভাবনায় সংগঠিত হতে পারেন।
বন্ধুগণ,
কেরলের এইপবিত্র মাটিতেই আদি শঙ্করাচার্য অদ্বৈত দর্শনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। অদ্বৈতেরসরল অর্থ হল, যেখানে দ্বৈত নেই, যেখানে তুমি আর আমি পৃথক নই, যেখানে আমার আর অপরেরবলে কিছু হয় না – এই ভাব যখন মনে জাগে তখন তা অদ্বৈতকে সাকার করে তোলে। আর এই পথইপরবর্তীকালে নারায়ণগুরুর পথ। নারায়ণ গুরু শুধুই অদ্বৈতের সিদ্ধান্তকে নিজের জীবনেগ্রহণ করেননি, সমগ্র বিশ্ব সমাজকে পথ দেখিয়েছেন যে, ঐ অদ্বৈত সিদ্ধান্ত কিভাবেজীবনে গ্রহণ করা যায়।
ভাই ও বোনেরা,
শিবগিরিতীর্থযাত্রা শুরু হওয়ার ১০ বছর আগে শ্রী নারায়ণ গুরুজির নেতৃত্বে অদ্বৈত আশ্রমেধর্মীয় সংসদের আয়োজন করা হয়েছিল। সারা পৃথিবী থেকে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম ও পন্থাবলম্বীপ্রতিনিধিরা সেখানে পৌঁছেছিলেন। সেই ধর্মীয় সংসদে সমগ্র বিশ্বের ধর্ম ও পন্থের সংঘর্ষথেকে মুক্তি, শান্তি-সদ্ভাবনা এবং সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলার আহ্বান রাখা হয়েছিল।
আমাকে বলাহয়েছে যে, সেই ধর্মীয় সংসদের প্রবেশদ্বারে গুরুজি বড় করে লিখিয়েছিলেন, “আমরা এখানেতর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে জেতার জন্য মিলিত হইনি, আমরা জানতে এবং জানাতে এসেছি”।সেখানে পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা এবং পরস্পরকে বোঝার প্রচেষ্টাই ছিল অত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ।
আজ যখন আমরা বিশ্ব পরিবেশের কথা বলি, তখন দেখি যে, কিভাবে আমাদেরদূরদ্রষ্টা সন্ন্যাসী সমাজ অতীতেই আজকের দিনের সঙ্কটগুলিকে দেখতে পেয়েছিলেন। আরআমাদের নিয়মিত সচেতন করার চেষ্টা করছিলেন।
ভাই ও বোনেরা,
আমরা যদি উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর দিকে তাকাই, তা হলে দেখতে পাব যে,স্বাধীনতা আন্দোলনে তৎকালীন সমাজ সংস্কারক ও ধর্মগুরুরা প্রচুর সংখ্যায় অংশগ্রহণকরেছিলেন। তাঁরা অনুভব করেছিলেন যে, ভিন্ন ভিন্ন জাতি ও বর্ণে বহুধা-বিভক্ত সমাজইংরেজদের মোকাবিলা করতে পারবে না। এই দুর্বলতা দূর করার জন্য তাঁরা সেই সময় দেশেরবিভিন্ন অংশে জাতপাতের বিরুদ্ধে অত্যন্ত ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। সেইসংস্কার আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। দাসত্বের শৃঙ্খল থেকেমুক্তি পেতে হলে নিজেদের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা থেকে মুক্তিসাধন জরুরি হয়ে উঠেছিল।
এই আন্দোলনসমূহের নেতৃত্ব প্রদানকারী সাধু-সন্ন্যাসীরা সাধারণ মানুষকেসমতার আদর্শে অনুপ্রাণিত করেছেন। দেশের প্রয়োজনে তাঁরা নিজেদের আধ্যাত্মিকযাত্রাকে রাষ্ট্রনির্মাণের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। তাঁদের নেতৃত্বে সাধারণ মানুষ যখনজাতির উপরে উঠে ভাবতে শুরু করেছেন, তখনই দেশ উঠে দাঁড়িয়েছে আর ঐক্যবদ্ধ হয়েইংরেজদের বিতাড়িত করেছেন।
বন্ধুগণ,
আজ দেশের সামনে আরেকবার এ রকম সময় এসেছে। জনগণ দেশকে অভ্যন্তরীণদুর্বলতাগুলি থেকে মুক্ত করতে চায়। আপনাদের মতো হাজার হাজার সংগঠন ও সংস্থাএক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। শুধু জাতপাত নয় আর যেসকল রোগ দেশেরক্ষতি করছে, সেগুলি থেকে দেশকে মুক্ত করতে, সেগুলি সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতনকরে তুলতে আপনাদের এগিয়ে আসার প্রয়োজন রয়েছে।
১৫ আগস্ট, ১৯৪৭ সালে দেশ দাসত্বের শৃঙ্খল মুক্ত হলেও সেই শৃঙ্খলের দাগ এখনওআমাদের সামাজিক ও আর্থিক ব্যবস্থায় অমলিন হয়ে রয়েছে। আপনাদের সহযোগিতায় আমরা সেসব কলঙ্কথেকে দেশকে মুক্ত করতে পারব।
ভাই ও বোনেরা, জ্যোতিবা ফুলে, সাবিত্রী বাঈ, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্রবিদ্যাসাগর এবং দয়ানন্দ সরস্বতীর মতো মহাপুরুষেরা মহিলাদের প্রাপ্য মর্যাদাদানেরজন্য দীর্ঘ সংগ্রাম করেছেন। আজ তাঁদের আত্মা এটা দেখে প্রসন্ন হবে যে, দেশেমহিলাদের অধিকার স্থাপনের ক্ষেত্রে কত বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তিন তালাক নিয়েযেভাবে মুসলিম মা-বোনেরা দীর্ঘ সময় ধরে ভুগেছেন, তা আজ আর কারও কাছে লুকোনো নেই।এর বিরুদ্ধে তাঁদের দীর্ঘ লড়াইয়ের পরিণাম হিসাবে আজ তাঁদের তিন তালাক থেকে মুক্তিরপথ পাওয়া গেছে।
ভাই ও বোনেরা,
আমাদের সন্ন্যাসী, ঋষি ও মুনিরা বলেছেন, “মানুষ ভালো কাজ করলে নারায়ণ হয়েযায়”।
শুধু বাগাড়ম্বর নয়, ঘন্টার পর ঘন্টা পূজাপাঠ করে নয়, ভালো কর্ম করারমাধ্যমেই মানুষ নিজেকে ঈশ্বর করে তুলতে পারেন। এই কর্মই সংকল্প থেকে সিদ্ধিরযাত্রা। এই কর্মই ১২৫ কোটি ভারতীয়দের জন্য নতুন ভারত-এর যাত্রা।
২০১৮’য় এই যাত্রা আরও তীব্র হবে। কালো টাকা, দুর্নীতি থেকে শুরু করে বেনামীসম্পত্তির বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ নেওয়া, সন্ত্রাসবাদ ও জাতিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকরা, সংশোধন, সম্পাদন এবং রূপান্তর-এর মন্ত্র নিয়ে চলার মাধ্যমে সকলের সঙ্গে সকলেরউন্নয়নসাধন করে ২০১৮’য় আমরা ভারতীয়রা এক জোট হয়ে দেশকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেব – এইপ্রতিশ্রতি ও প্রত্যাশা নিয়ে আমি নিজের কথা শেষ করছি।
আরেকবার আপনাদের সকলকে,
শ্রী নারায়ণ গুরুর ভক্তদের শিবগিরি তীর্থযাত্রা এবং নতুন বছরের অনেক অনেকশুভেচ্ছা জানাই।
অনেক অনেক ধন্যবাদ।