ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী নয়াদিল্লিতে জি-২০ নেতৃবৃন্দের শীর্ষ সম্মেলনের মধ্যাহ্নভোজ পর্বে আজ এক দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মাননীয় মিঃ ইমানুয়েল ম্যাঁকর-এর সঙ্গে। এ বছর জুলাই মাসে প্যারিসে তাঁদের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর থেকে পারস্পরিক সম্পর্কের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও অগ্রগতির বিষয়টি তাঁরা খতিয়ে দেখেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী প্যারিস সফর করেছিলেন এ বছর জুলাইয়ের ১৩ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত। তাঁর এই সফর ছিল এক কথায় ঐতিহাসিক। কারণ, ১৪ জুলাই, ২০২৩ তারিখটি ছিল ফ্রান্সের জাতীয় দিবস। সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সম্মানিত অতিথি হিসেবে শ্রী মোদী প্যারিস রওনা হয়েছিলেন। একইসঙ্গে ঐ মুহূর্তটি ছিল ভারত-ফ্রান্স কৌশলগত অংশীদারিত্বের ২৫তম বার্ষিকী।
আজকের এই দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে দুই বিশ্ব নেতাই ভারত-ফ্রান্স পারস্পরিক সম্পর্কের দৃঢ়তা ও গভীরতা নিয়ে পর্যালোচনাকালে বলেন যে গভীর আস্থা ও বিশ্বাস, মিলিত মূল্যবোধ, সার্বভৌমত্ব এবং কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের ওপর আস্থা – এর ওপর ভিত্তি করে দু’দেশের গভীর ও নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এছাড়া, রাষ্ট্রসঙ্ঘের সনদে উল্লেখিত আন্তর্জাতিক আইন ও নিয়ম-নীতির প্রতি আনুগত্য এবং অঙ্গীকারবদ্ধ থাকার কথাও দুই দেশ এর আগে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছে। সেইসঙ্গে, বহুপাক্ষিকতা তথা বহুত্ববাদের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস দু’দেশের সম্পর্ককে আরও গভীরে নিয়ে গেছে বলে মনে করেন দুই বিশ্ব নেতা। আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে মিলিত প্রচেষ্টা ও সহযোগিতাকে আরও প্রসারিত করার প্রয়োজনের বিষয়টিও অনুভব করেন তাঁরা। ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’, অর্থাৎ ‘এক অভিন্ন বিশ্ব তথা এক অভিন্ন পরিবার তথা এক অভিন্ন ভবিষ্যৎ’ – এই মন্ত্রটিকে সম্বল করে সমবেতভাবে বিশ্বের সবক’টি দেশকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য উজ্জীবিত করতে তাঁরা একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা সূত্রে আবদ্ধ থাকার কথাও আজ ঘোষণা করেন। কারণ তাঁরা মনে করেন, এর মধ্য দিয়ে এক নতুন বিশ্ব শৃঙ্খলা গড়ে তোলা সম্ভব।
‘হরাইজন, ২০৪৭’ রোডম্যাপটি অনুসরণ করে এবং সেইসঙ্গে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পারস্পরিক সহযোগিতার রোডম্যাপটির কথা স্মরণে রেখে প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদীর প্যারিস সফরকালে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা স্থান পেয়েছিল। আজ নয়াদিল্লির এই দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে দুই বিশ্ব নেতাই প্রতিরক্ষা, মহাকাশ, পরমাণু শক্তি, ডিজিটাল সরকারি পরিকাঠামো, গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি প্রচেষ্টা, জলবায়ু পরিবর্তন, শিক্ষা এবং দু’দেশের জনসাধারণের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের এক নিবিড় বাতাবরণ গড়ে তোলার অনুকূলে মত প্রকাশ করেন। ভারত-ফ্রান্স অংশীদারিত্ব ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল তথা আফ্রিকার উন্নয়নে কাজে লাগানোর কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেন তাঁরা। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলিতে পরিকাঠামো, সংযোগ ও যোগাযোগ, জ্বালানি শক্তি, জীববৈচিত্র্য, নিরন্তর উন্নয়ন প্রচেষ্টা এবং শিল্প প্রকল্পগুলির ক্ষেত্রে দু’দেশের মিলিত সম্পর্কটি কাজে লাগানোর কথাও উল্লেখ করেন তাঁরা। এছাড়া, আন্তর্জাতিক সৌর সমঝোতার মতো বিষয়টি যে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলিতে এক নতুন কর্মকাণ্ডের সূচনা করতে চলেছে, একথাও তাঁরা গভীর আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্গে ব্যক্ত করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক সৌর সমঝোতার মতো বিষয়টির সূচনা হয় মিলিতভাবে ভারত ও ফ্রান্সের পক্ষ থেকে। এছাড়াও, বিপর্যয়রোধী পরিকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দু’দেশের মিলিত সহযোগিতার বিষয়টিও ছিল আজ তাঁদের আলোচ্যসূচির মধ্যে।
ভারতের ‘মিশন চন্দ্রায়ন-৩’-এর সাফল্যে প্রধানমন্ত্রী শ্রী মোদীকে অভিনন্দন জানান প্রেসিডেন্ট ম্যাঁকর। এই প্রসঙ্গে ছ’দশক ধরে ভারত ও ফ্রান্সের মধ্যে মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে যে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা পর্যালোচনা করে এ পর্যন্ত অগ্রগতির সাফল্যের একটি চিত্রও দুই নেতা তাঁদের আলোচনাকালে তুলে ধরেন। নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার্স গ্রুপে ভারতের সদস্যপদের জন্য অকুন্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতার কথা পুনরায় ব্যক্ত করেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট।
দু’দেশের নিবিড় সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতাকে আরও গভীর করে তোলার কথা বলেন তাঁরা। এজন্য প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিকে অত্যাধুনিক করে তোলা ছাড়াও প্রতিরক্ষা উৎপাদন সংক্রান্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের সহযোগিতার পরিসর আরও বৃদ্ধি করা উচিত বলে তাঁরা মনে করেন। প্রতিরক্ষা শিল্প সংক্রান্ত রোডম্যাপটি দ্রুত চূড়ান্ত করার সপক্ষেও মত প্রকাশ করেন দুই বিশ্ব নেতা।
ডিজিটাল প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন প্রচেষ্টা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ে সহযোগিতা ইত্যাদির ওপর বিশেষভাবে জোর দিয়ে দুই নেতা এই সমস্ত ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় করার কথা গভীর আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্গে ব্যক্ত করেন। দু’দেশের সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচিকে আরও সম্প্রসারিত করার জন্য একযোগে কাজ করে যাওয়ারও অঙ্গীকার করেন দুই বিশ্ব নেতা।
ভারতের জি-২০ সভাপতিত্বকালে ফ্রান্স তাদের সমর্থন ও সহযোগিতা অব্যাহত রাখায় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাঁকরকে ধন্যবাদ জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন যে এই বিশেষ সময়কালে ফ্রান্সের সমর্থন ও সহযোগিতা ভারতকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ঐক্য ও সমঝোতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে তথা অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রচেষ্টা সফল করে তোলার কাজে আরও বেশি করে সাহায্য করেছে। দু’দেশের মিলিত সম্পর্ক বিশ্বের বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সমাধান তথা একটি স্থায়ী বিশ্ব শৃঙ্খলা গড়ে তোলার কাজ যে ত্বরান্বিত করবে সে সম্পর্কে তাঁদের গভীর আস্থার কথা বিশেষ জোরের সঙ্গে ব্যক্ত করেন তাঁরা। জি-২০-তে আফ্রিকা ইউনিয়নের সদস্যপদে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টিকে ভারত ও ফ্রান্স একইসঙ্গে স্বাগত জানিয়েছে এবং আফ্রিকা ইউনিয়নের সঙ্গে কাজ করে যেতে যে দুই দেশ সমানভাবে আগ্রহী একথাও তারা নির্দ্ধিধায় ব্যক্ত করেছে, কারণ আফ্রিকার অগ্রগতি, সমৃদ্ধি এবং উন্নয়ন প্রচেষ্টায় তা এক অনুঘটকের ভূমিকা পালন করবে।