ভারতের ১৩০ কোটি মানুষের পক্ষ থেকে আপনাদের সকলকে নতুন দিল্লিতে স্বাগত জানাতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত।
অতিপরিচিত সংস্কৃত শব্দসমষ্টি ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্’ অর্থাৎ এই বিশ্ব একটি পরিবার – এর মধ্যে আমাদের ঐ প্রাচীন বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। আমাদের আস্থার প্রতীক মহাত্মা গান্ধীর মধ্যেও ঐ একই বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ঘটেছে। তিনি বলেছিলেন যে, প্রত্যেকের চাহিদা পূরণে এই গ্রহ অনেক কিছু দিয়ে থাকে, কিন্তু প্রত্যেকের আকাঙ্খা পূরণের জন্য এই গ্রহ যথেষ্ট নয়।
প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানে বেঁচে থাকার গুরুত্বের কথা আমাদের ঐতিহ্যে রয়েছে।
প্রকৃতির উপাদানগুলির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মাধ্যমে তা প্রতিফলিত হয়েছে। আমাদের উৎসব, অনুষ্ঠান এবং আমাদের প্রাচীন পুঁথি ও গ্রন্থেও সর্বদাই এটি প্রতিফলিত হয়।
ভদ্র মহোদয় ও মহোদয়াগণ,
ভারত আজ বিশ্বের দ্রুততম বিকাশশীল অর্থনীতি। এই দেশবাসীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ।
সুস্থায়ী ও প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানে এই মানোন্নয়নে আমরা বদ্ধপরিকর। আর এইভাবেই আমরা সেই কাজ করে চলেছি।
এই লক্ষ্যে বিগত দু’বছরে আমরা চার কোটি নতুন রান্নার গ্যাস সংযোগ দিয়েছি।
বিষাক্ত ধোঁয়ার কবল থেকে এই রান্নার গ্যাস সংযোগ গ্রামীণ মহিলাদের মুক্তি দিয়েছে।
এরফলে, জ্বালানি কাঠের ওপর থেকেও তাঁদের নির্ভরশীলতা দূর হয়েছে।
এই একই প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত হয়েছে, সারা দেশ জুড়ে ৩ লক্ষের বেশি এলইডি বাতি লাগানোর মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের পাশাপাশি বায়ু মণ্ডলে প্রচুর পরিমাণে কার্বনডাই অক্সাইড গ্যাসের মিশ্রণ রোধ করা গেছে।
পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদনের এক উচ্চাকাঙ্খী লক্ষ্য পূরণে আমরা কাজ করছি। ২০২২ সাল নাগাদ আমরা ১৭৫ মেগাওয়াট সৌর ও বায়ুশক্তি উৎপাদনের লক্ষ্য স্থির করেছি।
বিশ্বে সৌরশক্তি উৎপাদনের দিক থেকে এখন আমাদের স্থান পঞ্চম। কেবল তাই নয়, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রেও আমরা ষষ্ঠ স্থানে রয়েছি।
আমাদের লক্ষ্য প্রতিটি পরিবারের কাছে বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছে দেওয়া। পরিবেশের অবক্ষয়কারী জ্বালানির ওপর থেকে নির্ভরশীলতা আরও কমানোই আমাদের উদ্দেশ্য।
জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর থেকে নির্ভরশীলতা আমরা কমাচ্ছি। যেখানে সম্ভব সেখানেই আমরা জ্বালানির উৎস খোঁজ করছি। আমরা শহরগুলির রূপান্তর ঘটাচ্ছি এবং গণপরিবহণ ব্যবস্থার পরিবর্তন নিয়ে আসছি।
দেশ হিসাবে আমরা নবীন। কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ভারতকে বিশ্বের উৎপাদন হাব হিসাবে গড়ে তোলার দিশায় কাজ করছি।
আমরা ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ অভিযান শুরু করেছি। এই অভিযানের মাধ্যমে উৎপাদন ক্ষেত্রে ‘জিরো ডিফেক্ট’ ও ‘জিরো এফেক্ট’ (পরিবেশের ওপর) প্রক্রিয়ায় গুরুত্ব দিচ্ছি। উদ্দেশ্য হ’ল উৎপাদন ব্যবস্থায় ভুল-ত্রুটি দূর করে পরিবেশের ওপর হানীকারক প্রভাব রোধ করা।
পরিবেশ দূষণ রোধে জাতীয় সংকল্পের অঙ্গ হিসাবে ২০০৫ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের গড় অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) অনুযায়ী কার্বন নিঃশরণের পরিমাণ ৩৩-৩৫ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস করতে ভারত বদ্ধপরিকর। ২০৩০ সালের মধ্যেই এই লক্ষ্য পূরণ করার পথে আমরা অগ্রসর হচ্ছি।
রাষ্ট্রসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ভারত কোপেনহেগেন লক্ষ্য পূরণের পথেও এগিয়ে চলেছে।
আমাদের এক মজবুত ‘জাতীয় জৈব বৈচিত্র্য কর্মপন্থা’ রয়েছে। সমগ্র বিশ্বের মাত্র ২.৭ শতাংশ এলাকা ভারতের ভৌগলিক সীমানা হওয়া সত্ত্বেও, এখানে জৈব বৈচিত্র্যের ৭-৮ শতাংশের অস্তিত্ব রয়েছে। একই সঙ্গে, সমগ্র বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৮ শতাংশের বাস ভারতে। আমাদের বনাঞ্চল ও বৃক্ষশোভিত এলাকার পরিমাণ বিগত দু’বছরে ১ শতাংশ বেড়েছে।
বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ ক্ষেত্রেও আমরা ভালো সাফল্য পেয়েছি। বিভিন্ন বন্যপ্রাণী যেমন – বাঘ, হাতি, সিংহ, গন্ডারের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জলের যোগানের সমস্যা মোকাবিলার বিষয়টিকেও আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখেছি। ভারতে জলের পর্যাপ্ত যোগান বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে চলেছে। আমরা ‘নমামি গঙ্গে’-র মতো বিরাট উদ্যোগ নিয়েছি ইতিমধ্যেই এই কর্মসূচির সুফল পাওয়া শুরু হয়েছে। শীঘ্রই আমাদের সবচেয়ে পবিত্র নদী গঙ্গার পুনরুজ্জীবন ঘটবে।
ভারত মূলত কৃষি প্রধান দেশ। কৃষির জন্য জলের নিরবচ্ছিন্ন যোগান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি কৃষি জমিতে জল পৌঁছে দিতে আমরা প্রধানমন্ত্রী কৃষি সিঞ্চাই যোজনা শুরু করেছি। আমাদের লক্ষ্য ‘প্রতি ফোটায়, আরও বেশি ফসল’।
ভদ্র মহোদয় ও ভদ্র মহোদয়াগণ,
বিশ্বের অধিকাংশ দেশই যখন অসঙ্গতিপূর্ণ উদ্যোগে নজর দেয়। পক্ষান্তরে ভারত তখন প্রকৃত কিছু কাজ করে দেখানোর চেষ্টা করে।
এটা ছিল সেই প্রকৃত বা স্থায়ী পদক্ষেপের অঙ্গ, যা ভারত সহ ফ্রান্সকে আন্তর্জাতিক সৌর জোট গঠনে উৎসাহিত করে। প্যারিস সম্মেলনের পর সম্ভবত এটাই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। অন্তত পক্ষে পরিবেশের স্বার্থের কথা ভেবে।
প্রায় তিন মাস আগে আন্তর্জাতিক সৌর জোটের প্রতিষ্ঠা সম্মেলনে ৪৫টিরও বেশি দেশের নেতৃবৃন্দ, আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলির প্রধান ও শীর্ষকর্তারা নতুন দিল্লিতে সমবেত হয়েছিলেন।
আমাদের অভিজ্ঞতা বলে যে, উন্নয়ন পরিবেশ-বান্ধব হতে পারে। তবে এই উন্নয়ন আমাদের সবুজ সম্পদের বিনিময়ে হওয়া উচিৎ নয়।
বন্ধুগণ,
এ বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসে একটি অত্যন্ত জটিল চ্যালেঞ্জের সমাধানের কথা বলা হয়েছে।
প্লাস্টিকের বিপদ মানবজাতির কাছে ভীতির কারণ হয়ে উঠেছে। এই প্লাস্টিকের অধিকাংশই রি-সাইকেল বা পুনর্ব্যবহার হয়ে ওঠে না। এমনকি, এর অধিকাংশই নন-বায়ো ডিগ্রেবল বা পরিবেশের পক্ষে হানীকর।
আমাদের সামুদ্রিক জৈব বৈচিত্র্যে প্লাস্টিক দূষণের মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। বিজ্ঞানী ও মৎস্যজীবীরা উভয়ই এই বিপদের ইঙ্গিত দিয়েছেন। এরফলে, মাছের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে, সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা বাড়ছে এবং বাসস্থান বিনাশ হয়ে যাচ্ছে।
সামুদ্রিক বর্জ্য বিশেষ করে, মাইক্রো প্লাস্টিকের সমস্যার কোনও দেশের গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ‘পরিচ্ছনন সাগর’ অভিযানে যোগ দিতে ভারত প্রস্তুত হচ্ছে। আমাদের মহাসাগর ও সাগরগুলিকে বাঁচাতে ভারত অবদান রাখতে চায়।
প্লাস্টিক দূষণ আমাদের খাদ্য-শৃঙ্খলেও ছড়িয়ে পড়েছে। ঘটনা হ’ল – লবণ, বোতল বন্দী জল ও কলের জলের মতো মৌলিক খাবারের সঙ্গে মাইক্রো প্লাস্টিক জড়িয়ে রয়েছে।
বন্ধুগণ,
উন্নত বিশ্বের বহু জায়গার তুলনায় ভারতে মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার অনেক কম।
পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধান সম্পর্কিত আমাদের জাতীয় মিশন ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’-এ প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রকের একটি প্রদর্শনী আমি ঘুরে দেখেছি। প্রদর্শনীতে আমাদের সাফল্যের কাহিনীগুলি তুলে ধরা হয়েছে। এতে রাষ্ট্রসংঘ, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলি, শিল্প সংস্থা ও অসরকারি সংগঠনগুলি অংশ নিয়েছে। আমি আশা করি যে, প্লাস্টিক দূষণ রোধেও তাঁরা দৃষ্টান্তমূলক কর্মকান্ড চালিয়ে যাবে।
ভদ্র মহোদয় ও মহোদয়াগণ
পরিবেশের অবক্ষয় সবচেয়ে বেশি দুর্বল ও দরিদ্র মানুষজনকে আঘাত করে।
পার্থিব সমৃদ্ধির জন্য আমাদের যাতে পরিবেশের সঙ্গে আপোষ করতে না হয়, তা সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব ও কর্তব্য আমাদের প্রত্যেকের।
২০৩০ সালের মধ্যে সুস্থায়ী উন্নয়নের অঙ্গ হিসাবে সমগ্র বিশ্ব ‘কেউ পিছনে পড়ে থাকবে না’ – এ বিষয়ে সম্মত হয়েছে। প্রকৃতি মাকে সুরক্ষিত না রাখতে পারলে এই উদ্দেশ্য পূরণ সম্ভব নয়।
বন্ধুগণ,
পরিবেশের সুরক্ষায় ভারত এভাবেই এগিয়ে চলেছে। বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপন উপলক্ষে আন্তর্জাতিক সমষ্টির সঙ্গে আমাদের এই উদ্দেশ্য ভাগ করে নিতে পেরে আমরা আনন্দিত।
পরিশেষে, বিশ্ব পরিবেশ দিবস, ২০১৮-র আয়োজক হিসাবে আমি পুনরায় সুস্থায়ী উন্নয়নের প্রতি আমাদের অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ করছি।
প্লাস্টিক দূষণ রোধ ও এই গ্রহকে আরও ভালো বাসযোগ্য করে তুলতে আসুন আমরা একজোট হই। আজ আমরা যে সমস্ত সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, তা আমাদের সকলের ভবিষ্যৎ স্থির করে দেবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ কাজ নয়। কিন্তু সচেতনতা, প্রযুক্তি ও বিশ্বব্যাপী প্রকৃত অংশীদারিত্বের মাধ্যমে আমরা সঠিক সিদ্ধান্তই যে নিতে পারব – এতে আমি নিশ্চিত।
ধন্যবাদ।