ভারত ও ইতালির কৌশলগত সহযোগিতার অসীম সম্ভাবনার দিকে তাকিয়ে ব্রাজিলের রিও দি জেনোরো-তে জি২০ শিখর বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির সঙ্গে আলোচনায় যৌথ ও কৌশলগত কর্মপরিকল্পনাকে সময় বেঁধে প্রয়োজনীয় বিষয়ভিত্তিক ক্ষেত্রে আরও জোরদার করতে সম্মত হয়েছেন।
রাজনৈতিক স্তরে আলোচনা, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বিনিয়োগ, সংযোগ ব্যবস্থা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, তথ্যপ্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং স্টার্টআপ সহ মহাকাশ ক্ষেত্রে, শক্তি রূপান্তর, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, নিরাপত্তা সহযোগিতা, অভিবাসন ও চলাচল, সংস্কৃতি, শিক্ষা ক্ষেত্র, মানুষে মানুষে সম্পর্ক, চলচ্চিত্র ও পর্যটন প্রভৃতি ১০ দফা ক্ষেত্রে ভারত-ইতালি কৌশলগত কর্মপরিকল্পনায় সম্মত হয়েছে।
রাজনৈতিক স্তরে আলোচনার ক্ষেত্রে রয়েছে সরকারের প্রধান, বিদেশমন্ত্রী, বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের মধ্যে নিয়মিত বৈঠক এবং পারস্পরিক দেশ সফর সেইসঙ্গে বহুপাক্ষিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন মঞ্চে বৈঠকের ফাঁকে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া। উভয় দেশে বিদেশমন্ত্রী পর্যায়ে বার্ষিক দ্বিপাক্ষিক বৈঠক চালিয়ে যাওয়া, সেইসঙ্গে বৈদেশিক শাখার মধ্যে নিয়মিত আলোচনার বিষয়টি প্রধান্য পেয়েছে। এছাড়াও পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সহযোগিতার ক্ষেত্রকে আরও গভীরতা দিতে অন্যান্য মন্ত্রকের প্রধানদের মধ্যে নিয়মিত আলোচনার প্রক্রিয়াকে জোরদার করা হবে। অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং বিনিয়োগ ক্ষেত্রে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ নিয়ে ভারত-ইতালি যৌথ কর্মীগোষ্ঠীর মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা সম্পর্ক নিয়ে যুগ্ম কমিশনে কাজের ক্ষেত্রকে ত্বরান্বিত করা, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য প্রসার, বিনিয়োগ ও বাজারের ক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করা, সেই সঙ্গে পরিবহন, কৃষিপণ্য, যন্ত্রাংশ, রাসায়নিক এবং ঔষধ ক্ষেত্র, আসবাব, প্রযুক্তি ক্ষেত্রে উদ্ভুত নানা অত্যাধুনিক ক্ষেত্র, প্যাকেজিং, কোল্ড চেন, গ্রিন বা পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি সহ উভয় দেশের বৃহৎ কোম্পানীগুলির মধ্যে যৌথ উদ্যোগ ও উৎপাদন এবং এসএমই ক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রসারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণ, অর্থনৈতিক সংগঠন এবং বণিক সভাগুলির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংযোগ গড়ে তোলার বিষয়টিও এই কর্মপরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে। সেইসঙ্গে গাড়ি শিল্প, সেমি-কন্ডাক্টর, পরিকাঠামো এবং উন্নত নির্মাণ ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ বিষয়টিও যুক্ত করা হয়েছে।
পারস্পরিক যোগাযোগ প্রসারের লক্ষ্যে জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত সুস্থিতির দিকে তাকিয়ে সুস্থায়ী পরিবহনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা সম্প্রসারণ, জলপথ এবং স্থলপথে পরিকাঠামো সম্প্রসারণের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে যা ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপীয় অর্থনৈতিক করিডরের কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত। সেক্ষেত্রে জলপথ ও বন্দরের বিষয়ে সহযোগিতা নিয়ে চুক্তিও এর অন্তর্ভুক্ত।
ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতা সম্প্রসারণ সহ উভয় দেশের মধ্যে টেলিকম, কৃত্রিম মেধা, ডিজিটাল পরিষেবা ক্ষেত্রে মূল্য শৃঙ্খল সহযোগিতা গড়ে তোলা। চতুর্থ প্রজন্মের শিল্প, অত্যাধুনিক নির্মাণ, স্বচ্ছ জ্বালানী, ক্রিটিক্যাল খনিজ উত্তোলন ও পরিশোধন, উভয় দেশের মধ্যে এসএমই ও স্টার্টআপ সহ শিক্ষা ও শিল্প ক্ষেত্রে সহযোগিতার নানা রাস্তা খুঁজে বের করা হবে। ইতালি ও ভারতের মধ্যে জাতীয় স্তরে গবেষণার অগ্রাধিকারের নিরিখে উদ্ভাবন এবং গবেষণা ক্ষেত্রে সহযোগিতা সম্প্রসারণ সেইসঙ্গে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় উদ্যোগের পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়কেও প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। স্টেম প্রযুক্তি ক্ষেত্রে শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ সম্প্রসারণ, স্কলারশিপ এবং বৈজ্ঞানিক সংগঠন ও যৌথ প্রকল্পের ক্ষেত্রে সহযোগিতার ক্ষেত্র তরান্বিত করার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। দু-দেশের বিভিন্ন স্টার্টআপ, উদ্ভাবনী পরিমণ্ডল, ফিনটেক, শিক্ষা প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য ক্ষেত্র, লজিস্টিক্স, সরবরাহ শৃঙ্খল, কৃষি প্রযুক্তি, চিপের নকশা, এবং গ্রিন এনার্জি ক্ষেত্রে পারস্পরিক আলোচনার ক্ষেত্র গড়ে তোলা হবে। সেইসঙ্গে বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন এবং বিভিন্ন শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে সহযোগিতার পরিমণ্ডলের বিভিন্ন সুযোগ খতিয়ে দেখার বিষয়টিও এর মধ্যে রয়েছে। ২০২৫-২৭ সালের মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সহযোগিতার বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা রূপায়ণের বিষয়টি এ বছর কার্যকর করা হবে।
মহাকাশ ক্ষেত্রে ইতালির মহাকাশ সংস্থা (এএসআই) এবং ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা- ইসরোর মধ্যে সহযোগিতার সম্প্রসারণ ঘটানো হবে, পৃথ্বী পর্যবেক্ষণে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রকল্পকে যুক্ত করা ছাড়াও চন্দ্র বিজ্ঞানের ওপর জোর দিয়ে মহাকাশ পর্যবেক্ষণের বিভিন্ন প্রকল্পকে যুক্ত করা হবে। মহাকাশ ক্ষেত্রে গবেষণা এবং বাণিজ্যিক মহাকাশ সহযোগিতার ক্ষেত্রে বৃহৎ শিল্প, এমএমএমই এবং স্টার্টআপকে যুক্ত করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ২০২৫-এর মাঝামাঝি মহাকাশ শিল্প সংক্রান্ত ইতালির এক প্রতিনিধি দলে ভারত সফরের পরিকল্পনা রয়েছে। যার উদ্দেশ্য মহাকাশ পর্যবেক্ষণ, গবেষণা এবং বাণিজ্যিক সহযোগিতা গড়ে তোলা।
শক্তি রূপান্তরের ক্ষেত্রে পারস্পরিক শিল্প পরিমণ্ডল ও শিল্প সহযোগিতা ক্ষেত্রকে প্রসারিত করার বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। সেইসঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির প্রসার ঘটানো, বিশ্ব জৈব জ্বালানী জোট এবং আন্তর্জাতিক সৌর জোটকে শক্তিশালী করতে একযোগে কাজ করা, উদ্ভাবনী গ্রিড উন্নয়ন সমাধান সূত্র এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি নিয়ে নিয়মবিধির বিষয়টি নিয়ে পারস্পরিক তথ্য লেনদেন করা হবে।
প্রতিরক্ষা সহযোগিতার প্রশ্নে যৌথ প্রতিরক্ষা পরামর্শদাতা কমিটির বৈঠক বার্ষিক ভিত্তিতে আয়োজন করা, সেইসঙ্গে তথ্য বিনিময়ে সমন্বয় এবং পারস্পরিক দেশ সফর ও প্রশিক্ষণ সহযোগিতার বিন্যাস ঘটানো হবে। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় উভয় দেশের সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে পারস্পরিক আলোচনা, সহযোগিতা সমন্বয় ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হবে। এছাড়াও প্রযুক্তি সহযোগিতা, যৌথ উৎপাদন এবং প্রতিরক্ষা মঞ্চ এবং যন্ত্রাংশের ক্ষেত্রে যৌথ উন্নয়নের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। সমুদ্র ক্ষেত্রে সহযোগিতা সম্প্রসারণ এবং সমুদ্র ক্ষেত্রে দূষণ প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। এছাড়াও উভয় দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের মধ্যে প্রতিরক্ষা শিল্প নকশা এবং সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ান ডিফেন্স ম্যানুফ্যাকচারার্স এবং ইতালির ইন্ডাস্ট্রিস ফেডারেশন ফর এয়ারোস্পেস, ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটির মধ্যে সমঝোতাচুক্তির প্রসার ঘটানো সহ প্রতিরক্ষা গবেষণা ক্ষেত্রে দু-দেশের বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নিয়মিত আলোচনা এতে প্রাধান্য পেয়েছে।
নিরাপত্তা সহযোগিতার বিষয়ে সাইবার সুরক্ষা এবং সাইবার অপরাধের মতো বিষয়গুলি নিয়ে পারস্পরিক দক্ষতার প্রসার, মতবিনিময় সেইসঙ্গে নীতিগত ক্ষেত্রে নিয়মিত সংস্কার, প্রশিক্ষণের সুযোগ সম্প্রসারণ, বহুপাক্ষিক স্তরে সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ এবং অপরাধ দমন নিয়ে উভয় দেশের যৌথ কর্মীগোষ্ঠীর বার্ষিক দ্বিপাক্ষিক বৈঠক চলবে। সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সহযোগিতাকে জোরদার করার পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মঞ্চেও এ বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা করা হবে। পুলিশ, সুরক্ষাকর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশ্নে পারস্পরিক সহযোগিতা নিয়ে উভয় দেশের আইনী বিষয়ে সহযোগিতার বিষয়টিকে শক্তিশালী করা হবে। সন্ত্রাস দমনের ক্ষেত্রে পারস্পরিক তথ্য বিনিময়ের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
অভিবাসন এবং চলাচল ক্ষেত্রে শ্রমিক প্রশিক্ষণ এবং নিযুক্তিকরণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বিধানের পাশাপাশি বৈধ অভিবাসনের নিরাপদ প্রসারে জোর দেওয়া হয়েছে। ভারতে স্বাস্থ্য পেশাদারদের প্রশিক্ষণ নিয়ে একটি পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। পরবর্তীকালে ইতালিতে তাদের কর্মক্ষেত্রে নিয়োগের বিষয়টিও তাতে যুক্ত থাকছে।
উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে উভয় দেশের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে চুক্তির ভিত্তিতে দু-দেশে ছাত্র, গবেষক বিনিময় ব্যবস্থা বাড়ানো হবে। সেইসঙ্গে সংস্কৃতি, চলচ্চিত্র, পর্যটন এবং মানুষে মানুষে সংযোগের প্রসার ঘটানো হবে। উভয় দেশের বিশ্ববিদ্যালয় এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে সহযোগিতা প্রসারের পাশাপাশি কারিগরী এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষায় সহযোগিতা সম্প্রসারণ ঘটানো হবে। উভয় দেশের জাদুঘরগুলির মধ্যে যৌথ উদ্যোগ স্থাপনের মধ্যে দিয়ে পারস্পরিক সাংস্কৃতিক এবং জ্ঞানের পরিধির প্রসার ঘটানো হবে। যৌথ উদ্যোগে দু-দেশের মধ্যে চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রসার এবং প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ক্ষেত্র এবং গৃহগুলির সংস্কার এবং সংরক্ষণে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা জোরদার করা হবে। উভয় দেশের মধ্যে পর্যটন প্রসার এবং পর্যটক সংখ্যা বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। দু-দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্বন্ধকে স্থায়ী বন্ধুত্বের বন্ধনে বাঁধতে ভারতীয় এবং ইতালীয় সম্প্রদায়ের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া, সেইসঙ্গে ২০২৩ সালে স্বাক্ষরিত সাংস্কৃতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে কর্মসূচি রূপায়ণের বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে।