২০১৪ সালের গরমকালে, দেশের মানুষ সন্দেহাতীতভাবে রায় দিয়েছিলেন:
পরিবারতন্ত্রের বদলে সততাকে।
স্তব্ধতার বদলে উন্নয়নকে।
অচলবস্থার বদলে সুরক্ষাকে।
বাধার বদলে সুযোগকে।
ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতির বদলে বিকাশকে।
দেশের মানুষ এই পাঁচটি বিষয় নিয়ে বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। দেশে ভাল কিছুর বদলে দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, নিজেদের লোককে পাইয়ে দেওয়ার ঘটনা নিত্যদিন শিরোনামে থাকত।
এই অতীত দূরে সরিয়ে দেশের ভাল করার জন্য মানুষ ভোট দিয়েছিলেন।
২০১৪ সালে জনতার রায় এক যুগান্তকারী ঘটনা ছিল। কারণ ভারতের ইতিহাসে এই প্রথমবার কোনও অপরিবারতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে পেরেছিল।
‘পরিবার আগে’–র বদলে ‘দেশ আগে’— এই ভাবনা নিয়ে যখন কোনও সরকার কাজ করে, তখন সেটা তার কাজেও দেখা যায়।
বিগত পাঁচ বছরে ভারতীয় অর্থনীতি বিশ্বের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ভারত পাকা শৌচালয় নির্মাণে অসাধারণ সাফল্য লাভ করেছে (২০১৪-র ৩৮ শতাংশ বেড়ে এখন ৯৮ শতাংশ হয়েছে), যাঁরা ব্যাঙ্কিং পরিষেবা পেতেন না, তাঁদের কাছে সেই পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, মূলধন জোগান হয়েছে, পরিকাঠামো তৈরি করা হয়েছে, গৃহহীনদের জন্য বাড়ির ব্যবস্থা, আর্থিকভাবে দুঃস্থদের স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং তরুণ প্রজন্মের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এই সব পরিকল্পনার ফল এখন দেখা যাচ্ছে। সরকার প্রতিষ্ঠানগুলিকে বাকি সব কিছুর থেকে ওপরে রেখেছে।
যখন পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি দেশ শাসন করেছে, তখনই প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আঘাত এসেছে, ভারত সে সবকিছু দেখেছে।
সংসদ:
ষষ্ঠদশ লোকসভায় ৮৫ শতাংশ কাজ হয়েছে। এটা বিস্ময়কর। পাশাপাশি কাজের পরিমাণ গতবার অর্থাৎ পঞ্চদশ লোকসভার থেকে অনেকটাই বেশি।
২০১৪ এবং ২০১৯ সালের মধ্যে রাজ্যসভার কাজ হয়েছে ৬৮ শতাংশ।
অভ্যন্তরীণ বাজেট অধিবেশনের সময় লোকসভায় ৮৯ শতাংশ এবং রাজ্যসভায় মাত্র ৮ শতাংশ কাজ হয়েছে।
সংসদের এই দুই কক্ষের কি গুরুত্ব, তা দেশের মানুষ জানেন। যথন কোনও অপরিবারকেন্দ্রীক দল থাকে ক্ষমতায় থাকে, তখন তাদের কাজ অনেক বেশি চোখে পড়ে।
দেশের মানুষের প্রশ্ন তোলা দরকার কেন রাজ্যসভায় লোকসভার মতো কাজ হয় না? কোন শক্তি তাকে কাজ করতে বাধা দিয়েছে এবং কেন?
সমবাদমাধ্যম:
পরিবারতান্ত্রিক দলগুলো কখনোই নিয়ন্ত্রণহীন এবং সক্রিয় সংবাদমাধ্যমের কাজ পছন্দ করে না। আর তাই তো বাক্ স্বাধীনতার কন্ঠরোধ করতে তৎকালীন কংগ্রেস সরকারই যে প্রথম সাংবিধানিক সংস্কার এনেছিল। এতে আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছুই নেই। সংবাদমাধ্যমের কাজ হল সকলের কাছে সত্যটা তুলে ধরা, সত্যটা বলা। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের এই গুণকে অশালীন এবং খারাপ হিসেবে দেখানো হয়েছিল।
‘আপত্তিকর’ কিছু পোস্ট করেছেন বলে আপনার জেল হতে পারে ইউপিএ সরকারের শাসনকালে এমন আইনও আনা হচ্ছিল।
ইউপিএ–র এক ক্ষমতাশালী মন্ত্রীর ছেলের বিরুদ্ধে টুইটারে কিছু মন্তব্য করায় দেশের নিরিহ নাগরিকের জেল হতে পারে।
কর্ণাটকে একদল যুবক এক অনুষ্ঠানে নিজেদের মত প্রকাশ করেছিলেন। এবং তার ফলে তাঁদের গ্রেপ্তার হতে হয়েছিল। কর্ণাটকের শাসন ক্ষমতার দায়িত্বে রয়েছে কংগ্রেস।
তবে কংগ্রেসকে বলতে চাইব, কোনও হুমকিই বাস্তব সত্যকে পাল্টে দিতে পারবে না। মানুষের কন্ঠরোধ করে ওই দল সম্পর্কে মানুষের ভাবনাচিন্তা পাল্টে দিতে পারবে না।
সংবিধান এবং আদালত:
১৯৭৫ সালের ২৫শে জুন সূর্যাস্তের সময়, দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোও অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল।
একটা পরিবারকে রক্ষা করতে কংগ্রেস দল যে কতদূর যেতে পারে, তা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এক রেডিওবার্তাতেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
জরুরি অবস্থার মধ্য দিয়ে একটা দেশ রাতারাতি বন্দি হয়ে গিয়েছিল। এমনকি তখন মুখ খোলাকে অপরাধ, পাপ হিসেবে দেখা হত।
৪২তম সাংবিধানিক সংস্কার আদালতের ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছিল। সংসদ এবং আরও অনেক কিছুতেও তার প্রভাব ছিল।
জরুরি অবস্থা সরিয়ে দেওয়ার জন্য মানুষের প্রতিবাদের স্রোত আছড়ে পড়েছিল। কিন্তু যাঁরা এটিকে ব্যবহার করেছিলেন তাঁদের মধ্যে এখনও সাংবিধানিক বিরোধী মানসিকতা রয়ে গেছে। কংগ্রেস ৩৫৬টি ধারাটিকে প্রায় একশোবার ব্যবহার করেছে। এর মধ্যে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী নিজেই পঞ্চাশবারের বেশি ব্যবহার করেছেন। যখন তাদের কোনও রাজ্য সরকার অথবা কোনও নেতাকে পছন্দ হয়নি, তখনই তাঁদের সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হতো।
আদালত অবমাননার ক্ষেত্রে কংগ্রেসের ভূমিকা এক অন্য মাত্রায় পৌঁছেছে। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ‘প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বিচার বিভাগ’–এর কথা বলেছিলেন, যেখানে আদালত দেশের সংবিধানের বদলে পরিবারের প্রতি বেশি দায়বদ্ধ থাকবে।
‘প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বিচার বিভাগ’–এর তত্ত্বের জন্য কংগ্রেস সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে অনেক সম্মানীয় বিচারপতিদের এড়িয়ে গেছে।
কংগ্রেসের কাজ করার পদ্ধতি খুব সহজ— প্রত্যাখ্যান করো, সম্মানহানি করো এবং ভয় দেখাও। আদালতের কোনও রায় তাঁদের বিরুদ্ধে গেলে সেটা প্রত্যাখ্যান করে দাও। এরপর সেই বিচারকের সম্মানহানি করো। ওই বিচারকের বিরুদ্ধে ইমপিচমিন্ট আনা হতে চলেছে– এমন কথা নিয়ে আলোচনা শুরু করে দাও।
সরকারি প্রতিষ্ঠান:
ড. মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন যোজনা কমিশনকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী বলেছিলেন, ‘একদল জোকার’।
সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কংগ্রেরের কি ধ্যানধারনা তা এই মন্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়।
ইউপিএ সরকারের কথা মনে করুন। কংগ্রেস সিএজি সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছিল। কারণ, ওই প্রতিষ্ঠানটি তাদের ২জি, কয়লা দুর্নীতি সম্পর্কে সবাইকে জানিয়েছিল।
সিবিআই মানে কংগ্রেস ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন। গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের ঠিক আগের মুহূর্তে এই প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক দলগুলো বারবার কাজে লাগাত।
আইবি, র–এর মতো সংস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে সমস্যা তৈরি করা হতো।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার নেওয়া সিদ্ধান্তের কাগজপত্র টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল। যিনি এই কাজ করেছিলেন তিনি মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন না। এক প্রেস কনফারেন্সে এমন কাজ করতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সমান্তরালে কাজ করা জন্য এনএসি তৈরি করা হয়েছিল। এবং এই সবের পর কংগ্রেস প্রতিষ্ঠান নিয়ে কথা বলতে আসছে?
৯০–এর দশকে দেশের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো–তে এক ভুয়ো গুপ্তচরের কথা বলা হয়ছিল। এটা আসলে কেরলে কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দ থামানোর চেষ্টা ছিল। এবং এর কারণে এক বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয়েছিল। তবে সেটা ওঁদের কাছে কোনও ব্যাপারই নয়।
সশস্ত্র বাহিনী:
প্রতিরক্ষা মন্ত্রককে কংগ্রেস সব সময় অর্থ উপার্জনের এক উৎস হিসেবে দেখে এসেছে। আর তাই কংগ্রেসের কাছে বাহিনীর যে মর্যাদা পাওয়ার কথা ছিল, তাঁরা সেই মর্যাদা পাননি।
১৯৪৭ সালের পর প্রত্যেক কংগ্রেস সরকার প্রতিরক্ষা–দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়েছে। তারা শুরু করেছেন জিপ দিয়ে। এরপর তারা যুক্ত হয়েছেন বন্দুক, সাবমেরিন এবং হেলিকাপ্টারের সঙ্গে।
প্রত্যেকটা ফঁড়েই একটা পরিবারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
এক শীর্ষ কংগ্রেস নেতা এক সেনাপ্রধানকে গুন্ডা বলেছিলেন। এবং পরবর্তীকালে সেটাই দলের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে চালু হয়ে গেল। বাহিনীর প্রতি তাঁদের অসম্মান কত তীব্র— এই ঘটনাই তার প্রমাণ।
যখন আমাদের বাহিনী সন্ত্রাসবাদীদের ধ্বংস করছে, তখন কংগ্রেস নেতারা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ‘রক্তের দালালি’ করছেন বলে গাল পাড়ছেন। যখন বিমানবাহিনী সন্ত্রাসবাদীদের ধ্বংস করছে, তখনও বিভিন্ন প্রশ্ন তুলছে কংগ্রেস।
কংগ্রেস দলে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অভাব:
রাজনৈতিক দলগুলি হলো এমন স্পন্দনশীল প্রতিষ্ঠান যারা বিভিন্ন জনমত প্রকাশ করে। তবে দুর্ভাগ্য হলেও এটা সত্যি, কংগ্রেস দল গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না।
দলের কোনও নেতা দলের শীর্ষ পদে যাওয়ার স্বপ্ন দেখলে তাঁকে দল থেকে একেবারে ছেঁটে ফেলা হয়।
তাঁদের এই ধরণের অধিকারবোধ বিভিন্ন সময় আইনি প্রক্রিয়া পরিচালনার ক্ষেত্রে দেখা গেছে। এখন দলের শীর্ষ নেতারা বড় বড় দুর্নীতির অভিযোগে জামিনে রয়েছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যখন তাঁদের এই ব্যাপারে প্রশ্ন করে, তাঁরা জবাব দেওয়ার সৌজন্যটুকুও দেখায় না।
তাঁরা কি দায়বদ্ধতা থেকে ভীত নাকি তাঁরা এতে একেবারেই বিশ্বাস করেন না?
একটু ভালো করে ভাবুন:
সংবাদমাধ্যম থেকে সংসদ।
সেনা থেকে বাক্ স্বাধীনতা।
সংবিধান থেকে আদালত।
প্রতিষ্ঠানকে নিজের মতো অপমান করে চলেছে কংগ্রেস।
বাকি সবাই ভুল, এবং একমাত্র কংগ্রেসই সঠিক।
আপনি যখন ভোট দিতে যাবেন তখন অতীতের কথা মনে রাখবেন। এবং মনে করবেন কিভাবে একটা পরিবার ক্ষমতায় থাকার জন্য দেশকে ভারী দাম দিয়ে যেতে হচ্ছে।
এর আগেও যদি তাঁরা এমনটা করে থাকতে পারেন, তবে তাঁরা নিশ্চয়ই এটি ফের করতে পারবেন।
মুক্তির দাম হল শাশ্বত সতর্কতা।
আসুন আমরা সকলে সজাগ থাকি। এবং আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করে তুলতে কঠোর পরিশ্রম করি। যেগুলো সংবিধানের প্রতিষ্ঠাতারা আমাদের দিয়ে গিয়েছিলেন।